ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১২
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

ক্রমশ এক অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তিতে তাঁর মুখ আশ্লিষ্ট হয়ে উঠছিল, ওষ্ঠদ্বয় বিকৃত হচ্ছিল, মাথা নাড়ছিলেন আত্মবিস্মৃতের মতো।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ ০৭:০৩
Share:

পূর্বানুবৃত্তি: অঙ্গুষ্ঠ কর্তনের পর স্বাভাবিক ভাবেই শরচালনার ক্ষিপ্রতা হ্রাস পায় একলব্যের। নিশ্চিন্ত হন দ্রোণ। সাত্যকির কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শোনেন বাসুদেব। সাত্যকি আরও একটি আশ্চর্য পর্যবেক্ষণের কথা জানায়। একলব্যের সঙ্গে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মুখের সাদৃশ্য আছে। দ্রোণের পরিচালনায় হস্তিনাপুরের রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দেখে প্রীত হন ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র প্রমুখ রাজপুরুষগণ। বিদুর আলাদা করে একলব্যের ঘটনা উল্লেখ করে দ্রোণের রাজ-আনুগত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

Advertisement

শেষ প্রসঙ্গটিতে যে দ্রোণ অকস্মাৎ নীরব হয়ে গেলেন, তাঁর মুখের হাস্যলেশ নির্বাপিত হয়ে একটা পাংশু-কৃষ্ণ ছায়া নেমে এল, ধীরে ধীরে তিনি মুখটি নিচু করে ফেললেন— গমনোন্মুখ বিদুর সেটা আর লক্ষ করলেন না।

Advertisement

বৃক্ষচ্ছায়ে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে গুরু দ্রোণ অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তার পর, ওই বিমনা ভঙ্গিতেই, নিজের বাম হাতের আঙুলগুলি দিয়ে দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠটি স্পর্শ করতে লাগলেন নানা ভাবে।

ক্রমশ এক অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তিতে তাঁর মুখ আশ্লিষ্ট হয়ে উঠছিল, ওষ্ঠদ্বয় বিকৃত হচ্ছিল, মাথা নাড়ছিলেন আত্মবিস্মৃতের মতো। ডান হাতের অঙ্গুষ্ঠটি নিয়েই যেন বিড়ম্বিত দ্রোণ! অন্য হাত দিয়ে সেটিকে আকর্ষণ করলেন, নিষ্পিষ্ট করলেন, দৃঢ় মুঠিতে ধারণ করে ডানে-বামে আবর্তিত করলেন। নখর বসিয়ে ব্যথা অনুভব করতে চাইলেন বুঝি। তার পর সহসা তাঁর সংবিৎ ফিরল— চমকে উঠে এ দিকে-ও দিকে তাকালেন। কেউ দেখেনি তো?

২০

মগধাধিপতি জরাসন্ধের মন ভাল নেই বিশেষ। রাজসভাতেও কম আসছেন মাসাধিক কাল, নিজের প্রাসাদকক্ষেই বসে থাকেন চুপচাপ। ইদানীং মদ্যপানের অভ্যাসও কিঞ্চিৎ বেড়েছে। রাজকার্যের ভার অমাত্যদের হাতে আপাতত। রাজা বয়স্য বিটদের সঙ্গে নিয়ে পাশা খেলেন। পাশার চালের মধ্যেই কিছু গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকেন, তাঁর মুখ ভারাক্রান্ত দেখায় অধিকাংশ সময়েই।

জরাসন্ধ লোকটি বিচিত্র। প্রতিবেশী রাজারা তাঁর ভয়ে তটস্থ। দুর্মদ যোদ্ধা এবং প্রবল উচ্চাভিলাষী এই ব্যক্তি সাম্রাজ্যবৃদ্ধির লোভে নিয়ত ব্যতিব্যস্ত রাখেন ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে। জরাসন্ধ শিব-উপাসক, এ ব্যতীতও তিনি এক তন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ। এক দীর্ঘকাল ব্যাপী তান্ত্রিক যজ্ঞের আয়োজন করেছেন তিনি, বড় নিষ্ঠুর তার আয়োজন। একশত ক্ষুদ্র নরপতিকে নাকি শিবের সমক্ষে বলি দেওয়া হবে সেই যজ্ঞের উদ্‌যাপনে, এমনই জনশ্রুতি! সেই শত রাজবলির পরেই তিনি সম্রাট উপাধি গ্রহণ করবেন।

এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ কোনও ঘোষণা এখনও করেননি জরাসন্ধ, কিন্তু এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজ্যে অভিযান চালিয়ে তিনি অধিকার করেছেন সেগুলি, সেই সব রাজাদের বন্দি করেছেন নিজের কারাগারে। সচরাচর এ দেশে রাজ্যজয়ের পর দু’ধরনের আচরণ করা হয় বিজিত নৃপতিদের সঙ্গে— হয় তাঁকে জীবিত রেখেই করদ শাসকে পরিণত করা, নয় বিনা কালক্ষেপে অকুস্থলেই হত্যা। শৃঙ্খলিত করে নিজের রাজ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া ও অনির্দিষ্ট কাল কারারুদ্ধ করে রাখা— এমন উদাহরণ বিশেষ নেই। জরাসন্ধ পর পর তেমনটাই করে চলেছেন। তাই তাঁর সেই রাজবলিদানের যজ্ঞটি সম্পর্কে দেশব্যাপী আতঙ্ক ক্রমবর্ধমান। বিশেষত স্বল্পশক্তিসম্পন্ন ভূপতিদের নিদ্রা উড়েছে।

নিজ রাজ্যে কিন্তু জরাসন্ধ যথেষ্ট জনপ্রিয়, তিনি সুশাসক। প্রজাদের জন্য প্রচুর হিতসাধনের ব্যবস্থা তিনি করেছেন। দেশের মধ্যে মগধ যে সর্বাপেক্ষা ধনশালী রাজ্য তাই নয়, সর্বোৎকৃষ্ট নাগরিক সুযোগ সুবিধা আছে সেখানেই। অন্যান্য প্রতিতুল্য রাষ্ট্র যথা চেদি কুরু কোশল পাঞ্চাল মৎস্য ইত্যাদির তুলনায় মগধের সমগ্র ভূখণ্ডের অনেকটাই বেশি অংশ নগরায়িত। সুনির্মিত পথঘাট, চিকিৎসালয়, শিক্ষাসদন, বিচারশালা, সুপেয় জল, আরক্ষা, পণ্যকেন্দ্র— সমস্ত দিক দিয়েই উন্নত আয়োজন রয়েছে রাজ্যে। রাজা স্বয়ং শৈব হলেও ব্রাহ্মণেরা এখানে যথাযথ আদৃত হন, বৈশ্যগণ সম্পন্ন হয়ে ওঠেন, কৃষিজীবীরাও বঞ্চিত হন না। মগধ রাজ্যের সীমানায় আছে বিস্তৃত অরণ্য-অঞ্চল, সেখানে মৃগয়াজীবী ও অন্যান্য বৃত্তিধারী উপজাতিরাও একান্ত রাজ-অনুগত। প্রতিবেশী বঙ্গ-পুণ্ড্র-কিরাতরাজ্যের উপজাতীয় যোদ্ধারাও জরাসন্ধকে ভক্তি করে, তিনি এই তথাকথিত নিম্নবর্গের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। তাঁর জীবনের কিছু ব্যক্তিগত সংযোগও আছে এদের সঙ্গে। রাজা স্বয়ং দরিদ্র অভুক্তদের নিয়মিত ধন ও অন্ন দান করেন। রাজ্যে চৌর্য বা দস্যুতার অপরাধ নেই, কঠিন দণ্ডাদেশের ভয় আছে। সাধারণ গৃহস্থ ও শান্তিপ্রিয় রাজ্যবাসীর পক্ষে মগধ অতি সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ স্থান। তাঁর পররাজ্যলোলুপতা নিয়ে অন্তত নিজ প্রজাবর্গের মধ্যে কোনও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নেই, বরং সামরিক গৌরবগুলি তারা যথেষ্ট উপভোগই করে। নরপতিদের বন্দিত্ব বা যজ্ঞে তাঁদের নিধন-সম্ভাবনা— মগধের নাগরিকরা এ বিষয়ে জল্পনা করে বটে, কিন্তু খুব যে কিছু অসম্মতি বা নিন্দার পরিবেশ আছে এমন মনে হয় না। রাজার উন্নতি ও রাজ্যের উন্নতি তাদের কাছে সমার্থক, তা যে পদ্ধতিতেই হোক। পরাজিত শত্রুকে তো বধ করাই স্বাভাবিক। রণক্ষেত্রেই সে কার্য সমাধা করে আসে ক্ষত্রিয়, তাতে কেউ কখনও দোষ ধরে না। এখানে না-হয় ক’দিন অতিরিক্ত আয়ু মঞ্জুর করাই হল, না-হয় এক সঙ্গেই সব ক’টি মস্তক কাটা পড়বে— কী এমন বড় কথা!

এমন শক্তিমান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রতাপশালী ও ধনাঢ্য নৃপতি— তিনি সম্প্রতি হঠাৎ এমন অবসাদগ্রস্ত কেন? কোন হতাশা তাঁকে নিরুদ্যম করে রাখছে?

জম্বুদ্বীপের সাম্প্রতিকতম রাজনীতির চালচিত্রই কি অসুখী করেছে জরাসন্ধকে?

আর্যাবর্তের সামগ্রিক রাজনীতিকে জরাসন্ধ বস্তুত একটি তীক্ষ্ণ মেরুকরণের দিকে নিয়ে যেতে চান। তাঁর কর্মপ্রক্রিয়া সূক্ষ্ম ভাবে অনুধাবন করলেই ধরা পড়ে— তিনি ক্রমবর্ধমান বৈষ্ণব শক্তিকে মন্দীভূত করে শৈবগোষ্ঠীর পুনর্জাগরণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর রাজ্যবিজয় নীতিও সেই গণিতেই গঠিত। শিব-উপাসক রাজাদের সঙ্গে তাঁর মৈত্রী। বেছে-বেছে অ-শৈব রাজ্যগুলিতেই তিনি হানা দিয়ে চলেছেন, বিষ্ণু-অনুরাগী নৃপতিদের মধ্যে ত্রাস সঞ্চার করাই তাঁর রাজনৈতিক অভিসন্ধি।

শিব ও বিষ্ণু— এই আদি দেবতাদ্বয় পরস্পরের ঘনিষ্ঠ ও পরিপূরক হলেও, উপাসকদের মধ্যে তত সখ্য দেখা যায়নি। শৈব বনাম বৈষ্ণব— এই অন্তর্লীন স্রোত বহু দিন যাবৎই আর্যাবর্তে নীরবে বহমান ছিল। অনেক কাল আগে, ত্রেতার মধ্যভাগে, অযোধ্যার রাঘব রামকে বিষ্ণু-অবতার রূপে কীর্তিত করে এক প্রবল উত্থান হয়েছিল বিষ্ণু-উপাসকদের। শিব-পূজক রাক্ষস-নৃপতি রাবণকে নিধন করে রাম দাক্ষিণাত্যে আর্যরাজত্বের শিকড় বিস্তার করে এসেছিলেন। পরবর্তী কালে বৈষ্ণবশক্তির ক্ষয় হয়েছিল যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। সাম্প্রতিক কালে, প্রায় দুই দশক আগে, বৃন্দাবনের গোপ-পরিবারে এক শিশুর নানাবিধ কীর্তিকলাপকে ঘিরে বিষ্ণুভক্তদের দল আবার বলবান হয়ে উঠতে থাকে। তার নানা অতিলৌকিক লীলার কথা যেমন গুঞ্জরিত হতে থাকে উত্তর-জম্বুদ্বীপের বৃহৎ অংশ জুড়ে, তেমনই ধীরে ধীরে তার একের পর এক বাস্তব কর্মকাণ্ডও জনমানসে তাকে ব্যতিক্রমী গৌরবের আসন দেয়। মথুরার প্রতাপান্বিত শাসক কংসের প্রবল শত্রুতা তাকে পরাভূত করতে পারেনি। বরং নিরীহ গোপসম্প্রদায়কেই সুসংগঠিত করে সেই বালক কুখ্যাত কালীয়-গোষ্ঠীর দস্যুদের দমন করেছিল। ইন্দ্র-পূজকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংহত করে গিরি-পূজার মতো অভিনব উদ্যোগের মূল হোতা ছিল সে-ই, যাকে প্রথমে সকলে গো-পালক নন্দের সন্তান ভেবেছিল। পরে জানা যায়, সে আসলে মথুরার যাদব বসুদেবের পুত্র।

হ্যাঁ, এই হল সেই অঙ্কুশ, যা দেশবিশ্রুত মগধরাজের উচ্চাশার মর্মস্থলে গিয়ে বিঁধে রয়েছে। দুশ্চিকিৎস্য মনে হচ্ছে এই কাঁটার ক্ষতটিকে, কিছুতেই স্বস্তি বা নিষ্কৃতি মিলছে না! এই নব্য যাদব— কৃষ্ণ বাসুদেব!

শৈব জরাসন্ধ এই বালকের উত্থানেই বিপদসঙ্কেত পেয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝছিলেন, বৈষ্ণব স্রোতের পুনরুত্থান ঘটতে চলেছে তাকে ঘিরেই। কৃষ্ণ নামক এই যুবা বাস্তবিকই অসামান্য বলবুদ্ধির অধিকারী। কূটনৈতিক প্রজ্ঞাও তার অনন্য। কৈশোর-অতিক্রমের কালেই সে চির-শত্রুরাজ্য মথুরার রাজনৈতিক আবর্তকে নিজের অনুকূলে আনতে সক্ষম হয় এবং পরাক্রমী মাতুল কংসকে প্রকাশ্যে নিধন করে রাতারাতি যদুবংশের অন্যতম নিয়ামক হয়ে বসে। তার প্রভাবেই মথুরায় স্বৈরাচারী শাসনের পরিবর্তে শক্তিশালী গণপরিষদের আদলে একটি শাসনতন্ত্র গড়ে ওঠে, যেখানে রাজপদটি আলঙ্কারিক মাত্র থেকে যায়। বৈষ্ণব শক্তি এই উদীয়মান তরুণকে নিজেদের দলপতির স্থান দিয়ে তাকে সরাসরি বিষ্ণুর অবতার বলে প্রচার করে, যেমন একদা রাম সম্পর্কে বলা হয়েছিল। বাসুদেব কৃষ্ণ— এই ‘বাসুদেব’ শুধুই বসুদেবের অপত্যবাচক শব্দ নয়, বিষ্ণুভক্তদের মধ্যে পরম মর্যাদান্বিত একটি স্বতন্ত্র উপাধিও— এই ব্যক্তি অদূর ভবিষ্যতেই ভারতবিশ্রুত এক চরিত্র হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে চলেছে, জরাসন্ধের অভিজ্ঞ বোধ তেমনই ইঙ্গিত দেয়। কৃষ্ণের সাফল্য যত বিকশিত হবে, বিষ্ণু-পূজকদের আস্ফালন তত বৃদ্ধি পাবে— এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

জরাসন্ধ নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেননি। মথুরায় রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মথুরার উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। বিশেষত, নিহত মথুরা-নায়ক কংস তাঁর জামাতা ছিলেন; কৃষ্ণদ্বেষী শক্তির অন্যতম স্তম্ভও। তাঁর হত্যার প্রতিহিংসা-সাধনও জরাসন্ধের অবশ্যকর্তব্য। এ কাজে একই সঙ্গে তাঁর প্রতিবিধিৎসা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুইই চরিতার্থ হবে। বিপুল সৈন্য-সমাবেশ নিয়ে জরাসন্ধ যাদবদের বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন। এক বার নয়, একাধিক বার।

কিন্তু দেবকীপুত্র কৃষ্ণ আর রোহিণী-নন্দন বলরাম— প্রবীণ যাদব বসুদেবের দুই সন্তান অমিতবিক্রমে এবং অভাবনীয় কৌশলে প্রত্যেক বার তাঁর জয়লিপ্সায় ভস্ম-নিক্ষেপ করে দিয়েছে। কখনও দীর্ঘকাল মথুরা অবরোধ করে বসে থাকার পর জরাসন্ধের বাহিনী অসতর্ক ও আলস্যপরায়ণ হয়ে পড়েছিল, সেই সুযোগে অন্ধকারে অতর্কিত ঝটিকা আক্রমণে সেনানিবেশ ছিন্নভিন্ন বিধ্বস্ত অগ্নিদগ্ধ করে দিয়ে চলে যায় যাদবেরা। কখনও আবার আরণ্য-পার্বত্য পথের বাঁকে লুক্কায়িত মথুরার ঘাতক-সেনার দল নানা চাতুর্য, ফাঁদ ও প্রতারণার দ্বারা নিবারিত করেছিল সমতলেঅভ্যস্ত মগধচমূকে।

জরাসন্ধ শুধুই সৈন্যের সংখ্যাধিক্য ও শৌর্যের বলে বিজয় আশা করেছিলেন। এক মৈত্রী-জোটও গঠন করেছিলেন সমমনস্ক বা অনুগত রাজাদের সঙ্গে। শেষ অভিযানটিতে তাঁর বিজয়-সম্ভাবনা ছিল বাস্তবিকই উজ্জ্বল। চেদি, বিদর্ভ, সৌভ, করূষ— এমন বেশ কয়েকটি রাজ্যের প্রধান তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন তাঁদের কৃষ্ণদ্বেষের কারণে। বিষ্ণু-উপাসক নরপতিদের মধ্যেও ভেদ উৎপাদনে সফল হয়েছিলেন জরাসন্ধ, কৃষ্ণের শত্রুভাবাপন্ন বৈষ্ণবরাও— যথা পৌণ্ড্রক ও শৃগাল— তাঁর ধ্বজাতলে এসেছিল। আবার পাঞ্চাল কলিঙ্গ মূর ও নরক ইত্যাদি রাজ্য শুধু মিত্রতার নিদর্শন হিসাবেই তাঁর পক্ষে বাহিনী পাঠিয়েছিল যুদ্ধে। কিন্তু তরুণ কৃষ্ণের সৈন্যাপত্য বড় কূট মেধায় ভরা। ব্যর্থ হয়েছিল জরাসন্ধের এই উদ্যোগটিও। শুধু তা-ই নয়, দেবকীনন্দনের বৌদ্ধিক অক্ষক্ষেপণে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হন তিনি। ক্ষাত্রনীতি মেনে যাদবদের কথামতো সন্ধি করতে হয়েছিল, আর আক্রমণ করবেন না কয়েক বৎসরকাল— এমন শর্তে সম্মত হতে বাধ্য হয়েছিলেন মগধেশ। যাদবরা সাক্ষী হিসেবে রেখেছিল চেদিরাজকে।

লগুড়াহত কুক্কুরের মতো মুখের গ্রাস ফেলে পরাঙ্মুখ হয়ে ফিরে আসার সে গ্লানি এখনওপ্রৌঢ় রাজার অন্তঃস্থলে দুষ্টক্ষতের মতো দুরারোগ্য হয়ে রয়েছে!

২১

“পিতা!”

দ্রুত পিছনে ফিরলেন দ্রোণ। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী, তার উপর আসন্ন-প্রাবৃটের কৃষ্ণমেঘমালা সজ্জিত হচ্ছে। নৈশ নভোমণ্ডল নিশ্ছিদ্র তিমিরাবৃত। দ্রোণের গৃহসংলগ্ন উদ্যানটিতেও গাঢ় অন্ধকার। তার মধ্যেই অদূরে দণ্ডায়মান অবয়বটি চেনা যাচ্ছে। একটু দূরে, শয়নকক্ষের মধ্যে যে ঘৃতদীপ জ্বলছে, গবাক্ষ দিয়ে তার আভা এসে পড়েছে তরুণের বলিষ্ঠ পেশিগুলিতে, চূড়াবদ্ধ কেশপাশে।

“অশ্বত্থামা, তুমি নিদ্রা যাওনি?”

“না, পিতা। গতকালও গভীর রাত্রে আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়েছিল, দেখেছিলাম আপনি শয্যায় নেই। বাতায়ন দিয়ে দেখেছিলাম, আপনি এই অন্ধকার উদ্যানে একাকী স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বহু ক্ষণ। তাই আমি স্থির করি, আজ আমি জেগে থেকে...”

দ্রোণ একটি শ্বাস ফেললেন। বললেন, “আমি একটু এখানে থাকব, বৎস। পদচারণা করব। তুমি যাও, আমি যথাসময়ে কক্ষে ফিরব।”

“কিন্তু আপনার এ হেন যামিনী-জাগরণের কারণ কী, পিতা? যখনই আপনি নিঃসঙ্গ থাকেন, তখনই বিমর্ষ দেখি, অন্যমনস্ক। রাত্রির পর রাত্রি এমন অন্ধকারে, নির্জনে, একাকী... কী নিয়ে এমন আলোড়িত আপনার অন্তর? আপনার আচরণে মর্ম-ব্যাধির উপসর্গ দেখছি কেন? আপনি আমার জনক, আচার্য, প্রভু... আপনার দাস... আমাকে বলুন, কোন কুশাঙ্কুর আপনার আত্মাকে এমন পীড়া দিচ্ছে?”

দ্রোণ নীরব রইলেন কয়েক পল। তার পর মৃদুস্বরে বললেন, “পুত্র, তোমার কখনও মনে হয়নি, তোমার পিতা একজন ধর্মভ্রষ্ট ব্যক্তি? ব্রাহ্মণের উপযুক্ততম বৃত্তি যাগযজ্ঞ পূজা আরাধনা ইত্যাদি সে কখনও আয়ত্ত করতে পারল না— সেই বাল্যকাল থেকে শুধু একটিই উন্মাদনার পিছনে ধাবিত হল! অস্ত্রবিদ্যা! যে কাজ ক্ষত্রিয়ের জন্য নির্দিষ্ট, যে বিদ্যা হনন করতে শেখায়, যে সাধনা তাকে স্বগোত্রীয় স্বজনদের কাছে ব্রাত্য ঘৃণ্য করে রাখল— সেই কর্ম, সেই বিদ্যা, সেই সাধনার পথটিকেই সে পঞ্জরাস্থির মতো আঁকড়ে ধরে রইল! ব্রাহ্মণজন্মটি বৃথাগেল তার। না লাভ হল কোনও তপের ফল, না সাধারণের ভক্তি!”

“সাধারণের সম্ভ্রম-ভক্তি আপনি পেয়েছেন, পিতা! হস্তিনায় শুধু নয়, অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে আচার্য দ্রোণের খ্যাতি...”

“খ্যাতি! কিসের খ্যাতি! সমাজে দ্রোণের পরিচয় কী, আজ? মহর্ষি ব্যাস যে ভারতেতিহাস চিত্রিত করে রাখবেন তাঁর জয়-মহাকাব্যে, তাতে কী কথিত থাকবে আমার বিষয়ে?” দ্রোণ যেন আত্মঘৃণায় অস্থির, “কী ভূমিকা আমার, সেই মহাভারতে? হস্তিনার অস্ত্র-প্রশিক্ষক! কুরুরাজের অন্নদাস! যদি আজ কুরু কোনও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, আমাকেও কি সেই যুদ্ধ-অভিযানে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে না, বাধ্যত? অর্থাৎ কুরুভৃত্য দ্রোণ যুদ্ধে তার প্রভুর হয়ে নিরীহ মানুষকে বধ পর্যন্ত করতে বাধ্য, শত্রুতার কারণে নয়— শুধু অন্নদায়-বদ্ধতার কারণেই বিপ্রের সৈনিকবৃত্তি! ধিক!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement