ছবি: পিয়ালী বালা।
পূর্বানুবৃত্তি: মেহুলি তার বন্ধুদের নিয়ে ঘর বন্ধ করে নেশা করছিল, তা নিয়ে কিছু বলা হলে, ঠাকুরমাকে অশালীন ভাষায় উত্তর দিয়েছে, সে সব জেনেও তাকে তেমন কিছু বলে না আকিঞ্চন। সারা দিন নিজের কাজকর্ম, মা-বাবার প্রতি রুটিন দায়িত্ব পালন, ক্লাব, বিনোদন নিয়েই ব্যস্ত থাকে সে। স্ত্রী কস্তুরীর দিকে তাকানোর কথা মনে পড়ে না তার। দুর্বার গতিতে উপরে উঠছে আকিঞ্চন। যোধপুর পার্কে বাড়ি, দুটো গাড়ির পরও আঠারো না-পেরোনো মেয়ের জন্য সে স্কুটি কিনেছে।
কস্তুরীর মনে আছে, প্রথম বার মাইনে পেয়ে সে বরের জন্য একটা ব্র্যান্ডেড শার্ট কিনেছিল, আর মেয়ের জন্য বারমুডা। ভেবেছিল পরের দিন শ্বশুর-শাশুড়ির জন্যও কিছু না কিছু একটা কিনে আনবে। কিন্তু সেই রাতেই আকিঞ্চন খুব ভদ্র ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই বার সে গিফটটা নিচ্ছে বটে, তবে আর যেন কোনও দিন তাদের জন্য কস্তুরী টাকা নষ্ট না করে। এই ‘তাদের’ ব্র্যাকেটের মধ্যে আকিঞ্চন, মেহুলি-সহ একতলায় অবস্থানকারী দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও অন্তর্ভুক্ত, এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল আকিঞ্চন। আর কথা বাড়ায়নি কস্তুরী, তবে খেয়াল করে দেখেছিল, কোনও দিনই কস্তুরীর দেওয়া শার্টটা পরেনি আকিঞ্চন। এমনকি তার মেয়েও না। ওদের অনুপস্থিতিতে আলমারি ঘেঁটে দেখেছে, শার্ট এবং বারমুডা দুটো দুজনের আলমারিতেই সযত্নে রাখা আছে। ওগুলো যে কোনও দিন ব্যবহার করবে না ওরা, এটাও কী ভাবে জেনে গিয়েছিল কস্তুরী।
বাড়ি থেকে সাউথ সিটি মল বেশি দূরে নয়। কিন্তু কস্তুরীর যেতে ইচ্ছে করে না। কী করবে গিয়ে? কী কিনবে? তার যতটা দরকার তার চেয়ে ঢের বেশি আকিঞ্চন তাকে দিয়ে রেখেছে। এখনও ডজনখানেক শাড়ির পাট ভাঙা হয়নি। সাজগোজের জিনিস কস্তুরীর লাগে না। কোনও ইনভিটেশনে যেতে হলে হালকা করে লিপস্টিক বুলিয়ে নেয়। কপালে একটা টিপ। ব্যস। অযথা গয়নাগাঁটি পরলে নিজেকে কেমন ভারী ভারী আর সঙের মতো লাগে। তার চেয়ে কস্তুরীর বরং ঘরে বসে বসে মোবাইলে সিরিয়াল দেখতে বেশ লাগে। বেশ একটা ঘরোয়া ব্যাপার আছে সিরিয়াল ব্যাপারটায়। সিনেমা হলের মতো একশো লোকের মাঝে বসে দেখা নয়। সিরিয়াল দেখতে দেখতে খুব কান্না পেলে কেঁদেও নেওয়া যায় একান্তে।
কস্তুরী একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মেম্বারশিপ নিয়েছে। সেখানেই তার প্রিয় সিরিয়াল তিনটে দেখে। মন চাইলে সিনেমাও দেখে নেয়। কস্তুরীর আর একটা কৌতূহল আছে। তার পছন্দের তিন চারটে মেয়ে আছে, যারা সিরিয়ালে অভিনয় করে। ওদের বেশ লাগে। ওদের অভিনয় মন দিয়ে দেখার চেয়েও কস্তুরীর খুব জানতে ইচ্ছে করে ওদের বাড়ি কোথায়, ওরা কখন বাড়ি যায়, ওরা বাড়িতেও কি এমন ঝলমলে জামাকাপড় পরে থাকে... নিশ্চয়ই না। ওদের কাজের ধরনধারণই বা কেমন? ইসস, যদি যাওয়া যেত ওদের বাড়ি, অন্তত যদি কারও সঙ্গে আধ ঘণ্টা কথা বলা যেত। সিনেমা-সিরিয়ালের জগৎ সম্পর্কে কত কী শোনা যায়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো আর উপায় হয় না।
বারান্দা থেকে ফিরে কস্তুরী অলস ভাবে বিছানায় নিজেকে গড়িয়ে দেয়। দুপুরে ঘুমোনো তার অভ্যেসে নেই। অফিস কামাই তার কদাচিৎ হয়। অত্যন্ত দরকার না হলে সে পারতপক্ষে অফিস বাঙ্ক করে না। রবিবারগুলো অবশ্য অন্য রকম। খেয়েদেয়ে সে মোবাইল নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। হয় কোনও মুভি, নয়তো প্রিয় কোনও সিরিয়াল দেখে। সম্প্রতি একটা হিন্দি সিরিজ় দেখা শুরু করেছে সে। কোনও দিন হয়তো কোনও সিরিয়ালের দেখা এপিসোডও আর এক বার দেখে, অবশ্যই সেই সিরিয়ালে যদি রিখি সেন থাকে। অনেক পরে একটা ম্যাগাজ়িনে সে জেনেছিল, ওটা মেয়েটার আসল নাম নয়।
সপ্তাহের অন্য দিন কস্তুরীর বিজ়ি শিডিউল। সকালে আকিঞ্চন, মেহুলি এবং কখনও সখনও নীচের দুই বুড়োবুড়ির জন্য ব্রেকফাস্ট করা তো আছেই। তা ছাড়া দুপুরের লাঞ্চ রেডি করা। সেটা অবশ্য তার নিজের জন্য। শ্বশুর-শাশুড়ির লাঞ্চ, ডিনার নিয়ে চিন্তা নেই, শাশুড়ি নিজেই বানিয়ে নেয়, হেল্প করে চন্দন। আকিঞ্চন কোর্টের ক্যান্টিনে খেয়ে নেয় আর মেহুলির একদম পছন্দ নয় বাড়ির থেকে খাবার বয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া। আগে অবশ্য নিয়ে যেত, আজকাল ব্যাপারটা তার খুব প্রিমিটিভ লাগে। তাকে যে হাতখরচা দেয় আকিঞ্চন, তা বড় কম নয়। মাসের তিরিশ দিনের হিসেব করলে হয়তো কস্তুরীর মাসমাইনের চেয়ে সামান্য কমই হবে।
ওইটুকু একটা মেয়ের হাতে এত টাকা দেওয়ার কোনও অর্থ সে খুঁজে পায় না সে। মেয়ের এখন যা বয়স, সেই বয়স কস্তুরীরও এক দিন ছিল। সেই সময় সামান্য দশ টাকা পেলেও কস্তুরী লাফিয়ে উঠত। স্কুলের টিফিন বলতে ছিল মায়ের হাতে রান্না করা চিঁড়ের পোলাও অথবা রুটি-তরকারি। আকিঞ্চন অবশ্য বলে, “সময় বদলাচ্ছে, নিজেকে বদলাও।” কস্তুরী মানতে পারে না। টাকা থাকা মানেই সেটা নয়ছয় করে উড়িয়ে দেওয়া নয়। এত টাকা দিয়ে কী করে মেহুলি রোজ রোজ, ভেবেই পায় না কস্তুরী। আর লেখাপড়া! কখন পড়ে ও? বারো ক্লাসের পড়া কি কম! স্কুল ফাইনাল অবধি ধরেবেঁধে বকাবকি করে পড়তে বসাত মেয়েকে। কস্তুরী তখন থেকেই টের পাচ্ছিল, মেয়ে তাকে মানতে চায় না। গত দু’বছর এই অগ্রাহ্যতা বেড়ে দ্বিগুণ। কস্তুরী আর কিছু বলে না এখন। সে বিশ্বাস করে জোর করে কিছু হয় না। তবুও মাঝে মধ্যে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।
কস্তুরীর মনে পড়ল, সকাল থেকেই ভেবে রেখেছিল উত্তরের বারান্দা ঘেঁষা ঘরদুটোয় এক বার হাত লাগিয়ে দেখবে। ওই ঘরগুলোয় কেউ থাকে না, কিছু আসবাব রয়েছে। চার দিক বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সব কিছুর উপরে কী করে যেন ধুলোর স্তর জমে যায়। কস্তুরী একটা ঝাড়ন নিয়ে ঢুকল। প্রথমেই বাঁ দিকেরটায় ঢুকে জানলাগুলো খুলে দিয়ে বাইরে তাকাল। ক্লাব থেকে আর কোনও শব্দ আসছে না। হয়ে গেল দেশপ্রেমের হিড়িক, ভাবল কস্তুরী।
একটা ঘর সেরে সে দ্বিতীয় ঘরটায় ঢুকল। সেটাও হয়ে যেতে সে ভাবল, কত দিন হয়ে গেল মেহুলির ঘরে হাত লাগায় না সে। মেয়ের পছন্দ নয়। প্রকাশ্যে সে কথা ঘোষণা করা ইস্তক কস্তুরী আর যায় না। ওই আলপনা যা পারে করে দেয়। আজ ফের ঢুকল সে। বিছানার উপরে এক দিকে তাল করে রাখা জামাকাপড়, অন্তর্বাস। আর এক দিক জুড়ে মিউজ়িক প্লেয়ার, একটা উল্টে রাখা বিদেশি ফোন, একটা ট্যাব, ইয়ারফোন, পোর্টেবল স্পিকার, ডায়েরি এই সব। এক বার ইচ্ছে হল ডায়েরিটা খুলে দেখে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল সে। উচিত হবে না। মেয়ে এখন বড় হয়েছে।
ঘরের কোনও কিছুতেই হাত ছোঁয়াল না সে। মনটা চঞ্চল হচ্ছে। সামান্য মনখারাপ ছুঁতে চাইছে তাকে। বছর দুয়েকের মধ্যে মেহুলি কী ভাবে যেন বদলে গেল! অন্যমনস্ক ভাবে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অসংখ্য বইপত্রের পাশে একটা বই নজর কাড়ল। এক বিখ্যাত কবির একটা কবিতার বই। ওরে বাবা! মেহুলি কবিতা পড়ে না কি? না কি এটাও স্টেটাস সিম্বল! তবুও মনটা সামান্য খুশি হল। বইটা রেখে আলমারির সামনে দাঁড়াল। খুলব কী খুলব না ভাবতে ভাবতে খুলেই ফেলল। ইসস! উপচে পড়ছে জামাকাপড়। ডান দিকে একটা হালফ্যাশনের ড্রেস ঝোলানো আছে দেখে সামান্য সরিয়ে দেখল সে। ও বাবা! পিছনে আরও কিছু জিনিস ঠাসা। পারফিউম, নেলপলিশ, লিপ বাম, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন। হাত টানতে গিয়ে টুপ করে কী একটা পড়ল মেঝেয়। কস্তুরী দেখল একটা ছোট প্যাকেট।
নিচু হয়ে প্যাকেটটা তুলে খুলে ফেলল কস্তুরী। ভিতরে আর একটা প্যাকেট। এটা কী? বার করে চোখের সামনে ধরতেই মুহূর্তে কস্তুরী পাথর। চার দিকের চারটে দেওয়াল যেন ঘন হয়ে এল! সময় যেন থমকে গেল। অথচ বাইরের ঘরের দেওয়ালঘড়িটা তার নিজস্ব নিয়মেই এগিয়ে যাচ্ছিল টিকটিক করে।
ঘণ্টা দুয়েক উন্মাদবেগে চালিয়ে অবশেষে রাস্তার পাশে একটা বড় রেস্তরাঁর সামনে বাইক থামাল ময়ঙ্ক। যোধপুর পার্ক গার্লসের গেট থেকে কোনা এক্সপ্রেস ধরে এতখানি এসে টায়ার্ড লাগছে তার। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “উফ, পিঠটা ধরে গেছে। লেট’স হ্যাভ সাম ফুড।”
“এই সময় আবার কী খাব?”
“একটা বিয়ার-সিয়ার মেরে দেব। সুপ্পার থকে গেছি মাইরি।”
“ইয়েস। ওয়ান সাইড ডিশ প্লিজ়। রুখাসুখা মারতে কেমন লাগে।”
“দাঁড়া, আগে একটু দম নিতে দে। এতটা একটানা চালাইনি আগে।”
“ভাট বকিস না বাওয়া। আগের মালটাকে নিয়ে এ দিকেই তো কোথাও এসেছিলি তুই।তখন হাঁপাসনি?”
“তোর যত ভাটের কথা।”
“বেশি চটকাস না! একা খাচ্ছিস! একটা দে।”
“কাউন্টার দিচ্ছি।”
“শালা কিপটে মাল। একটা গোটা ছাড়।”
ময়ঙ্ক প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “তার পর বল, আছিস কেমন? তোর সঙ্গে আমার দেখা হল এগজ়্যাক্টলি আফটার ফোর ইয়ারস।”
“আরও তিন মাস অ্যাড কর। বাই দ্য ওয়ে তোর কেসটা কী বল তো? মীরাট গিয়ে ফেঁসে গেছিলি নাকি? ওর খবর কী?”
“কার?”
“ইস, বোকু মাইরি। কিস্যু জানে না! ওই অপ্সরা না ঊর্বশী কে যেন? বল না মাইরি নামটা।”
“কার কথা বলছিস ঝেড়ে কাশ না?”
“ইয়েস। মনে পড়েছে। ঊর্মি। ঊর্মিমালা শাঁখারী। আমরা শাঁকালু বলে চাটতাম। সে কোথায়?”
নিমেষে ময়ঙ্কের মুখ উদাস, “দেখ বরের সঙ্গে আছে হয়তো।”
“মজাটজা করে ছেড়ে দিয়েছিস? তাই তো?”
“মারব এক লাথি। ওই সব আমি করি না। চল বিয়ার খাই।”
“অ্যাঃ, সতী বৌদি আমার! দাঁড়া তোর হচ্ছে।”
পর পর তিন বোতল বিয়ার উড়ে গেল। সঙ্গে চিলি চিকেন এক প্লেট। সবটা শেষ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ময়ঙ্ক। তার পরেই খেয়াল করল মেহুলি ওকে অনেক ক্ষণ ধরে দেখছে। সে জিজ্ঞেস করে, “বল কেমন আছিস?”
“তুই কেমন আছিস আগে বল। এইট-এর পর জাস্ট হাওয়া হয়ে গেলি। ফিরে এলি চার বছর কাটিয়ে। এর মধ্যে নো কল, নো মেসেজ, নো হোয়াটসঅ্যাপ। আগের নাম্বার নট রিচেবল।”
“আমার খবর দিল কে তোকে?”
“কে আবার! শাঁকালু। সেও দেখি এক দিন স্কুলে আসছে না। লিভ ইট। তোদের ভবানীপুরের বাড়িটায় এখন কেউ থাকে না?”
“থাকবে না কেন? অনেকেই আছে। জাস্ট আমরা শিফট হয়ে গেলাম মীরাট। অল বিজ়নেস এক্সপ্যানশন প্ল্যানিং। ও তুই বুঝবি না। নাউ, ইট’স ইওর টার্ন। তোর ক্যারাটে-কুংফুর খবর কী? এখনও চালাচ্ছিস না, ঘেমে গিয়ে থেমেছিস?”
“চালাচ্ছি। সামনের মাসে ব্ল্যাকবেল্টটা নিতেই হবে বাডি।”
মেহুলি চুপ করে গেল। ময়ঙ্ক ওকে দেখছে। বাইরে তো বটেই, ভিতরে ভিতরেও মেয়েটার একটা চেঞ্জ এসেছে। তবে কি কোনও প্রবলেমে আছে? সে জিজ্ঞেস না করে পারল না, “আই গেস তুই কোনও প্রবলেমে আছিস। মে আই নো কী প্রবলেম, টিনা?”
চমকে তাকাল মেহুলি, “এখন মনে রেখেছিস এই নামটা! উফফ!”
“ভাল না?”
“ধুর, বিচ্ছিরি! আমি তো ভেবেছিলাম ভুলে মেরে দিয়েছিস এত দিনে। তোর মাইরি ফোটোগ্রাফিক মেমরি।”
মেহুলিকে টিনা বলে ডাকত এই ময়ঙ্ক মদনানিই। আসলে হয়েছিল কী, মেহুলি এক দিন তার প্ল্যাস্টিকের টিফিনবক্সের বদলে নতুন কেনা হালফ্যাশানের স্টিলের টিফিনবক্সে খাবার নিয়ে গিয়েছিল। ওর বান্ধবীদের মধ্যে শেলি ছিল সবচেয়ে মিচকে। বাইরে বেরিয়ে সে দিন মেহুলির দেখা করবার কথা ছিল ময়ঙ্কের সঙ্গে। ময়ঙ্ক ছুটির পর গার্লস স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করছিল। মিচকে শেলি সে দিন ময়ঙ্ককে বলেছিল, “মেহুলি টিনের বাক্সে টিফিন এনেছে।”