ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২৬
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

অপরাহ্ণ আসন্নপ্রায়। শারদ গোধূলির গগনে কিঞ্চিৎ মেঘসঞ্চারের আভাস। শীতল বায় বইতে শুরু করবে স্বল্পক্ষণের মধ্যেই। সমিধ ও ধেনু-সহ আশ্রমশিষ্যদের প্রত্যাবর্তনের সময় হল।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২ ১০:৩০
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: রাজা দ্রুপদের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে উত্থিত হবে এক কুমার ও কুমারী— এক জন দ্রোণহন্তা এবং অপর জন কুরুকুল পতনের কারণ। মহাযজ্ঞ, ঋষিবচন, রাজপ্রচার ও দৈববাণী— এই চার উপায়ের সংযোগে মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে সব ঘটনা। জম্বুকের কাছ থেকে সমস্ত পরিকল্পনা বুঝে নেন মহর্ষি উপযাজ। তবুও শেষ অবধি তিনি নিজে রাজি হন না, অন্য উপায়ের সন্ধান দেন। অপর দিকে, পাণ্ডবদের বারণাবত প্রেরণের উদ্যোগে গভীর ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখতে পান অভিজ্ঞ বিদুর।

Advertisement

জম্বুক প্রশ্ন করে, “আপনার যেমন নৈতিক দিকে আপত্তি, তাঁর তেমনটি নয়?”

উপযাজ হাসলেন, “না, তিনি খুবই উদার। আচার-বিচার শুচি-অশুচি ইত্যাদি সম্পর্কে দৃঢ়নিষ্ঠ নন। ভূমিতে পতিত ফল আমরা গ্রহণ করি না, উনি করেন। গুরুগৃহে বাস করতাম যখন, দেখেছি আমার ভ্রাতা অন্যের পাত্র থেকে তাদের উচ্ছিষ্ট অন্নও নির্বিকারে ভোজন করতেন। সে জন্য যোগ্যতা সত্ত্বেও সমাজে তিনি কিঞ্চিৎ নিন্দিত, তাঁর যজমান-সংখ্যা অতি স্বল্প— এবং সম্ভবত সেই অখ্যাতি-হেতুই রাজা দ্রুপদ তাঁর কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাননি। কিন্তু রাজা যে বিপুল ধনের প্রলোভন দিচ্ছেন তাতে ভ্রাতা যাজ সম্মত হতে বিলম্ব করবেন বলে মনে হয় না। এবং এ জন্য কৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুসারে যা-যা করণীয়, সে সব গূঢ় কৃত্যও তিনি সানন্দে নির্বাহ করবেন।”

Advertisement

“আপনি স্বয়ং তাঁকে যদি একটু বুঝিয়ে বলেন,” জম্বুক বিনীত অনুরোধ করে, “যজ্ঞটি সফল হওয়া নিয়ে কথা। ঋত্বিক যিনিই হোন!”

“বলব। ধীরে ধীরে রাজা দ্রুপদকেও আমি সম্মত করাব ভ্রাতা যাজের কাছে প্রস্তাবটি নিয়ে যেতে। তার পর, ভ্রাতাকে আমি সমস্ত নিগূঢ় বার্তা বুঝিয়ে বলব। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যান, দূত। মহান বাসুদেবকে বলবেন, এ যজ্ঞ হবে! তিনি ঠিক যেমন বাঞ্ছা করেন, তেমন ভাবেই হবে।”

“বড় আশ্বস্ত করলেন, ব্রহ্মর্ষে!” জম্বুক আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানায়।

“আর একটি গূঢ় তথ্য আপনাকে জানাই। মহাত্মা কেশবকে আপনি তা জ্ঞাপন করবেন এবং তাঁর সম্মতি আছে কি না আমাকে বলবেন...”

“কী গূঢ় তথ্য?”

অতি নিম্নকণ্ঠে, কিছু যেন সঙ্কুচিত ভঙ্গিতেই উপযাজ বললেন, “আমার ভ্রাতা যাজ... তিনি প্রত্যন্ত অরণ্য-সংলগ্ন অনার্য উপজাতি-পল্লিতে যাতায়াত করতেন যৌবনকালে। সেখানে এক কৃষ্ণাঙ্গী যুবতীর গর্ভে তাঁর এক কন্যা জন্মেছিল, তার অল্পকাল পরে তার মায়ের দেহান্ত হয়। বিপ্র-জারজ বলে নিজসমাজ-ত্যক্তা সেই বালিকা এক নির্জন পর্ণকুটিরে তার বৃদ্ধা মাতামহীর কাছে লালিতা, কিন্তু ভ্রাতা যাজ তাকে গোপনে নিরন্তর স্নেহ-পরিচর্যা এমনকি সুশিক্ষা পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি বৃদ্ধা মৃত্যুশয্যায়; কন্যাটির কী গতি হবে ভেবে ভ্রাতা খুব উদ্বিগ্ন...”

ভেকের ঘ্রাণে আশীবিষ যেমন তীক্ষ্ণস্নায়ু হয়ে ওঠে, মুহূর্তের মধ্যে জম্বুক ছিলা-টান হয়ে বসল। উত্তেজিত, কিন্তু একাগ্র। প্রশ্ন করল, “কন্যাটি রূপবতী? বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের পত্নী হওয়ার যোগ্যা? আপনার নিজের কী বিচার, হে প্রাজ্ঞ?”

ঋষি বলেন, “শ্যামাঙ্গী— কিন্তু অলোকসামান্য রূপ। দারিদ্রের কারণে উপযুক্ত বিকাশ-দ্যুতি নেই, কিন্তু যথোচিত পরিচর্যায় চতুর্দিক আলো করে দেবে। আর, পিতার দীক্ষা-প্রভাবে কন্যার ব্যক্তিত্ব-বিচারবোধও খুবই জাগ্রত...”

“ঋষিবর, এই কন্যাই চূড়ান্ত হল। যজ্ঞাগ্নি-সম্ভূতা হবে সে-ই। আপনি আমার বাক্যই সিদ্ধান্ত ধরে নিতে পারেন,” জম্বুক আর বিলম্ব করে না, “প্রভু বাসুদেবের সম্মতিও আমি স্বয়ং এসে জানিয়ে যাব পুনরায়!”

“বেশ। কর্মটি তবে সহজতর হল। রাজার পক্ষে এই সন্ধান তত সুবিধাজনক হত না...”

জম্বুক বিনীত কিন্তু আপ্লুত ভঙ্গিতে বলে, “নিয়তি সহায়! আপনি সেই কালের এক মহান অক্ষ হয়ে উঠছেন, হে পুণ্যাত্মা!”

উপযাজ সামান্য আবেগার্দ্র কণ্ঠে বলেন, “কালের আহ্বান ফেরানো যায় না। আমি শুধু স্বহস্তে পূর্ণাহুতিটি দেব না বলে মূল ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। কিন্তু ভ্রাতাকে আমি যজ্ঞে সহায়তাও করব, সহ-ঋত্বিক হয়ে এই কর্মের অংশভাক্‌ হতে আমার অসম্মতি নেই। তাতে আমার পুণ্যহানি হবে না...”

“যাক। এ উত্তম প্রস্তাব। ধন্য!”

অপরাহ্ণ আসন্নপ্রায়। শারদ গোধূলির গগনে কিঞ্চিৎ মেঘসঞ্চারের আভাস। শীতল বায় বইতে শুরু করবে স্বল্পক্ষণের মধ্যেই। সমিধ ও ধেনু-সহ আশ্রমশিষ্যদের প্রত্যাবর্তনের সময় হল।

তৃপ্তমুখে উঠে দাঁড়ায় বার্তাবহ। সে অনুভব করছে, তার দৌত্য সফল হয়েছে। ঋষি উপযাজ পুণ্যভীরু, কিন্তু উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আলোড়ন উঠেছে তাঁর অন্তরে, কর্তব্য করবেন তিনি। জম্বুক প্রণাম জানিয়ে বলে, “আমি তবে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরি?”

“অবশ্যই! যদুনাথ হৃষীকেশকে আপনি নিশ্চিন্ত করুন গিয়ে। এই মহাযজ্ঞের সাফল্যের দায়িত্ব আমি নিলাম। যজ্ঞ সফল হবে, দ্রুপদের পুত্র-কন্যা যথাসময়ে যজ্ঞোত্থিত হবে, তাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থহবে না।”

জম্বুক এক বার আকাশের দিকে তাকাল। তার মনে হচ্ছে, দূরের ওই রক্তিম পশ্চিম দিগন্তে যেন অনাগত কালের সেই মহাযজ্ঞের হুতাগ্নি! আর এই পূর্বাকাশে যে মেঘগর্জন হল সহসাই— যেন পাঞ্চজন্য শঙ্খের নিনাদ! এই মুহূর্তে কেউ তা শুনতে পাচ্ছে না— কিন্তু অচিরেই সমগ্র জম্বুদ্বীপপ্রকম্পিত হবে সেই নির্ঘোষে। নিয়তির অমোঘ নির্দেশের মতো!

৪৩

“তার পর?”

“তার পর ঘোষণা হল— মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত! এত ক্ষণ যজ্ঞভূমিকে বেষ্টন করে বসে, সহস্র বিপ্র একত্রে মন্ত্রপাঠ করছিলেন উচ্চস্বরে। কাষ্ঠনির্মিত সুউচ্চ যজ্ঞবেদির উপর প্রধান ঋত্বিক ঋষি যাজ দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে পূর্ণাহুতির স্তোত্র পাঠ করছিলেন। যজ্ঞাগ্নিতে ঘৃত ঢালছিলেন তাঁর ভ্রাতা উপযাজ। বিশাল ধূসর ধূমরাশি কুণ্ডলীকৃত হয়ে চতুর্দিকে বিস্তারিত হয়ে পড়ছিল। দূরে, বেষ্টনীর বাইরে সমবেত সহস্র কাম্পিল্যবাসী সেই ধূমে আচ্ছন্ন। তারা সকলে চক্ষু মুছছিল। হঠাৎ বিপুল বাদ্যধ্বনি। কাড়া নাকাড়া তূরী ভেরী শঙ্খ শৃঙ্গ। সকলে সচকিত হয়ে দেখল— ধূমের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক তরুণ কুমার!”

প্রবীণ গিরিকর্ণ যথেষ্ট সবিস্তারেই বিবরণ দিচ্ছিল। কুরুশার্দূল ভীষ্মের প্রধান ও বিশ্বস্ততম গূঢ়পুরুষ এই গিরিকর্ণ, তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি ও প্রাঞ্জল বর্ণনক্ষমতার জন্য প্রসিদ্ধ। সদ্য পাঞ্চাল-প্রত্যাগত এই চর এখন গঙ্গাপুত্রের নিজস্ব মন্ত্রণাগারে দাঁড়িয়ে।

রুদ্ধদ্বার এই সভায় ভীষ্মের সঙ্গেই উপস্থিত রয়েছেন বিদুর, দ্রোণ, কৃপ ও অশ্বত্থামা।

হস্তিনা-রাজনীতির পাঁচ জন প্রধান ব্যক্তির মুখভঙ্গিতে পৃথক পৃথক অনুভব ব্যক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। গাঙ্গেয়র আননে কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্য ও সন্দেহ, অশ্বত্থামার মুখ ঘৃণা ও ক্রোধে কঠিন। কৃপ উদ্বিগ্ন। বিদুর আপাত ভাবে শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা তাঁর চোখে-মুখে।

আর, পঞ্চম ব্যক্তিটি? তিনি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। তাঁর মুখের রেখাগুলি এতটুকু তরঙ্গায়িত হচ্ছে না, ভয় ক্রোধ সংশয় পরিহাস কোনও কিছুরই সামান্যতম লেশ নেই। তিনি সব শুনছেন। দেখছেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াহীন পলক ফেলে চলেছেন শুধু।

এ আলোচনার যা বিষয়বস্তু, তাতে দ্রোণেরই আলোড়িত হওয়ার কথা সর্বাধিক! কিন্তু তিনি আজ যেন এক নিরাসক্ত শ্রোতা, নির্বিকার দর্শক মাত্র।

“ধূমের মধ্যেই দাঁড়িয়ে? মানে, তার আগে কোথাও তার অস্তিত্ব ছিল না, অকস্মাৎ ধূমের মধ্যে আবির্ভূত হল?” ভীষ্ম কিঞ্চিৎ অবিশ্বাসের সুরেই জিজ্ঞাসা করলেন।

“আজ্ঞে, হ্যাঁ, মহাভাগ! যজ্ঞাগ্নি থেকে সগর্জনে উঠে এসে, দৃপ্ত ভঙ্গিতে দৃঢ় পদবিক্ষেপে কাষ্ঠ-মঞ্চের একেবারে সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। অতি তেজোদৃপ্ত যুবা, বলিষ্ঠ পেশিসমৃদ্ধ গঠন, গাত্রবর্ণ ঈষৎ শ্যাম কিন্তু সুদর্শন। তাঁর বর্ম ও মুকুট অগ্নিবর্ণ, স্কন্ধে ধনুঃ, পৃষ্ঠে তূণীর ও দক্ষিণ হাতের মুঠিতে শাণিত খড়্গ!”

বিদুর ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন, “অগ্নি থেকেই উত্থিত হল? তুমি তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলে সেই মুহূর্তে?”

গিরিকর্ণ বিনীত কণ্ঠে জানায়, “হ্যাঁ, প্রভু! আমি দেখেছি।”

“তুমি তো বললে চতুর্দিক ধূমে আচ্ছন্ন ছিল! জনতার সঙ্গে তুমিও তো ছিলে বেষ্টনীর বাইরে, দূরে! তোমার চক্ষুও তো বিহ্বল ছিল নিশ্চিত! কী ভাবে দেখলে ও নিশ্চিত হলে যে, ওই সুসজ্জিত যুবক ধূমের আড়াল দিয়ে সোপান বেয়েই উঠে এসে দাঁড়াল না যজ্ঞমঞ্চে?”

“না, আর্য! অসম্ভব! আমি বস্তুত এই সন্দেহ মনে রেখেই সোপানের উপর খর দৃষ্টি রেখেছিলাম! আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম এমন অবস্থানে যাতে সোপানশ্রেণি সম্পূর্ণ দৃষ্টিগোচর থাকে। নিঃসংশয়ে বলতে পারি, সোপান বেয়ে কেউ ওঠেনি। এমনকি যে মুহূর্তে ওই কুমারকে মঞ্চে দেখা গেল, ঠিক তার পূর্বমুহূর্তেও যজ্ঞাগ্নির নিকটে কেবল ঋষি যাজ ও উপযাজ ভিন্ন কেউ ছিলেন না। কুমারকে গ্রহণ করার জন্য দ্রুপদ-পত্নী যজ্ঞাগ্নির পাশে থাকবেন, এমন শুনেছিলাম। কিন্তু তিনি নাকি প্রস্তুত হতেই পারেননি, তার পূর্বেই অগ্নিকুণ্ড থেকে পুত্র উপস্থিত! কোনও মানুষ বাইরে থেকে আসেনি, এ বিষয়টি তর্কাতীত। সেখানে শুধুই লেলিহান শিখাগুলি অত্যুচ্চ ছিল। সমস্ত দর্শকও নিঃসন্দেহ ছিলেন, এ অলৌকিক প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরাও! অগ্নি থেকেই উদ্ভূত হয়েছেন কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন, এ আমি নিশ্চিত!”

অশ্বত্থামা রোষরক্তিম মুখে বসেছিলেন। পিতার সম্ভাব্য হন্তারকের প্রসঙ্গে এই আলোচনা তাঁর গাত্রে জ্বালা ধরাচ্ছিল। পারলে এখনই গিয়ে সেই অগ্নিসম্ভূত ঘাতকটির ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement