ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ
পূর্বানুবৃত্তি: লোহারবাবু, দুয়ারিবাবুরা সকলেই বোসস্যরের প্রতি আনুগত্য দেখাতে শুরু করলেন। অতিরিক্ত গরমে ঘুরে বোসস্যর অসুস্থ হয়ে পড়লে দুয়ারিবাবু তাঁর কোয়ার্টার্সের অফিসরুমে রাতে কাজ করতে বলেন বোসস্যরকে। ঘরটি তুলনায় ঠান্ডা। বোসস্যর নিমরাজি হন। এক সঙ্গে কাজ করতে করতে নানা অজুহাতে বার বার বোসস্যরকে একা রেখে উঠে যেতে থাকলেন বিটবাবু। দুয়ারিবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে বোসস্যরকে জড়িয়ে অপবাদ দেওয়াই ছিল ফন্দি। বিপদের আঁচ পেয়ে শেষ মুহূর্তে বেঁচে গেলেন বোসস্যর।
এর পর ন্যাকা সেজে বেন্দা মধুদার কাছে সেই সব ঘটনার কথা শোনে একটু রং চড়ানো অবস্থায়, যার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিজেই। আরও জানতে পারে যে, মাঝরাতে দুয়ারিবাবুর হুমকি আর বৌটার চাপা কান্নার শব্দ শুনেছে অতি-উৎসাহীরা, কাজ হাসিল করতে না পারায় বিটবাবু নাকি বৌটাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। তার পর আলো ফোটার আগেই গাড়ি জোগাড় করে ঘরে তালাচাবি দিয়ে ভাগলবা। এমনকি ছুটির দরখাস্তও দিয়ে যায়নি। ওর পেয়ারের ফরেস্ট গার্ড নীলমাধবকে বলে গিয়েছে, পুরুলিয়ায় ডিএফও অফিসে গিয়ে দরখাস্ত জমা দেবে। এই হল এ পর্যন্ত ঘটনার সার-সংক্ষেপ।
সে দিন বোসস্যর খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। বাকি কর্মচারীরাও সন্ত্রস্ত, চুপচাপ। এমনকি নাটুকে লোহারবাবু পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করলেন না। স্যরের মনমর্জি আন্দাজ করতে না পেরে বেন্দাও একটু দূরে-দূরেই রইল সারাদিন। পর দিন আবার স্যরের মেজাজ শরিফ। বেন্দাকে পাইলট করে জামতোড়িয়া বিটের কাজকর্ম দেখলেন। তার পর দুপুরবেলা গভীর জঙ্গলে বিশাল একটা নিমগাছের নীচে ফাঁকা জায়গায় ডিকি থেকে একটা মোটা চাদর বার করে মাটিতে পেতে শুয়ে পড়লেন।
এ রকম পাগলামি উনি আগেও করেছেন। বিশেষ করে মার্চ-এপ্রিল মাসে যখন মহুল গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে থাকত আর পাকা নিমফলের মতো পেকে-ওঠা মহুয়া ফুলগুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়ত গাছতলায়, বাইক চালাতে চালাতে থেমে গিয়ে উনি বাইক স্ট্যান্ড করিয়ে নেমে যেতেন গাছতলায়। ডিকিতে রাখা মোটা চাদরটা পেতে দিতে হত ফুলে-ভরা মহুল গাছের নীচে, ওর উপর আপনা থেকেই খসে পড়ত রসে-টুপটুপে পাকা মহুয়া ফুল। অনেকগুলো জড়ো হলে সেগুলো খেতেন আয়েশ করে, বেন্দাও একটু আড়ালে গিয়ে এক মুঠো করে হাপিস করে আসত মাঝে-মাঝে।
টাটকা মহুয়া ফুলের স্বাদ এতটাই মিষ্টি যে, বেশি খেলে গলার কাছটা তেতো লাগে। স্যর ওই ফুল ভরপেট খেয়ে ঝিম হয়ে পড়ে থাকতেন অনেক ক্ষণ, তার পর উঠে বসে জড়ানো গলায় ওর সঙ্গে বকবক করে যেতেন যত ক্ষণ মন চাইত। তার পর দু’জনে বাইকে করে ফেরা, তবে কোনও অবস্থাতেই বেন্দা স্যরকে বাইক চালাতে দিত না ওই সময়।
সে দিনও স্যর চাদর পেতে গাছতলায় শুয়ে আছেন এমনিই, কারণ মহুয়া ফুলের সময় সেটা নয়, বেন্দা সাহস করে কথাটা তুলল। ও যে পুরো ঘটনাটা লুকিয়ে দেখেছে, সেটা জানার পর স্যর বললেন, ‘‘কাজটা ভাল করোনি। তোমাকে দেখতে পেলে ওরা রাগের মাথায় মিথ্যে অপবাদ দিয়ে মারধরও করতে পারত। তা ছাড়া তোমায় তো বলেইছি যে এত সহজে আমার কিছু হবে না। ভবিষ্যতে আর এ রকম টেনশন কোরো না। আমার কিছু বাড়তি ক্ষমতা আছে যা সবার থাকে না, সেটাই আমাকে খুব খারাপ সময়েও খানিকটা সুবিধে দেয়।’’
তার পর স্যর ওকে বললেন যে, ফরেস্টের জবরদখল ওঠানোর দিনে দলবল নিয়ে ওখানে যাওয়ার সময়ই ওঁর সন্দেহ হয়েছিল যে, এমসিসির লোকজন আশপাশে হাজির আছে, তাই সঙ্গের কর্মচারীদের বাড়াবাড়ি করতে দেননি বা মহিলাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে বাধা দিয়েছিলেন। সেন্টারের মেয়েরা সেই ভাল ব্যবহারটা লক্ষ করে ওঁর সম্বন্ধে ভাল ধারণা তৈরি করে নিয়েছিল। তাই খুনে লোকটা ফারসা চালানোর আগেই ওঁকে ঘিরে ধরেছিল, যাতে গায়ে চোট না লাগে। এমনকি সন্ধেবেলা চলে আসার আগে ওই লোকটাই এসে পায়ে হাত দিয়ে ওর নিজস্ব ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়েছিল।
ট্রাকটা আটকানোর সময় উনি জানতেন যে, সে দিন একটা ঝামেলা হবেই, তবে অত বড় আকারে হবে বলে ভাবতে পারেননি। যখন ওরা পুলিশকে, এমনকি সশস্ত্র দারোগাকেও রেয়াত করল না, তখন উনি ঝুঁকি আছে বুঝতে পেরে সর্ব ক্ষণ ভিড়ের ভিতরটাতেই থাকছিলেন, যাতে চট করে কেউ তির, টাঙি বা ফারসা চালানোর মতো ফাঁক না পায়। ওঁকে যে ইয়ং ছেলেদের গ্রুপটা ঘিরে আগলে রেখেছিল, সেটা খেয়াল করেই উনি সাবধানে নড়াচড়া করছিলেন। খালাসি ছেলেটাকে নিয়ে একটু টেনশন তৈরি হয়েছিল বটে, তবে একশো ভাগ নিরাপত্তা না পেলে উনি বন্দুক আর গুলির উপরেই ভরসা করতেন। গুলি-টুলি চললে সরকারি অফিসার হিসেবে অস্ত্র ব্যবহারের সুবিধেটুকু তো ছিলই।
শুনতে শুনতে বেন্দার মনে হয়েছিল, স্যর যেন সব কিছুই খুব সহজ-সরল করে নিচ্ছেন। তাই থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘‘আর দুয়ারিবাবুর ব্যেপারটো, স্যর? উট্যাও কি আপুনি জাইনথ্যেন য্যে অম্যন করে বেরয়ে এ্যালেন? আর অ্যাকটু হল্যেই তো উনি আপনাক্যে ফাঁসায়্যে দিথ্য!’’
স্যর একটু হাসেন, ‘‘তুমি তো আগাগোড়া সবটাই ফলো করেছ, তাই নতুন করে বলার কিছু নেই। সত্যি বলতে, প্রথম থেকেই দুয়ারিবাবুর উপর আমার বিশ্বাস ছিল না, এমনকি লোহারবাবুর উপরও নয়। আমাকে ওর ঘরে বসিয়ে বার বার নানা অছিলায় শিবুবাবুর বেরিয়ে যাওয়ায় একটা খটকা তো ছিলই, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ওঁর গিন্নির বিশেষ একটা ব্যবহারই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলতে পার! শেষ বার শিবুবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই ওঁর শোবার ঘরের ভিতর থেকে হঠাৎই খুব জোরে-জোরে হাতপাখার শব্দ আসা শুরু হল! ফট ফট করে যেন তালপাতার পাখা কিছুতে সজোরে লাগছে বলে মনে হল। অন্য কেউ হলে ওটাকে আমন্ত্রণের ইঙ্গিত বলে ধরে নিতে পারত, কিন্তু আমার মনে হল যেন ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে ইশারায় আমাকে সাবধান করে দিতে চাইছেন। অনেক সময় চলন্ত ট্রেনের চাকার শব্দকে অনেকে যেমন খুশি ছড়ার রূপ দেয়, তেমনই আর কী! মনে হল, হাতপাখাটা যেন ‘এসো-এসো’ না বলে ‘ভাগো-ভাগো’ বলছে। আমি অন্তত তাই শুনেছিলাম। মেয়েরা তো মায়ের জাত, পাশে একটা তিন বছরের শিশুকে শুইয়ে রেখে স্বামীর অত বড় নির্লজ্জ ছলনায় অংশ নিতে হয়তো ওঁর মন সায় দেয়নি। কী জানি, মেয়েদের মন দেবতারাও বোঝেন না, আমরা তো কোন ছার!’’
বেন্দা কথাটা ঠিক হজম করে উঠতে পারল না। দুয়ারিবাবুর পরিবারকে ও বেশ কিছু দিন ধরেই দেখছে, কর্তা-গিন্নির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব আছে বলে ওর আগে মনে হয়নি। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। আসলে স্যরের চালচলনে এমন একটা সারল্য আছে, যে অল্প সময়েই কোনও-কোনও মানুষ স্যরের অনিষ্ট চাইবে না। ওর মতোই হয়তো দুয়ারিবৌদিও ভেবেছিলেন, এমন সাদাসিধে লোকটার ক্ষতি করব কেন! ও শুধু বুঝে উঠতে পারে না, এ রকম একটা ভাল মানুষের জীবনে কী এমন ব্যথার কাহিনি থাকতে পারে, যার জন্যে উনি আর বাঁচা-মরার পরোয়া করেন না! এমন কে-ই বা থাকতে পারে যে, এই মানুষটাকে বুঝতে ভুল করেছে— যে হদ্দ বোকা লোকটা নিজের ভালটুকুও হিসেব করে বুঝে নিতে পারে না!
বোসস্যর আর বেশি খুলে কিছু বলেননি, অবশ্য ওদের দু’জনের পদ আর অন্য সব কিছু বিচার করলে বন্ধুর মতো সব কথা বলাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু চুপচাপ থেকেই স্যর বেন্দার মতো অল্পশিক্ষিত মানুষেরও মনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাই বহু ক্ষণ বাদে নীরবতা ভেঙে বেন্দা বলে উঠেছিল, ‘‘ইবার অ্যাকটো বিহা করে ল্যান, স্যর! আপোনার মতো লোক লিজের ভাল্যোটাও বুইঝত্যে পারে না, মেডাম এল্যে তক্ষন ঠিক্যেই আপোনাক্যে সহি রাস্তায় লিয়্যে আসব্যেক। আমরাও এ্যাকদিন ভালোমইন্দ খাইতেঁ পেথ্যম, আজ্ঞা!’
স্যর হেসে ওঠেন, ‘‘ওরে বদমাশ, এক দিন খাওয়ার লোভে একটা নির্দোষ মেয়েকে ফাঁসিতে চড়াতে চাও? তার চেয়ে ভাল, আমি দু’দিন তোমাকে পুরুলিয়ার ভাল হোটেলে খাইয়ে দেব। আমার মতো বোকার পাল্লায় পড়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হওয়াটা কি ভাল বলে মনে কর না কি?’’ বেন্দা মুচকি হাসে, বলতে বাধো-বাধো ঠেকে যে পুরুলিয়া ডিএফও অফিসে স্যরের সঙ্গে ও গেলে জনা-তিনেক রেঞ্জারবাবু ওর কাছ থেকে স্যরের সম্বন্ধে খোঁজখবর নেয়। বেন্দা বোঝে যে ওদের সবারই বিয়ের যোগ্য মেয়ে আছে। তা ছাড়াও লোহারবাবু কাকে যেন বলছিল, চেনা-জানার সুবাদে টাটা আর রাঁচি থেকেও দু’-এক জন জানতে চেয়েছে পাত্র হিসেবে উনি কেমন, নেশা-ভাঙ করেন কি না, উপরি-টুপরি কেমন হয়-টয়। লোহারবাবু তাদের বলেছেন, এ ছেলেকে দিয়ে কিস্যুই আশা নেই— নিজেও খায় না, আশপাশের লোককেও শান্তিতে খেতে দেয় না। এমন অপোগন্ডের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেয়ে মেয়েকে আইবুড়ো বসিয়ে রাখা ভাল!
কে জানে এত বছরের মধ্যে স্যর বিয়ে করেছেন কি না, করলে ছেলে-মেয়ে ক’টি!
ঢং করে একটা ঘণ্টা পড়ে থানার ঘড়িঘরে, ক’টা বাজল সেটা বুঝে উঠতে পারে না বেন্দা, রাত একটা, না আড়াইটে, না কি সাড়ে-তিনটে বাজল এখন? ওর চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসে ক্লান্তিতে। হয়তো দীর্ঘ অতীত-ভ্রমণের কারণে। প্রায় সাতাশ বছর আগের ঘটনার খুঁটিনাটি মনে করা তো কম ধকলের নয়, বিশেষ করে একটা চোট-পাওয়া মাথার কথা বিবেচনা করলে।
পর দিন সকালে উঠে বেন্দার প্রথম কাজ হয় রেডিয়োটা সারানো, তার পর ও বাপ আর নাত-বৌয়ের মধ্যে ঝামেলাটা মেটায়। বুড়ো বাপটাকে একগাদা করে গুঁড়োলঙ্কা খাইয়ে মেরে ফেলার ফিকিরটা নিয়ে বাবার নাত-বৌকে সটান চ্যালেঞ্জ করতেই বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়ে গিয়ে স্বীকার করে যে, ওর মায়ের পরামর্শেই ও এমনটা করছিল। বেন্দা ওকে ঠান্ডা মাথায় বোঝায়, কেঁদে-কেটে অন্যায় হয়েছে বলে সে মেনেও নেয়। বাবাকে সবটা না বলে জানায়, ‘‘আজই ডাগদারের ঠেঙ্গে অসুদ লিয়্যে আইসব, দু’দিন খাঁল্যেই প্যাট অ্যাক্কেরে পোস্কার হইয়েঁ যাব্যেক। অ্যাকদম ট্যানশন কইর্যো না!’’
বেলা ন’টার পর ও রেঞ্জ অফিসে হাজির হয় খবর নেওয়ার জন্যে। কবে, কখন বোসস্যর আসবেন বান্দোয়ানে, সেটা জানা দরকার। রেঞ্জারবাবু ফিল্ডে বেরিয়েছেন বলে অনেক ক্ষণ বসতে হল ওকে, এই ক’দিনেই নিজেকে কেমন বাইরের লোক বলে মনে হচ্ছে। ফাঁকতালে নাটা মদনা পর্যন্ত এসে দু’বার ওকে কাঠি করে যায়। ও মনে-মনে ঠিক করে, এ বার বোসস্যর ঘুরে গেলে তার পর থেকে আর রেঞ্জ অফিসের সীমানা মাড়াবে না।
রেঞ্জারবাবু ফিরলেন খুব ক্লান্ত হয়ে, বললেন, ‘‘দ্যাখ বেন্দা, তুই বিকেলের দিকে আসিস, তোর সঙ্গে কথা আছে কাজকর্মের ব্যাপারে। কিছু দিন আমার পাইলটের কাজটা তোকেই করে দিতে হবে। জানিসই তো, অফিসে কাজের লোক দিন-দিন কমে যাচ্ছে। তোকে হাতখরচের কিছু টাকা আমি যে ভাবে হোক ব্যবস্থা করে দেব। তুই আর আপত্তি করিস না— অন্তত আমি যে ক’দিন এখানে আছি। আর হ্যাঁ, আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় কালীপুর চিড়িয়াখানায় কাজ করে। ঘণ্টাখানেক আগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম অনিকেত বোস সম্বন্ধে, যে কবে আসবেন উনি। তাতে বলল যে, আজই সকালে ওকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি ওঁর, বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। কী রে, তুই অমন করছিস কেন? তোর কি মৃগী রোগও আছে নাকি আবার, অ্যাঁ?’’
১১
অসময়ে ওয়েদারটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল, কাল রাতেও বৃষ্টির আভাস ছিল না। ভোরবেলা থেকে শুরু হয়েছে জোর হাওয়া আর বৃষ্টি— কখনও জোরে, কখনও টিপটিপ করে। আসলে গুজরাতে এ সময়ে বৃষ্টি-বাদল থাকে না। এমনিতেই তো রাজ্যটা প্রায়-ঊষর। অক্টোবরের শেষে এখানে শীত পড়ে যায়। অন্নুর মনে হল, ওর মনের মতো আকাশের মনও ভার হয়ে আছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, তাই সকালেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আজ অফিস যাবে না। কিন্তু একা থাকার উপায় কোথায়? কখনও কাজের লোকেরা এসে এটা-ওটা নিয়ে বিরক্ত করছে, তো কখনও প্রীত ওর শরীরের খবর নিতে গিয়ে আদিখ্যেতার একশেষ করছে। অন্য সময় প্রীতের ওকে কথায়-কথায় চোখে হারানো ও বেশ উপভোগ করে, আজ অসহ্য লাগছে। প্রীত কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে একা ঘরে যেন একটু শান্তি পেল অন্নু। তার মন চলে গেল একত্রিশ বছরেরও আগে এমনই এক বর্ষণমুখর দিনে।
যথেষ্ট ভালবেসেই অন্নু অ্যানথ্রোপলজি বেছে নিয়েছিল। কিন্তু পরে আশপাশের লোককে বোঝাতে হিমশিম খেয়েছিল যে, বিষয়টা সায়েন্স না আর্টস? ওর মতে দু’টোই, কারণ এর অনেকটা ইতিহাস আর বাকিটা বিজ্ঞান। যা-ই হোক, ওর ডিপার্টমেন্ট সায়েন্স বিভাগের লাগোয়া ছিল। বিশেষ করে জ়ুলজি বা প্রাণিবিদ্যা বিভাগের, ফলে দু’টো ডিপার্টমেন্টেই ওর অবাধ বিচরণ। মাঝে একটা ছাউনি-দেওয়া গোল বসবার জায়গা দু’টো বিভাগের মেয়েরাই সর্ব ক্ষণ দখল করে রাখে। শরীরী উপস্থিতি এবং ব্যক্তিত্ব মিলিয়ে অন্নু তাদের মক্ষিরানি। ওদের কাউকে টিজ় করলে কপালে দুঃখ আছে। হালকা চড়চাপড়, বা দু’-এক জনকে কানও ধরতে হয়েছে। ফলে, ছেলেরাও ওই মেয়েদের এড়িয়ে চলে।
সেই দিনটায় ওরা গোলঘরে গিয়ে বসার পরেই হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। সবার মধ্যে একটা মিইয়ে-যাওয়া অনুভূতি। হঠাৎই অন্নুর নজরে পড়ল একটা অচেনা ছেলের দিকে— ওর ভাষায় একটু ন্যালা-ক্যাবলা টাইপের।
ক্রমশ