ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৬
Bengali Serial Novel

খরস্রোত

সকালে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হয়েছে। উষাপতি খানিক আগে বালিগঞ্জে রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে পদার্পণ করেছেন।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৪০
Share:

ছবি কুনাল বর্মণ।

পূর্বানুবৃত্তি: বিশ্রাম নিচ্ছিলেন নীলমণি। তাঁর কাছে ভাই উমানাথকে নিয়ে আসেন রমানাথ। দাদার কাছে জানান ভাইয়ের মদ্যপান এবং চটুল গানের আসর বসানোর বৃত্তান্ত। নীলমণি ছোট ভাইকে নিয়ম করে পাটের গদিতে যাওয়ার আদেশ করেন। পরে রমানাথকে ডেকে তিনি রমানাথের দ্বিতীয় বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। আরও জানান যে, উমানাথ দীর্ঘ দিন ধরেই তাঁদের জেঠামশাইয়ের ঘরে আসর বসাচ্ছে। সে প্রসঙ্গে উঠে আসে জেঠামশাই আদিত্যনাথের কথা। নীলমণি জানান, সকলে তাঁকে পাগল বলে ভাবলেও তিনি ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তাঁর কাছ থেকেই বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র পেয়েছিলেন নীলমণি। তাঁর পরামর্শেই নীলমণি যোগাযোগ করেছিলেন উত্তরপাড়ার বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মারা যাওয়ার আগে জেঠামশাই তাঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন একটি মাউজ়ার পিস্তলও। নীলমণির স্ত্রী কালীঘাটে তাঁর বাপের বাড়িতে। সন্তানহীনা বলে তাঁকে নিয়ে বারবার অনুযোগ করেন নীলমণির বোন নিভাননী।

Advertisement

নীলমণি সামলাতে চেষ্টা করেন, “ছি নিভা! অমন করে বলে না...”

“একশো বার বলব! হাজার বার বলব!” বলে নিভাননী ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

Advertisement

নীলমণি হাসেন। ননদ-ভাজের সম্পর্ক বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল। নিভা যা-ই বলুক না কেন, রমার বিয়েটা তাঁকে দিতেই হবে। বাবার সঙ্গে এক বার কথা বলা দরকার।

নীলমণি পিতা বনমালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ান। হঠাৎ মনে পড়ে বাবার আফিমের নেশার কথা। তিনি এখন নিশ্চিত আফিম খেয়ে ঝিমোচ্ছেন। সুতরাং, নীলমণি পথ বদল করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোনে দাঁড়ান। উঠোনে লিচুগাছের তলায় শুকনো পাতার উপর সরসর করে শব্দ হয়। নীলমণি বুঝতে পারেন, কোনও সরীসৃপ হেঁটে চলেছে। হয়তো খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে সে।

মাত্র কয়েক হাত দূরে। অথচ তাঁর ভয় করে না। এতটুকু ভয় করে না। আচ্ছন্নের মতো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শুধু।

সকালে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হয়েছে। উষাপতি খানিক আগে বালিগঞ্জে রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে পদার্পণ করেছেন। ভাগ্য ভাল, তাঁকে বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হয়নি। বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে তাঁর আসার পর।

মহারাজের বাড়িটি বেশ বড়। অনেকগুলো ঘর। বাড়ির সামনে প্রশস্ত মাঠ। চতুর্দিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির পিছনেও অনেকটা জায়গা। সেখানে ক্রিকেটের জন্য পিচ তৈরি করা আছে। মহারাজ ক্রিকেটপ্রেমী। এই চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেও মাঝে মাঝে ব্যাট ধরেন। মহারাজের একটি চোখ পাথরের হলে কী হবে, বিপক্ষ বোলারকে মোকাবিলা করেন নিপুণ হাতে। তবে এখন বুঝতে পারেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসছে। এ বার থেকে ক্রিকেট মাঠের বাইরে থেকেই ক্রিকেটকে ভালবাসতে হবে। মাঠে নেমে খেলাটা ছাড়তে হবে।

বালিগঞ্জ ল্যান্সডাউন রোডের প্রাসাদোপম বাড়িতে এই প্রথম আসছেন উষাপতি। মহারাজ যতই অতিথিপরায়ণ হোন না কেন, তার নিজের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল এবং সেটা বলেও ফেললেন এক সময়। একটা বড় থালায় অনেক রকম মিষ্টি ও ফল কেটে তাকে দেওয়া হয়েছিল। উষাপতি তা দেখে প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “মহারাজ, রাজবাড়ির এই খাওয়া কি আমার পেটে সইবে?”

জগদিন্দ্রনাথ ঈষৎ ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “আলবাত সইবে। আর তা ছাড়া, এখানে আপনি রাজবাড়ি কোথায় পেলেন? রাজবাড়ি তো আমার নাটোরে। এক বার চলুন, দেখবেন রাজবাড়ি কাকে বলে।”

উষাপতি মাথা নাড়েন। ভাবেন, সত্যিই এক বার নাটোর রাজবাড়ি দর্শনে যেতে হবে। এক টুকরো আম মুখে দিয়ে উষাপতি ঘরের চার দিক চোখ বোলাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘরের কোণে রাখা একটি পাখোয়াজ তাঁর চোখে পড়ল। মহারাজ একটু ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলেন। ফিরতেই উষাপতি বললেন, “মহারাজের কি পাখোয়াজেও হাত চলে?”

“ওই একটু আধটু। জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অব নান!” বলেই হেসে উঠলেন জগদিন্দ্রনাথ রায়। তার পর বললেন, “আপনার আজ আর কী কাজ আছে?”

“কাজ তেমন কিছু নেই। তবে, ট্রেন জার্নি করে এসে এখনও অবধি বিশ্রাম হয়নি। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নেব,” উষাপতি বললেন।

“এ বাড়িতে বিশ্রাম নিতে কি মহাশয়ের আপত্তি আছে?”

“না, মানে...”

“কোনও না নয়। বাইরে তাকিয়ে দেখুন, মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে।”

উষাপতি জানলার বাইরে চোখ রাখেন। সত্যিই, বৃষ্টিটা এখন জোরেই পড়ছে। এই বৃষ্টিতে ঘরের বাইরে বেরোনোর প্রশ্নই আসে না। তা ছাড়া, সঙ্গে ছাতা নিয়েও আসেননি তিনি।

উষাপতিকে নীরব থাকতে দেখে, জগদিন্দ্রনাথ বলেন, “কী ভাবছেন? ভাবছেন— মহা বিপদে পড়েছেন তাই তো?”

উষাপতি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, “না, না, ভাবছিলাম আমার ভাগ্যের কথা। রাজামশাইয়ের বাড়িতে রাজামশাই বিশ্রাম নিতে বলছেন, এ কি কম ভাগ্যের ব্যাপার? ক’টা লোকের ভাগ্যে এমন জোটে?”

জগদিন্দ্রনাথ হাসেন। হাসতে হাসতেই বলেন, “শুধু বিশ্রাম নয়, দুপুরের আহার ও আহার শেষে, বৃষ্টি ধরলে হাতিবাগানে স্টার থেটারে একটা নাটকও দেখতে যেতে হবে।”

উষাপতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের দিকে। তিনি ভাল করেই জানেন যে, মহারাজের এই অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নেই। তবু চেষ্টা করেন, “আজকে থাক মহারাজ, অন্য কোনও দিন না হয়—”

উষাপতিকে কথা শেষ করতে দিলেন না জগদিন্দ্রনাথ। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, অন্য দিন হতেই পারত। আসলে মহারানি আপনার লেখার খুব ভক্ত। এ পর্যন্ত আপনার গ্রন্থিত সব গপ্পোই ওর পড়া। তাই একটু লেখকসেবা তিনিই করতে চান। আর থিয়েটারে যদি না যেতে চান, তো আমি জোর করব না। আসলে, অমরবাবু বিশেষ করে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তো। একা যাব, ভাবলাম আপনাকে বলি।”

“অমরবাবু, মানে সেই অমরবাবু, যিনি পুরনো ছক ভেঙে নাটকে নতুন যুগ এনেছেন?” উষাপতি বলেন।

“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এমনিতে মানুষটা খুবই বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করেন। মদ মেয়েমানুষ দুটোই সমান তালে চলে। কিন্তু, কাজের প্রতি নিষ্ঠা তাঁর একশো শতাংশ। কী অভিনয়প্রতিভা, আহা! কী সব সংলাপ! এখনও চোখে জল এসে যায়— মিথ্যা করে বল! অতি ক্ষুদ্র/ সকরুণ দুটি মিথ্যে কথা! হে ব্রাহ্মণ!/ বৃদ্ধ তুমি ক্ষীণ দৃষ্টি, কী করে জানিলে/ চোখে তার অশ্রু ছিল কি না? বেশি নয়,/ এক বিন্দু জল!”

উষাপতি অবাক হয়ে শুনছিলেন মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায়ের সংলাপ বলা। কী স্পষ্ট উচ্চারণ! মনে মনে ভাবছিলেন, এই ভদ্রলোকের কি অজানা কিছুই নেই?

উষাপতিকে নীরব থাকতে দেখে জগদিন্দ্রনাথ হেসে ফেললেন। বললেন, “ভাবছেন কী পাগলের পাল্লায় না পড়লেন। আসলে এটা ‘রাজা ও রাণী’র সংলাপ। পনেরো-ষোলো বছর আগে দেখেছিলাম ক্লাসিক থিয়েটারে। সঙ্গে ছিলেন স্রষ্টা স্বয়ং, রবীন্দ্রবাবু। শেষ দৃশ্যটির কথা আজও ভুলতে পারি না, যেখানে অমরবাবু বলছেন— ‘দেবী, যোগ্য নহি আমি তোমার প্রেমের।’ আহা! আহা! রবীন্দ্রবাবুকেও আমি আবেগতাড়িত হয়ে চোখের জল ফেলতে দেখেছি। এই দেখুন, আমি নিজেও কেমন আবেগে ভেসে চলেছি। আসলে কী জানেন উষাপতিবাবু, ক্রিকেটের মতো নাটকও ছিল আমার নেশা। ছেলেবেলায় অভিনয়ও করেছি। তবে বলার মতো কিছু নয়। যাক, বেলা অনেক হল, আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করি। আগে একটু গড়িয়ে নিন, তার পর নাওয়া-খাওয়া হবে’খন।”

ভৃত্যকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে, জগদিন্দ্রনাথ রায় উঠে পড়লেন। ডাকে বেশ কিছু পত্র এসেছে। সময়ের অভাবে দেখা হয়নি। উষাপতিবাবু বিশ্রাম করতে গেলে চিঠিগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নেবেন। অধিকাংশ চিঠিই তাঁর কাছে অর্থসাহায্য প্রার্থনা করে আসা। তার বাইরেও দু’-একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি থাকে, যেমন গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের একটি সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি লিখেছিলেন।

ভৃত্যকে অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে লম্বা করিডরের শেষ প্রান্তে একটি ঘরে এসে উপস্থিত হলেন উষাপতি। ঘরটি যথেষ্ট বড়। পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে খড়খড়ির জানালা। ঘরে একটি পালঙ্ক ছাড়াও একটি মেহগনি কাঠের সোফা ও আলমারি আছে।

ভৃত্যটি উষাপতির ছোট্ট বাক্সটি আলমারির মধ্যে রাখতে যাচ্ছিল। উষাপতি তাকে নিবৃত্ত করলেন। বললেন, “থাক, থাক। ও আমি রেখে দেব। তুমি এখন এসো।”

ভৃত্যটি চলে গেলে, উষাপতি জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। জানালার বাইরে দেবদারু গাছের সারি। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে তাদের শরীর। অদূরে মহারাজের ক্রিকেট পিচ। সেখানে জল জমে গেছে। হয়তো খানিক বাদেই জল নেমে যাবে। জানালা থেকে সরে এসে সোফায় গা এলিয়ে দেন উষাপতি। তখনই শুনতে পান মহারাজের কণ্ঠস্বর। দরজায় জগদিন্দ্রনাথ এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, “আপনার আজ বিশ্রামের প্রয়োজন। ও বেলা থিয়েটারটা তাই বাতিল করলাম। স্নান করে, খাওয়া-দাওয়া করে, একটু ঘুমিয়ে নিন বরং আজ। দেখবেন, সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।”

“কিন্তু আমি যে থিয়েটারের লোভেই থেকে গেলাম!” উষাপতি বললেন। থিয়েটারে যাওয়া হচ্ছে না শুনে তিনি যথেষ্টই বিমর্ষ হয়েছেন।

“বলেন কি মশাই, আপনারও থিয়েটারে এত টান!” মহারাজ অবাক হয়ে বললেন।

উষাপতি বললেন, “থিয়েটার ঠিক নয়, টান অমর দত্ত-য়। ভদ্রলোকের ছকভাঙা নাটক দেখার লোভ আমার অনেক দিনের। কলকাতায় তো থাকা হয় না, তাই দেখাও হয়নি। আজ যখন আপনি বললেন, তখন আর...”

“বেশ তো, আপনার যখন এতটাই ইচ্ছে, তখন যাওয়া হবে। অমরবাবুর সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেব’খন। এখন স্নান করে নিন, বেলাও অনেক হল...” কথাগুলো বলে জগদীন্দ্রনাথ চলে গেলেন।

খানিক ক্ষণ পর স্নান করার পর অনেকটা ক্লান্তি দূর হয়ে গেল শরীর থেকে। ভৃত্য এসে খবর দিল, মহারাজ এবং রানিমা তাঁর জন্য খাবার ঘরে অপেক্ষা করছেন।

উষাপতি ধীর পায়ে ভৃত্যটিকে অনুসরণ করে খাবার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন।

“আসুন উষাপতিবাবু!” বলে আপ্যায়ন করলেন জগদিন্দ্রনাথ। আলাপ করিয়ে দিলেন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী রমণীর সঙ্গে। বললেন, “প্রিয় লেখকের সঙ্গে কথা বলার জন্য হাঁপিয়ে উঠছে।”

উষাপতি নমস্কার জানালেন। বললেন, “আপনি আমার গল্পগুলো পড়েছেন, জেনে খুব গর্বিত হলাম।”

মহারানি হাসলেন। মৃদু কণ্ঠস্বরে বললেন, “আমার গর্বের কথাটাও ভাবুন একবার। প্রিয় লেখককে সামনে থেকে দেখছি। নিজের হাতে রান্না করে তাকে খাওয়াতে পারছি, এ কী কম ভাগ্যের কথা।”

উষাপতিও হাসলেন। বললেন, “আমার সৌভাগ্যের পাল্লা কিন্তু আপনাদের থেকেও বেশি। রাজগৃহে রাজা ও রানির এই আমন্ত্রিত ভোজের আয়োজন আমার কল্পনার একেবারে বাইরে ছিল।”

জগদিন্দ্রনাথ হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, “আপনি তো এখনও আসনই গ্রহণ করেননি। বসুন এইখানে...” বলে একটি মখমলের আসন দেখালেন তিনি।

উষাপতি সেই আসনে বসলে, সুদৃশ্য রুপোর থালায় খাবার পরিবেশন করলেন স্বয়ং রানিমা। থালায় সুবাসিত খিচুড়ি দেখে, উষাপতি মহারাজের দিকে তাকালেন। জগদিন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে বললেন, “রাজগৃহে আজ আপনার জন্য এই সামান্য আয়োজন— খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা।”

উষাপতির হাত তত ক্ষণে চলতে শুরু করেছে। খেতে খেতেই বললেন, “আজকের দিনে এর চেয়ে উপাদেয় খাবার আর হয় নাকি?”

“ইলিশটা গঙ্গার। খেয়ে বলুন তো স্বাদ কেমন। আমার তো পদ্মার ইলিশই পছন্দ। কলকাতায় আর পদ্মার ইলিশ পাব কোথায়?” জগদিন্দ্রনাথ বললেন।

“যথেষ্ট স্বাদ। স্বাদ আরও বেড়ে গেছে রান্নার গুণে!” বলেই রানিমার দিকে তাকালেন উষাপতি।

রানিমা মৃদু হাসলেন। কোনও উত্তর দিলেন না।

খেতে খেতেই জগদীন্দ্রনাথ ‘মানসী’ ও ‘মর্মবাণী’র প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, “আপনাকে দেওয়া পত্রে তো আমি উল্লেখ করেছি আমার ইচ্ছের কথা।”

“হ্যাঁ, আপনি চাইছেন, দুটো পত্রিকা আলাদা না বেরিয়ে সংযুক্ত আকারে বেরোক।”

“ঠিক তাই। আর সেই সংযুক্ত পত্রিকাটির দায়িত্বভার আপনারহাতে থাকুক।”

উষাপতি খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে বলেন, “এই দায়িত্বটা অন্য কাউকে দেওয়া যায় না?”

“না,” গম্ভীর ভাবে বললেন জগদীন্দ্রনাথ, “কেন, আপনার অসুবিধে কোথায়?”

উষাপতি একটু ইতস্তত করে বলেন, “কাজের চাপ একটু বেশি। সম্প্রতি একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি। তা ছাড়া, আমি কলকাতাতেও থাকি না যে, পত্রিকা অফিসে বসে কাজকম্ম করব।”

জগদিন্দ্রনাথ হাসলেন। যেন উড়িয়ে দিলেন উষাপতির সব যুক্তি। তার পর বললেন, “আপনাকে বেশি সময় দিতে হবে না। সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক হচ্ছে ‘মানসী ও মর্মবাণী’। আপনি অনেক সময় পেয়ে যাবেন। তা ছাড়া, আমি তো আছি।”

এর পর আর কোনও কথা বলা চলে না। উষাপতিও চুপ করে যান। তিনি জানতেন, তাঁর কোনও আপত্তিই টিকবে না মহারাজের অনুরোধের কাছে। ধীর পায়ে ঘরে ফিরে আসেন উষাপতি।

জগদিন্দ্রনাথ উষাপতির সঙ্গে ঘর পর্যন্ত আসেন। বলেন, “একটু বিছানায় গড়িয়ে নিন। দেখবেন, যেন ঘুমিয়ে পড়বেন না। ঘুমিয়ে পড়লে থিয়েটার যাওয়া মাথায় উঠবে।”

শুনে উষাপতি মৃদু হাসলেন। জগদিন্দ্রনাথও বিশ্রাম নিতে চললেন।

নরম বিছানায় অনেক চেষ্টা করেও চোখ চেয়ে থাকতে পারলেন না উষাপতি। জগদিন্দ্রনাথ না ডাকলে, থিয়েটারে যাওয়া সত্যিই মাথায় উঠত। ঘুম ভাঙতে উষাপতি দেখলেন, মহারাজ থিয়েটারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ঘুমিয়ে পড়ার জন্য খুব লজ্জা পেলেন উষাপতি। বললেন, “এখনই প্রস্তুত হয়ে আসছি।”

অল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে নেমে এলেন উষাপতি। দেখলেন, একটি কালো রঙের মোটর গাড়ির সামনে মহারাজ অপেক্ষা করছেন। উষাপতিকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “আপনি কি এখানেই ফিরে আসবেন থিয়েটার দেখে?”

উষাপতি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “না, না, থিয়েটার দেখে হোটেলে ফিরে যাব।”

মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার বাক্সটি যে ঘরে রয়ে গেল!”

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement