বহুদর্শী: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছিল জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা। —ফাইল চিত্র।
লাভপুরে রয়েছেন পরিচালক। রাঙামাটির দেশে আঁধার নেমেছে। প্রবীণ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালককে শোনাচ্ছেন মহাভারতের উদ্যোগপর্বের কাহিনি। হঠাৎ এক বৃদ্ধা এসে তারাশঙ্করকে প্রণাম করলেন।
“কে রে নসু নাকি— আয় আয়।” পরিচালককে ইঙ্গিত করে বৃদ্ধাকে তারাশঙ্কর বললেন, “এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে।” পরিচালককে জানালেন, এই হলেন ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র নসুবালা। পরিচালক তপন সিংহ দেখলেন, বৃদ্ধা নন, আসলে নসুবালা পুরুষ। ভাবে-ভঙ্গিতে, পোশাকে, মনে নারী! প্রিয় ‘নস্যে’কে গান শোনাতে বললেন সাহিত্যিক। দু’জনকে ‘কত জন্ম জন্মান্তরের অকৃত্রিম বন্ধু’ বলে মনেহল পরিচালকের।
তপন সিংহের সঙ্গে এক দিন তারাশঙ্কর গেলেন ময়ূরাক্ষীর তীরে, এক গ্রামে। মাটির বাড়ি। হাঁক দিতেই বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। হাউহাউ করে সে কী কান্না। বন্ধুকে তারাশঙ্কর বলছেন “শান্ত হ, শান্ত হ’।”— মানুষটি তাঁরই সহপাঠী, ‘আরোগ্য-নিকেতন’-এর ডাক্তার। পুত্রশোকে অধীর।
তারাশঙ্কর এমনই। মহাভারতের গল্প বলতে-বলতে যেন গত যুগের বাংলার লোকবিশ্বাসের কথা বলেন তিনি। আবার নতুন যুগের পরিচালককে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর কালের সঙ্গে।
ঘরের কথা
বস্তুত, এই মহাকালের সঙ্গে সখ্যটির শুরু বাড়ি ও জন্মস্থান লাভপুর থেকে। তারাশঙ্করের (ডাক নাম হবু) জন্ম ২৩ জুলাই, ১৮৯৮-এ। বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা প্রভাবতী দেবী। পুত্রকামনায় তারার পুজো করা হয়েছিল। হরিদাস গত যুগের প্রতিনিধি। যুগের গুণ-বদগুণ, সবই উপস্থিতি তাঁর মধ্যে। জীবনে বদলটা ঘটল ইংরেজি শিক্ষিত প্রভাবতীর সান্নিধ্যে। এই দুই কালকে এক সুতোয় বাঁধছেন ছেলে তারাশঙ্কর। বাবা প্রয়াত হয়েছেন। স্বামীর দেহের পাশে বৈধব্য বেশে প্রভাবতী বসে। ছেলের মনে হল, “...আমার বাবা আমার কালের অর্ধাঙ্গ— আমার জ্যোতির্ময়ী প্রদীপ্তদৃষ্টি শুভ্রবাস পরিহিতা তেজস্বিনী মা আমার কালের অর্ধাঙ্গ।” এই মা-ই তাঁর ‘ধরিত্রী’। প্রভাবতী তাঁর কালের গুণেই হয়তো ছেলের মনে বেঁধেছেন স্বদেশবোধ, লেখালিখি শিক্ষার রাখি।
মায়ের সঙ্গে, স্ত্রী উমাশশীরও লেখকের জীবনে গভীর প্রভাব। ১৯১৬-য় বিয়ে। দম্পতির সন্তানেরা: সনৎকুমার, সরিৎকুমার, গঙ্গা, বুলু, বাণী। স্ত্রীকে বলেন ‘বড়বৌ’। স্ত্রীর কাছে কখনও লেখক অপমানিত হওয়ার কথা বলছেন। কখনও আবার চাইছেন সাহায্য: “...তোমার কাছে ভিক্ষে করছি।... দু’শো টাকা তুমি আমাকে দাও।” শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকেও বাঁধছেন শব্দ-অনুভবের মায়াডোরে, “সে যে আমার জীবনকে জুড়ে রয়েছে— মাটির বুকের উপরে বয়ে যাওয়া নদীর মত।”
পিসিমা শৈলজাদেবীর প্রভাবে উমাশশীর সঙ্গে দাম্পত্যের প্রথম-পর্বের ‘সকল মাধুর্য ও সরলতা প্রায় ঝলসে’ যায়। তারাশঙ্করের দৌহিত্রী কাঞ্চনকুন্তলা মুখোপাধ্যায় শৈলজাদেবীকে অত্যন্ত রাগী ও মুখরা হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। হয়তো পারিবারিক মূল্যবোধের কারণেই পিসিমা সম্পর্কে তারাশঙ্করের অভিধা, ‘তেজস্বিনী এবং দৃপ্তভাষিণী’।
আসলে, মহাকালের কালখণ্ড— সমাজ-পরিবেশ-অর্থনীতি-রাজনীতি মানবজীবনের মূল্যবোধ নির্মাণ করে, বদলে দেয়। তারাশঙ্কর তা প্রত্যক্ষ করেছেন জন্মভূমিতেই। দেখছেন, পাঁচ-আট হাজার টাকার জমিদারির সঙ্গে লক্ষ-লক্ষ টাকার ব্যবসায়ীদের লড়াই। দেখছেন, লাভপুরের গ্রাম থেকে মফস্সল হয়ে ওঠা। জমিদারের মাইনর স্কুলের জায়গায় হাই ইংলিশ স্কুলে খেমটা নাচ, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, রামপুরহাটে দুকড়িবালা দাসীর গ্রেফতার, লাভপুর স্কুলের শিক্ষকদের বিলিতি কাপড়ে অগ্নি-সংযোগ, থিয়েটারের ড্রপসিন, গ্রন্থাগারের রবার স্ট্যাম্পে ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দ মুছে যাওয়া— দেখছেন সবই।
লাভপুরেই প্রাথমিক পড়াশোনা। দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় লাভপুর যাদবলাল এইচ ই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে, বহরমপুর কলেজ ঘুরে কলকাতার সেন্ট জ়েভিয়ার্স ও সাউথ সাবআরবান কলেজ। কিন্তু রাজনীতি ও ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য পড়া শেষ হয়নি।
রাজনীতির পাকদণ্ডী
মহাকালের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রাজনীতি। তারাশঙ্কর আদ্যোপান্ত রাজনীতি-সচেতন মানুষ। তাই তাঁকে অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে কংগ্রেসে যোগ দিতে, ম্যালেরিয়া নিবারণী বাহিনীর নেতা হিসেবে বীরভূমের গ্রামে-গ্রামে ছুটে বেড়াতে দেখা যায়।
কিন্তু এই রাজনীতির সূত্রে এসেছে বিপর্যয়ও। বর্ণনা দিচ্ছেন তারাশঙ্করের বন্ধুস্থানীয়, তথা পরে টালা পার্কের পাড়ার লোক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। জানাচ্ছেন, সিউড়ির মহকুমাশাসক তখন মণি সেন। তারাশঙ্করের বিশেষ ঘনিষ্ঠ তিনি। মহকুমাশাসকের অনুরোধ, “তারাশঙ্করবাবু, আপনি এক বার শুধু বলুন, রাজনীতি আপনি ছেড়ে দেবেন। এ সব নোংরা কাজ আর করবেন না।” তারাশঙ্করের উত্তর, “দেশকে আমি ভালবাসি। আপনি একে নোংরা কাজ বলছেন? ছি!” অতএব, কারাবাস, সিউড়ি জেলে, চার মাস। আসলে তারাশঙ্করের রাজনৈতিক জীবনে তাঁকে যেন ‘স্থির আলোকোজ্জ্বল পথরেখা’টি দেখিয়েছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী। তাই বোধহয় অগস্ট আন্দোলনের ছায়া থাকে ‘গণদেবতা’, ‘মন্বন্তর’, ‘পঞ্চগ্রাম’ প্রভৃতিতে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’ ইত্যাদি সম্মান দিয়েছে এ-ও ঠিক। বিধান পরিষদ, রাজ্যসভার মনোনীত সদস্যও হয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেসের দলীয় রাজনীতি তারাশঙ্করকে রক্তাক্ত করেছে। ১৯৫৫-র দিনপঞ্জি থেকে বিষয়টি জানা যায়। বিনোবা ভাবে বাঁকুড়ায় এলে, ভূদান হিসেবে পৈতৃক সম্পত্তির টাকা দান করলেন তারাশঙ্কর। সঙ্গে-সঙ্গে অতুল্য ঘোষের খোঁচা, কংগ্রেসের তহবিলে কিছু না দিয়ে এমন কাজ করার অর্থ আদতে নাম কেনার চেষ্টা! তারাশঙ্করের মনে হল, এ যেন পিছন থেকে কেউ পিঠে ছুরি বসাল। কংগ্রেসের দলীয় কোন্দল যে তিনি পছন্দ করেননি, তার প্রমাণ ‘যুগান্তর’-এ প্রকাশিত ‘গ্রামের চিঠি’। এ সবের জন্যই বোধহয় বলেছেন, “কোন রাজনৈতিক দলের কোন সংস্পর্শে আসতে আমার রুচি নেই।”
সমস্যা বেধেছে বামপন্থীদের সঙ্গে, ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসের সূত্রে যা বাড়ে। কিন্তু ইনিই আবার মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্য থাকা ‘অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এরও সভাপতি। সেখানে সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে বিরূপ কথা বলা হলে, সংগঠনটি ত্যাগ করলেন তারাশঙ্কর। পরে অনুরোধে ফিরে এলেও, এ সব আলোচনা নিয়মবিরুদ্ধ করা হয়।
সুভাষের সঙ্গে তারাশঙ্করের সম্পর্কটি যে অন্য সূত্রে বাঁধা। অতীতে, বীরভূমের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তখন গুরুসদয় দত্ত। তাঁর ‘ব্রতচারী’ তখন বীরভূমে হিল্লোল তুলেছে। কিন্তু তা নিয়ে ব্যঙ্গ-কবিতা ছাপা হল তারাশঙ্করের বোলপুরের ছাপাখানা থেকে। জামানত চাওয়া হল। সুভাষচন্দ্রের পরামর্শেই জামিন নিলেন না। তবে ছাপাখানায় তালা পড়ল। সুভাষচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধার সাক্ষ্য দেয়, তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী-ঘূর্ণি’র উৎসর্গপত্র।
আসলে, মহতী মানুষকে স্বীকৃতি দিতে পারেন তারাশঙ্কর। তাই কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতবিরোধ থাকলেও তিনি বলতে পারেন, “...রুশ বিপ্লব এবং মহান লেনিনই সকল মানুষের মুক্তির বার্তা ও পন্থাই আমাকে প্রথম জ্ঞাপন করেছিলেন।” লেনিন সম্পর্কে ব্যবহার করছেন ‘আশ্চর্য মানববন্ধু’, ‘পথপ্রদর্শক’-এর মতো শব্দ।
শব্দ-কথায়
তবে রাজনীতি নয়, সাহিত্য। তাঁর সাধনক্ষেত্রটি বুঝতে দেরি করেননি তারাশঙ্কর। প্রথম জীবনে অল্পবিস্তর কবিতা, নাটক ইত্যাদি লিখেছেন। কিন্তু তাঁর মূল ক্ষেত্র, কথাসাহিত্য। নিজেও বলেন, “...আমি আসলে ঔপন্যাসিক। গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম লিখে আমি উপন্যাস রচনার পূর্ণতৃপ্তি পেয়েছি।”
তবে লেখক-জীবনের প্রথম পর্ব জুড়ে অবহেলা আর অবজ্ঞা। ‘চৈতালী-ঘূর্ণি’ বাজারে ভাল কাটেনি। বইয়ের ‘দপ্তরী’ এসে টাকা চাইলেন। জানালেন, গুদামে রাখার জায়গা নেই। হয় বই নিতে হবে, না হলে পুরনো কাগজের দরে বিক্রি করে দেবেন। সাহায্য করলেন সজনীকান্ত দাস। পরেও অবিক্রীত বই নিয়ে গল্প শুনিয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বই চাইতেই, তারাশঙ্কর অবিক্রীত ও স্তূপীকৃত বইয়ের মধ্যে থেকে ‘কবি’ বার করলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মজা করে বললেন, “কি ভাই, যে মাল বাজারে কাট্ছে না, সেইটেই হাতে গছিয়ে দিলে?” পরে পড়তে গিয়ে বুঝলেন, কী অপূর্ব সে সৃষ্টি। বললেন, “এদেশের দুর্ভাগ্য যে এমন বই-এর এখনও প্রথম সংস্করণ কাটেনি।” সঙ্গে সঙ্গে, তারাশঙ্কর দিলেন ‘রাইকমল’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উপলব্ধি: “তোমার সব বই যদি সাহিত্য থেকে মুছেও যায় তাহলে জানবে, কবি ও রাইকমল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের মধ্যেও অমর...।”
বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ এক লেখকের অর্থাভাবের প্রসঙ্গ রয়েছে লেখকের নিজের কথাতেই। তখন ম্যালেরিয়া ভয়াবহ রোগ। জ্বরে অজ্ঞান মেয়ে গঙ্গা। প্রথম দিন ডাক্তারের টাকা মিটিয়েছেন শিল্পী যামিনী রায়। পরের দিন ‘প্রবাসী’র অফিসে পাওনা ৭৫ টাকা চাইতে গেলেন তারাশঙ্কর। জানানো হল, দশ দিন পরে আসতে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অভুক্ত তারাশঙ্কর। চোখ ফেটে জল। পকেটে অবশিষ্ট আনা তিনেক পয়সা দিয়ে এক মুঠো মুড়ি আর ছোলা জুটল। কাত্যায়নী বুক স্টলে গিরীন সোমের কাছে পৌঁছলেন। গিরীন একশো টাকা আর দু’টি মিষ্টি সাজিয়ে দিলেন। ‘কালিন্দী’ ছেপেছিল ওই প্রকাশনা সংস্থাই। পর পর বেরোল ‘কবি’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’। আর পিছন ফিরে তাকাননি তারাশঙ্কর।
তবে সমালোচকদের একাংশের মতে, তারাশঙ্করের লেখা নাকি, স্থূল! বুদ্ধদেব বসু এক কদম এগিয়ে এ-ও বলেছেন, তারাশঙ্কর জানতেন না, কী ভাবে লিখতে হয়! এ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন ঠেকেছে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। তারাশঙ্কর দু’টি বই পাঠিয়েছেন কবির কাছে। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “রাইকমল গল্পটির রচনার রস আছে এবং জোর আছে— তা ছাড়া এটি ষোলো আনা গল্প, এতে ভেজাল কিছু নেই।” অন্য বইটি, ‘ছলনাময়ী’। স্থূলতার অভিযোগ উড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, তারাশঙ্করের গল্পে ‘বাস্তবতা সত্য হয়েই দেখা দেয়’।
লেখালিখির সূত্রেই রবীন্দ্র পুরস্কার, অকাদেমি, জগত্তারিণী পদক, জ্ঞানপীঠ, নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট প্রভৃতিতে ভূষিত হন তারাশঙ্কর।
জহুরি রবীন্দ্রনাথের বলা ‘বাস্তবতা’র প্রত্যক্ষ কালচিহ্ন তারাশঙ্কর-সৃষ্ট বহু চরিত্রেও। ‘পদচিহ্ন’-এর গোপীচন্দ্র চরিত্রটি লাভপুরের যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘শুকসারী-কথা’র সীমা আসলে লাভপুরের দুর্গা পাল, ‘পঞ্চগ্রাম’-এর স্বর্ণময়ী বাস্তবে লাভপুরে দেখা অন্নপূর্ণা পাল। তাঁর গাড়ির চালক, বীরভূমের মহুটা গ্রামের বাসিন্দা করালী মণ্ডল ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় ‘করালী কাহার’। চালক করালীকে তারাশঙ্কর বলেছিলেন, “দেখিস তোকে বাঁচিয়ে রাখব...।”
মানুষকে ‘বাঁচিয়ে রাখার’ তাগিদটা বাস্তবেও তাড়া করেছে তারাশঙ্করকে। বন্ধু কালিকানন্দ অবধূত এক বার সমস্যায় পড়েছেন। সমস্যা সমাধানে, অবধূতের বিখ্যাত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ প্রকাশে প্রধান সহায়ক হন তারাশঙ্কর। কখনও আবার সাহিত্যিক স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের সময়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ফোন করেন। আবার এক দিন তারাশঙ্কর লিখছেন বাড়িতে। হাজির মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারাশঙ্করের মনে হল যেন ‘ভগ্নপ্রায় জয়স্তম্ভ’। মানিককে যাতে সাহায্য করা যায়, সে জন্য ‘অবশ্য কর্তব্য’ হিসাবে হুমায়ুন কবীরকে চিঠি লিখলেন তিনি।
তারাশঙ্কর মুখ্যত কথাসাহিত্যিক হলেও, তাঁর কলম চলেছে রঙ্গমঞ্চেও। লাভপুরে ‘বন্দেমাতরম থিয়েটার’, তিনকড়ি চক্রবর্তী, নরেশ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়দের আনাগোনা শৈশব থেকেই তারাশঙ্করকে যেন এক মায়ারাজ্যে নিয়ে গিয়েছে। এই জীবনে তাঁর প্রেরণা লাভপুরেরই বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই প্রেরণায় তারাশঙ্কর লিখেছেন ‘মারাঠা তর্পণ’ নাটক। কিন্তু অপরেশচন্দ্র না পড়েই সেটি ফিরিয়ে দেন। পরে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে ‘রাইকমল’ নিয়ে নাটক করতে আগ্রহী হন স্বয়ং শিশিরকুমার ভাদুড়ী। কিন্তু স্টার থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ায় তা আর মঞ্চস্থ করেননি তিনি। যদিও ‘কালিন্দী’, ‘আরোগ্য-নিকেতন’, ‘কবি’, ‘দুই পুরুষ’, ‘পথের ডাক’ প্রভৃতির অভিনয়ে তারাশঙ্করের মঞ্চসাফল্য ধরা আছে।
যাত্রার জগৎকেও দেখেছেন নিবিড় ভাবে। তারই প্রতিফলন, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘অভিনেত্রী’। পরে, তারাশঙ্করের ‘সপ্তপদী’ করে যাত্রামঞ্চে তুফান তোলেন যাত্রাভিনেতা স্বপনকুমার। মঞ্চের পাশাপাশি তারাশঙ্করের গল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে অন্তত ৩৬টি। এখানেও বিগত কালের প্রতি কতটা আগ্রহ ছিল তারাশঙ্করের তা টের পাওয়া যায় একটি ঘটনার সূত্রে। সত্যজিৎ রায় ‘জলসাঘর’-এর দৃশ্যগ্রহণের জন্য নিমতিতার জমিদারবাড়িটি পছন্দ করলেন। তারাশঙ্কর জানতে চাইলেন, সেটি উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীদের জমিদারবাড়ি কি না। সত্যজিৎ জানান, তা-ই। ঘটনা হল, বাংলার জমিদারদের নিয়ে একটি বই থেকে তারাশঙ্কর উপেন্দ্রনারায়ণের কথা জেনেছিলেন। তিনিই জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়।
টালা পার্কের তারাবাবু
পূর্ণ সময়ের লেখক হিসেবে তারাশঙ্করই সম্ভবত প্রথম বাঙালি, যিনি উত্তর কলকাতার বর্ধিষ্ণু অঞ্চল টালা পার্কে বাড়ি-গাড়ির মালিক হন। যদিও, মহানগর যেন তাঁকে সংগ্রামের মধ্যে স্থিতধী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। সাক্ষী, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। তারাশঙ্কর বৌবাজারের একটি মেসে থাকেন। গায়ে-গায়ে ঘর। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। বিভূতিভূষণ দেখলেন, মাদুর পেতে আধশোওয়া অবস্থায় লিখছেন তারাশঙ্কর। সামনে পড়ে এক মুঠো টান দেওয়া সিগারেট। বিভূতিভূষণকে দেখে বললেন, “প্রবাসীর জন্যে একটা গল্প শেষ করছি।” গল্পটি, ‘অগ্রদানী’!
আবার, মনোহরপুকুরের সেকেন্ড লেনে টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে দেড় বছর কাটিয়েছেন। সেখানে বসেই লেখা ‘জলসাঘর’, ‘ছলনাময়ী’, ‘শ্মশান-বৈরাগ্য’, ‘আগুন’ প্রভৃতি। ছেলে সরিতের স্মৃতিতে অম্লান ১/১ এ আনন্দ চ্যাটার্জি লেন, বাগবাজারে ভাড়াবাড়ির দৃশ্য—ফাইবারের ছোট সুটকেস কোলে রেখে, দোয়াত-কলমে লিখছেন তারাশঙ্কর। পুজোর খরচ মেটাতে পর পর লিখছেন ‘বন্দিনী কমলা’, ‘কবি’ উপন্যাস, ‘রাঙাদিদি’, ‘চোরের পুণ্য’ ইত্যাদি ছোটগল্প। সংসারের চাপে ইচ্ছা থাকলেও কেনা হয়নি ঝর্না কলম। পরে ‘কালিন্দী’ প্রকাশ হলে কিনেছেন জীবনের প্রথম ঝর্না কলম, শেফার্স।
তবে মহানগর অর্থকষ্টের থেকেও গুরুতর একটি আঘাত দেয়। তারাশঙ্করের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি ‘সন্দীপন পাঠশালা’ সিনেমাটিতে না কি মাহিষ্য সম্প্রদায়কে হেয় করা হয়েছে। হাওড়ার একটি ব্যায়াম সঙ্ঘের রজতজয়ন্তী উৎসবের সভাপতি হয়েছেন তারাশঙ্কর। ফিরছেন গাড়িতে। হঠাৎ হামলা পঞ্চাননতলা রোডে। মারধর, গাড়ি ভাঙচুর চলল। ঠোঁট-কপাল থেকে ঝরল রক্তও।
এ সবের পরেও আত্মভোলা এক বীরভূমের তরুণই যেন মহানগরের বুকে ঘুরে বেড়ান। পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে রয়েছে, টালা পার্কে প্রতি বিকেলে তারাশঙ্করের হাঁটতে যাওয়ার ছবি। দেখা গেল, এক দিন বেশ টাইট জামা পরে দাঁড়িয়ে সাহিত্যিক। কৌতূহল দেখে বললেন, ‘আমার জামাটা হাতের কাছে পেলাম না। তাই নাতির জামাটা পরেই বেরিয়ে এলাম!’
কিন্তু নাগরিক হলেও, তারাশঙ্কর মনে-মনে বরাবরই রাঙামাটির দেশেরই লোক। সাক্ষ্য নাতি হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ষাটের দশকে লাভপুরে তারাশঙ্কর। এসেছেন হিমাদ্রিও। এক দিন নাতিকে বললেন, “এটাই আমার আসল বাড়ি। কলকাতাটা তোমাদের।” নাতিকে গ্রাম দেখাতে বেরোন পিতামহ। লাভপুর আর মহাগ্রামের সীমানা। রাস্তার ধারে বিরাট বকুল গাছ। দাঁড়ালেন তারাশঙ্কর। বললেন, “এই-যে বকুল গাছটা দেখছ, আর দূরে যে ভাঙা বাড়িটার অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, ওরা দুজনেই ‘আরোগ্য-নিকেতন’-এর বিষয়বস্তু।”
বস্তুত, ‘আরোগ্য নিকেতন’ বইটি বোধহয় তারাশঙ্করের বিশেষ প্রিয়। তাই বড় জামাই শান্তিশঙ্কর অকালে প্রয়াত হলে, হঠাৎ টালা পার্কেরই বাসিন্দা সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে হাজির হলেন তারাশঙ্কর। দিলেন ‘গীতবিতান’, ‘সঞ্চয়িতা’। সঙ্গে ওই বইটিও। বললেন, “শান্তির স্মৃতিতে দিচ্ছি... নিয়ম আছে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের এই সময় বই দিতে হয়। তোমরাই আমার কাছে ব্রাহ্মণ।”
প্রণাম করলেন নরেন্দ্রনাথ। তাঁর মনে হল, ‘আমি ব্রাহ্মণও নই, পণ্ডিতও নই। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যে তাঁদের প্রতিভূ হলাম।’
তবু অনন্ত
জামাইয়ের মৃত্যুর অভিঘাতে সংসারের জন্যই, ৬৪ বছর বয়সে ‘যুগান্তর’-এ কিছু দিন চাকরি করতে হয় তারাশঙ্করকে। কিন্তু ‘লেখক-সত্যের কমান্ড ছাড়া অন্য কোন কমান্ডের অধীন’ যে নন! কিছু দিন পরে চাকরি ছেড়েও দিলেন। যে দিন পদত্যাগ, সে দিনই তাঁকে দেখা গেল ছবি আঁকতে। ‘রেখার যাত্রী’ তারাশঙ্কর ‘সপ্তপদী’ উপন্যাসের কৃষ্ণেন্দু, ‘যাদুকরী’, ‘পুণ্ডরীক’, ‘স্বপ্নকন্যা’-সহ প্রায় ৭০টি ছবি এঁকেছেন বলে অসমর্থিত সূত্রের দাবি। ছবির বিষয়, প্রকৃতি, প্রতিকৃতি ও অবশ্যই মৃত্যুবোধ।
মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অধ্যাত্মচেতনা তারাশঙ্করের অল্প বয়সেই ঘটেছে। মেয়ে বুলুর প্রতি তারাশঙ্করের প্রতি একটু যেন বেশিই টান। বুলুকে এক আত্মীয়া কালো বলে খুব অপমান করলেন এক দিন। ছেলে সরিতের স্মৃতিতে রয়েছে: অপমানিত বুলুর তারাশঙ্করের কোলে আশ্রয় নিয়ে কান্নার দৃশ্যটি। সে বলে, “...বাবা তুমি কালো আর আমি কালো এই বাড়িতে— আর সবাই ফর্সা।” এই আদরের মেয়েটিই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় মাত্র বছর ছয়েক বয়সে মারা যায়। শোকে অধীর তারাশঙ্কর যেন প্রত্যক্ষ করেন ‘অনন্ত এক রাত্রি’।
জীবনের অর্থ সন্ধানে তারাশঙ্কর চাইলেন দীক্ষা, এমনকি সন্ন্যাস নিতেও। বাড়িও ছাড়েন এক বার। মন শান্ত হলে টের পান ঈশ্বর-অনুভূতি। এই অনুভূতিই তাঁকে সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে। সে ক্ষমতা টের পেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামও। তারাশঙ্করের শিশুপুত্রটির মৃত্যু হয়েছে। সৎকার করে ফিরে তারাশঙ্কর জানলেন, আসছেন কাজী নজরুল ইসলাম-সহ দু’জন। বাড়িতে তারাশঙ্কর বলে দিলেন, শিশুপুত্রের মৃত্যুর কথা যেন না জানানো হয়। নজরুল এলেন। হইচই হল। ফেরার সময়ে নজরুল জানতে পারলেন তারাশঙ্করের পুত্রবিয়োগের কথা। ট্রেনে উঠে বললেন, “ভারতবর্ষের একজন খাঁটি মানুষকে দেখে গেলাম।... ভারতবর্ষকে প্রণাম জানাই তোমার কাছে।”
এই ভারতভূমির মৃত্যু, দর্শন, অধ্যাত্মচেতনাই বার বার ফিরে আসে তারাশঙ্করের জীবনে, সাহিত্যেও— ‘গণদেবতা’য় গীতার নিষ্কাম কর্মযোগে, ‘মঞ্জরী অপেরা’য়, ‘সন্ধ্যামণি’, ‘সর্বনাশী এলোকেশী’ বা ‘সনাতন’-এ। হয়তো নিজের মৃত্যুও টের পান! ১৯৬৮-র দিনপঞ্জিতে লিখছেন, “বড় বউ আমাকে ধ’রে রাখ তুমি।” ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। মৃত্যু।
কিন্তু জন্মদিনের আগে, মৃত্যুর প্রসঙ্গ তোলা কি ঠিক? বরং, ফেরা যাক ওঁর টালা পার্কের বাড়িতে। অন্দরমহল থেকে পর্দা দিয়ে দরজা ঢেকে আলাদা করা বাইরের ঘর। ৮ শ্রাবণ, জন্মদিন। ঘরটি সাজানো ফুলে-ফুলে। গুণমুগ্ধদের ভিড়। আর তারাশঙ্কর? হয়তো চা-মিষ্টির সঙ্গে আপ্যায়ন করতে-করতে বলছেন, “বিধাতার আশীর্ব্বাদ আকাশের পুষ্পবৃষ্টির মত বর্ষিত হয়েছে আমার উপরে। আঘাত খেয়েছি— কিন্তু তা প্রসন্ন আশীর্ব্বাদের তুলনায় নগণ্য। পৃথিবীকে ভালবাসি।” আমাদের দায়িত্ব, এই ভালবাসাটির যত্ন নেওয়া।
তথ্যঋণ: ‘আমার কালের কথা’, ‘আমার সাহিত্য জীবন’: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘আমার পিতা তারাশঙ্কর’: সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘তারাশঙ্কর: সমকাল ও উত্তরকালের দৃষ্টিতে’, ‘তারাশঙ্কর: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য’, পত্রিকা: ‘কথাসাহিত্য’, ‘দেশ’, ‘আনন্দলোক’,‘পশ্চিমবঙ্গ’, ‘বৈশাখী’।