Bengali Feature

রূপকথার দিনবদল

দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথায় স্বাধীনতার স্বপ্ন চিনল যে জাতি, বিশের দশকে তার চার দিকে যুদ্ধ আর ভঙ্গুর সমাজ। চল্লিশের কালবেলায় তার স্বপ্নহীন রাতগুলোয় জাপানি বোমার ভয়, অনাহার আর দারিদ্র। সে দিনও কি রূপকথা খুঁজত মানুষ? সে রূপকথায় কি রাজা-রানি সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করত আজীবন? না কি বদলে যাওয়া সমাজ তার রূপকথা সাজাত নতুন নিয়মে?

Advertisement

প্রমিতি চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৪
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

বসন্ত কাল। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। আর তার ধাক্কায় সদ্য-ফোটা আমের বোলগুলো থেকে থেকে এ পাশে-ও পাশে দুলছে। ননু পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে গাছটা দেখছে, চওড়া পাতাগুলোর আড়াল থেকে সূর্যটাকে অস্ত যেতে দেখছে। এক রাশ সোহাগি গোলাপি আলো ছিটকে যাচ্ছে রাস্তার পাশের টিলাটায়, বাগানের চামেলি ফুলের গাছে, নামতার বইয়ের পাতায়। ননু অপেক্ষা করছে একমনে। ওই দূরের কারখানায় ছুটির ভোঁ বাজল। এই বারে তাদের আসার সময় হয়েছে! দুপুর আর সন্ধের মাঝখানের এই নরম আদুরে সময়টায়, যখন মা রান্নাঘরে জলখাবার তৈরি করে, রূপুসী মেনি ঘুমভাঙা চোখে থাবা চাটে, মাসিমা তখনও কলেজ থেকে ফেরেনি, ঠিক তক্ষুনি ছোট ঢিপিটা পার হয়ে, ঘাসের মধ্যেকার এক ফালি সরু রাস্তা দিয়ে আলি-ভুলি আসে। আর অমনি পড়াশোনা-খাওয়াদাওয়া ফেলে ননু তাদের সঙ্গে এক ছুট্টে বেপাত্তা! মা ডাকে, মাসি কমলা লজেঞ্চুস নিয়ে এসেছে, কী সুন্দর জেলি ভরা! কিন্তু ননুর সে সব শোনার সময় তখন নেই। আজ যে তার বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন! “উকুনে-বুড়ীর বিয়ে হবে, পায়েস হবে বেশ, উকুনে-বুড়ীর মাটির কড়া, পায়েস হবে তাতে ভরা; পাড়ার লোকে পায়েস খাবে, পায়েস হবে শেষ!”

Advertisement

আলি-ভুলির দেশটা যে কী ভাল, কী ভাল, কী বলব! তাদের দেশে মস্ত সব কুড়ি-পঁচিশতলা বাড়ি, বিয়ের জন্যে সে সব আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাগানে মাটির কড়া ভরে পঞ্চব্যঞ্জনে রান্না চেপেছে। তার মনমাতানো গন্ধে দেওয়ালিপোকা, ডোরাকাটা ফড়িং, ঘুরঘুরে পোকা— সব্বাই এসে জড়ো হয়েছে। জোনাকিরা মাথায় পিদিম জ্বেলে ব্যস্তমুখে তদারকি করছে… এমন সময়ে কোথাকার একটা মস্ত ফড়িং বেচারা মাথা ঘুরে গিয়ে পড়েছে পায়েসের কড়ার মধ্যে। ননু আর কী করে, তার সঙ্গে হাসপাতালে চলল। সে দেশের হাসপাতালটাও কিন্তু আমাদের মতো নয়। সেখানে ছোট ছোট সাদা ডানাওয়ালা পরিরা রোগীদের ওষুধ খাওয়ায়, তাদের ঘুম পাড়িয়ে চাঁদের আলোয় হাত ধরাধরি করে নাচে! সেখানে সব্বাই সব্বাইকার জন্য ভাবে! কেউ কষ্ট পেলে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়!

তখন ১৯১৯ কি ’২০। সে ছিল এক মস্ত গোলমালের সময়! বছর দশেক আগে বাংলা ভাগ কোনও মতে ঠেকানো গিয়েছিল বটে, কিন্তু মানুষগুলো দু-দণ্ড হাঁপ ছাড়ার আর সময় পেলে না! সেই মুজফফরপুরের বোমার মামলায় সোপর্দ হয়ে কচি ছেলে দুটো ফাঁসির সাজা পেল, আর সেই ইস্তক ঘরের ভালমানুষ ছেলেপিলেগুলোও যেন বেমালুম বদলে গেল। সময়ে বাড়ি ফেরে না, রাজা-রানির রূপকথা শোনার তাদের সময় কোথায়? রাত বাড়ে, বেড়ে রাখা ভাত জুড়িয়ে ঠান্ডা জল হয়ে যায়, ভোররাত্তিরে পুলিশ এসে দরজায় ধাক্কা দেয়, স্বদেশি ডাকাত খোঁজে। ডানপিটে ছেলেগুলো আর রাক্ষস-খোক্কসকে ভয় পায় না, বিকেলের পড়ে আসা আলোয় সাপের মাথার মণি খোঁজে না, একলা আমবাগানে গিয়ে বন্দুক ছোড়া মকশো করে। তারই মধ্যে আবার বাধল যুদ্ধ। ছোট থেকে ননু জেনে এসেছে, নিমকি বা মিষ্টি-গজা কম পড়লে ছেলেপুলেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। কিন্তু এ যে দেখা গেল, বড়রাও নিজেদের মধ্যে যারপরনাই মারামারি করল, আর তাদের লড়াইয়ে অকারণে কষ্ট পেল সাধারণ মানুষগুলো। এই তো, ননুর ইশকুলের প্রাইজ়ের টাকাগুলো এ বারে যুদ্ধের ত্রাণ তহবিলে দান করা হল। ননু জানে, রোজ সকালে কাগজ পড়তে বসে বাবার মনখারাপ হয়। বাবা চা-বিস্কুট খায় না, ধরে আসা গলায় মাকে বলে, “এত কিছু হচ্ছে, ছোট ছেলেগুলো বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে, তাও এরা বদলাবে না! চেমসফোর্ড সায়েবকে একলা দোষ দিয়ে লাভ কি? সরকারের নাকি তিন হাজার লক্ষ টাকার দেনা। জিনিসের দাম যে ভাবে বাড়ছে, আবার এই দু’বছরে ফলন তেমন হয়নি। এই বাজারে কী ভাবে চালাবো, বলতে পারো?” ননু দেখেছে, মার চোখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ! ননু দেখেছে, মাসিমা আজকাল কলেজ যায় না, কে এক রাওলাট সায়েব শক্ত আইন জারি করেছে, দিকে দিকে ছাত্ররা হরতাল করছে। পঞ্জাবের এক বাগানে গুলি চালিয়ে অনেক লোককে মেরেও ফেলেছে পুলিশ! খবরটা শুনে মা চোখ মুছছিল। বাবা দুপুরে ভাত খেল না, মাসি সারা দিন মুখ মেঘলা করে রইল। ননু এখন বোঝে, তারা ভাল নেই। চার দিকে শুধু কষ্ট আর মনখারাপ! এমন বিচ্ছিরি মনকেমনের দিনগুলোয় ননু আলি-ভুলির সঙ্গে না গিয়ে আর করে কী!

Advertisement

আলি-ভুলির দেশে তখন শরবতি রঙের সকাল! কাঠবেড়ালির ছানাগুলো জড়াজড়ি করে রোদ পোহাচ্ছিল, ননুকে দেখে কী খুশি! শুধু কাঠবেড়ালি? কামিনীগাছের মা-বাবা বুলবুলি, দুষ্টু চিল, মালীর ছেলে গোবিন্দ, ঝলমলে পাথরের রানি রত্না, ছোট্ট বাঁদরছানা পাপু আর আবা— কে নেই সেখানে? ভাগ্যিস, ননুর মা-মাসিমারা ওদের দেখতে পায় না, তাই তো তাদের ‘সত্যি’ জীবনের কালশিটেগুলো ওদের গায়ে লাগে না! আলি-ভুলির দেশে আইন-কানুন, পেয়াদা-পুলিশ নেই, যুদ্ধ নেই, এ পৃথিবী কখনও ঢিমেতালে চলে, ননুর বাড়ির পাশের চামেলি গাছের ঝোপে, ডেঁয়ো-পিঁপড়ের ঢিপিতে রূপকথার নকশা কাটে, আবার কোনও ঝুপঝুপে বর্ষাকালে হঠাৎই বদলে ফেলে তার খামখেয়ালি ভূগোলের চৌহদ্দি। মা জেরা করে, “কোথায় গিয়েছিলি? কারা এই আলি-ভুলি?” মাসি বলে, “দেখা তো, তাদের বাড়ি কোথায়?” ননু কী করে বোঝাবে ওদের? আলি-ভুলির দেশ তো এখানেই, কিন্তু বড়দের সংসার-সীমানার বাইরে। সংসারের ‘সত্যি’ গুলো যখন বড়দের কষ্টে, লোভে আর হিংসেয় মাখামাখি হয়ে যায়, তখনই সে সমাজ-বারোমাস্যার চলতি ইতিকথা পেরিয়ে আলি-ভুলির দেশে সূর্য ওঠে, নতুন রোদের গন্ধ মেখে লুকোনো সব কোটর থেকে বেরিয়ে আসে লাল-নীল পরিরা। তাদের কারও নাম ইচ্ছে, কারও নাম আশা। কিন্তু “মানুষের বয়স হলে এমন হোঁতকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোন কথা বিশ্বাস করতে চায় না!”

সুখলতা রাও-এর হাত ধরে ‘সন্দেশ’-এর পাতায় ননুর সঙ্গে আলি-ভুলির বন্ধুতার সময় হল ১৯২২। লেখা তারও বছর দুই-তিন আগে! সত্যি বলতে, ঠাকুরমার আর ঠাকুরদাদার ঝুলির পরে পরে বাংলা রূপকথার গল্প আর খুব বেশি দূর এগোয়নি। এগোনোর সুযোগও পায়নি সে ভাবে। রাজনীতির ঝড়ঝাপটা সামলে যেই না মানুষগুলো তাদের মধ্যবিত্ত সংসার-সীমানাটা সাজাতে চেয়েছে, অমনি তাতে বাদ সেধেছে তার ভারাক্রান্ত রোজনামচার ব্যর্থতা। বিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্তের সংসার যাপনে উনিশ শতকের আদর্শবাদের রোমাঞ্চ নেই, অতীন্দ্রিয় জাতিসত্তার খোঁজে যে সমাজ এক দিন তার সদর আর অন্দরের মধ্যে পরিপাটি সীমানা এঁকেছিল, যুদ্ধের বাজারে তা কবেই মুছে গেছে! মাঝের সময়টা যেন গোটা জীবন জুড়ে যুদ্ধ ঘনিয়ে ওঠারই সময়। সে যুদ্ধ শুধু উপনিবেশ আর ঔপনিবেশিকের নয়, সে যুদ্ধ শুধু পৃথিবীজোড়া ক্ষমতা যাচাইয়ের আস্ফালনের নয়, সে যুদ্ধে মানুষ নিজের মধ্যেই স্বপ্ন আর দীনতার নিরন্তর দোটানায় জেরবার হতে হতে রোজ এক বার করে সকালের কুয়াশা দেখে, আর একই ব্যর্থতা নিয়ে আরও এক বার রাতের অন্ধকারে পৌঁছয়! স্বাধীনতার লড়াই, মহাত্মা গান্ধীর প্রতিবাদ, যুদ্ধের বাজারে রোজকার অভাব-অনটন, বেকারত্ব, ফুরিয়ে আসা খাবার, ফাটকাবাজি আর ঘুণ ধরা একটা সমাজের বাড়তে থাকা অর্থের লোভ ঘুলিয়ে ওঠে তার স্বপ্নে। যুদ্ধ বাধে আবারও, মাঝে হয়তো খুব বেশি হলে বিশ বছরের ফারাক! খবর আসে, ব্ল্যাকআউটের রাতে কলকাতায় জাপানি বোমারু হানার ভয় আছে! অতএব বাড়িগুলোয় জানলা বন্ধ, পরদা টানা। সন্ধের পর থেকে রাস্তায় টহল দেয় এয়ার রেড-ওয়ার্ডেনের ব্যাজ পরা ভলান্টিয়াররা। সামান্য আলোর রেশ দেখলেই চেঁচিয়ে ওঠে, “ও মশায়, তেরো নম্বরে আলো দেখা যাছে যে!” ঝুপ করে আলো নিবে যায়, আবার আলপিন-ফোটানো স্তব্ধতা আর অন্ধকার। সে রাত্তির ভোর হয় না, বন্ধ জানলায় লতিয়ে ওঠে নয়নতারার চারা। আর মৃতপ্রায়, পচাগলা জীবনের মিথ্যে কাঠামোটা বয়ে বেড়াতে থাকা মানুষগুলো তত দিনে নিজেদের উপরে নিষ্ঠুর হতে শিখে যায়! নিষ্ঠুর মানুষ তো আর রূপকথা খোঁজে না, জীবন সত্ত্বেও সে তো মৃত! আলি-ভুলি কিন্তু সে দিনও তার কাছে আসে! মানুষের আশপাশে তাদের শেষ দেখা গিয়েছিল বোধহয় পঞ্চাশের দশকে। তবে সে তো ছাপা বইয়ের কথা। আলি-ভুলির খান পনেরো গল্প লেখা হয়েছিল বেশ কিছু দিন আগেই। তাই ধরে নিই না কেন, সাল তখন বিয়াল্লিশ কি তেতাল্লিশ, আলি-ভুলির সঙ্গে খোকাবাবুর দেখা হল এক্কেবারে শেষের গল্পে।

সাইরেন বাজছে, সাইরেন! এ দিকে রেশনের দোকানের সামনে আস্বাভাবিক ভিড়। বেশির ভাগই মহিলা, এরা কলকাতার মানুষ নয়, সব বর্মার যুদ্ধের ভয়ে পালিয়ে এসেছে। ইশকুল থেকে খোকাবাবুকে নিয়ে ফেরার রাস্তায় চাকর যেই না সেই ভিড়ে একটু দাঁড়িয়েছে, অমনি কোত্থেকে আলি-ভুলি এসে হাজির। ননু এখন কিনা মস্ত বড় হয়ে গেছে, তাই এখন তারা খোকার সঙ্গেই খেলে। রেশনের দোকানের পাশের সরু গলি দিয়ে আলি-ভুলির দেশে বেড়াতে গেল খোকা। পথ তো একটুখানি, কিন্তু এ কী? খোকা অবাক হয়ে দেখে, আলি-ভুলির দেশের সে সব কুড়ি-পঁচিশ তলা বাড়ি কবে ভেঙে গেছে! একখানা মাটির চালাঘর টিমটিম করছে, তারও অর্ধেক চাল ভাঙা, দাওয়ায় বসে একটুখানি ভাত নুন দিয়ে মেখে খাচ্ছে তার বন্ধুরা। ঘরে বাবার অসুখ, ওষুধ নেই, পথ্যি নেই, যুদ্ধের বাজারে চাল আক্রা! একে নাকি দুর্ভিক্ষ বলে! খোকার ইশকুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, আলি-ভুলিও আর বিশেষ আসে না! তার বদলে খোকার বাড়ির নীচে, গাড়ি-বারান্দার ধারে ভিড় জমায় একগাদা লোক। না খেয়ে খেয়ে তাদের গায়ে শুধু চামড়া আর হাড়। খোকা আতঙ্কে চেঁচিয়ে ডাকে, “কোথায় তোমরা সবাই? এদের খাবার দিয়ে যাও।” কেউ আসে কি? সরকারি রিপোর্ট বলে, মে মাসের সে দিন ময়মনসিংহ, বাকরগঞ্জ, নোয়াখালি, চাটগাঁয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে সাতশো ছুঁয়েছিল। তমলুকের কাছাকাছি গ্রামগুলোতে ভিড় করেছিল হাজারখানেক খেতে না পাওয়া মানুষ! সরকারি পুলিশ তাদের খালি হাতেই ফিরিয়ে দেয়। প্রবল খিদেয় ধুঁকতে থাকা, কাঁদতে থাকা মানুষগুলো কি আলি-ভুলির দেশ খুঁজে পেয়েছিল সে দিন? কাঠবেড়ালি, চড়াই, বুলবুলি আর চন্দনারা কি ছুটোছুটি করে তাদের জন্যে রাশি রাশি ধান, ছোলা, মটর, ভুট্টা এনে দিয়েছিল? খোকা জানে, আলি আর ভুলি ওদের ঠিক বেড়াতে নিয়ে যাবে নিজেদের দেশে। পেট ভরে খিচুড়ি খাওয়াবে, চোখের জল মুছিয়ে, ফর্সা জামা পরিয়ে বলবে, “রোজ এসো তোমরা, রোজ রোজ এসো।”

রূপকথা তৈরি হয় কোথায়? বড়রা হেসে বলেন, “রূপকথা আবার কী?” ও সব শিশুমনের খামখেয়ালি কল্পনা। নইলে ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’র ঘুপচি বাড়ির একতলার সিঁড়ির নীচে নাকি পরিস্থান! নইলে এই দারুণ ঘেরাটোপ অন্ধকারে, হিংসা, দারিদ্র, বিশ বছরের অভাব আর বাঁচার ব্যাকুল চেষ্টার দিনেও নাকি আলি-ভুলির দেশে মিহিদানা রঙের আকাশ? আকাশকুসুম আর কাকে বলে? আরে, ছেলেমানুষের চোখে তো নোনা-ধরা পুরনো দেওয়ালের চিত্তিরবিচিত্তির, রানি মাকড়সার ঝুলও সাতরঙা! এমন তার রঙের জৌলুস যে, হাত ছোঁয়ালে নাকি কমলা রং হাতে লেগে যায়, টুংটাং শব্দে ঘর ভরে যায়! সত্যি ভাবতে হয় বুঝি এ সব? রূপকথা তো ছেলেমানুষের মনের মধ্যে, নেহাতই ফালতু! বড় হয়ে বুঝতে শিখলে দেখবে, রূপকথা দিয়ে দেশ গড়া যায় না। দেশ গড়তে সত্যি দরকার হয়। কেমন সত্যি? ওই যে অক্ষয় মৈত্রবাবু বলেছেন না, দেশ গড়তে লাগবে দেশ আর জাতির বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক জ্ঞান। সে জ্ঞান হবে তথ্যনির্ভর, তাতে ভালমন্দ, সুখদুঃখের আবেগ থাকবে না, সময়ের ধারায় আগুপিছু হবে না মোটে। এই যে রূপকথায় বার বার সময়ের এ দিক-ও দিক করা, সত্যিকারের জায়গা ভুলে পক্ষিরাজের পিঠে চেপে তেপান্তরে পাড়ি দেওয়া— এ সব বড় হলে এক্কেবারে বন্ধ। সবাই অবশ্য সে কথার সবটা মানেননি। আরে বাবা, ইতিহাস তো শেষে মানুষেরই গল্প, সেখানে যদি অনুভূতির নরম ওঠাপড়াগুলোই ছেঁটে ফেলা হয়, তা হলে জাতির স্বকীয়তা থাকবে কী করে? তাই দেশের কথা বলতে গেলে, তার মানুষগুলোর সবটুকুর কথা বলতে গেলে, কল্পনা ছাড়া উপায় কী? রবি ঠাকুর তো বলেইছেন, মনের রূপকথায় দেশকাল জুড়ে যাবে, সময়ের ভাগাভাগি মুছে গিয়ে, কাছে-দূরের সীমানা লেপেপুঁছে জন্ম নেবে সমগ্র একটি জাতিসত্তা। রূপকথার সে জাতিতে অন্ধকার আর আলোর দ্বন্দ্ব থাকবে না, আপন-পরের দ্বৈরথ থাকবে না, ছোট-বড়র ভাগাভাগি পেরিয়ে জ্বলজ্বল করবে জাতির একটাই মাত্র ‘আত্মপরিচয়’। দেশ-কাল ছাপিয়ে সে পরিচয় খুঁজতে যাওয়াটাই তো মস্ত রূপকথার শামিল। সে রূপকথা বুঝি নেহাত মিথ্যে? শুধুই ছেলেমানুষি খামখেয়ালের পাঁচমেশালি? না কি রূপকথা সুখ-দুঃখের গল্পে মোড়া সত্যি-সমাজের সেই আরশিনগর, যেখানে জীবনের চলতি চিহ্নগুলোই উল্টো জলছবি আঁকে? নইলে আলি-ভুলির দেশের পাকা ইমারত খামোকা ধসে পড়ে কেন? কার ভয়ে লাল-কালো শামুকছানা খোলসের বাইরে আসে না আর? সত্যিই বুঝি পুলিশের সার্চলাইটের আলোর গরম পুড়িয়ে দেয় সন্ধেপরির নরম পাখা? ছোট্ট মেয়ে হিমানী অবাক হয়ে দেখে তার বন্ধু রাস্তায় কুড়িয়ে ফ্যান খায়, তিন দিন ভাত খায়নি সে!

কুসমির সঙ্গে সন্ধেবেলায় একটু-আধটু ‘গল্পসল্প’ করতে বসে রবি-দাদামশায় এক বার বলেছিল, “জগতে দুরকম পদার্থ আছে। এক হচ্ছে সত্য, আর হচ্ছে আরও-সত্য।” আর সেই দু’রকমের সত্যির মাঝের ছোট্ট ফাটলটায় সাদামাটা কেজো জীবনের গল্প জমে জমে যখন আচমকাই সাতরঙের ঝিলিক মারে, তখন তৈরি হয় রূপকথা! হতে পারে, সেই রূপকথা শুধু একা এক জনের, আবার হতে পারে সেই রূপকথা গোটা সময়টার। না হলে যে বাঙালি সমাজ বিশের দশকের গোড়ায় জাতি-আদর্শের রূপকথা সাজাতে অন্তর্মুখী হয়েছে বার বার, যে গল্পে কাঁকনমালা আর কাঞ্চনমালার বকলমে বাঙালি ঘরদুয়ারের লক্ষ্মীশ্রীর সাতসতেরো এঁকেছেন দক্ষিণারঞ্জন, যে দেশে রাজপুত্তুর-রাজকন্যে সুখে রাজ্যপাট করেছে হাজার বছর ধরে, সেই রূপকথাই কিনা বিয়াল্লিশের ভাঙা সমাজে ঘর ছাড়ার দিশা খুঁজেছে! ক্লান্ত, ধুঁকতে থাকা চল্লিশের কড়চায় যখন মানুষগুলো পরস্পরের প্রতি হিংসায় আক্রোশে আর বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে, আর প্রত্যেকটা মুহূর্তে অনেকখানি করে ক্ষয় করছে স্বপ্ন দেখার আদুরে মনটুকু; দুপুরে তার ভাত জোটেনি কত দিন, গায়ের জামা ছেঁড়া, আদর্শের অন্তরটাও ফোঁপরা হয়ে গেছে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের বিকট শব্দে আর খিদিরপুর ডকে বোমা পড়ার গল্পে, সেই মনের অর্থহীন ইচ্ছেগুলোকে খামোকাই একটু ঝাঁকিয়ে দিতে ‘দিনেদুপুরে’ বেমালুম হাপিশ হয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায়ই বা কী ছিল? তাই তো চল্লিশের বেআক্কেলে রূপকথায় রাজা-রানির সুখের গার্হস্থ নেই, রাজকন্যের নোংরা পাটকিলে চুলে দুটো বিনুনি, ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে বেজায় রোগা, গলায় পেতলের মাদুলি। আর রাজপুত্তুর? সে-ই বা রাজকন্যেকে বিয়ে করে কোথায় সংসার পাতবে? বরং সকাল সকাল ইশকুল যাওয়ার পথে কলু দেখেছে, রাজপুত্তুর মালকোঁচা মেরে সড়সড় করে নেমে যাচ্ছে রাস্তার খোলা গর্তে। ওখান থেকে কাদা তুলবে সারা দিন ধরে। রাজপুত্তুরের খোঁচা-খোঁচা চুল, হাসিটাও কেমন যেন মিচকে মতো, কলুকে দেখে এক বার চোখ মটকে বক দেখাল, কিন্তু কলু তাতে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। রাজপুত্তুরদের তো চার দিকে অনেক শত্রু, তাই তাদের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকতে হয় বইকি! সাধারণ লোকে কি আর তার সবটা জানে, বোঝে? কিন্তু কলু জানে, ওই গর্তটার মধ্যে যেখানে রাস্তার হাজারো কাদার সঙ্গে বুড়িগঙ্গার নোনাজল মিশেছে, আর পাশের গুদোমঘরের দেওয়ালের কোণ এক্কেবারে ঘেঁষটে আছে, সেখানেই আছে ওর লুকোনো রাজপ্রাসাদ। ওর নাম ‘পেরিস্তান’! রাজপুত্র এখন গরিব, তার হাতির দাঁতের পালঙ্ক নেই, সিংহাসনের চুনি-পান্নাগুলো অবধি স্যাঁকরাবাড়িতে বাঁধা দিতে হয়েছে, কিন্তু তার একটা মস্ত প্রবালের দ্বীপ আছে, দারুণ মিষ্টি আঙুরলতায় ঢেকে রাখা ফিরোজা নীল একখানা সমুদ্র আছে, লাল-নীল হীরেমন পাখির ঝাঁক আছে। সন্ধে হলেই সে দ্বীপের সামনে দিয়ে সুর করে মালগাড়ি যায়। শব্দ হয় ‘টং লিং টং লিং’।

লীলা মজুমদার পেরিস্তানের গল্প শুনিয়েছিলেন ষাটের দশকের এক্কেবারে গোড়ার দিকে। তত দিনে রাজনীতির নিয়মে স্বাধীনতা এসেছে বটে, সংবিধানে সব্বাইকে সমান ঘোষণাও করা হয়েছে, তাও কোথাও যেন মস্ত একটা গলদ থেকে গিয়েছে। কেউ খুশি হয়নি এতটুকুও। লোকে বলছিল, এমন স্বাধীনতা বেবাক ঝুটো, নেহাত পানসে। সমাজের ছোট-বড়র মিলমিশ হয়নি মোটে, বড়লোকেরা তাদের চিলেকোঠায় লুকোনো বর্মিবাক্সে ইয়াব্বড়-বড় সব মণিমুক্তো জড়ো করে রেখে বেমালুম চেপে গেছিল, আর গরিবঘরের প্যাংলা ছেলেগুলো পিঠে-পার্বণের দিনে একটু পায়েস খেতে চেয়ে কেঁদে-চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিল! স্বাধীনতার লড়াইয়ের দিনগুলোয় যে স্বপ্ন ছিল, মন ভাল করে দেওয়া কেমন একটা নেশার মতো ছিল, সেটুকু কবেই বাসি কপ্পুরের মতো উবে গিয়েছিল। তখন সমাজটায় একটা স্যাঁতসেঁতে ভোঁতা কষ্ট জড়িয়ে থাকত সারা দিন! তাই রুমু-বোগিরও সক্কাল-সক্কাল মন-খারাপ হত, আর ঝগড়ু ওদের দুমকার গল্প শোনাত সারাটা বেলা! কী ভাল জায়গা দুমকা, চার দিকে শাল আর সীতাহার গাছের জঙ্গল, শালবনে থেকে থেকে দমকা হাওয়া দেয় আর সাদা গুঁড়োর মতো রেণু ওড়ে! সকালে ঝিলমিলে রোদ, আর রাত্তিরে পাতা খসার শিরশিরে শব্দ!। সেখানে পার্টির মিটিং-মিছিল নেই, রেশনের লাইন নেই, ঝগড়া-মারামারি-নোংরা কথা নেই। সূর্য ডোবার আগে সেখানকার আকাশে হলদে পাখিরা খেলা করে, আর সেই ‘হলদে পাখির পালক’ যার গায়ে এক বার লাগে, কষ্ট আর তাকে ছুঁতেই পারে না কোনও দিন! রুমু-বোগি গলাগলি করে শুনত, দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে যেত, রাস্তার পাশে বকুলগাছটার তলায় একে একে জড়ো হত ফেমিন রেজ়িস্ট্যান্স কমিটি-র ছেলে-ছোকরারা। মাথার ওপর হলদে বসন্তবৌরি ডাকত। মাইকে ঘোষণা হত, পার্টির ত্রাণ তহবিলে কিছু টাকা এসেছে।আজ অভুক্ত মানুষগুলোকে দু’মুঠো ঘি-ভাত খাওয়ানো হবে!

এই ভাবেই কেটে গেল ষাট, সত্তর, আশির বছরগুলো। স্বাধীনতা পাওয়া ছোট্ট দেশটা হোঁচট খেতে খেতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল, তার মানুষগুলোও রোজকার অভাব-অভিযোগ-অভিমান পেরিয়ে, সংসারের ঊনকোটি-চৌষট্টি নাড়তে নাড়তে কেমন যেন বুড়ো হয়ে গেল! কত একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেল, গল্প বলার-শোনার লোকও বিশেষ রইল না। ব্যস্ত মানুষ তখন আর পাহাড়ি ঝরনার লাফালাফি দেখতে পেত না, কালবৈশাখীর দিনে বৃষ্টি-ফোঁটার নরম, সবুজ ভাপ টের পেত না, শালগাছের কোটরে শুঁয়োপোকাদের প্রজাপতি হওয়ার গল্পও জানত না। কুচকুচে রাত্তিরে লুব্ধক যখন মাঝ-আকাশে সাপের মাথার মণির মতো জ্বলজ্বল করত, তখন টেবিলের উপর শুকনো কাগজ ছড়িয়ে তারা রাস্তা সারাইয়ের চুনসুরকির হিসেব কষত। শক্ত শক্ত অঙ্ক করে বাঁধ তৈরির, নদী জোড়ার কসরত ভাবত। সেই করে কত তেপান্তর যে হারিয়ে গেল, কত ব্যাঙ্গমার ছানার ডানা ভেঙে গেল, কত রাজপুরী যে বাঁধের জলে তলিয়ে গেল, সে আর কী বলব! তখন শহরজোড়াই রাজার প্রাসাদ, কত ঘরে কত আলো— শিক্ষার, স্বাচ্ছন্দ্যের, সমৃদ্ধির। কিন্তু সে আলোয় জাদু ছিল না, তাই পরিরা আর আসত না! শীতকাতুরে আপেলবুড়ো একা-একা দাঁড়িয়ে থাকত ‘বনসবুজের দ্বীপে’। ছেলেমেয়েদেরও ইশকুলে পড়া থাকত, তার পর থাকত টিউশন। বুড়ো আপেলগাছের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলার সময় তাদের ছিল না। শেষে শৈলেন ঘোষের হাত ধরে কোত্থেকে এল ছোট্ট দুটো পাখি— জয় আর টুটু। শহুরে জীবনের কর্কশ দিনকাল পেরিয়ে, পাতি-জীবনের সঙ্কোচ পেরিয়ে তারা আপেলবুড়োকে এনে দিল একটুখানি ভালবাসা। পাখিদুটোও বেশি দিন থাকেনি এ শহরে। থাকবে কী করে? শহর জোড়া ইলেকট্রিকের তারে আর টেলিফোনের লাইনের কলকব্জায় খালি খালি ওদের পাখা কেটে যেত, রাতবিরেতে ইলেকট্রিকের ধাক্কায় ছোট্ট বুকটা ধুকপুক করত। ওদের তো আর আলি-ভুলির মতো বন্ধু ছিল না, তবে এক বার কোত্থেকে এক জন অদ্ভুত মানুষ এল! ঝাঁকড়া চুল, টানা-টানা চোখ, সারা দিন মিষ্টি গলায় কত রকম পাখির ডাক যে সে ডাকত! সত্যজিতের সেই ‘সুজন হরবোলা’ নাকি বড্ড পাখি ভালোবাসত। এক বার পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা রাক্ষস মেরে পাখিদের বাঁচিয়েওছিল। নইলে কী হত কে জানে? রূপকথার মতো পাখিগুলোও কি বেমালুম হারিয়ে যেত মানুষের জীবনের সত্যি থেকে?

রূপকথা বলে সত্যিই কিছু হয়? না কি বাস্তব বলে আদৌ কিছু আছে? কুসমির দাদামশায় মজা করে বলত, সত্যি আর রূপকথা একই মানুষের দুটো গল্প। মানুষের তো ক্ষমতা অনেক বেশি, তাই সে আপনা-আপনি নিজের সত্যিটা বদলে ফেলতে পারে। রোজ রাত্তিরে জ্যোৎস্নার স্রোত বেয়ে মেঘের খেয়ানৌকোখানা যখন পৃথিবীর ঘাটে এসে লাগে, তখন সে সারা দিনের ভাল-খারাপের শক্ত শক্ত অঙ্ক কষে ঘুমিয়ে পড়ে বলেই তো নৌকোখানা দেখতে পায় না। ভাবে, রূপকথা মিথ্যে বুঝি! অথচ তার সত্যি পৃথিবীতেই তো আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি নামে, টিনের চালে ঝমঝম শব্দ হয়, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বেরোয়, মাকড়সার ঝুলের আগায় ম্যাজিকের মতো ঝুলে থাকে জলের ফোঁটা, আঁস্তাকুড়ের ছাইয়ের গাদায় ফুটে থাকে গুণমণির থোকা থোকা সাদা ফুল। আর বোকা মানুষগুলো চোখ বুজে নিঝুম হয়ে থাকে। সেই অভিমানেই বোধহয় রূপকথা তাদের কাছে ঘেঁষে না। অথচ এই পৃথিবীতে মানুষ যে দিন জন্মাল, সে দিন থেকেই সে রূপকথা বুনেছে। ‘সত্যি’ জীবনের উপরে জমে থাকা রোজকার ধুলো ঝেড়েমুছে রূপকথাই মানুষকে তার ভিতরের সুন্দরটাকে চিনতে শিখিয়েছে, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। জলের টলটলে সবুজ চিনিয়েছে, সূর্যাস্তের লাল চিনিয়েছে। কষ্টের দিনগুলোয় আদরের ওমে জড়িয়ে তাকে সারিয়ে তুলেছে। বড় হয়ে মানুষ সে কথা অবিশ্বাসে উড়িয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু সে-ই আবার বুড়োবেলায় গল্প শুনিয়েছে নাতি-নাতনিকে। সে গল্পে হরিণগড়ের রাজপুত্তুর কখনও হয়ে গিয়েছে ডাকাতের মেজসর্দার, কখনও গোঁসাইবাগানের ডাকাত-ভূত নিধিরাম ছোট্টছেলে বুরুনের অঙ্ক কষে দিয়েছে মন খারাপ সারাতে! সময় আর সমাজের মনকেমনের দিনগুলোয় সেই মানুষই তো তার কেজো জীবনের লুকোনো কোটর থেকে বার করে এনেছে আশ্চর্য জাদুকরী সব মায়ামন্তর। কারণ শেষ পর্যন্ত মানুষও তো জানে, তার ইতিহাসের ‘সত্যি’ গল্পটাও নেহাতই একপেশে। সেও এখন মানে যে, সমাজের চলতি ইতিহাসের ‘সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয়’— সে কথা হলফ করে বলা বেজায় মুশকিল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement