ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৮
Bengali Serial Novel

খরস্রোত

নিবারণ দরজা ঠেলে উমানাথকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। ঘরে লাল কার্পেট পাতা। তার উপর সাদা চাদরের গদি। কয়েকটি লাল রঙের তাকিয়া।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৪৮
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

উমানাথের প্রশ্নের উত্তরে নিবারণ মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে। তার পর আশ্বাস দেয়, “বাবু, আমি আপনার জাত চিনি। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন, ঠকবেন না।”

Advertisement

বলতে বলতেই, একটা বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রিকশাটা। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখেই, এক জন বেলফুলের মালা নেওয়ার জন্য উমানাথকে জোরাজুরি করল।

নিবারণ বলল, “নিন না একটা। আপনার হাতে ভাল মানাবে।”

Advertisement

উমানাথ একটা মালা কিনে নিবারণকে অনুসরণ করে দোতলায় একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিবারণ ঘরের দরজায় টোকা মারে। ভিতর থেকে প্রবেশের অনুমতি আসে। নিবারণ দরজা ঠেলে উমানাথকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। ঘরে লাল কার্পেট পাতা। তার উপর সাদা চাদরের গদি। কয়েকটি লাল রঙের তাকিয়া। গদিতে মধ্যমণি হয়ে বসে আছে যে নারী, সে খুব সুন্দরী না হলেও, লাবণ্যময়ী। নিবারণ কানে কানে বলল, “কেমন, পছন্দ তো? পাপড়িবাই... ঠিক ফুলের পাপড়ির মতো... তাই না?”

উমানাথ নিবারণের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল লাবণ্যময়ী সেই নারীর দিকে।

পাপড়িবাইয়ের মুখে পান ছিল। পিকদানিতে পানের পিক ফেলে, উমানাথের উদ্দেশে বলল, “আইয়ে বাবুসাহেব, বৈঠিয়ে।”

উমানাথ নরম গদিতে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসল।

পাপড়িবাইয়ের নির্দেশে একটি মেয়ে দুটো মদ খাওয়ার গেলাস রেখে গেল। পাপড়িবাই উমানাথের গেলাসে মদ ঢালল। নিজেও নিল। সোডা মেশাল। তার পর চোখ বুজে এক চুমুকে সবটা শেষ করে দিল।

উমানাথ অবাক হয়েছিল। তাকে আরও অবাক করে পাপড়িবাই বলল, “ফি দিন এইটুকুই নিই, আর নিই না।”

“কেন?” উমানাথ প্রশ্ন করে।

“আর খেলে যে নেশা হয়ে যাবে। বাবুর সেবা করব কী করে,” বলে সামান্য মদির হেসে গান শুরু করে, “পিয়া বিন নাহি আওত চৈন/ আরে পিয়া বিন নাহি আওত চৈন...”

উমানাথ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান শোনে। খুব আহামরি না হলেও, মেয়েটির গলায় কাজ আছে। মাঝে মাঝে তারিফ করতে ভোলে না উমানাথ— “বাঃ বাঃ, কেয়াবাত!”

পাপড়িবাই একের পর এক গান গেয়ে চলে। আর, সেই গানের ফাঁকে ফাঁকে সুরাপাত্র থেকে উমানাথ নিজেই তার গেলাসে ঢেলে নেয় তরল পানীয়। রাত বাড়ে। উমানাথের নেশাও জমে ওঠে। ক্রমশ উমানাথ পাপড়িবাইয়ের নিকটবর্তী হয়। পাপড়িবাই বাধা দেয় না। উমানাথের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “ঔর মত পিয়ো, বাবু।”

উমানাথ কোনও কথা বলে না। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে পাপড়িবাইয়ের নরম শরীর...

পাপড়িবাইয়ের ঘর থেকে উমানাথ যখন বেরিয়ে এল, তখন তার পা টলছে। সিঁড়ির মুখে নিবারণ দাঁড়িয়ে একটা লোকের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করছিল। উমানাথকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল।

উমানাথ বলল, “আমাকে ধরতে হবে না। আমি ঠিক আছি। তুই একটা মোটরগাড়ি দেখে দে।”

নিবারণ গাড়ির সন্ধানে যেতেই, উমানাথ গেয়ে উঠল, “পিয়া বিন নাহি আওত চৈন...”

একটা মড়া পুড়ছে। তার পোড়া কটু গন্ধ এসে নাকে লাগছে ঈশানের। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। তবু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চিতার লেলিহান আগুনের দিকে। ওই আগুনই এক দিন মা-র সারা শরীর জাপটে ধরেছিল, যেমন আজ এই মৃতের শরীরকে বেষ্টন করে আছে। শ্মশানের ডোম কাঠ দিয়ে খুঁচিয়ে দিচ্ছে আগুন। আর একটু পরে মৃতের শরীর যখন পুড়ে ছাই হবে, তখন ও ছাইয়ের ভিতর থেকে মৃতের নাভি বার করে আনবে। নাভি পোড়ে না। গঙ্গার জলে ফেলে দিতে হয়।

শবযাত্রীরা ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাদের সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। ঈশান জানে না, কে মারা গেছে, সে মেয়ে না পুরুষ, জোয়ান না বুড়ো। তার এ সব জানারও দরকার নেই। শুধু এটুকু জানে, এই শ্মশানের কোথাও না কোথাও মা লুকিয়ে আছে। তাকে দেখা দেবেই।

প্রায় দিনই রাত্রিবেলায় মাকে স্বপ্ন দেখে ও উঠে বসে। মা-র সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তেই ঘুমটা ভেঙে যায়। মাকে আর দেখতে পায় না। চুপ করে বসে থাকে। সারা রাত আর ঘুম হয় না। ভোররাতে শ্মশানে চলে আসে। যদি মড়া পোড়ে, তা হলে শ্মশানে লোক থাকে। না হলে শ্মশান ফাঁকা।

ঈশান গঙ্গার ঘাটে বসে থাকে। নিস্তব্ধ রাতে নদীর কুলকুল শব্দ শোনে। হাওয়ায় শ্মশানঘাট লাগোয়া অশ্বত্থ গাছের পাতাগুলো নড়ে ওঠে। ঈশান মায়ের অস্তিত্ব টের পায়। অথচ, মাকে দেখতে পায় না। তার পর পাখিদের ঘুম ভাঙে। তাদের কলককাকলিতে এড়েদার এই শ্মশানঘাট মুখরিত হয়ে ওঠে। দু’-এক জন নাইতে আসেন। আস্তে আস্তে ভোর হয়। ঈশান বাড়ির পথে রওনা হয়। যাওয়ার পথে কালীমন্দিরে মাথা ঠুকে নমস্কার করে আসে।

আজ শ্মশানে লোক আছে। কারণ মড়া এসেছে। কেউ গল্প করছে, কেউ তার মতোই বসে আছে শান বাঁধানো ঘাটে, কেউ বা আবার চিতার পাশে থেকে ডোমকে নির্দেশ দিচ্ছে। চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সে দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ঈশান। হঠাৎই শুনতে পেল, কেউ যেন তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করছে।

ঈশান ব্যস্ত হয়ে পিছনে তাকাতেই লোকটাকে দেখতে পেল। দীর্ঘকায় ভদ্রলোক। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। ঈশানের পাশে এসে বসলেন ভদ্রলোক। আবার বললেন, “তোমার নাম কী? তুমি তো শ্মশানযাত্রী নও।”

ঈশান নিজের নাম বলে। শ্মশানে আসার উদ্দেশ্যও জানায়। ভদ্রলোক প্রথমে কোনও কথা বলেন না। তার পর বলেন, “আমি তোমার কষ্টটা বুঝি। পৃথিবীতে মায়ের থেকে আপন আর কেউ নেই। ওই যে দেখছ চিতার আগুন জ্বলছে, খানিক পরেই তা নিবে যাবে। আর নিবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যাবে। কিছুই থাকবে না। যাক, কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”

“নাইন,” উত্তর দেয় ঈশান।

“বাড়ি কোথায়?”

“নদাপাড়ায়।”

“তা হলে তো কাছেই থাকো। কাছে থাকো বলেই কি রোজ এত রাতে শ্মশানে আসতে হয়?”

“রোজ আসি না। মাঝে মাঝে যে দিন মনে হয়, এখানে এলে মাকে দেখতে পাব, সে দিন আসি।”

“পেয়েছ দেখতে?”

“না। তবে মনে হয়, এখানেই আছে মা,” মনটা শান্ত হয়।

“মা তো আছেনই, তবে অন্য কোথাও নয়, তোমার অন্তরে। তোমার হৃদয়ে আরও এক জন মা আছেন, সেটা কি জানো তুমি?”

“আর এক মা? কে তিনি?”

“ভারতমাতা। যাঁর পায়ে আজ পরাধীনতার শৃঙ্খল।”

ঈশানের মনে পড়ে যায় যোগিনী মা-র কথা। যোগিনী মা-ও একই কথা বলেছিলেন। ঈশান যোগিনী মা-র কথা তুলতে গিয়েও চেপে যায়। বলে, “এই পরাধীনতার শৃঙ্খল কি আমরা ভাঙতে পারি না?”

“অবশ্যই পারি। দেখছ না, তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। এই লড়াইয়ে আমাদের জয় হবেই,” ভদ্রলোক বললেন। আবেগে তাঁর চোখমুখ বদলে যাচ্ছিল। একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, “ক্ষুদিরাম নামে যে ছেলেটিকে ফাঁসি দেওয়া হল, তার বয়স জানো?”

কী উত্তর দেবে, তা বুঝতে না পেরে, ঈশান হাঁ করে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে।

ভদ্রলোকের চোখ এখন গঙ্গার দিকে। সেখান থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, “মাত্র আঠারো বছর। এক বারও ইতস্তত করেনি। তাকে যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সে তা পালন করেছিল। যদিও, গাড়ি চিনতে ভুল করায় আসল শয়তানটাই বেঁচে যায়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে, শেষ কথা কী বলেছিল ক্ষুদিরাম, জানো?”

এটা জানে ঈশান। বড়দের কাছে শুনেছে। বলল, “বন্দে মাতরম্।”

“মানে জানো কথাটার?” ভদ্রলোক বললেন।

এটাও ঈশানের জানা। সে বলল, “মায়ের উদ্দেশে প্রণাম জানানো।”

“ঠিক। মাকে বন্দনা করাই ‘বন্দে মাতরম্‌’। তবে এই মা হচ্ছেন বাংলার মা, ভারতের মা। তুমি চাইলে, এই মায়ের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারো। ভেবে দেখো। আমার নাম উমাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। বেলঘরিয়া মোষপুকুরের ধারে বাড়ি। চলে এসো এক দিন। আমি এ বার ও দিকে যাই। পোড়ানো শেষ হল বোধহয়। এ বার চান করে বাড়ি যাই,” বলে ভদ্রলোক হাঁটা দেন।

সেই দিকে খানিক ক্ষণ তাকিয়ে ঈশানও হাঁটা দেয় বাড়ির পথে। হাঁটতে হাঁটতে ঈশান ভারতমাতাকে কল্পনা করার চেষ্টা করে মনে মনে। কিন্তু কী আশ্চর্য, মা-র মুখটাই ঘুরে ফিরে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার চোখে জল আসে। ঈশান দ্রুত পা চালায়।

দুটো দিন কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল ঈশানের। ছাদে উঠে একা একা কত বার যে ‘বন্দে মাতরম্‌’ বলেছে, তার ইয়ত্তা নেই। জেঠিমা উঠেছিলেন কাপড় মেলতে। দূর থেকে ঈশানকে লক্ষ করে একটা হাঁক পাড়লেন, “এই ঈশান, এ দিকে আয় তো এক বার।”

ঈশান কাছে এলে ভাল করে নিরীক্ষণ করেন, তার পর বলেন, “তোর মতলবটা কী বল তো? সাতসকালে ছাদে উঠে হাত-পা নেড়ে বিড়বিড় করছিস! লেখাপড়ার পাট তো চুকিয়ে দিয়েছিস। স্কুলমুখো হওয়ার নাম নেই। বাপটাকে একটু সাহায্য করতে পারিস তো? দিন রাত এ পাড়া-ও পাড়া ঘুরে বেড়ালে হবে?”

ঈশান কোনও উত্তর দেয় না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জেঠিমা আরও কী সব বলতে বলতে ছাদের সিঁড়ির পথে অদৃশ্য হয়ে যান।

বিকেলের দিকে ঈশান রওনা হয় মোষপুকুর। এর মধ্যে শশিকান্তকে জিজ্ঞেস করে ঈশান জেনে নিয়েছে মোষপুকুর জায়গাটা ঠিক কোথায়। শশিকান্তর মাসির বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরে। শশিকান্তর মাসির বাড়িতে বেশ কয়েক বার গেছে ঈশান। তাই খুঁজে নিতে অসুবিধে হবে না তার।

মোষপুকুরের কাছে এসে দু’-এক জনকে জিজ্ঞেস করতেই ঈশান জানতে পারল উমাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির হদিস।

ভদ্রলোক ঠিকই বলেছিলেন। মোষপুকুরের ঠিক ধারেই ওঁর বাড়ি। লাল রঙের দোতলা বাড়ি। বাড়ির দরজার উপর সাদা পাথরের ফলকে লেখা ‘সারদা ভবন’।

ঈশান দরজায় কড়া নাড়তেই, এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক দরজা খুলেই বললেন, “রবি তো বাড়ি নেই এখন। তুমি বোধহয় রবির বন্ধু? আমি রবি এলে বলব’খন। তা তোমার নাম কী ভাই?”

ঈশান নিজের নাম বলে। তার পর খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমি উমাশঙ্করবাবুর কাছে এসেছি। আমাকে উনি আসতে বলেছিলেন।”

ভদ্রলোক নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলেন, “ও, আচ্ছা। এই পাশের ঘরে আছে। চলে যাও, সোজা।”

পাশের ঘরের দরজা ভেজানো। ঈশানের আলতো ঠেলাতেই দরজা খুলে গেল। ঈশান দেখল, ঘরের মধ্যে একটি তক্তপোশে আধশোয়া হয়ে, বই পড়ছেন উমাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়।

ঈশানের পায়ের শব্দ পেয়েই উঠে বসলেন ভদ্রলোক। বললেন, “রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছিলাম। তুমিও পড়বে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। মন শুদ্ধ হবে। স্নিগ্ধ হবে।... যাক, তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমার মতো অনেক ছেলেকে আমার দরকার।”

“আমি কি বিপ্লবী হব? আপনি কি আমায় দীক্ষা দেবেন?” ঈশান বলে। তার গলাটা কাঁপা-কাঁপা।

উমাশঙ্কর হাসেন এ কথায়। বলেন, “দরজায় খিল দিয়ে এসো।”

ঈশান দরজা বন্ধ করে এলে, উমাশঙ্কর তাকে তক্তপোশের এক ধারে বসতে বলেন।

“বিপ্লবের পথ বড়ই কঠিন, ভাই। এই পথে থাকতে তুমি প্রস্তুত তো?” উমাশঙ্কর বলেন।

“হ্যাঁ আমি প্রস্তুত!” ঈশান বলে।

“প্রাণ বাজি রেখে এই পথে নামতে হয়। পারবে?”

“পারব। দেশের জন্য প্রাণ যদি যায়, যাবে।”

“সাবাস! তোমাকে কাজে লাগবে দেশের। তুমি ঠিকই জানো, বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হয়। তবে সেটা যেখানে সেখানে হয় না। আমার দীক্ষা অনুশীলন সমিতিতে। তোমারও সেখানেই হবে। আমি নিয়ে যাব। তবে তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। ধরে নাও, এটাই তোমার বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার আগে একটা পরীক্ষা।”

ঈশান কিছুই বুঝতে পারে না। উৎসুক মুখে তাকিয়ে থাকে সামনের দীর্ঘকায় ভদ্রলোকের দিকে।

উমাশঙ্কর তক্তপোশ থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে তক্তপোশের তলায় ঢুকে যান। ছোট একটা ট্রাঙ্ক বার করে তার তালা খোলেন।

ঈশান লক্ষ করে, ট্রাঙ্কের মধ্যে এক পাশে কিছু জামাকাপড় অযত্নে রাখা, অন্য পাশে অনেক কাগজপত্র থরে থরে সাজানো। কিছু কাগজ সেখান থেকে বার করে নেন উমাশঙ্কর। তার পর ট্রাঙ্কটিতে তালা দিয়ে আবার তক্তপোশের নীচে চালান করে দেন। এর পর কাগজগুলো ঈশানের হাতে দিয়ে বলেন, “তোমার কাজ হবে, রাতের অন্ধকারে বেলঘরের রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে এই কাগজগুলো আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া। পারবে না?”

“খুব পারব। এটা আর এমন কী কঠিন কাজ! আমি তো ভেবেছিলাম, অনেক কঠিন কাজ আমাকে করতে হবে,” ঈশান হাসতে হাসতে বলে।

“যতটা সহজ তুমি মনে করছ, ততটা সহজ নয়, ঈশান। কাজটায় ঝুঁকি আছে। পুলিশ জানতে পারলে, তোমাকে তো ধরবেই। তার পর তোমার থেকে আমার নাম জেনে, আমাকেও ধরবে। তাই খেয়াল রাখবে কেউ যেন তোমাকে লক্ষ না করে,” উমাশঙ্কর সতর্ক করে।

ঈশান অবাক হয়ে তার হাতে ধরা কাগজগুলোর দিকে তাকায়।

উমাশঙ্করের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, “ওগুলো বিপ্লবী দলের মুখপত্র। পুলিশের কাছে নিষিদ্ধ।”

ঈশান একটি কাগজের সামনের পৃষ্ঠায় চোখ বোলায়। ইংরেজিতে লেখা। কাগজটির নাম ‘লিবার্টি’।

ঈশান জিজ্ঞেস করে, “বাংলা ভাষায় লেখা নেই?”

“আছে,” উত্তর দেন উমাশঙ্কর, “তার নাম ‘ভারতের স্বাধীনতা’। তবে, এই মুহূর্তে আমার কাছে ওগুলো নেই। তুমি এই ইংরেজি কাগজগুলোই দেয়ালে সেঁটে দাও। আর কিছু করতে হবে না। কিন্তু সাবধান! কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়।”

কাগজগুলোকে বগলদাবা করে ঈশান যখন ঘরের বাইরে বেরোল, তখন সন্ধে হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বাজছে। শাঁখের শব্দ শুনে ঈশান কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করল। তার পর বাড়ির পথে অগ্রসর হল।

১০

রমানাথের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। সব সময় ক্লান্তি। যা খান, তা হজম হয় না। যুদ্ধের বাজারে ব্যবসাতেও মন্দা চলছে। রোজ বড়বাজারে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে ভরসা একটাই যে, উমাটা ব্যবসা ধরে ফেলেছে। এখন তাঁর না গেলেও চলে। তবু আজ গদিতে এসেছেন ঘনশ্যামের সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কথাবার্তার প্রয়োজনে। রোদ পড়ে এলে উঠব উঠব করছেন, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে নিবারণ ঢোকে এবং রমানাথকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement