Diego Maradona

তাঁর মধ্যে বাঙালি খুঁজে পেল মতি নন্দীর নায়ককে

সদ্য আসা টিভি লোডশেডিংয়ে মাঝে মাঝেই অন্ধকার। তবু ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে বাঙালি মজে গেল দশ নম্বর নীল-সাদা জার্সির দাপটে। তার কিছু দিন আগে আর্জেন্টিনাকে যুদ্ধে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপে ছেলেটার খেলা যেন তারই মধুর প্রতিশোধ। মারাদোনা তখন থেকেই বাঙালির রূপকথা।সেই যে ছিয়াশি সালে মারাদোনাকে দেখতে শিখল বাঙালি, সেই দেখা তারা শুধু টিভিতে আটকে রাখল না, নিজেরাই হয়ে উঠতে চাইল মারাদোনা।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

তখন সবে এ-দেশে টেলিভিশন নামের বস্তুটির খাতিরদারি শুরু হয়েছে। ১৯৮২-তে টেলিভিশনের ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক সার্ভিস চালু হল, সে বছরই ভারতীয় বাজারে এল রঙিন টিভি। তাই ছিয়াশির মারাদোনাকে কোনও কোনও বাঙালি দেখতে পেল ১০ নম্বর নীল-সাদা জার্সিতে, বাকিদের কাছে মারাদোনা সাদা-কালো। তাতে কী! একটা বেঁটে-খাটো ঝাঁকড়া-কোঁকড়াচুলো ছেলে পড়ে আর ওঠে। তার পর বাঁ-পায়ে দুলকি চালে বল নিয়ে কাটিয়ে চলে এক-দুই-তিন-চার— গতি তখন তুঙ্গে, পালতোলা নৌকা সে-মুহূর্তে ক্ষিপ্রগতি পানসি। সেই গতির কাছে বিপক্ষ-ডিফেন্ডাররা কুপোকাত, পায়ের ছোঁয়ায় বল প্রতিপক্ষের জালে। শুধু পা? প্রয়োজন মতো এ ছেলে শরীরের যে-কোনও জায়গা দিয়ে নাচাতে পারে বল— ফুটবল যেন তার শরীর। এমন আশ্চর্য শরীরী ফুটবল মশারির ভেতরে বসে দেখছে বাঙালি পুরুষেরা— বাবা, ছেলে, ছেলের বন্ধু, ওপরের বাড়িওয়ালা জেঠু। শোবার ঘরে একটা ছোট আলমারি, তার মাথায় সাদা-কালো টিভি, টিভির ভেতর মেক্সিকো। মেক্সিকোর ওপর মারাদোনা— মা পাশের ঘরে, কাল সাত-সকালে উনুন ধরাতে হবে, রান্নার গ্যাস তখনও আসেনি।

Advertisement

তবে ছিয়াশি সালে শহর পুরুলিয়া মারাদোনাকে দেখতে পাচ্ছে, কারণ আসানসোলে সবে তৈরি হয়েছে টিভির ‘রিলে-সেন্টার’। কলকাতা যা দেখতে পায়, এখন তা দেখতে পায় পুরুলিয়া। পুরুলিয়াতে তখনও কলকাতার সকালের কাগজ বিকেলে আসে, কিন্তু রাতের টিভিতে চলে আসে মারাদোনা। মারাদোনা কলকাতা আর পুরুলিয়ার দেখায় একাকার— মারাদোনা বল পায়ে যেন নাচছে, আর তা প্রাণভরে চাখছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ।

তার শরীর সাহেবদের মতো সাদা নয়, আবার পেলের মতো কালোও নয়। তার দেশের নাম আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনো পুংলিঙ্গ, আর্জেন্টিনা স্ত্রী লিঙ্গ, ‘নারী’। অর্থ তার ‘রুপোর মতো সাদা’। বাঙালির চোখে আর্জেন্টিনা আর মারাদোনা তখন সমার্থক। বাংলা মিডিয়াম ম্যাপ-বইয়ে চোখ রেখে খোঁজে সে দেশ। সে দেশকে বুক অব নলেজ বলেছে ‘ল্যান্ড অব সিলভার’। এ দেশের মানুষদের মন একরোখা। বিরাশি সালে আর্জেন্টিনা ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। ফকল্যান্ড দ্বীপমালার মালিকানা নিয়ে দু’দেশের যুদ্ধু। ফকল্যান্ডে সাহেবদের উপনিবেশ সেই ১৮৪১ সাল থেকে। বিরাশি সালের ২ এপ্রিল আর্জেন্টিনা ঢুকে পড়ল ব্রিটিশ-অধিকৃত দ্বীপপুঞ্জে। নৌ-বহর আর যুদ্ধ-বিমান পাঠিয়ে সাহেবরা শেষ অবধি আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দিল, ১৪ জুন আত্মসমর্পণ করল রুপোর দেশের যোদ্ধারা। হারল বটে, তবে ফকল্যান্ডের যুদ্ধ এ-দেশের মানুষের মনে জাগিয়ে তুলেছিল দেশপ্রেমের সুর। ১৯৮৪ সালে সে-দেশে তৈরি হয়েছিল সিনেমা ‘যুদ্ধে-যাওয়া ছেলেরা’, হোর্হে লুই বোর্হেস লিখেছিলেন কবিতা। বোর্হেস তো এক লেখায় তাঁর স্বদেশ আর মার্গারেট থ্যাচারের সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড দু’পক্ষকেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দুটো টেকো লোক চিরুনি খুঁজছে।

Advertisement

এ-হেন ফকল্যান্ড যুদ্ধের ছোঁয়া ফুটবল মাঠেও লেগেছিল। আর্জেন্টিনার সিজার আর্ডাইল তখন ইংল্যান্ডের টটেনাম ক্লাবে খেলতেন। যুদ্ধের সময় তাঁকে ইংল্যান্ড ছাড়তে হল। সেদিনের পুরুলিয়া এত খবর জানত না। তবে পশ্চিমবঙ্গ টেলিভিশনে ফুটবল খেলিয়ে ছোট-ছোট অসাহেবি দেশগুলোকে দেখতে দেখতে ভাবত, এ-পৃথিবী কেবল সাদা সাহেবদের নয়।

মারাদোনাকে আপনজন বলে মনে হত আম-বাঙালির। এর আগে পেলেকে নিয়ে এমন করে মজেছে বাঙালি। তবে মারাদোনাকে তারা যেভাবে টিভিতে দেখেছে, পেলেকে তো সেভাবে দেখতে পায়নি। পেলে তাদের ভাল রাজপুত্তুর, কালো রাজপুত্তুর। খবরের কাগজের ছবিতে তাদের পেলে দর্শন। কলকাতা প্রদর্শনী ম্যাচে পেলেকে দেখেছে, কিন্তু সে দেখার সৌভাগ্য কলকাতার বাইরের বাঙালির হয়নি। পেলে কলকাতার, মারাদোনা শুধু কলকাতার নয়। অহিভূষণ মালিক তাঁর নোলেদা নামের ছবিতে-গল্পে পেলেকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। উত্তর কলকাতার নোলেদা সেদিন আশ্চর্য ফুটবল খেলেছিলেন। হাতে দৌড়ে পায়ে বল-ধরে গোলের পর গোল দিয়েছিলেন তিনি। এমন কাণ্ড অহিভূষণ মালিকের ছবির গল্পে হয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার গল্পেও হত। ঘুঁটেপাড়ায় ফুটবল খেলতে গিয়েছিল কলকাতার টেনিদা। বর্ষাকাল, শিবতলার পুকুর ভেসে গেল। মাঠভর্তি মাছ। মাছ দেখে মাছে-ভাতে বাঙালি কি আর থাকতে পারে? ‘রইল খেলা, রইল বিচালিগ্রাম আর ঘুঁটেপাড়ার কম্পিটিশন– তিনশো লোক আর একুশ জন খেলোয়াড়, দু’জন লাইন্সম্যান— সবাই কপাকপ মাছ ধরতে লেগে গেল। প্লেয়াররা জার্সি খুলে ফেলে তাতেই টকাটক মাছ তুলতে লাগল। খেলতে আর বয়ে গেছে তাদের।... খেলার মাঠ ছেড়ে ক্রমেই দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবাই।’ এরই মধ্যে রেফারি টেনিদাকে ধমক দিলেন ‘ইয়ু গো অন প্লেয়িং’। এই ইংরেজি ধমকে টেনিদা ভিজে মাঠে প্রায় সাঁতার কেটে বত্রিশটা গোল দিল। তা নিয়ে চাটুজ্যেদের গুলপট্টি রকে টেনিদার গলাবাজি, ‘একটা ম্যাচে একাই বত্রিশটা গোল দিলুম, পেলে-ইউসেবিয়ো-রিভেরা-চার্লটন সব কাত করে দিলুম।’ এ সবই বাঙালির টিভিতে মারাদোনাকে না দেখা জীবনের গল্পগাছা।

মারাদোনাকে দেখে বাঙালি বুঝল গল্প আর সত্যিকারের মাঠ এক নয়, এক হতে পারে না। মতি নন্দী ক্রীড়াসাংবাদিক বলেই ময়দানের অভিজ্ঞতায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে এগিয়ে। তাঁর লেখায় বাঙালি ময়দানের সত্যিকে দেখেছিল, আর চিনেছিল একরোখা লড়াইয়ের সত্যকে। ১৯৭৮-এ মতি নন্দীর লেখা থেকে তৈরি হয়েছিল বাংলা ছবি ‘স্ট্রাইকার’। শমিত ভঞ্জ তরুণ ফুটবলার প্রসূনের ভূমিকায়। গরিব বাড়ির ছেলে প্রসূন ময়দানের নোংরা দলাদলিকে ডিঙিয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ১৯৮৬ সালেই মতি নন্দীর গল্প নিয়ে সরোজ দে-র ছবি ‘কোনি’ মুক্তি পেয়েছিল। সৌমিত্র অভিনয় করেছিলেন বলেই এ-ছবি দর্শক গিলেছিল খিদ্দা আর কোনির লড়াই, মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির লড়াই। ছিয়াশি সালে তারাই, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, টিভিতে মারাদোনার দর্শক। মারাদোনাকে মতি নন্দীর গল্পের বাস্তব বলে মেনে নেয়। ইংরেজদের কাছে হেরে যাওয়া দেশের একটা ছেলে ফুটবল মাঠে পায়ে বল নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে। এই ছেলেটাকে তারা তো নিজেদের বলে ভাববেই।

ছিয়াশি সালে গ্রুপ-এ তে সেবার বুলগেরিয়া, ইটালি, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ কোরিয়া। সবার চোখ আটকে যায় আর্জেন্টিনায়। যেদিন আর্জেন্টিনার খেলা, সেদিন তাদের একটাই প্রার্থনা ‘লোডশেডিং’ যেন না হয়! পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ তখন চকিত-চপলা। লক্ষ্মীর মতো। এই আছে এই নেই। বিশেষ করে গরমকালে বাঙালির মাথার ওপর যত ফ্যান ঘোরে, তত বেশি টান পড়ে বিদ্যুতে। বাঙালির চোখের সামনে ম্যাজিক-বাক্সে অন্ধকার নেমে আসে। বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে যেমন আর কিছু চায় না, তেমনি সেবার বাঙালি টিভিতে মারাদোনাকে পেয়ে আর কিছু চায়নি। কপিল দেবের ৮৩ সালের জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ঝোড়ো ইনিংসের খবর তারা পেয়েছিল পরে। লর্ডসে কপিলদেবের ভারত যখন তেতাল্লিশ রানে হারিয়ে দিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, তখন সে খেলার টাটকা ছবি অধিকাংশ বাঙালির কাছে ছিল অধরা। তাদের কানে ছিল রেডিয়ো। রেডিয়োতে ক্রিকেট তাও শোনা চলে। বল করা আর বল-মারার সে খেলায় আউট হওয়া আর রান নেওয়ার খবর ভেসে আসে। কিন্তু ফুটবল? একটা চকিত শরীর বল নিয়ে ছুটছে। কাটাতে কাটাতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স অতিক্রম করে বল ঢুকিয়ে দিচ্ছে জালে। সেই দেখার হর্ষ শোনায় ম্লান।

সেই যে ছিয়াশি সালে মারাদোনাকে দেখতে শিখল বাঙালি, সেই দেখা তারা শুধু টিভিতে আটকে রাখল না, নিজেরাই হয়ে উঠতে চাইল মারাদোনা। ‘ওয়েজ় অব সিয়িং’ বলে জন বার্জারের টেলিভিশন সিরিজ যা বই হয়েও প্রকাশিত, সেখানে বার্জার অয়েল-পেন্টিং নিয়ে নানা কথা সাজিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে বাড়িতে অয়েল পেন্টিং শুধু ছবি হিসেবে টাঙিয়ে রাখা হত না, যাঁরা অয়েল-পেন্টিং টাঙিয়ে রাখতেন, তাঁরা ওই ছবির বস্তুগুলিকে নিজেদের বলে ভাবতেন। পরে যখন তৈরি হল বিজ্ঞাপনের ছবি তখন সেখানেও তাই অয়েল পেন্টিং-এর রীতি, কম্পোজ়িশন অনুসরণ করা হল। যাঁরা বিজ্ঞাপন তৈরি করছেন তাঁরা ক্রেতাদের ভাবাতে চাইছেন যে, এই বিজ্ঞাপিত বস্তু তাঁর অধিকারে। জিনিসটি কেনার চাহিদা তুঙ্গে উঠছে। মারাদোনাকে দেখার রূপকথা টিভিতেই হারিয়ে গেল না। মারাদোনাকে নিজের অধিকারে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠল বাঙালি। কলকাতার দেওয়ালে মারাদোনার মস্ত ছবি, ঘরে রঙিন পোস্টার। দশ নম্বর নীল-সাদা জার্সি বিক্রি শুরু হল। সেই জার্সি গায়ে পাড়ার মাঠে নামল বাঙালি ছেলে-ছোকরা। আর একক প্রচেষ্টায় দশজনকে কাটিয়ে গোল দেওয়ার কী মরিয়া চেষ্টা! গোল দেওয়ার পর সেই লাফ। হাওয়ায় ছুড়ে দেওয়া সেই আকাশি চুম্বন। পাড়ার রক আর বারান্দার গ্যালারিতে ইতি-উতি এসে দাঁড়াতে লাগল পাড়ার শাড়ি, ফ্রক। আর পাড়ার মারাদোনাদের সেই কাটানো আর গোল-দেওয়া ধূসর বিকেলগুলো কেমন অচেনা আর বিবশ করে দিতে লাগল। ফ্রকে শাড়িতে গোল দেওয়া বিকেলে সন্ধে নামত।

মারাদোনা তো কেবল ওঠেননি, পড়েছেনও। মাদক-সেবনে নাম উঠেছে তাঁর। ডোপিং শব্দটা যখন মারাদোনার সূত্রে কানে এসে লাগছে বাঙালির, তখন প্রথমে বিশ্বাস করেনি তারা সে কথা। ভেবেছে ফাঁসানো হয়েছে তাদের ছেলেটিকে। খবর সত্য বলে জানা গেছে যখন, তখন তারা বলেছে, ‘আর কেউ দেখাক তো, কেমন ডোপিং করে মারাদোনার মতো খেলা যায়!’ ছিয়াশিতে যার গলায় জয়মাল্য দিয়েছিল, সেই মালা তারা ছিনিয়ে নিতে চায়নি। এমনকি মারাদোনা এসেছিল বলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল তাদের ফুটবল প্রেমের ধারা।

বাঙালি তখন হয় ব্রাজিল, নয় আর্জেন্টিনা। মাঠে বদলে গিয়েছিল খেলার রকমফের। একক ক্ষমতায় দলকে জেতানোর চেষ্টার বদলে সকলে মিলে খেলার চল শুরু হল। বল একের থেকে অন্যের পায়ে চালিয়ে দেওয়া সেই নতুন ফুটবলের দস্তুর। রইল না একা আর দশজনকে কাটানোর ম্যাজিক। সময় বদলায় বটে, কিন্তু স্মৃতি হারায় না। মারাদোনার সময় হারিয়েছিল, স্মৃতি হারায়নি। তাই এই চলে যাওয়ার সময় আজ যখন ভেঙে গেছে কলকাতার পাড়া কালচার তখনও বাঙালি মারাদোনাকে ঘিরে সেই পুরনো পাড়াকে ফিরে পায়। আর ফিরে পায় মশারির ভেতরে বসা রাতগুলিকে— মারাদোনা রাত, মারাদোনা দিন। বাঙালির পুরনো উনুনে আঁচ পড়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement