ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৪
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

বৃষ্ণিপ্রধান উত্তর না দিয়ে পর্যায়ক্রমে সাত্যকি আর বলরামের মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত মুখে যুগপৎ দার্ঢ্য ও কৌতুক ফুটে উঠল।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২২ ০৮:২৪
Share:

পূর্বানুবৃত্তি: দ্রোণাচার্যর তীব্র আত্মধিক্কার শুনে বিস্মিত হয় অশ্বত্থামা। সে পিতাকে মনে করিয়ে দেয়, কুরুকুমারদের কাছে গুরুদক্ষিণা যাচ্ঞার মাহেন্দ্রক্ষণ সমাসন্ন। অন্য দিকে বিদর্ভরাজকন্যা রুক্মিণীর স্বয়ংবরের আয়োজন হয়েছে। সেখানেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছেন যাদব কৃষ্ণ। কারণ রুক্মিণীর সঙ্গে তাঁর গোপন প্রণয়। সম্ভবত অনাহূত ভাবেই যদুপতি উপস্থিত হবেন স্বয়ংবরে। জেনে বিরক্তির ভাব বাড়ে মগধরাজ জরাসন্ধের মনে। তখনই খবর আসে তরুণ নিষাদ একলব্য তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী।

Advertisement

বিদর্ভ-পতি ভীষ্মক কৃষ্ণের প্রতি তেমন বিরূপ নন, কিন্তু তাঁর প্রভাবশালী বীর পুত্র রুক্মী জরাসন্ধ-ঘনিষ্ঠ। কৃষ্ণের ঘোর শত্রু ও যাদবদের অনিষ্টচিন্তক সে। কৃষ্ণের আর-এক পরম বৈরী চেদিরাজ শিশুপালের সঙ্গেও তার নিবিড় মিত্রতা, শিশুপালকেই সে ভগ্নী রুক্মিণীর উপযুক্ত পাত্র স্থির করেছে। সুতরাং কৃষ্ণের আমন্ত্রণ না-আসাই স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু কৃষ্ণ যাবেন। রাজকুমারী রুক্মিণী স্বয়ং তাঁকে আহ্বান করেছেন, কৃষ্ণকেই তিনি বরমাল্য দিতে চান, ভ্রাতার আদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে। তিনি মিনতি করেছেন, তাঁর দয়িত যেন স্বয়ংবরে উপস্থিত হয়ে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। এর পর গৃহে বসে থাকে কোন ক্ষত্রবীর?

Advertisement

কৃষ্ণ যাবেন। স্বয়ংবরের ঠিক আগের দিন, সদলেই যাবেন। গোপনেও নয়, প্রকাশ্যে। স্বয়ংবরে আমন্ত্রণ না-পেলেই বা! বিদর্ভরাজের আতিথ্য নিতে চলে এসেছেন, সৌজন্য-সাক্ষাৎ— এমন হতে কোনও বাধা নেই। রাজ্যের প্রধান, মহান ভীষ্মক তাঁর শত্রু নন। যদিও বা শত্রু হতেন, তা হলেও স্বয়মাগত অতিথিকে আপ্যায়ন করা ছাড়া উপায় থাকত না। নীতির বাধ্যতা তেমনই।

বলরাম উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, “রুক্মী যদি বিশ্বাস-হনন করে? গুপ্তহত্যার চেষ্টা করে?”

“করবে না, জ্যেষ্ঠ! পরদিন মধ্যাহ্নে স্বয়ংবরান্তে সহোদরার বিবাহ, এ-অবস্থায় ইচ্ছা থাকলেও অযুধ্যমান অতিথিকে অকারণে হত্যার উপায় নেই, দেশব্যাপী কলঙ্ক হবে। ধর্মলঙ্ঘনের দোষে ব্রাহ্মণরা বেঁকে বসবেন, শুভকার্য পণ্ড হবে। বরং স্বয়ংবর-সভার প্রতিরক্ষা-বলয়টিকে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ বলবান করাই রুক্মীর পক্ষে স্বাভাবিক। সভায় অশান্তি হলে তখন সম্মুখযুদ্ধে শত্রুনিপাত ধর্মানুমোদিত। রুক্মী স্বয়ংবরটিকেই নিশ্ছিদ্র করার উপর গুরুত্ব দেবে, গুপ্তহত্যার উপর নয়, অন্তত এই ক্ষেত্রে।”

সাত্যকি সহমত হলেন। প্রতিপক্ষকে অনুধাবন করতে কৃষ্ণের সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি বললেন, “তা ঠিক। তবে... স্বয়ংবর-সভায় তো আমাদের উপর তীক্ষ্ণ প্রহরা থাকারই কথা। শুধু রুক্মী নয়, জরাসন্ধ শিশুপাল সহ অন্য অরাতিবর্গও আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে দৃষ্টি রাখবে। তাদেরও নিজস্ব সেনা-প্রস্তুতি থাকবে নিশ্চিত, সামান্যতম প্ররোচনাতেই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা। কেশব, আপনি কি সত্যই মনে করেন আমরা ওই সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিহত করে সভা থেকে বিদর্ভকন্যাকে সুরক্ষিতা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারব? এবং তার পর, অবাধে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে দ্বারাবতী পর্যন্ত...?”

বৃষ্ণিপ্রধান উত্তর না দিয়ে পর্যায়ক্রমে সাত্যকি আর বলরামের মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত মুখে যুগপৎ দার্ঢ্য ও কৌতুক ফুটে উঠল।

“তিনটি বিষয়ের উপর ভরসা করছি আমি,” বললেন কৃষ্ণ, “এক, রুক্মিণীর সংগৃহীত গূঢ়বার্তা; দুই, রুক্মীর নির্বুদ্ধিতা। আর তিন, দুই মহাবীর— হলায়ুধ আর শৈনেয়-র পরাক্রম।”

রেবতীবল্লভ বলদেব ও শিনিপৌত্র সাত্যকি দু’জনেই কিছু ক্ষণ নীরব থাকার পর হেসে উঠলেন।

“রুক্মিণী কী গোপন বার্তা সংগ্রহ করেছেন, কান্‌হা?” বলরাম জানতে চাইলেন।

কৃষ্ণ উত্তর দিতে যাবেন, এমন সময় ছিন্নবস্ত্র অপরিচ্ছন্ন কদাকার অর্ধোন্মাদ-গোত্রের এক ব্যক্তি দ্বারে এসে দাঁড়াল, “প্রভু...”

বলরাম ও সাত্যকি দু’জনেই ঈষৎ চকিত হয়ে ফিরে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত লাগল চিনতে। তার পর বলরাম সহাস্যে বললেন, “জম্বুক! ওহ্‌, চেনে কার পিতার সাধ্য!”

আগন্তুক ঘনশ্মশ্রুর মধ্য থেকে হরিদ্রাভ দাঁতগুলি বিকশিত করল। সাত্যকিও এত ক্ষণে চিনেছেন। বাসুদেবের অতি আস্থাভাজন গূঢ়পুরুষ এই জম্বুক। দ্বারকার পণ্যশালায় ছোট একটি পুষ্প-বিপণি আছে এই ব্যক্তির। সেখানে যখন সে মাঝেমধ্যে বসে, সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র। সরল, সুভদ্র, রসিক, আলাপী, সৌম্যদর্শন। কিন্তু তার প্রকৃত রূপ জানেন মাত্র অঙ্গুলিমেয় জনাকয় যাদব-প্রধান, যাঁরা কৃষ্ণের একান্ত ঘনিষ্ঠ। অভিনয় ও ছদ্মবেশে অতি নিপুণ, শৃগালের মতো ধূর্ত, ঈগলের মতো খরদৃষ্টি, তথ্যসংগ্রহে অসামান্য পারদর্শী, বাক্্পটু, শ্রুতিধর ও সম্মোহনবিদ—এমন চর সমগ্র আর্যাবর্তে বিরল। বিশেষত দূরবর্তী রাজ্যগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের বা লোকচক্ষুর অন্তরালে বিশেষ গূঢ় বার্তা প্রেরণের প্রয়োজন হলে এই ব্যক্তি অপরিহার্য। কৃষ্ণের গুপ্তচররা সকলেই সুদক্ষ, কিন্তু জম্বুক তাদের সকলের গুরুস্থানীয়!

বলরাম ও সাত্যকি কিছু ক্ষণের জন্য কক্ষ ত্যাগ করলেন। রুক্মিণী-সংক্রান্ত আলোচনা পরে হবে। চর কোনও গুপ্তসংবাদ নিয়ে এলে তা একমাত্র কৃষ্ণের সকাশেই ব্যক্ত হবে, তৃতীয় কোনও ব্যক্তির সেখানে উপস্থিত থাকা নিষেধ— বলরামেরও। এ-নিয়ম অনেক কালের।

“এসো হে...” কৃষ্ণ ডাক দিলেন জম্বুককে।

২৪

“দীর্ঘকাল গুপ্ত আশ্রয়ে ছিলে, আমি তোমার সম্পর্কে চরমুখে সংবাদ পেতাম। প্রতীক্ষায় ছিলাম,” সুপ্রসন্ন মুখে বললেন জরাসন্ধ, “এখন অঙ্গুষ্ঠটির কী অবস্থা, দেখাও তো বৎস! শল্যচিকিৎসা সম্পূর্ণ কার্যকর হয়েছে?”

“তা হয়েছে... দেখতে প্রায় আসলটির মতোই, মহারাজ,” বিনীত ভঙ্গিতে ঈষৎ হাসে একলব্য, তার পর সামান্য ঝুঁকে পড়ে দক্ষিণ হস্তটি জরাসন্ধের দিকে প্রসারিত করে দেয়।

রাজার চক্ষু সামান্য বিস্ফারিত হয়। বিস্ময়কর দৃশ্য বটে! সদ্যমৃত এক ব্যক্তির বৃদ্ধাঙ্গুলি কর্তন করে নিষাদের কর্তিত আঙুলটির ক্ষতস্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল— এখন দীর্ঘ পরিচর্যার পর সেটি স্বাভাবিক ভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে!

“সীবনের ক্ষত উপশম হতে কোনও সমস্যা হয়নি তো? বেদনা দূর হয়েছিল দ্রুত?”

“সম্পূর্ণ, মহারাজ। তিন পক্ষকালের মধ্যেই,” একলব্য বলে, “তার পর দীর্ঘকাল শুশ্রূষা-পর্ব চলেছে, নির্দেশানুসারে ব্যায়াম ওষুধ সব। তার পর স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। সব কাজ করা যায় এখন।”

“সঞ্চালন করে দেখাও,” কিঞ্চিৎ উত্তেজিত কণ্ঠেই বললেন জরাসন্ধ। একলব্য বুড়ো-আঙুলটি দু’বার নাড়াল। তার নিজের আঙুল নয়, কে বলবে! দিব্য নড়ছে!

নিজ দেহ থেকেও নয়, অপরের শরীরের অঙ্গ নিয়ে প্রতিস্থাপন! এও কি হয়? অবিশ্বাস্য ঘটনা। অসম্ভবকে যেন জাদুমন্ত্রে সম্ভব করেছে চিকিৎসক! সমগ্র জম্বুদ্বীপে এমন অভূতপূর্ব চমৎকার আগে কখনও ঘটেনি!

প্রায়-অসম্ভবই ছিল, নিষাদের অঙ্গে এই শল্যচিকিৎসাটি। জরাসন্ধ জানেন, তিনি স্বয়ং উদ্যোগী না হলে এটি সংঘটিত হতেই পারত না। প্রথমত, এই ধরনের অস্ত্রোপচার-মূলক চিকিৎসা এখনও সমাজে তেমন স্বীকৃত নয়। রাজ-বৈদ্য ও সমাজ-প্রতিষ্ঠিত ভিষকরা, যারা মূলত ব্রাহ্মণ, তারা এর তীব্র বিরোধী। জীবিত বা মৃত কোনও মানবদেহে চিকিৎসা-অভিপ্রায়ে অস্ত্রাঘাত— ভেদন, কর্তন, ছেদন, সীবন ইত্যাদি— এই বিপ্র-নিয়ন্ত্রিত সমাজে বহুল ভাবে নিন্দিত। অঙ্গের প্রতিস্থাপন তো একেবারেই অননুমোদিত! দ্বিতীয়ত, একলব্যের এই অঙ্গুষ্ঠটির যথাযোগ্য ব্যবস্থা করাও ছিল দুরূহতম কর্ম, চিকিৎসা-পদ্ধতির বাস্তব বিচারেই।

চিকিৎসাবিদ্যার একটিমাত্র শাখাই আবহমানকাল ধরে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে— তা হল প্রয়োগমূলক ঔষধবিদ্যা; মূলত ভেষজ নির্যাস, ভূগর্ভস্থ বা অন্যবিধ প্রাকৃতিক রসায়ন, যা মৌখিক ভাবে সেব্য অথবা প্রলেপযোগ্য। কিন্তু সমাজ-ধিক্কৃত আরও কিছু গুপ্তবিদ্যার মতো, শল্যচিকিৎসার চর্চা এবং গবেষণাও গোপনে বহমান আছে দীর্ঘকাল। এই বিদ্যার উদ্গমও আদি ঋষিদের একশ্রেণির মধ্য থেকেই ঘটেছে, কিন্তু লোক-অপবাদের ভয়ে তাঁরা স্বনামে এই বিদ্যার প্রসার করেননি। এর অভ্যাসকারী চিকিৎসকেরা গোপনচারী, আরণ্য উপজাতিদের মধ্যে তাদের বাস। শবব্যবচ্ছেদ করেন, প্রকৃতিদত্ত অঙ্গে পরিবর্তনের চেষ্টা করেন— এই ‘জঘন্য’ বৃত্তির কারণে ব্রাহ্মণ-ঋষি ও শাস্ত্রবিদরা এদের অসুর, মায়াবী, রাক্ষস, দানব প্রভৃতি অনার্য-বিশেষণের মাধ্যমে ঘৃণা ব্যক্ত করে থাকে।

নিয়তির পরিহাস এই যে, প্রয়োজন পড়লেই ধনী ক্ষত্রিয়-বৈশ্যেরা গোপনে এই অন্ধকার-জগতের দ্বারস্থ হয়। যুদ্ধে, দুর্ঘটনায় বা রাজাদেশে অনেক ব্যক্তির নাসাচ্ছেদন হয়ে যায়— তারা এই ‘ঘৃণিত’ আরণ্যক অস্ত্রচিকিৎসকদের কাছ থেকেই অঙ্গ-সংশোধন করিয়ে আনে। নাসাহীন ব্যক্তির নিজের ঊরু বা গুলফ থেকেই চর্ম-পেশি ইত্যাদি কেটে এনে ত্রিকোণাকারে কর্তিত নাকের জায়গায় বসিয়ে সীবন করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও, দীর্ঘদিন ধরে কানে কুণ্ডলাদি ভারী অলঙ্কার পরে থাকার ফলে লতির ছিদ্র বেড়ে যায়, কোমল মাংস ছিন্ন পর্যন্ত হয়ে যায়। সেই বিকৃতিও সংশোধন করে দিতে সক্ষম ওই ‘মায়াবী’রা। লোকে সব জানে। নিন্দাও করে, আবার দায়ে পড়লে দৌড়য়ও। যেন চণ্ডালীগৃহে ব্রাহ্মণের নৈশাভিসার— দিবায় অচ্ছুৎ, নিশায় কণ্ঠলগ্না!

কিন্তু একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ প্রতিস্থাপনের কর্মটি গুরুতর ও অতি-দুঃসাধ্য, বিরল গোত্রের অস্ত্রোপচার। নাসিকা বা কর্ণের মতো নাতিস্থূল চর্ম ছেদন-সীবনের ক্ষেত্র নয় এটি। অস্থিসন্ধি-সহ নিটোল কোনও বিকল্প দেহাংশ প্রয়োজন,যা একলব্যের নিজের শরীর থেকে কেটে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সন্ধান করতে হয়েছিল সদ্য মৃত— তখনও তাপ বর্তমান, রক্ত-শিরা-পেশি-স্নায়ু ব্যবহারযোগ্য আছে— এমন দেহের। সৌভাগ্যক্রমে, মিলেছিল তেমনটিই। রাজনির্দেশে দক্ষতম চিকিৎসকেরদল বনান্তরালে অক্লান্ত চেষ্টা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাবলে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তার পর তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা-উত্তর শুশ্রূষার স্তরগুলি অতিক্রম করেছে একলব্য। দীর্ঘকালব্যাপী প্রক্রিয়া সেটি।

জরাসন্ধ নিবিড় ভাবে নিরীক্ষণ করলেন। অভূতপূর্ব কৃতিত্ব দেখিয়েছেন অন্ধকার-রাজ্যের জাদুকরেরা! কিশোরের বৃদ্ধাঙ্গুলিটি, সন্ধি ও নখর সমেত, প্রায় নিখুঁত দেখাচ্ছে; শুধু, মৃত ব্যক্তির গাত্রবর্ণে সামান্য প্রভেদ ছিল, একলব্যের ত্বকের সঙ্গে সম্পূর্ণ মেলেনি। খুব খুঁটিয়ে না দেখলে সেটুকুও ধরা কঠিন। আর আছে সীবন-চিহ্নগুলি। তা নিয়ে চিন্তা নেই, কালের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টির অগোচরে চলে যাবে অনেকটাই।

“অতি চমৎকার!” প্রশংসা করলেন জরাসন্ধ, “বালক, তুমি হয়তো জানো— আমার জন্মের অব্যবহিত পরেই এক দুরূহ অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়েছিল! এই অস্ত্র-বৈদ্যের গোষ্ঠী থেকেই এক ভিষক, নারীর বেশ ধরে এসে, আমার প্রাণ রক্ষা করে। তার নাম ছিল জরা। আমার নামেই তার স্মৃতি অক্ষয় হয়ে আছে।”

একলব্য মাথা দোলায়। সে জানে। জরা-চিকিৎসক তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিল, তাই রাজা এই গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল। সাধারণ্যে এক অতিলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে এই নিয়ে— যে, জরাসন্ধ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন দ্বিখণ্ডিত অবস্থায়, জরা ‘রাক্ষসী’ মায়াবলে সেই দুই-খণ্ড শিশু জুড়ে দিয়ে যায়। আরণ্যক ভিষকদের কাছে নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়েই একলব্য অতীতের প্রকৃত ঘটনা জেনেছে সম্প্রতি। লোকমুখে প্রচলিত আরও নানা গল্পের মতোই, দ্বিখণ্ডিত শিশুর কাহিনিও অতিরঞ্জিত। বস্তুত, সদ্যোজাত শিশুর উদরের চর্ম-আবরণীটিই কোনও জন্মগত ত্রুটির কারণে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় ছিল, অন্ত্র পাকস্থলী ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ উপাঙ্গগুলি অনাবৃত ও দৃশ্যমান। ব্যতিক্রমী এক জন্মগত ত্রুটি। উদরের সেই দ্বিধাবিভক্ত চর্মটুকুই জুড়ে দিয়ে গিয়েছিল শল্যবিদ জরা। সেই সীবন-অভিজ্ঞান এখনও ক্ষীণ বোঝা যায় রাজার দেহে।

চেদিরাজ শিশুপালেরও অনুরূপ কাহিনি আছে, অতিরিক্ত হাত-পা ইত্যাদি নিয়ে জন্মেছিলেন বলে কথিত। সম্ভবত সেখানেও, এমনই কোনও গুপ্ত-চিকিৎসকের দক্ষতার প্রয়োজন হয়েছিল। তার পর অলৌকিক আখ্যান দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়।

অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে থাকে একলব্য।

...সে দিন নিজের অঙ্গুষ্ঠটি দ্রোণাচার্যকে দান করে দেওয়ার পরে, বৃক্ষতলে জীবন্মৃতের মতো পড়ে ছিল সে। দেহের রক্ত বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু মনের ক্ষত থেকে অনর্গল শোণিতপ্লাবন! বনচর ব্যাধ ও কাষ্ঠাহরকরা ঘটনা জেনেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। অতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল তারা, এমনকি বিষাক্ত তির নিয়ে আশ্রম আক্রমণ করবে ও রাজকুমারদের মেরে ফেলবে বলেও সংবদ্ধ হচ্ছিল। একলব্যই ক্ষীণকণ্ঠে তাদের নিষেধ করে, বলে যে, রাজকুমাররা নিরপরাধ। এমনকি অর্জুন— যার মঙ্গলার্থে একলব্যের এহেন অমঙ্গল সাধন করলেন গুরু দ্রোণ— তার চোখেমুখেও শেষ পর্যন্ত অনুতাপের ছায়াই দেখেছিল একলব্য। অল্প বয়স— প্রাথমিক ভাবে কোনও ঈর্ষা জেগে থাকতেও পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আচার্যের এত নৃশংসতা সম্ভবত অর্জুনও মনে-মনে সমর্থন করেনি। না, কুরুনন্দনদের প্রতি নিষাদের বিদ্বেষ নেই কোনও।

আর দ্রোণ? ক্ষুব্ধ ব্যাধেরা জানতে চেয়েছিল; তাঁর কিছু ব্যবস্থা হবে না?

“হলেও, সেটা আমার নিজের ব্যাপার, আমার একার,” তুষারশীতল কণ্ঠে বলেছিল একলব্য, “আমি নিজের হাতে তাঁকে দক্ষিণা দিয়েছি, বিদ্যার ঋণ শোধ করেছি। এর পর যা যোগ-বিয়োগ, সে অঙ্ক আমি একা বুঝে নেব।”

ব্যাধেরাই কালবিলম্ব না করে দ্রুতগামী শকটে হিরণ্যধনুর পুত্রটিকে সযত্নে পৌঁছে দেয় পিতৃরাজ্যে। মগধরাজের কানে যায় এই ঘটনার কথা, তিনি অচিরেই একলব্যকে ডেকে পাঠান। দ্রোণের প্রতি তীব্র রোষে তিনি তপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। একলব্যকেও ভর্ৎসনা করেন তার হঠকারিতার জন্য। তার পর তাকে বলেন নিজের পরিকল্পনার কথা। এক জন প্রতিভাবান ধনুর্ধারীর সব সম্ভাবনা এক কুচক্রী আচার্যের নীচতায় নষ্ট হবে, এ তিনি হতে দেবেন না— সর্বতোপ্রকার প্রচেষ্টা করবেন যাতে একলব্যের অঙ্গুষ্ঠটি কোনও ভাবে প্রতিস্থাপিত করা যায়। হয়তো বা, তাঁর পরামর্শেই একলব্য গিয়েছিল দ্রোণের সকাশে— এই বিষয়ে কোনও অনুতাপ বা অপরাধবোধও হয়ে থাকবে তাঁর! খুবই আন্তরিক ছিল রাজার উদ্যম। তাঁর মুখেই প্রথম একলব্য জানতে পারে, গুপ্ত গোষ্ঠীর শল্যবিদদের সঙ্গে মগধনৃপতির সুচারু যোগাযোগের বিষয়টি।

কিন্তু কর্তিত অঙ্গের ক্ষতস্থানে অন্য ব্যক্তির অঙ্গ জুড়ে দেওয়া! এ কি আদৌ বাস্তবোচিত ভাবনা? বিস্মিত একলব্যকে জরাসন্ধ আশ্বস্ত করেছিলেন। তাঁর গভীর বিশ্বাস গুপ্ত শল্যবিদদের ক্ষমতার উপর। কিন্তু তাতে যে একলব্যের সংশয় পুরোপুরি দূরীভূত হয়নি, তাও সে দিন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

“কী, এখন বিশ্বাস হচ্ছে তো?” দণ্ডায়মান নিষাদের দিকে তাকিয়ে জরাসন্ধ মৃদু হাস্য করে বলেন, “সত্যই অঘটন-ঘটন-পটীয়ান, এই গুপ্ত ভিষকের গোষ্ঠী!”

একলব্যও মৃদু হাসে, কিন্তু উত্তর দেয় না আর।

“শরক্ষেপণ করে দেখেছ?” জরাসন্ধ জানতে চাইলেন এ বার। এটিই মূল জিজ্ঞাস্য। অঙ্গুষ্ঠ পুনঃপ্রাপ্ত হলে পুনর্বার হস্তলাঘব ফিরে পাবে অমিত প্রতিভাধর ধনুর্ধারী, এই আশাতেই এত শ্রম-চেষ্টা-আয়োজন, “আমি শুনেছি হে, তুমি সুস্থ হওয়ার পর এই দীর্ঘ সময় ধরে গভীর অরণ্যে গোপনে আবার একাকী অস্ত্রাভ্যাস করেছ!”

একলব্যের হাসিটি এবার ক্রমশ মলিন হচ্ছে। মুখে ভাষাও নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement