ছবি: কুনাল বর্মণ।
“টু দ্য পোস্টমাস্টার,
মাতিবান্ধা পোস্ট অফিস
মাননীয় মহাশয়, ...
এ রকম সম্বোধন পড়ে আগে বিরক্ত হত শিঞ্জিনী, এখন চুপচাপ ‘মাননীয় মহাশয়’ শব্দবন্ধের দু’টি শব্দের শেষেই লাল কালি দিয়ে একটা করে আ-কার জুড়ে দেয়। বাথানগাছি আর ময়নাপাড়া স্টেশনের মাঝে মাতিবান্ধা হল্ট। এখানে সারা দিনে সর্বসাকুল্যে দু’টি ট্রেন থামে।
এক বছর আগে এক গ্রীষ্মের দুপুরে প্রথমে রিকশা, তার পর ট্রেন, তার পর আবার রিকশা এবং শেষে ভ্যানরিকশায় শহর থেকে এই প্রত্যন্ত গ্রামে প্রথম পৌঁছেছিল পোস্টমাস্টার শিঞ্জিনী। প্রাচীন পোস্ট অফিসের গায়ে ‘ইন্ডিয়া পোস্ট’-এর তোবড়ানো সাইনবোর্ড দেখে হতাশ হলেও শিঞ্জিনী ঠিক করেছিল, সে এখানকার হাল ফেরাবে।
গ্রামে পৌঁছতেই বাসিন্দারা এসে ঘিরে ধরল শিঞ্জিনীকে। সবার চোখেমুখে কৌতূহল। ভোলানাথ সরকার বললেন, “আমাগো দিদিমণি এয়েচেন এক্কেরে খাস কলকাতা থে, এই গেরামে কিস্যু নাই গো! দিদিমণি আমাগো টাহার উপায় করে দিবেন!”
এক পাল ছাগল নিয়ে হেলেদুলে এলেন বাদল শীল, শিঞ্জিনীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “এই আপিসে আগে ছেল দুলাল মাস্টার। তা সে গেসে মইর্যা গোখরো সাপের কামড়ে। ভাল কইর্যা ব্লিসিং পাউডার ছড়ায় দিবেন আগে।”
শিপ্রা রায় আর কনক নস্কর দু’ঝুড়ি সিঁদুরে আম রেখে গেলেন।
“দিদিমণি শুনসি খুব ল্যাহাপড়া জানে গো গোঁসাই!” হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সুবল পাগলা, “আমার ছোঁড়াটাও জানত গো ল্যাহাপড়া, বিএ পাস দিসিল, তার পর কোথায় পালাল গো!” বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল সে। এ সবের মধ্যেই বিকেল চারটে নাগাদ ওভারসিয়ার এসে জয়েনিং-এর সব কাজকর্ম মিটিয়ে দিয়ে গেলেন।
তার পর তিন বছর কেটে গেল এখানেই। অফিস লাগোয়া একটি ছোট্ট ঘরে থাকে শিঞ্জিনী। প্রথম প্রথম রাতে ঝিঁঝির ডাকে আর সাপের ভয়ে ঘুম হত না, এখন আর কিছু মনে হয় না। প্রথম প্রথম সপ্তাহান্তে কলকাতার বাড়ি যেত শিঞ্জিনী, এখন গ্রামেই থাকে। শনিবার বিকেলে সে গোকুল বিশ্বাসের কুঁড়েঘরে কীর্তন শুনতে যায়, রবিবার সকালে নিজের রসায়নের বই নিয়ে বসে আর তার গ্রিন কেমিস্ট্রির আধখানা থিসিসটা নিয়ে ভাবে। সন্ধ্যায় গ্রামের মেয়েদের বাংলা, ইংরেজি আর বিজ্ঞান পড়ায়।
শিঞ্জিনী মুখার্জি, ওরফে মাতিবান্ধা ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের হেড, একটু অদ্ভুত মানুষ। সকাল সকাল অফিসে ঢুকে দরজা-জানলা খুলে সে বেঠোভেন চালিয়ে আগের দিনের অফিস জার্নাল আর অ্যাকাউন্ট খাতাটা মিলিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে যখন অফিসে কোনও গ্রাহক থাকে না, সে বাইরে অঝোর বৃষ্টি আর সামনের ভাঙা শিবমন্দিরটা দেখতে দেখতে শোনে দেবব্রত বিশ্বাসের গান। কলকাতা থেকে নতুন ফাইল হোল্ডার, কলমদানি, পেপারওয়েট, বাঁধানো খাতা আনিয়েছে সে। যত্ন করে সব কিছুর হিসাব রাখে, অ্যাকাউন্ট খোলে, চিঠি বুকিং করে, পুরনো ফাইলপত্র বার করে মন দিয়ে পড়ে। শিঞ্জিনী গ্রামের সবাইকে বিশেষ করে প্রায় সমস্ত মেয়ে-বৌদের পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। আগে গ্রামবাসী এখানে টাকা জমা রাখতে ভয় পেত, এখন চোখ বুজে বিশ্বাস করে পোস্টমাস্টার দিদিমণিকে।
শিঞ্জিনীর মা-বাবার পছন্দ নয় মেয়ে গ্রামে থাকুক। তা ছাড়া গত কয়েক মাস থেকেই মেয়ে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কথা শোনে না, বাড়ি আসে না। খালি গ্রামের মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, বাচ্চাদের ডারউইন পড়ায়, গ্যালিলিয়ো পড়ায়, রবীন্দ্রনাথ পড়ায়। মেয়েদের নিয়ে আবার সমিতি তৈরি করেছে একটা, সেখানে বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, গৃহনির্যাতন, যৌন নির্যাতন নিয়ে সরল ভাষায় বোঝায়, শেখায়। তাদের সচেতন করে।
“এত দিন তো পড়ে থাকলি ওই গণ্ডগ্রামে। ঠিকমতো আর বাড়িতেও আসিস না, আমার বাপু একদম ভাল লাগে না ওই গ্রামটা। ও সব সভাসমিতি করে নিজের বিপদ ডেকে আনিস না মা, গ্রামের মানুষ খুব সাংঘাতিক, কখন যে কী... হ্যালো... হ্যালো...” শিঞ্জিনী নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, তাই মায়ের কথাগুলো শহুরে ধোঁয়াশার মতো মিলিয়ে গেল।
শিঞ্জিনী টেবিল থেকে বইটা তুলে নেয়। সে এখন পড়ছে অরুণ জোশীর লেখা ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব বিলি বিশ্বাস’। কিসের যেন একটা অস্থিরতা তাড়া করে বেড়াচ্ছে বিলি বিশ্বাসকে। ধন সম্পত্তি শিক্ষা দীক্ষা সংসার, সব ঠেলে পালাচ্ছে সে। কোথায় পালাচ্ছে? তা আর জানা গেল না, বিলির পা মিলে গেল আদিবাসী মানুষদের মাদলের তালে।
শিঞ্জিনী সারা দিনের কাজকর্মের পর ডায়েরি লেখে। পাতার পর পাতা লিখে যায়। বর্ষার অন্ধকার রাতে যখন সারা গ্রাম থমথম করে, তখন পোস্ট অফিস লাগোয়া ছোট্ট ঘরে জ্বলে টিমটিমে হ্যারিকেন। সেই আলোয় দেখা যায়, ঘরের ভিতর চেয়ারে এক ছিপছিপে শরীর টেবিলে মিশে গিয়ে লিখে চলেছে অজানা ইতিহাস, পরিকল্পনা, আলোর গল্প। কত রাত ভোর হয়ে যায়, ঘুলঘুলির বাসায় ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙে অলস চড়াই। তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরের দালানে এসে দাঁড়ায় শিঞ্জিনী। দেখে, রাতের ঝড়বৃষ্টির পর আকাশে ফুটে উঠেছে ভোরের কমলা আভা।
ইতিমধ্যে গ্রামের মোড়লের সঙ্গে শিঞ্জিনীর দু’বার কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে— মহিলা সমিতি গঠন আর বাচ্চাদের ধর্মগ্রন্থ না পড়িয়ে বিজ্ঞান পড়ানো নিয়ে। মোড়লের বক্তব্য, “গ্রামে প্রাইমারি ইস্কুল আছে, তাও আপনার কী দরকার এত কিছু করার? আপনার বয়স অল্প, শহরের মেয়ে, অফিসের কাজ করুন, না হলে ট্রান্সফার নিয়ে শহরে যান।”
শিঞ্জিনী শান্ত ভাবে বলেছে, “স্কুলে ঠিকমতো ক্লাস হয় না দত্তবাবু। আর ওদের সিলেবাস থেকে ডারউইন বাদ দিয়ে দিচ্ছে, ইতিহাসের চরিত্র বাদ দিয়ে দিচ্ছে... এ ভাবে ওরা কী শিখবে! তাই আমার ইচ্ছে, বই থেকে বাদ গেলেও ওদের জীবন থেকে যেন সে সব মানুষেরা বাদ না যায়। দত্তবাবু, স্কুলে টিচাররা আসেন না, বেশির ভাগ দিন স্কুলটা বন্ধ থাকে, আমি চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু কোনও উত্তর...”
ওকে রূঢ় ভাবে থামিয়ে দিয়েছিল মোড়ল, “আর লিখবেন না। যদি ভাল থাকতে চান, তা হলে যা বলছি শুনুন। আর গ্রামের মেয়েমানুষদের নিয়ে সভা করে অসভ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা বন্ধ করুন, এতে গ্রামের মানমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে।”
শিঞ্জিনী দু’দিন গুম মেরে পড়ে থাকে ঘরে। অফিসের কাজ করে যন্ত্রের মতো। কনক রায় এসে দিদিমণির খোঁজ নিয়ে যায়। আলো সরকার এসে দিদিমণির কাছ থেকে ধার করে পড়া ‘মনীষীদের জীবনী’ ফেরত দিয়ে যায়। অনু ভৌমিক দিদিমণিকে প্রণাম করে বলে যায়, “আমি কৃষ্ণনগরে পড়তে চলে যাচ্চি দিদিমণি। আপনি যে ম্যাডামের ঠিকানা দিইচিলেন তার সাথে কথা হইচে।" বিক্রম বিশ্বাস ঘরের বাইরে থেকে বলে, “দিদিমণি, গেরামে তো আগুন উঠতাসে! আপুনি সভাসমিতি করা বন্ধ করেন। আমার মাইয়াটার বিয়া ঠিক হইসে, তায় মাইয়া আর মাইয়ার মা একজোটে বলে কিনা নাবালিকার বিয়া হইব না। এ কি শেহান আপনি দিদিমণি? আপনি বোঝায়ে কয়েন, ভাল জামাই হাতছাড়া হয়া যায় আর কী!”
শিঞ্জিনীর ঘোর লাগতে থাকে। মনে হয় যেন সে আর তার মধ্যে নেই, এই পৃথিবীতে সে যে জন্য এসেছিল, তা যেন আর কখনও করা হয়ে উঠবে না। তার বমি আসে, হাত-পা শিরশির করে। তবু এক অদৃশ্য শক্তির উপর বিশ্বাস রেখে সে আবার উঠে দাঁড়ায়, লিখে চলে তার ডায়েরি, চুপিচুপি তার অফিসে কবিতা শেখায় তার কচি কচি শিশুগুলোকে... “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির...”
গ্রামে আর প্রকাশ্যে কোনও স্বামী বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে মারে না। ছেলেমেয়েদের সংবিধানের কোন ধারায় কোন আইন, সব শিখিয়েছে এই অলক্ষুনে পোস্টমাস্টারনি। কোথাও অন্যায় হলেই আলো, কৌশিক, অর্পিতা, মেঘনা, বাবাইরা ছুটে যায় দল বেঁধে।
অচল স্কুল এবং চিকিৎসাকেন্দ্রটির বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। পোস্টমাস্টারের অক্লান্ত চিঠির ফলে আজ পাঁচ বছর পর বেশ কয়েকটি ট্রেন থামে মাতিবান্ধা স্টেশনে। গ্রামের পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট বাড়তে থাকে, সুপার সাহেব নিজে এসে বাহবা দিয়ে যান। এখানকার জীবনযাত্রায় পোস্টমাস্টারের কষ্টে দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলে যান, শিগগিরই শহর-ঘেঁষা অফিসে ট্রান্সফার পাবে শিঞ্জিনী।
সুপার সাহেব কথা রেখেছিলেন। যথাসময়ে ট্রান্সফার হয়ে যায় এই ডিভিশনের প্রথম মহিলা পোস্টমাস্টারের।
ট্রান্সফারের এক বছর পর পোস্ট অফিসের চাকরি ছেড়ে দেয় শিঞ্জিনী। এখন গবেষণায় নিযুক্ত সে। সিন্থেটিক বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার নিয়ে তার কাজ। অনেক বছর পর আজ সে এসেছে মাতিবান্ধা গ্রামে। সেখানে এখন পুরনো স্কুলটি ভেঙে একটি বড় প্রাইমারি ও হাই স্কুল হয়েছে, একটি প্রাইভেট স্কুল হয়েছে। আলো সরকার এখন মাতিবান্ধা হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা, কৌশিক ডাক্তার হয়েছে। সেই বিক্রম বিশ্বাসের মেয়ে, যার ভাল বর হাতছাড়া হয়ে গেছিল, সে এখন মাতিবান্ধা অঙ্গনওয়াড়ির সুপারভাইজ়ার। শিঞ্জিনীর তৈরি করা মহিলা সমিতি এখন আরও বড়, আরও সক্রিয়, ঠিক যেমন সে স্বপ্ন দেখেছিল। পিচরাস্তাটায় হাঁটতে হাঁটতে শিঞ্জিনীর দেখা হয়ে যায় বৃদ্ধ মোড়লের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে গ্রামের ছেলেমেয়েদের মাধ্যমে যোগাযোগ আছে শিঞ্জিনীর। বিশেষত ওঁর মেয়ের সেই দুর্ঘটনার পর থেকেই।
“ভাল আছেন, দত্তবাবু?”
"আর ভাল মা! সে অবস্থাও গেছে, ব্যবস্থাও গেছে। তোমার কাজে বাধা দেওয়ার পাপে মেয়েটাকে হারালাম মা! তোমাকে কত কিছু বলেছি, আর তুমি দূরে থেকেও এই বুড়ো বাপের হয়ে এত বছর ধরে লড়াই করার সাহস জোগাচ্ছ, তোমার হাতে তৈরি ছেলেমেয়েরাই তো আজ...”
দত্তবাবুর মেয়ের প্রসঙ্গে মন খারাপ হয় শিঞ্জিনীর। সে তাড়াতাড়ি বলে, “আপনি চিন্তা করবেন না। এই মামলা আমরা জিতেই ছাড়ব। ধর্ষক জন্তুগুলোর শাস্তি হবেই।”
পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ঘুলঘুলির দিকে তাকায় শিঞ্জিনী, সেখানে আর চড়াইদের বাসা নেই, ইলেকট্রিকের তার গেছে ফুটোর ভিতর দিয়ে। তার চেয়ারে এখন বসে এক তরুণ, নাম সোমক। সোমক মন দিয়ে কাজ করে, নষ্ট করার মতো সময় নেই তার। মাতিবান্ধা এ বারের অর্থনৈতিক বছরে সাব-ডিভিশনের মধ্যে অ্যাকাউন্ট খোলায় প্রথম হয়েছে। অফিসে নামী কোম্পানির মজবুত নতুন আলমারি, নতুন ভল্ট। মোবাইল ব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে কত গ্রাহক। পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটার আসে না আর, সবই রেজিস্টার বা স্পিড।
নিজের মনেই হেসে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে শিঞ্জিনী। কোথায় গেল সেই গোকুল বিশ্বাসের ঘরে কীর্তন শোনার সন্ধেগুলো, কোথায় গেল তার বর্ষার সন্ধ্যায় জানলার ধারে বসে গাওয়া দেবব্রতর গান, রাতের পর রাত জেগে বোনা স্বপ্ন, নতুন পরিকল্পনা! আজ তো সে না থাকলেও মাতিবান্ধা উন্নতি করেছে, পাকা রাস্তা হয়েছে, স্কুল হয়েছে, হাসপাতাল হয়েছে, ছেলেমেয়েগুলো মানুষ হয়েছে। শুধু শুধু সে-ই অনিশ্চয়তায় কষ্ট পেয়েছে। কোনও কিছুই কারও জন্য থেমে থাকে না।
“আপনার লেখা কবিতাগুলো সুন্দর...” তরুণ পোস্টমাস্টারের কথায় চমকে উঠল শিঞ্জিনী। আকাশে গুমরে উঠল মেঘ। সে বলে, “তুমি আমার কবিতা কোথায় পড়লে?”
“আপনার হাতের লেখাও সুন্দর। কোথাও আপনার নাম লেখা নেই যদিও, কিন্তু এই অফিসের একমাত্র মহাশয়া তো আপনিই। আপনিই তো শুরু করেছেন এই গ্রামের ভিত নির্মাণ। আপনার দুটো কবিতার বই-ই আমি কিনে পড়েছি। কেমন লাগছে এই গ্রাম আপনার এখন? আপনার স্বপ্নের কিছুটাও কি পূরণ হয়েছে?”
“তুমি কী বলছ বলো তো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
মাথা নিচু করে একটু হেসে শিঞ্জিনীর সামনে সোমক এগিয়ে দেয় বহু যুগ আগের ছোট্ট সেই ডায়েরিটি।
“আপনার মতো আমারও পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটার শখ। আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার এই অপূর্ব ডায়েরিটি আমি রাত জেগে পড়ে শেষ করেছি, চেষ্টা করেছি আপনার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু কাজ করার। মহিলা সমিতির নাম আপনার ইচ্ছেমতোই রাখা হয়েছে ‘জাতিকা’। গোকুল বিশ্বাসের কীর্তনের আকুল বর্ণনা পড়ে আমি পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছি তাঁর ভজনকীর্তন শুনব বলে। গত বর্ষার শেষে তিনি মারা গেলেন। তাঁর গাওয়া সব গান রেকর্ড করে রেখেছি। শুনবেন?”
টেপরেকর্ডারে ক্যাসেট ঢুকিয়ে প্লে বোতামে চাপ দেয় সোমক।
‘আমি জানি না কে বা এসেছি কোথায়/ কেন বা এসেছি কে বা নিয়ে যায়/ যাই ভেসে ভেসে কত দেশে দেশে/ চারিদিকে গোল ওঠে নানা রোল.../ কত আসে যায় কাঁদে হাসে গায়/ এই আছে আর তখনই নাই...’
গোকুল বিশ্বাসের সুরের টানে ওলটপালট হতে থাকে শিঞ্জিনীর মন, পা কাঁপতে থাকে। মনে পড়ে প্রথম বার ভাঙা রাস্তা দিয়ে এই গ্রামে তার আগমন, অক্লান্ত সেই ঝিঁঝির ডাক, ভয়ে কাটানো নির্ঘুম রাত, দোয়েলের শিস, আমের মুকুলের ঘ্রাণ, অপমান, কান্না, স্বপ্ন, দীর্ঘশ্বাস, বাদল শীলের বাড়ির শাঁখের সুর, সুবল পাগলার নিষ্পাপ হাসি। প্রসন্ন হেসে দু’চোখ বোজে সে। এই বার আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি নামবে বড় বড় ফোঁটায়।