ছবি: পিয়ালী বালা।
পূর্বানুবৃত্তি: প্রিয় অভিনেত্রী মিশুকের সঙ্গে মুখোমুখি কথা হল কস্তুরীর। তার নিয়ে যাওয়া চকলেট নেয় মিশুক। খানিক ক্ষণ কথাবার্তার পর শুটিংয়ে ডাক পড়ে মিশুকের। বিদায় নেয় কস্তুরী। সে আর কারও সঙ্গে দেখা করতে চায় না শুনে মনে মনে অবাক হয় মিশুক, তার ভালও লাগে। অন্য দিকে, উপন্যাস লিখতে লিখতে স্বর্ণেন্দুর মনে পড়ে মোহরদার কথা। বড় দাদার মতো আগলে রাখতেন স্বর্ণেন্দুকে। তাঁর জোরাজুরিতেই স্বর্ণেন্দুর উপন্যাস লেখার শুরু। প্রথম উপন্যাস মোহরদাই ছাপিয়েছিলেন পূজাবার্ষিকীতে। উপন্যাস বেরনোর পর মোগলাই খাইয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বর্তমান উপন্যাসটার শব্দসংখ্যা প্রায় পঞ্চান্ন হাজার ছাড়িয়েছে। ইচ্ছে আছে আশির কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে থেমে যাওয়া। আচমকা মেহুলির মুখটা মনে ভেসে উঠল। অল্পস্বল্প নয়, বেশ কয়েকটা ঢিলে বল্টু মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। নইলে কেউ বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে এই অন্ধকার মাঠ ধরে ছুটে আসতে পারে? আরএকটা সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে রাত কাটানো? আচ্ছা, সেই যে মেয়েটার বাড়ি থেকে ঘুরে এল, তার পর তো মেয়েটার সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি। এক বার দেখবেন না কি ফোন করে? কতই বারাত হয়েছে? কী ভেবে মোবাইলটা বার করলেন পকেট থেকে।
“হ্যালো।”
“আঙ্কল? হোয়াট আ স্প্লেন্ডিড সারপ্রাইজ়। কেমন আছ?”
এর মানে মেহুলি তার নাম্বারটা সেভ করে রেখেছে! স্বর্ণেন্দু বললেন, “ভাল আছি রে। তুই কেমন আছিস মেহুলি?”
কিছু ক্ষণ নীরবতা। স্বর্ণেন্দু অবাক হয়ে বললেন, “কী হল রে?”
“আপনি ভুল নাম্বারে কল করেছেন।”
“মানে?”
“আমি তো মেহুলি নই। আমি পৌষালী। ঠিক কি না?”
এক লহমায় চোখটা ভরে গেল স্বর্ণেন্দুর। পৌষালী! তাঁর একমাত্র মেয়ে। এত দিনে নিশ্চয়ই মেহুলির মতো বড় হয়ে গেছে। আছে, এই পৃথিবীর কোনও এক জায়গায়, তবে কোথায় সেটা জানা নেই। জীবন যত সায়াহ্নের দিকে এগিয়ে যায়, মানুষ ততই নিজের সন্তান-সন্ততির কাছাকাছি থাকতে চায়। তার এমন কপাল, স্ত্রী-সন্তান থেকেও নেই। মেহুলিকে ঘিরে একটা স্বপ্ন দানা বাঁধতে যেতেই নিজেকে ধমকেছিল স্বর্ণেন্দু। আবার! আবার লোভ! তবুও মানুষের মন। সে দিন ফেরার সময় আর সামলাতে পারেননি তিনি। বলেই ফেলেছিলেন, “তুই আমার পৌষালী হবি?”
পরে ভেবেছেন মেয়েটা হয়তো ধরতেই পারেনি তাঁর আবেগটুকু। ভালই হবে ভুলে গেলে। অথচ এত দিন পরেও মেয়েটা ঠিক মনে রেখেছে! স্বর্ণেন্দু ধরা গলায় বললেন, “তুই মনে রেখেছিস? তুই...”
কথা শেষ করতে পারলেন না স্বর্ণেন্দু। চার দিক যত সঙ্কীর্ণ হয়ে আসে, মানুষের মন ততই ক্ষুদ্র হয়ে আসে। উদাত্ত প্রকৃতির মাঝে বসবাসকারী মানুষজনের মন সেই জন্য উদার হয়। আজ এই মুহূর্তে মাতাল বাতাসে এত বড় নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে স্বর্ণেন্দু হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন।
মেহুলি প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও সময় দিল সব কষ্টগুলোকে এক এক করে বার করে দেওয়ার জন্য। আহা, মেয়েরা কথায় কথায় কেঁদে ফেলে হালকা হয়। পুরুষেরা পারে না। কাঁদুক, আঙ্কল কাঁদুক। সে সবটা ঠিক জানে না, তবে সে দিন তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে আসার আগে এই মানুষটার শেষ কথাগুলো নিয়ে সে নাড়াচাড়া করেছে অনেক। নিজের মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে মানুষটা। আবার খানিকটা মজাও পেয়েছিল। যে পুরুষমানুষ বৌকে ধরে রাখতে পারে না, সে আবার কিসের পুরুষ? কিন্তু পরে মনে হয়েছে দুর্ভাগ্য সেই ভদ্রমহিলার, যে স্বর্ণেন্দুর মতো মানুষকে ভালবাসতে পারেনি।
“কেন কষ্ট পাচ্ছ? আমি তোমার পৌষালী নই?”
“হ্যাঁ রে, মা। তুই-ই তো আমার পৌষালী। যাকগে, বাদ দে, ও সব কথা তুলে লাভ কী? ও সব আমি ভুলে গেছি। তোর কথা বল।”
“হ্যাঁ, তুমি সব ভুলে গেছ। এখনই আরও বেশি করে বুঝতে পারলাম। যাক, এখন কোথায় আছ?”
“সেই ওসমানের ডেরায়। লিখছি।”
“লিখে ফাটিয়ে দাও। এখন কেন ফোন করেছ বলো তো?”
“পার্টিকুলারলি কিছু না। অনেক দিন কথা হয় না... মানে...আসলে...”
“মেয়েকে মিস করছ তো?”
ফের গলা বুজে এল স্বর্ণেন্দুর। কোনও মতে বলতে পারলেন, “এখন কী ইচ্ছে করছে জানিস?”
“হুম। জানি।”
“জানিস?”
“হুম। জানি তো। এখন তোমার ইচ্ছে করছে আমাকে একটা হাগ করে কপালে একটা কিস করতে। রাইট?”
হেসে ফেললেন স্বর্ণেন্দু, “ধরে ফেলেছিস পাগলি। আচ্ছা এক দিন আসছি তোর বাড়িতে। না কি কলেজে? না কি...”
“তোমার ভাবতে ভাবতেই মাস যাবে। দেখা হচ্ছে ওসমানের ডেরায়।”
“এখানে আসবি? কবে?”
“বোঝো! তোমার এখন ইচ্ছে করছে আমাকে দেখতে, আর আমি কি দু’মাস পরে আসব?”
“মানে...”
“মানে আমি আসছি। ওয়েট।”
“এই... এই... না... শোন...”
বৃথা। ফোন কেটে গেছে। মেয়েটা সত্যি আসছে না কি? কী কাণ্ড! হতভম্ব হয়ে সামনের ফলন্ত ফুলকপিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন স্বর্ণেন্দু।
তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। এই তিন সপ্তাহে আলাপ আরও বেশ এগিয়েছে। মিশুক তার ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে বার দুয়েক ফোন করেছিল। কী মিষ্টি গলা! তবে সমস্যা একটাই। মেয়েটা এত আস্তে কথা বলে যে, মোবাইলটা কানে একেবারে ঠেসে না ধরলে সব কথা বোঝা মুশকিল।
অফিসের একমাত্র অদ্রিজা জানে তার এই অভিযানের কথা। জানেন আর এক জন। শ্যামলেন্দু রায়। সব শুনে দৃষ্টিহীন শ্যামলেন্দুর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। দৃশ্যত বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। এই মানুষটাকে এই জন্য বেশ লাগে কস্তুরীর। আধুনিক সব কিছুর প্রতি নাক-উঁচু ভাব একেবারেই নেই।
সব শুনে তিনি বলেছিলেন, “যোগাযোগটা রেখো।”
তিনি শুনিয়েছিলেন লীলা দেশাইকে প্রথম চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা। কস্তুরী চমৎকৃত হয়েছিল। সেই কোন যৌবনকালে কালিম্পং-এর পাহাড়ি রাস্তায় দেখেছিলেন তাঁর স্বপ্নের নায়িকাকে, আজও মনে রেখেছেন!
এক দিন লাঞ্চের পর অফিসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে লেজার দেখছে কস্তুরী, ফোনটা এল। স্ক্রিনের উপর ‘মিশুক’ নামটা ফুটে উঠতেই উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল সে। তার মুখ থেকে “ও মা, মিশুক মুখার্জি!”
বেরিয়ে আসতেই অদ্রিজা বলল, “নে, এ বার নেচে নে কয়েক পাক।”
কস্তুরী ঠোঁট বেঁকাল। অদ্রিজাটা যেন কেমন! ও বোধহয় মাধুরী দীক্ষিতের ফোন এলেও বলবে, “এতে আর এমন কী, এক জন মহিলাই তো!” তবু অদ্রিজা তার প্রাণের বন্ধু।
বাইরের দোতলা আর তিনতলার সিঁড়ির সন্ধিস্থানে দাঁড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করেছিল কস্তুরী।
“আমি মিশুক।”
“হ্যাঁ... মানে বলো।”
“আপনি আজ এক বার প্রিন্সেপ ঘাটেআসতে পারবেন?”
“আ-আমি? ক’টার সময়?”
“এই ধরুন চারটে। প্রবলেম হবে?”
প্রবলেম! এক বার বিভাস দত্তের মুখটা ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। প্রবলেম যাই হোক, যেতেই হবে। সে বলল, “না, প্রবলেম কী?”
“গুড। তা হলে আসুন।”
“তোমার শুটিং শেষ?”
“আজ আমার অফ। আমি বাড়ি থেকে আসছি। আচ্ছা বাই।”
লাইনটা কেটে যেতেই তড়িঘড়ি বিভাস দত্তর কেবিনে ঢুকল কস্তুরী। যথারীতি মিষ্টি হেসে বিভাস দত্ত মনে করিয়ে দিল, কস্তুরীর হাতে কত কাজ পেন্ডিং। যতটা সম্ভব করুণ মুখ করে কস্তুরী জানাল, তাকে যেতেই হবে, খুব দরকার।
নিমরাজি হয়ে গেল দত্ত। তবে নিদান দিল, যাওয়ার আগে কালকের ভাউচারগুলো কমপ্লিট করে যেতে হবে। যাক। সিটে ফিরে এসে দ্রুত হাত চালাল কস্তুরী। এত্ত ভাউচার! শেষ হবে সাড়ে তিনটের মধ্যে? অদ্রিজা বলল, “যতটা পারিস কর। বাকিটা আমি মেরে দিয়ে মেল করে দেব। তবে ভুল করিস না ভাই। তা হলে আমার বারোটা বাজবে।”
বেরোতে বেরোতে তিনটে চল্লিশ বেজে গেল। পড়িমরি করে সে একটা অ্যাপ-ক্যাব ডেকে পৌঁছে গেল প্রিন্সেপ ঘাট। বাপ রে! আজ দিন বুঝে রাস্তায় বীভৎস জ্যাম! রাজনৈতিক দলের মিছিল বেরিয়েছে। প্রিন্সেপ ঘাটের চত্বরে ঢুকল চারটে পনেরোতে। চেনা কেউ নেই।
মিশুককে একটা ফোন করবে কি না ভেবে মোবাইল বার করতেই দেখল গোটা ছয়েক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। তার মধ্যে মিশুকেরটা খুঁজে নিয়ে দেখল, “হেভি রাশ। কামিং। ওয়েট ফর মি।”
যাক বাবা! বাঁচা গেছে। এখনও এসে পৌঁছয়নি। সে ‘ওকে’ লিখে এক প্যাকেট বাদাম কিনে টুকটাক মুখে ফেলতে লাগল। এখান থেকে বিদ্যাসাগর সেতুটাকে দিব্যি দেখা যায়। কী দারুণ একটা ব্রিজ আছে কলকাতার। সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, এক থাবায় হাতের ঠোঙা কেউ কেড়ে নেওয়ায় নিদারুণ চমকে গেল কস্তুরী।
সভয়ে তাকিয়ে দেখল মিশুক! মুচকি নয়, একেবারে খিলখিল করে হাসছে মেয়েটা। কী ভাল যে লাগছে মেয়েটাকে! মুখে খুব সামান্য মেকআপের টান। হালকা লিপস্টিকের লাইনার। একটা হলুদ-সাদা শাড়ি পরেছে, লাল ব্লাউজ়। চুল ছেড়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে সদ্য স্নান করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ওর অবাক-ভাবটা উপভোগ করতে করতে মিশুক বলল, “তোমাকে কী নামে ডাকব বলো তো?”
থমকে গেল কস্তুরী। তবে সত্যি, এটা একটা ব্যাপার বটে। মনটা আচমকা পিছিয়ে গেল। সত্যি তো, আজ অবধি কস্তুরীকে অন্য নামে কেউ ডাকেনি। প্র্যাকটিক্যালি কস্তুরীর অন্য কোনও নামই নেই। তবে মিশুক আচমকা ‘তুমি’তে নেমে আসায় বুকটা আচমকা বেশ হালকা হয়ে গেল।
“যাব্বাবা! একটা কোয়েশ্চেনে পুরো ফেড-আউট হয়ে গেলে যে!”
কস্তুরী কিছু বলতে যাচ্ছিল, একটা ভরাট পুরুষকণ্ঠে চমকে গেল, “আচ্ছা, আপনিকি ম্যাজিক জানেন?”
“স্যরি?”
“না মানে, আপনি না জানলেও ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেঁটে যদি...”
একটি ছেলে। মুখে হালকা দাড়ি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো নয়। পরনে ফর্মাল ড্রেস। হাতে গোটা দুয়েক আংটি আর একটা স্টিলের বালা। কানে আবার একটা হিরের কুচি। বেশ দেখতে ছেলেটি। কস্তুরী কী জবাব দেবে ভাবার আগেই মিশুক ঠাঁই করে একটা চড় বসাল ছেলেটির পিঠে। ছেলেটি ছদ্ম-আহত হওয়ার ভান করে বলল, “মারছিস কেন? ভুলটা কী বলেছি?”
মিশুক বলল, “আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ও হল শয়তান।”
কস্তুরী চমকে গিয়ে বলল, “শয়তান! মানে?”
ছেলেটি হেসে বলল, “লোকে একে মিশুক নামে চেনে ঠিকই, আসল নাম পাগলি, স্বভাবেও। ওর কথা বাদ দিন। আমি সব্য। সব্যসাচী বাগচী।”
সব্যসাচী হাত তুলে নমস্কার করল। ইম্প্রেসড হল কস্তুরী। আজকাল ছেলেমেয়েরা অযথা অচেনা লোকদের পায়ে হাত দেয় না। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত লাগে কস্তুরীর। সেও প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলল, “ম্যাজিকের ব্যাপারটা তো বুঝলাম না।”
কস্তুরী দেখল মিশুক মিটিমিটি হাসছে। সব্য কিন্তু বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, “চলুন বসি আমরা, নইলে গপ্প জমবে কী করে?”
ওরা প্রিন্সেপ বিল্ডিং-এর পিছনে বসল। প্রথম মুখ খুলল সব্যসাচী, “ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, আমি নিনিকে এমন করে কোনও দিন দেখিনি।”
কস্তুরী বিস্মিত হল, “নিনি কে!”
“ওহ, সরি, মিশুকের কথা বলছিলাম।”
“তুমি ওকে নিনি বলে ডাকো? স্যরি, তুমি বললাম বলে, কিছু মনে কোরো না ভাই।”
“ইট’স ওকে। তুই বললেও চলবে। আমিও কিন্তু বেশি ক্ষণ আপনি-তে থাকব না।”
“তা না হয় হল, কিন্তু ওই ব্যাপারটা কী?”
“হুম। দেখুন আমি নিনিকে চিনি আজ প্রায় সত্তর বছর। তাতে...”
ফের একটা কিল পড়ল সব্যসাচীর পিঠে। সে বলল, “কথায় কথায় মারিস কেন? তা যা বলছিলাম। নিনিকে চিনি বছর দুয়েক হল। এই দু’বছর ইম্প্রেশন দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেও যখন ফেল করলাম, ওর ফ্রেন্ড হিয়ান্তিকাকে ধরলাম। তবে মেয়ে কিছুটা আমার কথা শুনল।”
হাত তুলল মিশুক, “অবজেকশন। এখনওশুনি না।”
সব্য সে কথায় কান না দিয়ে বলে চলল, “আমি যতটা নিনিকে চিনেছি, তাতে ও কিন্তু এত সহজে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। আন্টি,আমি সারপ্রাইজ়ড।”
কস্তুরী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই মিশুক বলল, “আমি এ রকমই।”
সব্য বলল, “বিলিভ মি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে হিয়ান্তিকার সঙ্গে কথা বলে দেখবেন। এই জন্য জানো আন্টি, ওর কোনও বন্ধু নেই?”
মিশুক বলল, “খালি বাজে কথা।”
সব্য বলল, “বাজে কথা? আন্টি, বিশ্বাস করো, এটা ফ্যাক্ট। তাই প্রথম যখন আপনার কথা শুনলাম, বিশ্বাস করতেই পারিনি।”
কস্তুরী স্মিত হেসে বলল, “কিন্তু কেন? মিশুক এমন কেন?”
সব্য বলে, “আসলে সভ্যতার আদিকাল থেকেই ও ওই রকমই।”
মিশুক বলল, “তুই আমাকে ছোটবেলায় দেখেছিস না কি? আমি বলছি। আন্টি, আমি বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট টাইপের। আমার বন্ধু বলতে হিয়া। ওই যাকে সব্যসাচী হিয়ান্তিকা বলল। কেন কে জানে, মানুষের সঙ্গে আমি মিশতেই পারি না। কেমন বাধো-বাধো লাগে।”
সব্যসাচীর একটা ফোন এল। সে ‘এটাকে নিয়ে নিই?’ বলে উঠে চলে গেল।
মিশুক বলল, “দূর! আসল কথাটাই হচ্ছে না।”
“কোনটা?”
“তোমাকে কী নামে ডাকব? ভেবেই পাচ্ছি না। আর হ্যাঁ। আমাকে আর তুমি নয়, তুই।”
হঠাৎই কস্তুরীর চোখ সামান্য ভিজে এল। আচমকা মনের পর্দায় মেহুলির মুখটা ভেসে এল। সে বলল, “কাছে আয়।”
অমনি কস্তুরীর কোল ঘেঁষে বসল মিশুক। কস্তুরীর চোখ আরও ভিজে এল। ক’ঘণ্টার আলাপ! এর মধ্যেই তার প্রিয় অভিনেত্রী... এখন অবশ্য ওর প্রতি কোনও সেলিব্রিটি ফিলিংস আসছে না। একদম নিজের মেয়েটি যেন। কতকাল হয়ে গেল মেহুলি তার কাছ ঘেঁষে না। আচ্ছা, এটা কি সেই শূন্যস্থান পূরণ? নিজের মনকে প্রবোধ দিল কস্তুরী। সব মায়েরাই সন্তানদের গা ঘেঁষে থাকতে চায়। নিজে মা হলে মেহুলিও বুঝবে।
“তুমি বড্ড ভাবো। কী ভাবো এত?”
কস্তুরী এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না। সে ডান হাত দিয়ে মেয়েটিকে আরও জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে নিয়ে এল। মিশুককে বয়সের তুলনায় আরও বাচ্চা লাগে। বড় ভাল লাগছে কস্তুরীর। মনে হচ্ছে এই সন্ধেটা এই ভাবেই কেটে যাক। রক্তের সম্পর্ক নেই, শুধু মনের সম্পর্কের বন্ধন আছে, এমন কাউকে বুকের কাছাকাছি জড়িয়ে রাখতে যে কতটা ভাল লাগছে, এটা লক্ষ শব্দ খরচ করেও বোঝানো যাবে না। ঈশ্বরের কী আশ্চর্য ইচ্ছে!
কস্তুরীর মনে হল মিশুককে কোনও দিনই হয়তো আর অ্যাকট্রেস বলে ভাবতে পারবে না সে। মিশুক তার মেয়ে, তার নিজের মেয়ে।
ক্রমশ