ছবি: পিয়ালী বালা।
সত্যি! ভাবতে কেমন একটা লাগছে। সে দিনও ড্রয়িংরুমে বসে সেই রাধিয়া নামের মহিলাটি যখন কান্না-কান্না গলায় বিবরণ দিচ্ছিলেন, একদমই বিশ্বাস করতে মন চায়নি। মনে হয়েছিল সবটাই গালগল্প। আকিঞ্চন! তার আকিঞ্চন! এই রকম দেহের সম্পর্ক আর কত জনের সঙ্গে করেছে আকিঞ্চন? হয়তো রাধিয়া একাই নয়, আরও আছে। একটা জানতে পেরেছে, অনেকগুলো জানতেই পারেনি। আকিঞ্চনের লোকবল আর অর্থবলের কাছে সবাই চুপ করে গেছে। কস্তুরী আকিঞ্চনের টান-টান করে রাখা বিছানার চাদরে হাত বুলোতে লাগল। রোজ ঘুম থেকে ওঠা, সুপ্রভাত জানানো, মেয়ের দেখাশোনা করা, কোর্টে যাওয়া, বাড়ি ফেরা, টিভি দেখা, ফের শুয়ে পড়া— এই সবের মধ্যে আর এক জনের স্পর্শ ছিল এই ঘরের বিছানা-খাট-আলমারি-মেঝে জুড়ে? হা ঈশ্বর!
আজ অনেকদিন পরে আকিঞ্চনের খাটে গা এলিয়ে দিতেই নীচে বেল বাজল। ক্লাবের ছেলে না কি? আকিঞ্চনের কোনও খবর এল? বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এক সময় মনে হচ্ছিল, খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদলে হয়তো মেঘটা কেটে যেত। কিন্তু কান্না আসছে না। যা আসছে তা মিশুকের মুখ। ওর খিলখিল করে হেসে ওঠা, ছুটে এসে কোলে বসে পড়া, দেহের সঙ্গে দেহ মিশিয়ে হাঁটা, ‘বিচ্ছিরি লাগে’ বলে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করা... সব, সব। কেন, সেটা জানে না কস্তুরী।
“ইউ?” দরজায় মেহুলি, “তুমি? বাপির ঘরে?”
আজ মেহুলিকে দেখে কেন যেন খুব আদর করতে ইচ্ছে হল কস্তুরীর। রং চাপা হলে কী হবে, চোখেমুখে একটা আদুরে-আদুরে ভাব আছে মেহুলির। তার উপরে দুই বিনুনি করায় আরও বাচ্চা বাচ্চা দেখাচ্ছে ওকে।
কস্তুরী ভাবল, কত দিন হয়ে গেল মেয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়নি সে। আচমকা মনে পড়ায় সে বলল, “মেহু, দাঁড়া একটা জিনিস দেখাই তোকে।”
মা তার জন্য জিনিস নিয়ে এসেছে! মাকে তো বাপি এক বার বারণ করেই দিয়েছে। তার পর থেকে কত দিন তার জন্য কিছু কেনে না মা। অবশ্য দরকারও পড়ে না। বাপি তাকে যা হাতখরচ দেয়, সাফিশিয়েন্ট। তার পরেও লাগলে বাপি কিনে এনে দেয়। সে বস্তুত অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
কস্তুরী ড্রয়িংরুমে এসে মিশুকের দেওয়া প্যাকেটটা খুলে ড্রেসটা বার করে হাতে ঝুলিয়ে বলল, “পছন্দ?”
মেহুলি থমকায়, “তুমি কিনেছ?”
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল কস্তুরী, “নাঃ, আমি নই। তোর এক দিদি পাঠিয়েছে।”
“আমার দিদি! কোথাকার দিদি?”
“সে তুই চিনবি না। পছন্দ?”
কস্তুরী দেখল মেহুলি হাতে ধরে কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে ড্রেসটাকে, “রিয়্যালি বিউটিফুল। এটা আমি নেব?”
“শিয়োর মেহু। তোর জন্যই। তোর সেই দিদির সঙ্গে এক দিন আলাপ করিয়ে দেব। আমাকে কী দিয়েছে দেখবি?”
“কী?”
কস্তুরী জুতোর ব্যাগ খুলে দেখাল। এ বার খিলখিল করে হেসে ফেলল মেহুলি। ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কস্তুরী। এত সুন্দর করে মেহুলি হাসতে পারে? কত দিন ওকে হাসতে দেখেনি কস্তুরী। মেহুলি হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়ল। হাসি থামিয়ে বলল, “এটা তুমি পরবে মাম্মা?”
মাম্মা! এটাও বহু যুগ পরে কানে ভেসে আসা শব্দ! সে বলল, “একটু শাড়ি নামিয়ে পরলে দেখা যাবে না, বল?”
“সে তো পরের কথা। এগুলো কে দিল শুনি? আমার তো কোনও দিদির কথা মনে আসছে না।”
“বললাম না পরে বলব।”
কস্তুরীকে আরও চমকে দিয়ে তার পাশটি ঘেঁষে বসে মেহুলি বলল, “আমিও তোমাকে পরে বলব এক জনের কথা।”
“সে কী রে? আগে জানতে পারিনি তো। অবশ্য কত দিন পরে যে মন খুলে কথা বলছিস।”
“সে তো তুমিও।”
“তা সে কে? ইয়াং, হ্যান্ডসাম, টল ওয়ান? নাম?”
“স্বর্ণেন্দু মুখার্জি।”
“খুব সেকেলে নাম যে রে।”
“লোকটাই তো সেকেলে।”
“মানে?” হতভম্ব হয়ে গেল কস্তুরী।
“আরে দূর! বয়ফ্রেন্ড নয়। আঙ্কল টাইপ। ওর একটা মেয়ে আছে, কোথায় আছে জানা যায় না। নাম পৌষালী। আর কী জানতে চাও? একটা ড্রাইভার আছে। নাম মানিক। বাড়িতে রান্নার লোক আছে। নাম বাসুর মা। উনি রাইটার। থাকেন জ্যাংড়ায়। অ্যান্ড লাস্টলি, আমি ওকে ডাকি বাবি বলে। উনি প্রায় আমার বাবার বয়সি। আমাকে মেয়ের মতো দেখেন। ইন ফ্যাক্ট, মেয়েই ভাবেন।”
“কী কাণ্ড! এক দিন আলাপ করা।”
“আরে তোমরা দেখেছ ওঁকে।”
“দেখেছি!”
“সেই যে ভদ্রলোক গাড়ি করে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন বাড়িতে, মনে পড়ছে না?”
“ওহ, উনি? ভদ্রলোককে আগে থেকে চিনতিস? না, এই জন্য বলছি যে, সে দিন কোনও খবরাখবর না দিয়েই ভদ্রলোকের সঙ্গে এক রাত দিব্যি কাটিয়ে এলি? তুই কী রে মেহু! আমি হলে কিন্তু পারতাম না। চিনি না জানি না। আর তেমন চেনাজানা থাকলেও... হ্যাঁ রে, ওই ছেলেটার খবর কী রে? ওই যে লম্বা...”
“তুমি কত সহজে বললে, ভদ্রলোক। কী করে জানলে ইনি ভদ্র? মানে জেন্টলম্যান?”
নরম হাসিতে ভেঙে পড়ল কস্তুরী। দু’-একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া আজকের দিনটা একদম অন্য রকম। পর পর ব্যাপারগুলো যেন স্বপ্নের মতো। যেন স্বপ্নটা এইমাত্র ভেঙে যাবে আর শুনতে পাবে আকিঞ্চন বলছে, “চা-টা কি হবে, না, হবে না?” অথবা আলপনা বলছে, “দেখেছ কাণ্ড, তুমি নিশ্চয় চন্দনকে বলেছ মুলো আনতে, আর দেখো, নিয়ে এসেছে রাঙাআলু।”
স্বপ্নই তো। স্বপ্নের মতো একটা দিন। স্বপ্ন কি শুধু ভালই হয়? দুঃস্বপ্নের মতো আকিঞ্চনের জেলযাত্রা, তার পর সুখস্বপ্নের মতো প্রিয় এক জন অভিনেত্রীর সঙ্গে মা-মেয়ের মতো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সারাটা দিন কাটানো, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে মেহুলির অন্তরঙ্গ আচরণ! কার মুখ দেখে উঠেছে আজ সে?
কস্তুরী হাসি থামিয়ে বলল, “ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে এই-ই হয়। আরে বাবা, বাংলায় সবাইকেই ভদ্রমহিলা, ভদ্রলোক বলে। আর খারাপ হলে বদলোক। মানে, যত ক্ষণ না জানতে পারছি লোকটা বদলোক, তত ক্ষণ সে ভদ্রলোক। সিম্পল।”
মেহুলিও এক চোট হেসে নিল, “হাউ ফানি!”
কস্তুরী নিশ্চিত জানত এক দিন আকিঞ্চনের ভুল ভাঙবে, ভাঙবে মেয়ে নিজেও। কস্তুরী হাত বাড়িয়ে মেহুলির চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগল।
“মাম্মা, আমাদের এক পিসি আয়ারল্যান্ডে থাকে না?”
“হুম। জবাদিদি। হঠাৎ?”
“আয়ারল্যান্ডের কোথায় মা? অ্যাড্রেস জানো?”
“আমি ক্লিয়ারলি জানি না। বাপি জানতে পারে। আচমকা জবাদিদির খোঁজ পড়ল কেন?”
“ভাবছি আয়ারল্যান্ডে বেড়াতে যাব। তাই যদি সেই চান্সে...”
“তুই আয়ারল্যান্ড যাবি? কার সঙ্গে?”
“মুখার্জি আঙ্কলের সঙ্গে।”
“কে মুখার্জি আঙ্কল!”
“উফ, মাম্মা। তোমাকে বললাম না স্বর্ণেন্দু মুখার্জির কথা?”
“হোয়াট!”
আচমকা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল কস্তুরীর। মেয়ে কী বলছে? মাথার ঠিক আছে তো? ভদ্রলোককে সে দিন এক বার দেখেছে সে। মেহুলির বাবার বয়সি কি তার চেয়েও বড় হবে। দেখে অবশ্য খারাপ বলে মনে হয়নি। কিন্তু এক বার দেখে মানুষ চেনা যায়? ভাবতে গিয়ে কস্তুরী অন্যমনস্ক হল। এতগুলো বছর আকিঞ্চনের সঙ্গে কাটিয়েও কি তাকে চিনতে পারল কস্তুরী? চিনতে পারলে কি আজকের সকাল তাকে দেখতে হত?
কিন্তু তাই বলে একটা অচেনা লোকের সঙ্গে মেহুলি বাইরে যাবে? হয় না কি? অসম্ভব। আকিঞ্চন জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে। কস্তুরীর মাথা গরম হয়ে উঠল। লোকটাকে এক্ষুনি নাগালে পেলে যাচ্ছেতাই করত। কস্তুরী নিশ্চিত হল তার বোকা মেয়েটার কাছে বাবা-কাকা সেজে আসলে নোংরা ফায়দা লুটতে চাইছে বদমাশটা। মেহুলির বয়সের ছেলেমেয়েরাই এই সব ফাঁদে পা দেয়।
“কী ভাবছ মাম্মা? যাই? বেশি দিন তো, জাস্ট...”
“স্টপ। কী হচ্ছে কী মেহু? নিউজ়পেপারগুলো পড়ো তুমি? কত মেয়ে এদের ট্র্যাপে বিদেশে চালান হয়ে গেছে। আর ফিরতে পারেনি।”
“হিহিহি... আঙ্কল তেমন মানুষই নয়। আমাকে একেবারে নিজের মেয়ে মতোই দেখে। জানো, ওঁর মেয়ে নিউ জ়িল্যান্ডে...”
কস্তুরীর গলা বরফশীতল, “মেহু। তোমার বয়স অল্প। বোঝার চেষ্টা কর। কলেজ থেকে নিয়ে গেলে আমি আপত্তি করতাম না। কিন্তু এক জন আননোন পুরুষের সঙ্গে… নেভার।”
নিমেষে ঝটকা মেরে মেহুলি উঠে দাঁড়াল, “মাম্মা, জেনে রাখো, আঙ্কল আমাকে কিছুই বলেনি। উল্টে ডিসকারেজ করেছে। আমিই আঙ্কলকে যেতে রাজি করিয়েছি। আঙ্কলের তো, আফটার অল, তোমাদের মতো ডার্টি মাইন্ড নয়। আঙ্কল আমার কাছে ফাদার ফিগার।”
হতভম্ব কস্তুরী দেখল, হনহন করে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে মেহুলি। কস্তুরী ভাঙা গলায় ডাকল, “মেহু, তোর ড্রেসটা নিয়ে যা।”
নিমেষে ঘুরে দাঁড়াল মেহু। কস্তুরী দেখল মেহুলির নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, “আর ওই মেয়েটা কে? যার কাছে যাচ্ছ? যে এগুলো দিয়েছে? সে তোমার কে হয়? আমি কি কিছু জানি না? তার সঙ্গে তো তোমার কোনও ব্লাড রিলেশন নেই?”
“কী বলছিস?”
“আমি সব জানি। সাহিনার দাদা এই প্রফেশনে আছে। হি ইজ় আ প্রোডিউসার। কত মেয়ের সঙ্গে যে ওর দাদা... এই মেয়েগুলো টাকার জন্য সব পারে।”
“মেহু!”
“আমাকে ধমকে কী হবে? বাপির ব্লান্ডারটা আমি জানি না ভেবেছ? সব জানি। ইউ অল আর বিচ... শুধু আমি কিছু বললেই…”
“মেহু!”
এই বার বুঝি সব ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। চিৎকার করে উঠল কস্তুরী। মুহূর্তে মনে হল দেহের সব রক্ত মাথায় উঠে এসেছে। ছি ছি ছি! এ সব কী ডায়লগ। কাদের সঙ্গে মিশছে মেহুলি? নিমেষে এ যাবৎ যা করেনি তা-ই করতে মেহুলির দিকে ছুটে গেল কস্তুরী। সময়মতো মাথা সরিয়ে না নিলে চড়টা ঠিক বাঁ গালে গিয়ে পড়ত। প্রথমে বেশ খানিকটা অবাক, শেষে বিদ্যুদ্বেগে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল মেহুলি। কস্তুরী আর পারল না। সোফায় ফিরে এসে ধপ করে বসে পড়ল। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল সে। তার পর কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই।
এর পর ঠিক তিন মাস কেটে গেছে। পুজো এল, চলেও গেল। কস্তুরী নিজে দু’-এক বার জেলে গিয়ে আকিঞ্চনের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। নিজের ইচ্ছে ছিল না, শুধু শ্যামলেন্দু চেয়েছিল বলেই। ক্লাবের ছেলেরাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বারদুয়েক উকিলের সঙ্গেও কথা বলেছে কস্তুরী, যদিও উকিল ভদ্রলোক তেমন কোনও আশার আলো দেখাতে পারেননি। সব এভিডেন্স আকিঞ্চনের বিরুদ্ধে। রাধিয়ার ফ্ল্যাট থেকেও প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের সম্পর্কের। রাধিয়ার স্বামী আদিনাথ শ্রীবাস্তবও এখন পুলিশি হেফাজতে।
জেলে গিয়ে আকিঞ্চনের হাল দেখে খানিকটা চমকে গেলেও মুখের ভাব যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে কস্তুরী। মুখে তিন মাসের না-কামানো-দাড়ি, মাথার চুলে কত দিন চিরুনি পড়েনি। প্রথম দর্শনে কান্না এসে যাচ্ছিল কস্তুরীর। সামলে নিয়েছিল। তবে হাবভাবে বেশ ভেঙে পড়েছে আকিঞ্চন, বোঝা যাচ্ছিল।
কস্তুরী জিজ্ঞেস করেছিল, “কেমন আছ?”
একটা কষ্টকে চেপে রাখতে গিয়ে মুখটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। আকিঞ্চন একটা অদ্ভুত চোখে কিছু ক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করেছিল, “মেহু কেমন আছে?”
কস্তুরী উত্তর দেয়নি। আকিঞ্চন ফের বলা শুরু করেছিল, “বিশ্বাস করো, আমি...”
কস্তুরী আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিল।
মেহুলি এর মধ্যে একটাও কথা বলেনি কস্তুরীর সঙ্গে। আশ্চর্য! দুটো মানুষ একই বাড়ির একই ফ্লোরে আছে অথচ কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না।
ক্রমশ