ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৫
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

দ্রোণের বাক্য শেষ হওয়ার আগেই জ্যারোপণ শেষ অর্জুনের। একই সঙ্গে দুটি শর সে তুলে নিয়েছে তূণ থেকে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২২ ০৫:২৭
Share:

পূর্বানুবৃত্তি: অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার উদগ্র বাসনায় গোপনে অর্জুনকে দেওয়া দ্রোণের শিক্ষা অনুধাবন করে বসুষেণ। আয়ত্ত করে ধনুর্বাণের কিছু প্রাথমিক গূঢ় প্রয়োগকৌশল। সে বুঝতে পারে, শরাগ্রে প্রলিপ্ত নির্দিষ্ট রসায়নই শরাঘাতের মারণক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। তার কথা শুনে বিস্মিত হন পিতা অধিরথ। অন্য দিকে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে মুক্ত অরণ্যাঞ্চলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গিয়েছেন গুরু দ্রোণ। বালকদের ক্রীড়া-কৌতুক ও অস্ত্র-অনুশীলনে শিক্ষাকে উপভোগ্য করে তোলাই তাঁর উদ্দেশ্য।

Advertisement

শস্ত্র হল সেই সব প্রহরণ যা হাতে ধরে রেখে সম্মুখযুদ্ধ করা হয়, যা নিক্ষেপযোগ্য নয়। নিক্ষেপযোগ্য আয়ুধ, যেমন বিভিন্ন গোত্রের বাণ, ভল্ল, শূল, শক্তি, তোমর, চক্র ইত্যাদিকে সমরবিদ্যা অনুযায়ী বলা হয় অস্ত্র। অস্ত্রধারী দূর থেকে আঘাত হানতে সক্ষম, সরাসরি দৈহিক নৈকট্যে আসার প্রয়োজন পড়ে না। তাই খুব বেশি বক্তৃতার অভ্যাসও অনাবশ্যক। কিন্তু তরবারি, খড়্গ, ছুরিকা, গদা, কুঠার এই সব শস্ত্র-চালনা হয় প্রতিপক্ষের একেবারে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে। তাই, এ ক্ষেত্রে শারীরিক শক্তি ও সহনক্ষমতাও যেমন অধিক থাকা চাই, তেমন প্রয়োজন অতিরিক্ত মানসিক তেজ। নিজেকে উদ্বুদ্ধ রাখা ও প্রতিপক্ষকে মানসিক চাপে ফেলা— দুয়ের জন্যই শস্ত্রধারীদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আত্মপ্রশস্তি এবং হুঙ্কার-প্রতিহুঙ্কারের শিক্ষাও দেওয়া হয়।

Advertisement

ভীম ও দুর্যোধনের মস্তকে হাত বুলিয়ে দ্রোণ সকৌতুকে আর এক শিক্ষার্থীর দিকে তাকালেন। বললেন, “বৎস অর্জুন! তুমি সকলকে রক্ষা করতে পারবে কি, যদি একের অধিক বন্য পশু একযোগে আক্রমণ করে?”

ধনুর্ধারী শ্যামবর্ণ কিশোর মৃদুভাষী ও শান্ত। সামান্য হেসে সে বলে, “পারব, গুরুদেব।”

“আচ্ছা, দেখাও দেখি। মনে করো বায়ুকোণের ওই জম্বুবিটপ একটি হিংস্র ভল্লুক, নৈঋেতর ওই তালবৃক্ষকে বরাহ কল্পনা করো। দুটিই ধাবমান তোমার দিকে। দুটিকেই বিদ্ধ করতে হবে পলকপাতের ব্যবধানে।”

দ্রোণের বাক্য শেষ হওয়ার আগেই জ্যারোপণ শেষ অর্জুনের। একই সঙ্গে দুটি শর সে তুলে নিয়েছে তূণ থেকে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। এবং বাস্তবিক, চোখের পাতা পড়তে না পড়তেই জামগাছটির কাণ্ড ভেদ করে দিয়েছে প্রথম বাণ!

দ্রোণ খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার পরবর্তী ক্রিয়াটুকু দেখলেন। বস্তুত, এই দ্বিতীয় ধাপটি কী ভাবে সম্পন্ন করছে ধানুকী— সেটিই তার নৈপুণ্যের অগ্নিপরীক্ষা। একযোগে একাধিক তির শরাসনে স্থাপন করাই যথেষ্ট দুরূহ। তার পর, একটি শর ক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন অভিমুখে দ্বিতীয় শর! অতি কঠিন কাজ। প্রথমত, পূর্ববর্তী ক্ষেপণটির অভিঘাতে জ্যা তখনও কম্পমান, ফলে শরস্থাপন করাই সমস্যাজনক। দ্বিতীয়ত, অত স্বল্প সময়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমুখে বাণ চালানো; বায়ুর ঝোঁক বুঝতেই নাভিশ্বাস উঠবে। তির-নিক্ষেপের বিদ্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ হল পবন-গতি-জ্ঞান। বায়ুর বেগ, অভিমুখ ও উত্থান-নমনের স্পষ্ট ধারণা এবং সেই তিনটি বিষয়কে নিজের শরক্ষেপণের অনুকূলে প্রয়োগ; সেই প্রয়োগ-জ্ঞান অনুযায়ী সেই মুহূর্তের উপযুক্ত নির্মাণ-ভারসাম্যবিশিষ্ট বাণ নির্বাচন করা; কখন লঘু-মস্তক বাণ, কখন গুরু-মস্তক, কখন দীর্ঘ, কখন নাতিহ্রস্ব। বায়ু-গতি-বিজ্ঞান মেনে নির্দিষ্ট-সংখ্যক পক্ষিপুচ্ছ সংযুক্ত থাকে বিভিন্ন তিরের পশ্চাদ্ভাগে, তাতেও আছে প্রযুক্তির গণিত, স্মরণ রাখতে হয় তা-ও। সর্বোপরি সমস্তটাই হতে হবে তাৎক্ষণিক, মৌহূর্তিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।

একই সঙ্গে শ্যেনদৃষ্টি, উপস্থিত বুদ্ধি, শীতল মস্তিষ্ক, অনুশীলন-অভিজ্ঞতা ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান— এই পঞ্চগুণের চূড়ান্ত মাত্রা প্রয়োজন শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হতে গেলে। অন্য কোনও অস্ত্র বা শস্ত্রের বিদ্যা এতগুলি গুণ দাবি করে না, এত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জানার আবশ্যক হয় না। তাই, একমাত্র এই অস্ত্রবিদ্যাকেই বেদের তুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, ‘ধনুর্বেদ’ নামটি সেই মহিমারই দ্যোতক।

গভীর মনোনিবেশ সহকারে প্রিয় ছাত্রের কার্য দেখলেন দ্রোণ। এবং দেখে অভিভূত হলেন। এই কুমারের দক্ষতা বাস্তবিকই সহজাত। এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি অসম্ভব নমনীয় কিন্তু বলবান। ভীষ্মকে পরামর্শ দিয়ে গুরু দ্রোণ যে এই কুমারের জন্য রাজপুরীতে স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় নৃত্য-শিক্ষক এবং যোগব্যায়াম-শিক্ষক নিযুক্ত করেছেন, তার সুফল ফলেছে। সাধারণত কোনও রাজপুত্রকে নৃত্যকলা শেখাতে গেলে পৌরুষ-মদবশত সে তা প্রত্যাখ্যান বা অবহেলা করে, তা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু আদর্শ ছাত্র অর্জুন যে কোনও শিক্ষার বিষয়েই শতভাগ আগ্রহী। নৃত্যশিক্ষাতেও পরম সঙ্কোচহীন, অলজ্জ ও উৎকর্ষকামী সে। দ্রোণ লক্ষ করেছেন, নৃত্যাভ্যাসের গুণেই অর্জুনের করতল ও অঙ্গুলির মুদ্রাগুলি অতি নমনীয় ও লঘুসঞ্চালনক্ষম হয়েছে। বিদ্যুদ্বেগে নড়াচড়া করে তার বাহু ও মুষ্টির সমস্ত অস্থিসন্ধি। স্কন্ধ-বক্ষ-গ্রীবা-কটি— সমস্ত পেশি সাধারণ লোকের তুলনায় ত্রিগুণ প্রাণময়— প্রয়োজনে স্তম্ভের মতো সুস্থিত, প্রয়োজনে প্রপাতের মতো সচল। নৈঋেতর তালবৃক্ষটির দিকে সে যে গতিতে ঘুরে দাঁড়াল, যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুর গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করল এবং মরুৎ-বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে চকিতে নিক্ষেপ করল দ্বিতীয় বাণটি— তা শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ হওয়ার সমস্ত সুলক্ষণে প্রোজ্জ্বল।

একটিই প্রশ্ন করার ছিল দ্রোণের। তিনি কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু, পার্থ, জম্বুবৃক্ষে তুমি যে উচ্চতায় তির বিদ্ধ করলে, ভূমি থেকে প্রায় তিন হাত ঊর্ধ্বে— তালবৃক্ষে সেই সমতা কিন্তু রক্ষা করতে পারোনি। তালবৃক্ষে তোমার শরটি বড় নীচে বিদ্ধ হল যে, ভূমি থেকে মাত্র এক হাত! এই ত্রুটির কারণ?”

“ত্রুটি নয় তো, আচার্যদেব!” অর্জুন ঈষৎ সহাস্যমুখে কিন্তু অকম্প্র কণ্ঠে উত্তর দিল, “জম্বুবৃক্ষটিকে তো ঋক্ষ কল্পনা করতে বলেছিলেন। তার মর্মস্থল বিদ্ধ করতে তো বাণ মাটি থেকে ওই পরিমাণ উপরেই স্থির করা চাই! কিন্তু তালবৃক্ষ তো বরাহ— তাকে বধ করতে হলে...”

দ্রোণ বিস্ময়ে-আনন্দে বিহ্বল হলেন ক্ষণকাল। এখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক, এখনও শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়— কিন্তু ধনুর্বাণের এই অসামান্য কৃৎকৌশলটি চোখের পলকে সম্পন্ন করার সময়, ওই দুই মুহূর্তের মধ্যেও, এত বিপুল বাস্তববাদী ভাবনার উদ্ভাস ঘটাতে পেরেছে সে তার মস্তিষ্কের কোষে! এমন শিষ্য প্রকৃতই কোটিতে এক মেলে। এ কী অলোকসামান্য প্রতিভা নিয়ে এসেছে পাণ্ডুর তৃতীয় সন্তান!

আচার্যের শুষ্ক চক্ষু আর্দ্র হল। সমস্ত শিক্ষার্থীর সমক্ষেই তিনি আলিঙ্গন করলেন অর্জুনকে, গদগদকণ্ঠে বললেন, “পুত্র! তোমাকে আমি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদে পরিণত করব, এই কথা দিলাম! তোমার জয়ের পথ নিষ্কণ্টক হোক! এখনই তোমার তুল্য প্রতিভাশালী সমগ্র পৃথিবীতে কেউ নেই, এ আমি নিশ্চিত বললাম।”

“কেউ নেই? সত্যিই, গুরুদেব— আমার সমান কেউ নেই?” যেন গুরুর কানে কানে অস্ফুটে বলে আলিঙ্গনাবদ্ধ অর্জুন। পরম স্বীকৃতিটির বিষয়ে নিঃসংশয় হতে চায়।

প্রথম থেকেই দ্রোণ দেখেছেন, প্রশংসা শুনলে এই বালক তীব্র ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়। তার পরবর্তী কাজগুলি আরও কৃতিত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আরও নিবিড় অনুশীলন-মনোযোগ-পরিশ্রমে নিমজ্জিত করে দেয় নিজেকে। ‘আমি শ্রেষ্ঠ’— এই শব্দগুলি তার কাছে মাদক উত্তেজনার রসায়ন জোগায়।

এই কারণেই, কেবল এই শিক্ষার্থীকে নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্যই, নিজ আত্মজ অশ্বত্থামাকেও আজকাল গূঢ় বিদ্যা দেওয়া বন্ধ করেছেন দ্রোণ। অশ্বত্থামা তত বড় আধার নয়, পিতা হয়ে তিনি জানেন। পিতৃ-প্রশ্রয়ে কিছু উৎকৃষ্ট বিদ্যা সে অধিগত করেছে ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই তার সীমা। উত্তুঙ্গতম গ্রহণক্ষমতা বা প্রয়োগ-পারদর্শিতার প্রতিভা নেই কৃপী-নন্দনের। থাক তবে, একটি শাখাতেই ফলবতী হোক সমস্ত শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পদ!

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসও সে দিন আশ্রম-দর্শনে এসে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন— আচার্যের কোন শিষ্য সর্বাধিক প্রতিশ্রুতি বহন করছে, কে হবে ভবিষ্যৎ ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাযোদ্ধা?

দ্রোণ শুনেছেন, ভরতবংশের সমগ্র কাহিনি নিয়ে বেদব্যাস এক মহাকাব্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন, যা তাঁর শিষ্যদের মুখে-মুখে সারা জম্বুদ্বীপে প্রচারিত হবে। সব দিকে ব্যাসদেবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চতুর্দিকে তাঁর তথ্য-আহরণের মহতী প্রক্রিয়া চলমান। কুরু-বংশধরদের বিকাশ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তিনি সজাগ। বর্তমান কুরুকুমাররা আবার দ্বৈপায়নের প্রত্যক্ষ পৌত্রও বটে, তাই তৃতীয় পাণ্ডবের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে তিনি গ্রন্থে বিশেষ উল্লেখ রাখবেন স্বাভাবিক ভাবেই। দ্রোণ তাঁকে তা নিয়ে নিশ্চিত আশ্বাস দিয়েছেন।

“আমার সমান কেউ নেই, না আচার্য?” এখন জানতে চাইছে ব্যাস-পৌত্র অর্জুন নিজেও।

নিজের মাথাটি দুই দিকে সঞ্চালন করে ‘না বৎস’ বলতে গিয়েও এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন দ্রোণ, স্তব্ধ ও নিরুত্তর।

আচম্বিতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক কাতর অথচ ক্রুদ্ধ তরুণের মুখচ্ছবি! প্রিয়দর্শন সুগৌর আনন ক্ষোভে আরক্তিম, কণ্ঠে যুগপৎ অসহায়তা ও প্রতিবাদ...

“আপনি অর্জুনের প্রতি এমন প্রকট পক্ষপাতী, আচার্য! ছি! আপনি না গুরু, আপনার না নিরপেক্ষ হওয়ার কথা! তার পরিবর্তে আপনি এমন শঠতা করেন শিষ্যদের সঙ্গে!”

নির্জন মধ্যাহ্নে, সবাই যখন বিশ্রামরত— সে এসে দাঁড়িয়েছিল অভিযোগের উদ্যত অঙ্গুলি নিয়ে। দ্রোণ অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলেছিলেন, “কী বলতে চাও তুমি, রাধেয়! এত বড় অসম্মানের উক্তির স্পর্ধা...”

“নিজ সম্মান তো আপনি স্বয়ং মলিন করে চলেছেন, আচার্য! দিনের পর দিন!” সূত অধিরথের পুত্রটি তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন ভর্ৎসনাই করছিল গুরুকে, “নিরালা ধাতুশালায় আপনি কেবলমাত্র অর্জুনকে ডেকে নিয়ে আপনার গূঢ়বিদ্যা দান করেন। অন্য সকলকে ছল করে ক্রীড়া-বিলাসে মগ্ন করে রাখেন। কেন, প্রভু, অন্য ধনুর্ধররা কি কৌন্তেয়র সতীর্থ নয়, আপনার শিষ্য নয়? আশ্রমে যা-যা শিক্ষা দেওয়া হবে— ধর্মত ও ন্যায়ত প্রত্যেকেই কি তা পাওয়ার অধিকারী নয়? ...আপনার ছল অনুধাবন করে, আমি কয়েকদিন আপনার আহ্বান ব্যতিরেকেই কর্মশালায় প্রবেশ করেছিলাম— কিন্তু সেখানেও আপনি কপটাচরণ শুরু করলেন। গোপন পাঠ দেওয়ার প্রারম্ভেই আমার হাতে আপনি একটি মৃৎকলস ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “যাও রাধেয়, রাজপথিপার্শ্বের গভীর কূপ থেকে সুপেয় জল নিয়ে এসো!” কখনও বা অসুস্থ গুরুপত্নীর জন্য বৈদ্যগৃহ থেকে ঔষধ আনা, কখনও গাভীর বৎসটিকে গোশালায় বেঁধে রেখে আসা— ইত্যাদি তাবৎ আদেশ পালনের জন্য একমাত্র আমাকেই নির্বাচন করতেন আপনি— এবং ওই মোক্ষম লগ্নটিতেই, আগেও নয়, পরেও নয়! আপনিও বেশ জানেন, আচার্য, আপনি আমার সঙ্গে যা করে চলেছেন তার নাম প্রবঞ্চনা!”

“অর্জুন রাজপুত্র। হস্তিনার কুমার সে। আর আমি... হস্তিনার বেতনভুক শিক্ষক,” দ্রোণ গম্ভীর কিন্তু অনুচ্চস্বরে বলেছিলেন, “অন্নদাতাকে বিশেষ পক্ষপাত দেখানোয় কোনও অধর্ম নেই, অন্নদাতার জন্য প্রাণ অবধি দেওয়া যায়, স্বতন্ত্র বিদ্যাদান তো তুচ্ছ বিষয়! আর শোনো, বসুষেণ! হস্তিনার কুমারের সঙ্গে সূতপুত্রের তুলনা হয় না, জেনো! সমাজে যে-ভেদ প্রচলিত আছে, শাস্ত্রে যে-বর্ণাশ্রম আছে— একটি ক্ষুদ্র শিক্ষাসত্র তার বিপরীত কিছু অনুমোদন করবে, এই প্রত্যাশাই তোমার ভুল। তোমাকে আশ্রমের অন্তর্ভুক্ত করাই আমার অভিপ্রেত ছিল না— তোমার পিতার প্রভাবে তুমি অপ্রাপ্যের স্বাদ পেয়েছ অনেকটাই। এর অধিক পাবে না এখানে। আমি জানি, তুমি অর্জুনকে ঈর্ষা করো। এমনকি, ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান চাও, সেও তার প্রতিস্পর্ধী হওয়ার মানসেই! কিন্তু সে তো তোমার অপ্রাপ্য হে সূতনন্দন— এও তোমার জ্ঞাত থাকা উচিত ছিল!”

হেসেছিল অধিরথ-পুত্র, তিক্ত হাস্য। সক্ষোভে ও সশ্লেষে বলেছিল, “সে আমি অনেক পূর্বেই উপলব্ধি করেছি, গুরুশ্রেষ্ঠ! এও জানি, যে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নষ্ট হয়েছে তাঁর কাছে অধ্যয়ন নিরর্থক। আমি আজই শেষ বারের মতো এই আশ্রম-উদ্যানে পদপাত করলাম। আমি অন্য গুরুর সন্ধানে যাব। জন্ম দৈবাধীন, কিন্তু পুরুষকার আমার আয়ত্ত— আমি নিজ ভাগ্য নিজে নির্মাণে সক্ষম!”

দ্রোণ শুধু বলেছিলেন, “কল্যাণ হোক!”

রাধেয় তাঁকে প্রণাম করেছিল। তার পর বলেছিল, “বিদায়ের আগে একটি প্রশ্নের উত্তর যাচ্ঞা করি হে ভারদ্বাজ!”

“কী?”

“আপনি আমাকেও গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করেছেন, আমি জানি। সত্য বলুন, ধনুর্বেদে আমার দক্ষতা কি অর্জুনের চেয়ে কিছু কম বলে আপনার ধারণা? দৃষ্টি বুদ্ধি ধৈর্য মনঃসংযোগ অনুশীলন— এর কোনওটিতেই কি কৌন্তেয় অর্জুন বাস্তবে এই রাধেয়র চেয়ে উৎকৃষ্টতর? যদি আপনি আমাকে তার মতোই স্নেহ ও যত্ন নিয়ে অপক্ষপাতে শিক্ষা দিতেন, যদি ওই ভাবেই নিয়মিত দিতেন গূঢ়তম বিদ্যাগুলি, তবে আমিই কি হতাম না শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর?”

দ্রোণ মৌন ছিলেন কিছু ক্ষণ। তাঁর দৃষ্টি নমিত হয়েছিল আপনা থেকেই, খুব ধীরে ধীরে শুধু বলেছিলেন, “তোমার নতুন আচার্য হয়তো এ বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসার পথে তোমাকে চালনা করবেন!”

আজ অর্জুনের প্রশ্ন শুনে চকিতে রাধেয়র সেই শাণিত প্রশ্ন মনে পড়ে গেল। পার্থ জানতে চাইছে, ‘আমার সমান কেউ নেই?’ রাধেয়রও জিজ্ঞাসা ছিল, ‘আমার দক্ষতা কি অর্জুনের চেয়ে কিছু কম?’

কুরু-অন্নজীবী দরিদ্র ব্রাহ্মণ দ্রোণ আর অস্ত্রগুরু আচার্য দ্রোণ মুখোমুখি, দু’জনেই নীরব।

মহাগ্রন্থ-লিখনরত বেদব্যাসকেও রাধেয়র বিষয়ে কিছু অবগত করেননি দ্রোণ। কিন্তু ঋষি নাকি সর্বজ্ঞ, অন্তর্দ্রষ্টা... তিনি কি একেবারেই কিছু জানতে পারবেন না?

ক্রমশ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement