ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩১
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

কৃষ্ণপক্ষের গভীর তমিস্রাময়ী এই কাল-নিশা, তাঁদের জীবনের একটি পর্বান্তের সূচনা করল। জগতের চোখে তাঁরা এখন মৃত ছয়টি মানুষ।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:২৭
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: দ্রোণাচার্যের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও কৃপী সাশ্রুনয়নে ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রশ্ন করে বসেন, সত্যিই কি কখনও সে পারবে তার গুরুকে হত্যা করতে। আকস্মিক প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারে না ধৃষ্টদ্যুম্ন। দুর্যোধনদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দেয় পাণ্ডব ভাইয়েরা। বারণাবতের জতুগৃহে নেশাগ্রস্ত পুরোচনকে রেখে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায় তারা। সেখানে জননী-সহ পাঁচ নিষাদকেও দগ্ধ করা হয়, যাতে তাদের মৃতদেহ দেখে সকলে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীর মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হন।

Advertisement

ভীম বললেন, “শত্রুরা যত দিন এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকবে, তত দিন আমরা নিরাপদ— তাই না জ্যেষ্ঠ?”

“অবশ্যই! আশা রাখি দুর্যোধন আমাদের শেষকৃত্যও সমারোহেই করবে... এবং তার পর মন্ত্রণাগৃহে উল্লাস...”

Advertisement

“কিন্তু...” তৃতীয় পাণ্ডব এখনও বলে চলেছেন, “এ তো পরিকল্পিত হত্যা, জ্যেষ্ঠ! নির্দোষ-নিধন! পুরোচন ছিল হননেচ্ছু দুর্বৃত্ত, তাকে ছলে নিপাত করায় পাপ নেই। কিন্তু এই যে পঞ্চপুত্র আছে এমন ব্যাধ-রমণীর অনুসন্ধান করে তাদের সপরিবারে আহ্বান করে আনা— তার পর গুরুভোজন ও বিবশক পানীয় দ্বারা আচ্ছন্ন করে জ্বলন্ত ভবনের মধ্যে রেখে আসা— এ তো পাপ! আপনি স্বয়ং এমন ধর্মপথগামী হয়ে...”

আবার একটু সময় নিলেন যুধিষ্ঠির। যেন ঈষৎ ক্ষীণ শোনাল তাঁর কণ্ঠ, “ধর্মের গতি সূক্ষ্ম। আত্মরক্ষার্থে জীবহত্যা ধর্মানুমোদিত, প্রিয় ভ্রাতা! আত্ম-নিরাপত্তার কারণে হত্যা! ওই অরণ্যচারী ব্যাধরাই কি ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নিষ্পাপ মৃগ বধ করে না? সেও তো আত্ম-অস্তিত্ব রক্ষাই। ভগ্ন গৃহে নিষ্পাপ কীট, মহীলতা, মশক, সহস্রপদী, পিপীলিকা, চর্মচটিকা— যারা হয়তো কোনও গুরুতর ক্ষতিই করত না— তাদের নিধন করেই কি বসবাস করে না দরিদ্র? শীত-অপনোদনের জন্য যে অগ্নিকুণ্ড জ্বালা হয় তাতে কি অজস্র পতঙ্গ দগ্ধ হয় না? প্রিয় পার্থ, এও আমাদের আত্ম-নিরাপত্তার কারণে জীবনাশ! ওই গৃহে পঞ্চপুরুষ ও এক নারীর দগ্ধ শব না মিললে কাল প্রভাতেই স্পষ্ট হত যে, আমরা কোনও ভাবে পলায়নে সক্ষম হয়েছি! তখন দুর্যোধনের চর আমাদের সন্ধান করে বেড়াত— এবং এই অসহায় অরক্ষিত অবস্থায় সহজেই মারাত্মক ক্ষতি করতে পারত! এখন বহুকাল শত্রুরা আমাদের মৃতজ্ঞানে উপেক্ষা করবে, বিস্মৃতই হয়ে যাবে এক প্রকার! তাতেই আমাদের রক্ষা।”

সহদেব বললেন, “এখন তবে যত দিন সম্ভব আমাদের ছদ্ম-পরিচয়ে ভ্রমণ করতে হবে, তাই না? কুরু থেকে দূরে-দূরে...”

“কিন্তু, ভ্রাতঃ, অন্যত্রও তো আমাদের দেখে, চিনে ফেলতেই পারে লোকে!” নকুলের কণ্ঠে সংশয়, “হস্তিনার রাজকুমার ও রাজমাতাকে বহু লোক জানে...”

যুধিষ্ঠির বললেন, “না। তত সহজ হবে না! প্রথমত, আমরা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ নেব। শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ, অকর্তিত দীর্ঘ কেশ চূড়াবদ্ধ, পরনে মলিন বসন ও উত্তরীয়। যারা আমাদের রাজকীয় ক্ষত্রমর্যাদায়, অলঙ্কার-কিরীট-কবচভূষিত ও সম্ভ্রান্ত মহার্ঘ বেশে দেখেছে অতীতে, তাদের পক্ষে চেনা অসম্ভব! আমরা যে রাজ্যেই যাব, মূল নগরীতে অবস্থান না করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, দরিদ্রপল্লিতে আশ্রয় নেব। অন্য রাজ্যের দরিদ্ররা হস্তিনার কুমারদের চাক্ষুষ করেছে এ সম্ভাবনা প্রায় নেই। সবচেয়ে বড় কথা কী জানো, নকুল? যে ব্যক্তিরা মৃত বলেই প্রতিষ্ঠিত, যাদের মৃতদেহের সাক্ষী বহুজন, ধুমধাম সহকারে অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত হয়েছে, সারা দেশে প্রচার হয়ে গিয়েছে সেই মৃত্যুর বার্তা— তাদের পুনরায় প্রত্যক্ষ দেখলেও প্রত্যয় হয় না মানুষের। ভাবে, এ চোখের ভুল। মনে করে, একই রকম দেখতে, কিন্তু এরা তারা নয় কিছুতেই! মৃত্যুসংবাদ বড় অমোঘ বস্তু!...বুঝলে, অর্জুন, কেন প্রয়োজন ছিল ছয়টি দেহের?”

অর্জুন এখনও তর্কশীল। তিনি বললেন, “আপনি কি নিশ্চিত, জ্যেষ্ঠ— ওই ছয়টি মৃতদেহ দেখে কেউই আর একটুও সন্দেহ করবে না? স্বীকার করি, শবের ত্বক মাংস দগ্ধ হলে আর বাহ্যিক লক্ষণ মেলানো অসম্ভব। সাধারণ দর্শক প্রতারিতই হবে। কিন্তু কঙ্কাল? দেহগঠন? এগুলি বিচার করার মতো গভীর বুদ্ধি আমাদের বৈরীপক্ষে কারও না কারও তো থাকবেই! আপনিই বলুন, দগ্ধ ওই পাঁচ ভ্রাতার মধ্যে এক জনেরও গঠন কি মধ্যম পাণ্ডবের সঙ্গে সদৃশ হবে? এই বৈসাদৃশ্য দেখে সংশয় হবে না কারও?”

যুধিষ্ঠির মৃদু হাস্য করেন। তার পর বললেন, “কথাটি সঙ্গত বটে। কিন্তু তার বিপরীতে এও সত্য যে, বারণাবতে তো বটেই, আমাদের সমগ্র শত্রুশিবিরে এক জনও নেই যার বুদ্ধি এমন তীক্ষ্ণ প্রখর! বিশেষত, তারা তো আমাদের নিধন সম্পর্কে পূর্বাহ্ণেই অতি-নিশ্চিত, পুরোচনের কাছ থেকে নিশ্চয়ই তারা বার্তা পায় নিয়মিত। শোনো অর্জুন! যে অতি অধীর উৎসাহে ঘটনার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে, এবং তা ঘটবে বলেই প্রবল আত্মবিশ্বাসী— সে কখনও বিপরীত সংশয়ের বশবর্তী হয়ে রন্ধ্রসন্ধানে প্রবৃত্ত হয় না। মানব-মনস্তত্ত্ব এমনই!”

কুন্তী অনেক ক্ষণ কথা বলেননি। এ বার বললেন, “তার মানে কি এই দাঁড়াল, যুধিষ্ঠির— আমরা এখন পথের ভিক্ষুক? হস্তিনার যুবরাজ, কুরুবংশের রাজপুত্রেরা, রাজা পাণ্ডুর রানি— এরা সকলে এখন অনির্দিষ্টকাল গৃহহীন অনাথের মতো দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে? দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে উদরপূর্তি করবে মহারাজ পাণ্ডুর তনয়রা?”

যুধিষ্ঠির শান্তস্বরে উত্তর দেন, “হ্যাঁ, মা। আপাতত এই। নান্য পন্থা!”

অন্ধকারের মধ্যেই ললাটে করাঘাত করেন কুন্তী। হাহাকারে উদ্বেল হয়ে ওঠে তাঁর মাতৃবক্ষ।

পরমুহূর্তেই তিনি নিজেকে সংযত করে নেন। তাঁকে ভেঙে পড়তে দেখলে পুত্রেরা মনোবল হারাতে পারে। সারা জীবন তিনি পক্ষপুট দিয়ে ঢেকে রেখেছেন এদের, আজ এই নিবিড় সঙ্কটেও সে ভূমিকা ত্যাগ করা সমীচীন নয়। পুত্রেরা বয়ঃপ্রাপ্ত ও বলশালী হয়েছে, জননীকে তারা স্কন্ধে নিতে পারে আজ— কিন্তু মানসিক আশ্রয়ের জন্য এখনও তারা মাতৃমুখাপেক্ষী। এখন তিনিই এদের একমাত্র প্রেরণাদাত্রী। হ্যাঁ, যদি উপযুক্ত বধূরা থাকত...

পাঁচ ভাইয়ের প্রত্যেকের উপযুক্ত রূপ-গুণ-মননশালিনী পত্নী! তেমন খুঁজে পাওয়া কি সহজ কাজ হবে? ধর্মশীল যুধিষ্ঠিরের যোগ্য, দুর্দম অতিকায় ভীমের, ধীমান বীর অর্জুনের, রূপবান নকুলের, জ্ঞানী সহদেবের? এতগুলি যোগ্য কন্যা..!

দূর! এখন প্রাণসংশয়, অস্তিত্ব-সঙ্কট! এই কি পুত্রবধূ-সংগ্রহের কথা ভাবার ক্ষণ? ভাবীকালের গর্ভে কী নিহিত আছে, তা নিয়ে এখন ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। বারণাবত-যাত্রার আগে পুণ্যাত্মা ব্যাস স্বয়ং তাঁদের বলেছেন, শত অশুভের মধ্যেও মঙ্গল বিকশিত হবে, অকল্পিত সৌভাগ্য অপেক্ষমাণ তাঁর পঞ্চপুত্রের জন্য!

সৌভাগ্যের ক্ষীণ রেখাও এই মুহূর্তে পরিদৃশ্যমান নয়। কিন্তু প্রাজ্ঞ দ্বৈপায়ন খুবই নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলেছিলেন; অবশ্যই কোনও অপ্রকাশ্য ভবিষ্য-চিত্র জ্ঞাত আছে তাঁর। বাহ্য ঘটনাবলির অন্তরালে বিপুল গূঢ় রাজনীতির ফল্গু-স্রোত সর্বদা বহমান থাকে এই মহাভারত-নাট্যে, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় পৃথা তা বুঝেছেন। কিছু একটা ঘটতে চলেছে, ঘটানো হতে চলেছে, রজ্জু-সঞ্চালিত পুত্তলীর মতো তাঁরা সকলে সেই অমোঘ ইঙ্গিতের অধীন। তবে, যা ঘটবে তা তাঁদের হিতকর, এইটুকু বিশ্বাস আছে। ঋষিবাক্য মিথ্যা হবে না নিশ্চয়ই।

কুন্তী একটি ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলেই পরমুহূর্তে এক গভীর শ্বাস টেনে নিলেন। চতুর্দিক অন্ধকার, অদূরে অরণ্য, গঙ্গার ছলছল শব্দ কানে আসছে। অদূরে কোথাও অপেক্ষা করছে তরণী।

কৃষ্ণপক্ষের গভীর তমিস্রাময়ী এই কাল-নিশা, তাঁদের জীবনের একটি পর্বান্তের সূচনা করল। জগতের চোখে তাঁরা এখন মৃত ছয়টি মানুষ। প্রেতের মতো সঙ্গোপনে বিচরণ করতে হবে, যত দিন না ভাগ্য আবার আত্মপ্রকাশের অনুকূল হয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement