পূর্বানুবৃত্তি: বিচক্ষণ যুধিষ্ঠির ধরতে পারে কেমন করে দ্রোণের প্রশিক্ষণ গোপনে আয়ত্ত করেছে একলব্য। অন্য দিকে কুন্তী এবং তাঁর সন্তানদের সম্পর্কে ভীষ্মসমীপে নানা কদর্য ইঙ্গিত করে চলেন ধৃতরাষ্ট্র ও শকুনি। তীব্র রাগে ভীষ্ম প্রতিবাদ করলে ধৃতরাষ্ট্র জানান, তাঁর অভিযোগ আছে অস্ত্রশিক্ষক দ্রোণের বিরুদ্ধেও। সে সময় দ্রোণ বিভ্রান্ত একলব্যকে নিয়ে। শুধুমাত্র অর্জুনকে প্রদেয় তাঁর যাবতীয় শিক্ষা যদি একান্ত গুপ্তই না থাকে, তা হলে অর্জুনের নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন কেমন করে সম্ভব!
একলব্যের অস্ত্রসম্ভার নির্মাণে বন্য পশুর অস্থি আর শৃঙ্গ ছাড়াও ব্যবহৃত হয়েছে দৃঢ় ও ঘাতসহ নানাবিধ কাষ্ঠ-উপাদান। অরণ্য-সম্পদ থেকেই একলব্য খুঁজে নিয়েছে নানা বেধের শরশলাকা— সূক্ষ্ম থেকে স্থূল, লঘু থেকে গুরু— সমস্ত প্রকার! ওই পর্ণকুটিরের অভ্যন্তরেইতার নানাবিধ নিজস্ব পরীক্ষানিরীক্ষা চলে, গুরুর শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করেও স্ববুদ্ধিতে মৌলিক গবেষণা করতে শিখেছে সে রীতিমতো!
যে বিষয়টি সর্বাধিক চমকিত করল দ্রোণকে তা হল, অস্ত্রের ফলকে লেপন করার জন্য এই নিষাদ সংগ্রহকরেছে নানাবিধ বিষ! অধিকাংশই নিজস্ব উদ্ভাবন। বন্য গাছগাছড়া, বিষাক্ত ফল, কীটপতঙ্গের হুল, ভেকের গরলগ্রন্থি, উন্মাদ-রোগগ্রস্ত পশুর লালারস। আর, সর্পবিষ! অর্থাৎ, রসায়নাগারের রন্ধ্রপথে এ কিশোর বিষবিদ্যার প্রাথমিক বার্তাটিও আত্মস্থ করেছে!
তিরের ফলায় বিষ-রসায়নের প্রয়োগ, অতি গূঢ় জ্ঞান। বস্তুত এই জ্ঞানই হল ধনুর্বেদের চূড়ান্ত স্তর। যত বড় ধনুর্ধারী, তত এই বিদ্যায় তাঁর সিদ্ধি! লোকমুখে প্রসিদ্ধি এমনই যে, এগুলি দুষ্প্রাপ্য সব ‘মন্ত্রসিদ্ধ’ আয়ুধ; দেব-আশীর্বাদ বিনা এদের নাকি পাওয়া অসম্ভব! নানা অতিরঞ্জিত জনশ্রুতি দিয়ে ঘিরে রাখা হয় এদের। সর্বোৎকৃষ্ট স্তরের দিব্যাস্ত্র— যথা ব্রহ্মাস্ত্র, ব্রহ্মশির, পাশুপত— এদের ত্রিভুবন-বিধ্বংসী বলে প্রচার করা হয়। আসলে এই সব অস্ত্রের ফলকে এমন বিরল রসায়ন প্রলিপ্ত থাকে যা অমোঘ, দুশ্চিকিৎস্য, নিশ্চিত প্রাণঘাতী। শ্রেষ্ঠতম ও সচ্চরিত্র ক্ষত্রিয়-যোদ্ধা ও সদ্ব্রাহ্মণ ব্যতীত এই বিজ্ঞানের অধিকার কাউকে দেওয়া হয় না, প্রয়োগেরও বিধিনিষেধ অনেক। আবার, যিনি এই সব মৃত্যুমুখ আয়ুধের প্রয়োগ শিখবেন, বাধ্যতামূলক ভাবে তাঁকে নিবারণবিদ্যাও জানতে হবে— অর্থাৎ মারণ-বিষের প্রতিষেধক-বিজ্ঞানও। বহু দিন ধরে বহু প্রাজ্ঞ সাধকের, মূলত রসায়নজ্ঞ ব্রাহ্মণ ঋষিদের গোপন গবেষণায় উঠে আসা, এই বিষ-বিজ্ঞান ও তার প্রয়োগবিদ্যার নির্যাস।
এ বিদ্যা একান্ত ভাবে গুরুমুখী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সঞ্চালিত। গুরুই নির্বাচন করেন, কে উপযুক্ত আধার। তাকেই গোপনে দান করেন গুহ্য-সাধনার উত্তরাধিকার। দ্রোণ পেয়েছিলেন পরশুরামের কাছ থেকে। তিনি নির্বাচন করেছেন অর্জুনকে। অর্জুন এখনও গূঢ়তম জ্ঞানের প্রাথমিক স্তরটিতে রয়েছে মাত্র। কিন্তু তাকেই শ্রেষ্ঠ হতে হবে তার প্রজন্মে। সে নির্বাচিত। ধীরে ধীরে সেই পথে চলেছে সে।
সেখানে, এই নিষাদ-নন্দন! প্রতিভায়, সাধনায়, উদ্ভাবনে... অর্জুনের চেয়েও অগ্রবর্তী! নিঃসন্দেহে! সুতপুত্র বসুষেণের মধ্যে অর্জুনের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখেছিলেন দ্রোণ, তার আত্মমর্যাদায় আঘাত করে সুকৌশলে বিতাড়িত করেছেন আশ্রম থেকে! কিন্তু এই অনার্যবালক... একে তো নিষ্ক্রান্ত করার পথই নেই। এ একেবারেই প্রকৃতিদত্ত ব্যতিক্রমী মেধা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, গুরুর প্রত্যক্ষ সাহায্য ব্যতিরেকেই এত দূর! যদি সত্যই কোনও যোগ্য গুরু একে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটি নিজ উদ্যোগে দান করেন...
দ্রোণ আরও এক বার শ্বাস নিলেন। তার পর তাঁর গুম্ফ ভেদ করে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, “তোমার কৃতিত্বে আমি প্রসন্ন হয়েছি, বৎস একলব্য!” সহাস্যবদনে বললেন আচার্য দ্রোণ, “মৃন্ময় মূর্তি নয়, তুমি প্রত্যক্ষ ভাবেই রক্তমাংসের গুরুর শিষ্য হওয়ার যোগ্য। আমি এই মুহূর্তে তোমাকে শিষ্যত্বে বরণ করলাম।”
এক স্বপ্নাতীত হর্ষের বিভা মুহূর্তে নিষাদবালকের কৃষ্ণবর্ণ মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করে তুলল, দ্রোণ স্পষ্ট দেখলেন। কিন্তু তার পশ্চাতে দণ্ডায়মান আর একটি শ্যামল আনন যে সেই একই লহমায় মলিনবিবর্ণ হয়ে গেল, তাও দৃষ্টি এড়াল নাতাঁর। অভিমান-বিস্ময়ের যৌথ অভিঘাত যেন কয়েকটি অশ্রুকণা সঞ্চার করে দিয়েছে দু’টি অক্ষিকোণে!
এক বার অর্জুনের সেই ম্লান, হতাশ মুখের দিকে, এক বার ক্রুদ্ধ সাত্যকির দিকে, এক বার হতভম্ব দুর্যোধন আর অশ্বত্থামার দিকে পর্যায়ক্রমে দেখলেন আচার্য দ্রোণ। তার পর যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “অন্তত বিদ্যা-অপহরণের ন্যূনতম পাপটুকুও নবীন শিষ্যের হস্তে লিপ্ত থেকে যাওয়া উচিত নয়, কী বলো জ্যেষ্ঠ কুন্তীনন্দন? কী যেন সামান্য প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছিলে তখন?”
“গুরুদক্ষিণা, আচার্য! গুরুকে দক্ষিণা দিয়ে সন্তুষ্ট করলেই...”
একলব্যের দিকে ফিরে আবার হাসলেন ভারদ্বাজ। সুমিষ্ট স্বরে বললেন, “কী? গুরুকে সন্তুষ্ট করার মতো দক্ষিণা প্রদান করতে পারবে তো, বৎস?”
“আদেশ করুন, প্রভু! ফল মধু দুধ মৃগমাংস— যা যা নিয়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিন— অর্ধদণ্ডের মধ্যে সব জোগাড় করে আনছি। বা, যদি আরও অন্য কিছু মূল্যবান, দুষ্প্রাপ্য আপনার ইচ্ছা হয়, কিনে আনব বা ধার চেয়ে...” কণ্ঠ কম্পিত হচ্ছিল একলব্যের, অভাবিত আনন্দে, উত্তেজনায়, স্বপ্নপূরণের রোমাঞ্চে, “এই অরণ্যে যা কিছু সংগ্রহ করা সম্ভব, সব... সব...”
“পরিশ্রম করে সংগ্রহ করে আনার মতো দুর্মূল্য দুষ্প্রাপ্য কিছুই নয় সে বস্তু,” দ্রোণ এখনও সহাস্য, “তোমার সঙ্গেই রয়েছে, এখন দক্ষিণা হিসাবে সেটি প্রদানে তুমি সম্মত কিনা, তা-ই দেখার!”
“সঙ্গেই রয়েছে! তা হলে ধরে নিন, আচার্য— সে জিনিস আপনি পেয়েই গিয়েছেন!”
দ্রোণের মুখ থেকে হাস্যলেশ মুছে গেল সহসা। দীর্ঘ দক্ষিণহস্তটি একলব্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তবে দাও হে নিষাদ! দিয়েই দাও...”
১৭
কৃষ্ণকে গভীর ভাবে চিন্তিত ও আলোড়িত দেখাল। আসন থেকে উঠে কিছু ক্ষণ পদচারণা করলেন, গবাক্ষপথে চেয়ে রইলেন বাইরের দিকে। গিরিমালার উপরে নক্ষত্রখচিত, গাঢ় অসিতবরণ নৈশ আকাশ, সেখানে শুক্লা তৃতীয়া তিথির ক্ষীণ শশীকলা। সেই ম্লান চন্দ্রমার দিকে তাকিয়ে বৃষ্ণিশিরোমণি বাসুদেব যেন ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন কয়েক পলের জন্য।
কক্ষে একটিমাত্র ঘৃতপ্রদীপ জ্বলছে। শিনিপুত্র কিশোর সাত্যকি এক বার সম্পূর্ণ কক্ষটিতে দৃষ্টি আবর্তিত করে আনল।
কৃষ্ণ যদুবংশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর ভবনটিও যেমন সাধারণ-দর্শন, নিজস্ব প্রকোষ্ঠটিও অতি নিরাভরণ ও সম্পূর্ণতই বিলাসবর্জিত। অনেকটাই অন্ধকারে ঢাকা। শুধু সাত্যকি আর কৃষ্ণ যেখানে মুখোমুখি কাষ্ঠাসনে বসে আলাপ করছে— সেইটুকু আলোকিত। সচরাচর সন্ধ্যাকালে প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকোদ্ভাস কৃষ্ণ পছন্দ করেন না, একমাত্র অত্যাবশ্যক কর্মের জন্য ছাড়া। সাত্যকি এখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক, কিন্তু এই বিরাট পুরুষের আদর্শ তথা জীবনচর্যা সম্পর্কে সে যথেষ্ট অবহিত। সমগ্র যাদবকুল জানে কৃষ্ণের নীতি। আহারে বিহারে এমনকি প্রহারে সংহারেও দেবকীনন্দন দীর্ঘ কাল সংযম ও অনতিরেক অভ্যাস করে আসছেন। শুধু নিজের জীবনচর্যায় নয়, এই আত্মনিয়ন্ত্রণ তিনি সকলের জন্যই উদাহরণ হিসেবে স্থাপন করতে আগ্রহী।
সাত্যকি সমীহপূর্ণ দৃষ্টিতে বাতায়নলগ্ন কৃষ্ণচ্ছায়ামূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরুষসিংহ বাসুদেব যে তার মতো নগণ্য নাবালককে স্নেহ করেন, মাঝে মাঝে স্বয়ং তাকে নানাবিধ শিক্ষা দেওয়ার জন্য ডাকেন— এ তার সৌভাগ্য ও গর্ব। দ্রোণের আশ্রমে তার অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থাও কৃষ্ণের পরামর্শেই আয়োজিত, এ কথা সে জানে।
বয়সে নব্য তরুণ— কিন্তু এই বয়সেই যাদব-প্রধান, বীর কৃষ্ণ। শুধু প্রধান অথবা বীর বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। তিনি একাধারে যদুকুলের বাহু, হৃদয় ও মস্তিষ্ক। সর্বগুণাধার এমন ব্যক্তিত্ব বহু প্রজন্মের মধ্যে এ দেশে অবতীর্ণ হননি। এই যুবা শাস্ত্রজ্ঞানে পণ্ডিত, যুদ্ধবিদ্যায় অপরাজেয়, সৈন্যাপত্যে নিপুণ, কূটনীতিতে সুদক্ষ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় অপ্রতিম। যাদবরাজ্যকে বার বার নানা বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাঁর ক্ষুরধার কূটবুদ্ধি ও বাহুবলের সমন্বয়। আবার ব্যক্তিগত শত্রুতার বশেও যাঁরা তাঁর ক্ষতিসাধন করতে উদ্যোগী হয়েছে, সেই সব অরাতিদেরও আশ্চর্য প্রকৌশলে তিনি দমন করেছেন। অদ্ভুতকর্মা সদ্য-যুবক এই বার্ষ্ণেয়র নানা অতিমানবিক কীর্তি সম্পর্কে এরই মধ্যে আর্যাবর্তের নানা অঞ্চলে জনপ্রবাদ প্রচলিত হয়েছে— তিনি সাধারণ মানুষ নন, ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী, হয়তো বা স্বয়ং দেব-অবতার! রাজা হতে তিনি উৎসাহী নন, কিন্তু তাঁকেই সসম্ভ্রমে নেতা বলে মেনেছে যাদবদের প্রায় সমস্ত গোষ্ঠী। বৃদ্ধ নৃপতি উগ্রসেনও সিংহাসনে উপবেশন ছাড়া আর তেমন স্বাধিকার প্রয়োগ করেন না— নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব গণপরিষদের উপরেই ন্যস্ত। কৃষ্ণই সেই পরিষদের শেষ কথা। কিন্তু সেই আধিপত্যওতিনি বলপূর্বক প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁর নিপুণ যুক্তিজাল, অব্যর্থ মনস্তত্ত্বজ্ঞান ও শান্ত-মধুর বাচনে তিনি সম্পূর্ণ পরিস্থিতি করতলগত করেছেন।
যাদবকুল বংশানুক্রমে অপব্যয়ী, বিলাসী ও অতিভোগী। ধনের অপচয়েও যেমন— তেমনই যৌনসংসর্গে, মদ্যপানে, কথায়-কথায় অস্ত্রব্যবহারে। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই, নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু নেই তাদের। এমনকি কৃষ্ণভ্রাতা মহাজ্ঞানী মহাবীর বলরাম পর্যন্ত ক্রুদ্ধ হলে হঠকারী ও ধ্বংসোন্মুখ হয়ে ওঠেন, সুরাপাত্র হাতে পেলে জগৎবিস্মৃত হয়ে পড়েন। স্থিতধী কৃষ্ণ আপ্রাণ পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিয়ে চলেছেন এই অমিতাচারী উচ্ছৃঙ্খল যদুবংশীয়দের মিতাচার শেখানোর। কিন্তু বিশেষ সফল হয়েছেন কি? যাদবরা তাঁকে সম্মান করে ঠিকই, কিন্তু নেতার অনুসৃত জীবন-নীতিও নতমস্তকে মান্য করবে এত সুশীলতা তাদের রক্তেই নেই কখনও।
সাত্যকি বাসুদেবের মুখ ফেরানোর অপেক্ষা করে রইল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, কৃষ্ণ এখনও অনেক কিছু জানতে চাইবেন। এক পক্ষকাল অন্তর আশ্রমিক অবকাশ মেলে, তখন সাত্যকি হস্তিনা থেকে স্বগৃহে আসে, কৃষ্ণ তার কাছ থেকে নানা বিবরণ সংগ্রহ করেন নিভৃতে। প্রচুর প্রশ্ন থাকে তাঁর— দ্রোণের আশ্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে, কুরু-রাজকুমারদের গতিবিধি নিয়ে, এমনকি হস্তিনার রাজপুরুষদের কর্মকাণ্ড নিয়েও। তাঁর মূল আগ্রহ অবশ্য তাঁর পিতৃস্বসা-পুত্রদের বিষয়ে। পঞ্চপাণ্ডব-জননী শৌরসেনী কুন্তী যে কৃষ্ণ-পিতা বসুদেবের নিজ ভগ্নী— এ তথ্য সাত্যকি জেনেছে আশ্রমে যাওয়ার পূর্বাহ্ণেই। তাই, অর্জুনের নৈপুণ্য, ভীমের সামর্থ্য বা যুধিষ্ঠিরের সুবুদ্ধি— সব বিবরণ সাত্যকিকে দিতে হয় নিয়মিত। কৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন, চক্ষু ও কর্ণ সদা সজাগ রেখে চলার— যাতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্যও সযত্নে সংগৃহীত হয়।
কিন্তু, আশ্চর্য! নিজেই সাত্যকিকে বলেছেন বাসুদেব— তাঁর স্বসৃপুত্রদের তিনি এ যাবৎ কখনও চাক্ষুষ করেননি! হিমালয়েই তাদের জন্ম, অনেক কাল সেখানেই তারা যাপন করেছে। কৃষ্ণও নিজের জীবনের উত্তাল ঘটনাবর্তে ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে, তাদের হস্তিনা-প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী সময়টুকুতে আর সাক্ষাৎ করতে যেতে পারেননি। কিন্তু এই কুমারদের উত্থান সম্পর্কে তাঁর উৎসাহ-কৌতূহল অপরিসীম। কেন, তা সাত্যকির বোধগম্য হয় না সম্পূর্ণত। শুধু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে সে অনুভব করে, বীর কৌন্তেয়রা কৃষ্ণের কোনও ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনার অঙ্গ হতেও পারে হয়তো বা। হয়তো কৃষ্ণের নিজের কাছেও তা এখন অবধি অস্পষ্টতায় আবৃত, তিনি শুধু তথ্যগুলি নিয়ে রাখছেন।
তথ্যাভিজ্ঞতা হল কৃষ্ণের রাজনীতির এক মূল স্তম্ভ, সাত্যকি বেশ উপলব্ধি করে। জম্বুদ্বীপের প্রতিটি রাজ্যে ছড়ানো আছে তাঁর গূঢ়জাল। দক্ষ চরের দল নিত্য বিচরণ করে সর্বত্র। হস্তিনাতেও তারা আছে। কিন্তু নিরাপত্তা-বেষ্টিত আশ্রমের অভ্যন্তরে তারা সম্ভবত মন্ত্রভেদনে অপারগ। তাই কৃষ্ণের এই কূট পদক্ষেপ— একই সঙ্গে সাত্যকির সুশিক্ষা, আর গুপ্ত-সংবাদ আহরণের যৌথ কার্যসিদ্ধি! কী সহজ অথচ কী ব্যতিক্রমী কৌশল! পিতৃগৃহে বয়স্ক যাদবদের আলোচনা শুনেছে সাত্যকি। তাদের ব্যক্তিগত বীরত্ব অতুল হলেও, সংগঠিত সামরিক শক্তি খুব বিপুল নয়। কিন্তু এই যে তথ্য-আহরণের বিস্তারী আয়োজন করে রেখেছেন বাসুদেব— এতে সমগ্র দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বহু পূর্বেই অবহিত হয়ে থাকা যায়। ভাবনার দিক থেকে এগিয়ে থাকা যায় কয়েক যোজন। পূর্বপরিকল্পনা নেওয়া যায় সম্ভাব্য পরিস্থিতিগুলির বিচারে। এ বিষয়টিতে কৃষ্ণের পারঙ্গমতা প্রায় অলৌকিক। সাধারণ ঘটনার মধ্যেই অসাধারণ ব্যঞ্জনা লক্ষ করে নিতে পারেন এই অন্তর্দ্রষ্টা কুশাগ্রবুদ্ধি পুরুষ।
আর, এখন সাত্যকি তাঁকে যে বিবরণ দিচ্ছে— সে তো এক বিরল ব্যতিক্রমী কাহিনি! কৃষ্ণকে তা প্রবল ভাবে আঘাত করবে তা প্রত্যাশিত ছিলই।
বাতায়ন থেকে কৃষ্ণ আবার যখন কক্ষের দিকে মুখ ফেরালেন, তখন তাঁর চক্ষু তীক্ষ্ণ, ললাট ভ্রুকুটি-আক্রান্ত। কিছু ক্ষণ আগে, দ্রোণ-একলব্য সংবাদ শোনার সময়ে যে বিস্ময় ও অবিশ্বাসের রেখাগুলি তাঁর মুখে অঙ্কিত হয়েছিল, তার পরিবর্তে এখন গূঢ় অনুসন্ধানী এক সত্তা জাগ্রত হয়ে ওঠার লক্ষণ পরিস্ফুট।
“তুমি সমস্ত ঘটনা একেবারে সামনে থেকেই দেখেছ তো, যুযুধান?” কৃষ্ণ একটু ঝুঁকে পড়েছেন সাত্যকির মুখের কাছে, “আমি বলছি, চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে বলছ তো? অপরের মুখে শুনে-আসা বিবরণ, বা জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি— এমন নয় তো?”
“নির্জলা সত্য বৃত্তান্ত, হে বাসুদেব, স্বচক্ষে দেখেছি, দুই ধনু দূরত্বে দাঁড়িয়ে। এখনও সেই করুণ দৃশ্য আমার রোম শিহরিত করছে, এই দেখুন আর্য!”
“দ্রোণ একেবারে সরাসরি বলে দিলেন, ‘দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিটি দাও?’ নির্দ্বিধায় বললেন?”
“নিষ্কম্প কণ্ঠে! আমি নিজের শ্রবণকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অন্য কুমাররাও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।”
“কিন্তু নিষাদবালক ভীত-বিহ্বল হয়নি, তাই তো বললে তুমি? সে তৎক্ষণাৎ ছুরিকা বার করে...”
“একটি বৃক্ষপত্রের উপর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ স্থাপন করে সে সেটি কর্তন করে ফেলল! অমানুষিক যন্ত্রণা সে দন্তে দন্ত চেপে ধরে সহ্য করছিল, দেখলাম। অতঃপর, বাম হস্তে সেই পত্রপুট-ধৃত রক্তাক্ত মাংসখণ্ডটি গুরুর দিকে প্রসারিত করে সে বলল, ‘বাম হস্তে গুরুদক্ষিণা দিতে বাধ্য হলাম ভগবন্, অপরাধ মার্জনা করবেন...’!”
১৮
কৃষ্ণে দ্রুত কয়েকটি শ্বাস ত্যাগ ও গ্রহণ করলেন। যেন ঘ্রাণ নিচ্ছেন, মনে হল সাত্যকির। বাতাসের ঘ্রাণ থেকে যেমন শার্দূল মৃগের গতিপথ চিনে নেয়, তেমনই একাগ্র ও গূঢ়চিন্তিত দেখাচ্ছিল ভ্রূকুটিকুটিল সূক্ষ্মদৃষ্টি বাসুদেবকে।
ক্রমশ