খেলার মাঠে ফিরে এল দর্শক। সাফল্যে ফিরে এলেন সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া কয়েক জন ক্রিকেট তারকা। তাঁরা দেখালেন, জীবনের উৎসব ছেড়ে কিংবা হেরে যেতে নেই।
Bengali Story

জীবনে ফিরে আসার খেলা

করোনা অতিমারির প্রভাবে গত দু’বছর এই লিগও টালমাটাল হয়েছিল। কখনও বিদেশের মাটিতে, আবার কখনও দর্শকশূন্য মাঠে গড়িয়েছে আইপিএল-এর বল।

Advertisement

বিপ্রর্ষি চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২২ ০৬:০৬
Share:

সফল: আইপিএল জয়ী অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ড্য। ফাইনালে উইকেট পাওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত

দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের সামনে তখন মন্ত্রী, গায়ক, সুরকার কে নেই! এক অপ্রত্যাশিত ভাঙা হাটের চর্চায় তাঁরা হতবাক। অন্তর থেকে ছিন্নভিন্ন। চিকিৎসকরা যখন কৃষ্ণকুমার কুন্নথের মতো এক সঙ্গীতজীবনের নামের পাশে ‘ব্রট ডেড’ লিখে পূর্ণচ্ছেদ দিচ্ছেন, সামাজিক মাধ্যমের দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘হাম রহে ইয়া না রহে কাল, কাল ইয়াদ আয়েগি ইয়ে পল।’ তেমনই এক সময় চোখে পড়ল এক অমোঘ সত্যি, ‘ইউ উইল উইন, ইফ ইউ ডোন্ট কুইট।’ আসলে আমরা বাঁচি তো ওই মুহূর্তেই। যদি বিন্দু বিন্দু স্মৃতি দিয়ে একটা মহাসাগর তৈরি করা যেত, বোঝা যেত ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে জীবন নেই, প্রতি মুহূর্তে লড়তে লড়তে বেঁচে থাকার মধ্যেই জীবন। ডানা মেলার ইচ্ছেপূরণ নিহিত থাকে নতুন শুরুর গহনে। তাই পল্লবী, বিদিশাদের ছেড়ে যাওয়ার থেকেও সংক্রামক রবার্ট ব্রুসদের রূপকথা।

Advertisement

অনেকে বলেন, বাণিজ্যসফল বিষয়ে জীবনের আস্বাদ নেই। কিন্তু জীবন এত সরল নয়। ১৯৮৩ সালে ভারত ক্রিকেটে প্রথম বার বিশ্বসেরা হলেও ভারতে ক্রিকেটের প্রথম বাণিজ্যিক সাফল্য ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনে। তার পর তার রেখচিত্র শুধুই ঊর্ধ্বমুখী। সেই সাফল্য তুঙ্গ স্পর্শ করে ২০০৮ সালে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আয়োজনে। শুরু হয় আইপিএল নামক ক্রিকেটীয় বিনোদনের পথ চলা।

করোনা অতিমারির প্রভাবে গত দু’বছর এই লিগও টালমাটাল হয়েছিল। কখনও বিদেশের মাটিতে, আবার কখনও দর্শকশূন্য মাঠে গড়িয়েছে আইপিএল-এর বল। এ বছর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় প্রাথমিক ভাবে মহারাষ্ট্রের তিনটি স্টেডিয়ামে ও নক-আউট পর্বে কলকাতা ও গুজরাতে আয়োজিত হয় আইপিএল। নতুন ট্যাগ লাইন ‘অব ইয়ে নর্মাল হ্যায়’। মাঠভর্তি দর্শক, প্রিয় খেলোয়াড়ের জন্য চিৎকার, খেলার শেষ প্রহরে টেনশনে নখে কামড় আর তিলক বর্মা, আয়ুষ বাদোনি, আবেশ খান, উমরান মালিকদের তারকা হয়ে ওঠা— সব মিলিয়ে বার বার মনে হতে বাধ্য ‘ইয়ে তো নর্মাল হ্যায়’। কিন্তু অনেকের কাছেই এই আইপিএল সাধারণের মধ্যে অসাধারণের পরশ এনে দিয়েছে। শুধু খেলা নয়, ফিরে আসার খেলা দেখিয়েছে এই আইপিএল।

Advertisement

খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি জীবনীশক্তিতে ভরা পারফর্মার ক’জনই বা হতে পারেন? আর দর্শক হল ওই জীবনীশক্তির মূল রসদ। তাই দর্শকের মাঠে ফেরা তো ছিলই, এই আইপিএল ফেরাল সময়ের অতলে হারিয়ে যেতে বসা কিছু চরিত্রকেও। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হার্দিক পাণ্ড্য। জয়ী অধিনায়ক হার্দিক। এক সময় আইপিএল থেকে জাতীয় দল, কপিল দেবের সঙ্গে তুলনা, সব ঠিকঠাক চলছিল। একটি টক শো-এ মহিলাদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের জেরে তাঁর উপর নির্বাসনের খাঁড়া নেমে আসে। প্রভাব পড়ে পারফরম্যান্সেও। কাঁধের চোটের কারণে বল করতে পারছিলেন না। ব্যাটেও রান নেই। প্রথমে জাতীয় দল থেকে বাদ, তার পর মুম্বই ইন্ডিয়ান্স থেকেও— সব মিলিয়ে হার্দিক পাণ্ড্য নামটা কার্যত অস্তাচলে যেতে বসেছিল। তখন থেকেই শুরু হয় নিজেকে একা রেখে ফেরার প্রস্তুতি। আইপিএল-এর নতুন দল ‘গুজরাত টাইটানস’ যখন হার্দিককে অধিনায়ক করে দলে নিয়েছিলেন, তখনই ঝড় উঠেছিল সমালোচনার। মাঠে দেখা গেল এক অন্য হার্দিককে। ব্যাটে যে রান আসছে তা-ই নয়, কাঁধের চোটকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বল করছেন প্রায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে। উইকেট নিচ্ছেন। বিপক্ষের রানের গতি আটকাচ্ছেন। সেই সঙ্গে তুখোড় অধিনায়কত্ব। সব শেষে জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন। এ যেন রূপকথাকেও হার মানায়।

পরের ক্রিকেটার দীনেশ কার্তিক। স্ত্রী নিকিতার সঙ্গে ছোটবেলার বন্ধু সহখেলোয়াড় মুরলী বিজয়ের প্রণয় তাঁকে পারিবারিক ভাবে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। সালটা ২০১১। কেরিয়ার গ্রাফ হুহু করে নামতে শুরু করেছে। ২০১২ সালে মিউচুয়াল ডিভোর্স। জীবনটা ঢেকে গিয়েছে অন্ধকারে। ফিরে আসার পথে পেলেন ভারতীয় স্কোয়াশ-তারকা দীপিকা পল্লিকলকে। ২০১৫ সালে বিয়ে করলেন দীপিকাকে। আর ২০২২ সালে এসে ৩৬ বছরের দীনেশ কার্তিক ৩৪ মাস পর জাতীয় দলে ডাক পেলেন। সৌজন্যে তাঁর আইপিএল সাফল্য। ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারত যে দিন প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিল, সে দিন দু’দলের ২২ জন ক্রিকেটারের মধ্যে ২১ জনই অবসর নিয়েছেন। এখনও জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছেন শুধু এক জনই। ফিনিশারের ভূমিকায় পরপর বিস্ফোরক ইনিংস খেলে হারানো জায়গা ফিরে পেয়েছেন তিনি।

তিন নম্বর চরিত্র ঋদ্ধিমান সাহা। বাঙালি উইকেটকিপার। ধোনির সমকালীন হওয়ায় কোনও দিনই সে ভাবে সুযোগ পাননি। কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে প্রমাণ করেছেন। আইপিএল ফাইনালে শতরান থেকে জাতীয় দলের হয়ে টেস্টে শতরান, পিঠে ব্যথা নিয়ে সাম্প্রতিক ম্যাচ জেতানো ইনিংস— সবটাই করেছিলেন। তাও জাতীয় দলের দরজা তাঁর জন্য বন্ধ। আইপিএল-এর নিলামে প্রথমে অবিক্রীত ছিলেন। পরে গুজরাত টাইটানস তাঁকে কেনে। কিন্তু প্রথম দিকে বেশ কয়েকটা ম্যাচে সুযোগ পাননি, কিন্তু সুযোগ পেয়েই পর পর অর্ধশতরান। দলে জায়গা পাকা তো করলেনই, সঙ্গে হয়ে উঠলেন নির্ভরযোগ্য ওপেনার।

এক সময় ভারতীয় দলের দলের স্পিন আক্রমণ মানেই ছিল কুল-চা জুটি। সাফল্যের শিখরে থাকার সময় তাঁদের নিয়ে কার্যত দড়ি টানাটানি হত আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলির মধ্যে। এক জন কলকাতা নাইট রাইডার্সের নয়নের মণি, অন্য জন আরসিবি-র হার্টথ্রব। মাত্র একটা মরসুম। হঠাৎ ব্যাড প্যাচ। চায়নাম্যান বোলার কুলদীপের যে কোনও বল অনায়াসে ব্যাটাররা সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সমস্ত রহস্য হারিয়ে পিচের মাঝে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন কুলদীপ। চোখে জল। নির্মম ভাবে ছেঁটে দিল দল। জাতীয় দলও। যুজবেন্দ্র তো সাফল্য দিয়েও ব্রাত্য। পুরনো খেলোয়াড় রাখার সময় আরসিবি ভাবনাতেও আনেনি যুজবেন্দ্র চহালের কথা। এক বুক অভিমান নিয়ে রাজস্থান রয়্যালস-এ যোগ দেন হরিয়ানার এই স্পিনার। তত দিনে জাতীয় দল থেকেও বাদ পড়েছেন। এ বারের আইপিএল-এ যুজবেন্দ্র ২৭ উইকেট নিয়ে শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহক, কুলদীপের ঝুলিতে ২১ উইকেট।

এই ভারতীয়দের মাঝে এক বিদেশি চরিত্রও আছেন। তিনি ডেভিড মিলার। এক সময়ে তাঁর মারকুটে ব্যাটিংয়ের জন্য তাঁকে ‘কিলার মিলার’ বলা হত। সে সব এখন অতীত। জাতীয় দল থেকেও বাদ পড়েছেন। নিলামেও কেউই খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। তার পরেও খেলার সুযোগ পেয়েই জ্বলে উঠেছেন। একের পর এক ম্যাচে সাফল্য পেয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ারে বিস্ফোরণ ঘটালেন। শেষ ওভারে জয়ের জন্য যখন ১৬ রান দরকার গুজরাতের, প্রথম তিন বলে তিনটে ছক্কা মেরে দলকে জয় উপহার দিলেন। ফিরে আসার বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।

শেষ করব যার কথা বলে, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে ‘গব্বর’ নামেই পরিচিত। শেষ পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপেও শুরু করেছিলেন খুনে মেজাজে। কিন্তু একটা চোট সব পাল্টে দিল। জাতীয় দল থেকে তো ছিটকে গেলেনই। তাঁর জায়গায় কে এল রাহুল, ঈশান কিষাণ, শুভমন গিলদের লম্বা লাইন। ৩৭ বছর বয়সে পৌঁছে এমন অবস্থায় যে কেউ হাল ছেড়ে দেবেন। কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। দলে অভিজ্ঞ শিখর ধওয়ন, তবু অধিনায়কত্ব পেলেন ময়াঙ্ক আগরওয়াল। সেই পরিস্থিতিতেও ৩৮-এর উপর গড় নিয়ে ৪৬০ রান। সর্বোচ্চ ৮৮। কোনও উল্লাস নেই, জবাবি আগ্রাসন নেই। নিঃশব্দে ফিরে আসার ক্যানভাসজোড়া সুখছবি আছে। এ ভাবেই একে একে অসম্ভবের অজুহাতকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে সম্ভবের জয়গান শুনিয়েছে ফিরে আসার এই আইপিএল।

জীবন-উৎসব ছেড়ে যেতে নেই বলেই কিছু মানুষ ফেরে, ফিরে আসতে জানে। উদাহরণ তৈরি করে বেঁচে থাকার। এ বারের আইপিএল ফিরে আসার লড়াইয়ের দিকচিহ্ন হয়ে থাকল। বাণিজ্যসফল বিষয়েও মিশে গেল জীবনের গন্ধ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement