দ্বীপনিসর্গ: মলদ্বীপের সমুদ্রতট ও তটরেখা বরাবর সবুজের সমাবেশ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। ছবি: গেটি ইমেজেস।
মলদ্বীপের স্বাধীনতা দিবস ২৬ জুলাই এবং আমাদের ১৫ অগস্ট। দু’টি উপলক্ষ মিলিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় মলদ্বীপীয় শিল্পীদের পক্ষ থেকে সে দেশের প্রথিতযশা শিল্পী আব্দুল্লাহ রামিজ বলেছিলেন, তাঁদের অনুষ্ঠানে আমাদের জন্য ‘সারপ্রাইজ়’ থাকবে। কিন্তু তাই বলে এমন ‘সারপ্রাইজ়’? অনুষ্ঠানে ভারতের জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান? ‘বন্দে মাতরম্’-বিতর্কের সময় আমার যুক্তি ছিল, মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতেও তো রয়েছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’। কিন্তু পূর্বের প্রতিবেশীর মতো পশ্চিমের দ্বীপরাষ্ট্রেরও এই রকম চমক দেওয়ার দক্ষতায় আমি তো হতবাক! ভারতীয় কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে আমার হাত-পা ঠান্ডা! সংবিধান অনুযায়ী মলদ্বীপ ‘ইসলামিক রিপাবলিক’, কেউ আবার ধর্মীয় অনুশাসনের নিগড়ে আমাদের মাপতে না বসে!
এই হল প্রথম ঘটনা।
দ্বিতীয় ঘটনা। সুলতান পার্ক মলদ্বীপের রাজধানী মলের একেবারে সেন্ট্রাল পয়েন্ট, একেবারে যেন আমাদের ধর্মতলা। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে একটা বোমা হামলার পর থেকে এই পার্কে আর কোনও বড় অনুষ্ঠান হয়নি। নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সন্দেহ অনুযায়ী, সুলতান পার্কে সেই বোমা বিস্ফোরণের পিছনে নাকি আল কায়দা-র হাত ছিল। এ-হেন সুলতান পার্কে অনুষ্ঠান করার জন্য রাজধানী মলে শহরের তৎকালীন মেয়র আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। ২০২০-র বর্ষশেষে যাবতীয় কোভিড প্রোটোকল মেনে যদি কিছু করা যায়। আমরাও রাজি হলাম। রাত্রি সাড়ে আটটায় শুরু হল অনুষ্ঠান। মানুষে মানুষে নির্দিষ্ট ব্যবধান মূল মঞ্চের সামনে। সেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে আমাদের পশ্চিমের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দূতাবাস, যারা সর্বদাই আমাদের কাশ্মীরি বন্ধুবান্ধবদের নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। সেই ‘চ্যালেঞ্জ’ এবং অন্য দিকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এর ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রক এবং মসজিদকে সাক্ষী রেখেই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পার্কের তিন দিকে খোলা রাস্তা, সেখান থেকেই এই মুক্তমঞ্চ সরাসরি দেখতে পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে লোক জমছে। রাত বাড়ছে— দ্বীপবাসী হুল্লোড়বাজ মানুষের ভিড়ও। মলদ্বীপের আর এক বিখ্যাত শিল্পী, মারিয়াম ওয়াহিদা গাইলেন, ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি, দেখ ফির হোতা হ্যায় কেয়া...’
পার্কের ভিতরে বাইরে সবাই উচ্ছ্বসিত। শুধু আমার বুক ঢিপঢিপ! অনুষ্ঠান হচ্ছে ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারের ব্যানারে; মলদ্বীপের আইনানুসারে রিসর্ট ছাড়া অন্যত্র মদ্যপান দণ্ডনীয় অপরাধ।
এই দু’টি ঘটনা উল্লেখ করার কারণ, আমাদের এই পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যেখানকার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল নিয়ে গোটা বিশ্বে চর্চা হয়েছে, সেই ১৩০০ দ্বীপের রাষ্ট্রের অস্থিমজ্জায় কতটা ভারতীয় সংস্কৃতি, বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, বলিউড মিশে রয়েছে তা বোঝানোর জন্য। এই লেখার শুরুতেই যে আব্দুল্লাহ রামিজের কথা বলেছি, যিনি চার বছরের যাপনে আমার কাছে ‘আব্দুল্লাহ ভাই’ হয়ে উঠেছিলেন, সেই সত্তরোর্ধ্ব শিল্পী কিন্তু একটিও হিন্দি শব্দ বলতে পারেন না। কিন্তু যে কোনও হিন্দি গান যতটা আবেগ এবং নিখুঁত সুরে গেয়ে দেবেন, তাতে মিউজ়িক রিয়ালিটি শো-এর অনেক প্রতিযোগীও লজ্জা পাবে। আব্দুল্লাহ ভাই, শাকির ভাইয়ের মতো যাঁরা আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, অর্থাৎ প্রাক-ইন্টারনেট যুগে বলিউড নামক কুহকি মায়ায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু শুধুমাত্র টেপরেকর্ডারে শুনে শুনে হিন্দি গান শিখেছিলেন। আজকের মলদ্বীপে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতোই নবীন প্রজন্মের হাতে স্মার্টফোন, বাড়িতে বাড়িতে কারাওকে, কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্রের ৭০ পার করে দেওয়া প্রজন্ম বলিউডকে চিনেছিল শুধুমাত্র গান ভালবেসে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক সময়ে মলদ্বীপের রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী বলে পরিচিত আব্দুল্লাহ ইয়ামিন, যিনি এই নির্বাচনে জেলে বন্দি থেকেও খেল দেখালেন, তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই মামুন আব্দুল গাইয়ুমকে সেই গত শতকের আশির দশকে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেনা পাঠিয়ে বাঁচানোর অনেক আগে থেকেই আমাদের সঙ্গে এই দ্বীপরাষ্ট্রের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছিলেন শচীন কর্তা, রাহুল দেব বর্মণ কিংবা শঙ্কর জয়কিষনরা। মলদ্বীপকে দস্যু আক্রমণ থেকে বাঁচানোর স্মৃতি আর এই দ্বীপরাষ্ট্রে সেই সময় হওয়া সার্ক সম্মেলনের নস্টালজিয়াকে ফিরে পেতে মলের জেটি ধরে যত বার হেঁটেছি, অনুভব করেছি আমার পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ কিংবা হড়বড় করে হাঁটতে থাকা কিশোর যে গান গুনগুন করছে, সেটা আসলে বলিউডের কোনও হিট গান।
আজকের মলদ্বীপ ‘ফেভারিট টুরিস্ট ডেস্টিনেশন’ হয়ে ওঠার পিছনে গত শতকের আশির দশকে এক জন ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফার। তিনি যখন বিমান ভাড়া করে শ্রীলঙ্কার কাছাকাছি সমুদ্রের ছবি তুলছেন, তখনই নীল জল আর অপার সাদা বালুর পর পর দ্বীপপুঞ্জ দেখে ছবি তুলতে শুরু করেন। সেই মলদ্বীপের আন্তর্জাতিক পরিচিতি পাওয়ার শুরু। তার পরেরটা ইতিহাস। ফ্লোরিডা বা মোনাকোকে টেক্কা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ কী ভাবে বছরের পর বছর টম ক্রুজ়, ডেভিড বেকহ্যাম, ম্যাডোনা বা শাকিরার মতো আন্তর্জাতিক মানের সেলিব্রিটিদের বড়দিন কাটাতে টেনে নিয়ে এসেছে, তা অবশ্যই আলাদা করে চর্চার বিষয়। কিন্তু ওই ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফার হয়তো জানতেন না, মুসলিম সংখ্যাগুরু এই দ্বীপরাষ্ট্রের সংস্কৃতির রোজকার যাপনেও কত গল্প লুকিয়ে রয়েছে। যেমন, ইদের সন্ধ্যায় নারী-পুরুষ সকলে মিলে ‘বোডুবেরু’ (বড় ঢোল) সহযোগে নাচগান, তেমনই সমুদ্রের ধারে বালিতে সবাই মিলে রঙ খেলা, একে অপরকে শুভেচ্ছার রঙে রাঙিয়ে দেওয়া মলদ্বীপের সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ।
গত চল্লিশ বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা, বিশেষ করে চার্টার্ড প্লেনে করে আসা সাদা চামড়ার মানুষদের অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে মলদ্বীপ পশ্চিমি আদবকায়দায় রপ্ত হয়ে গিয়েছে। রাজধানী শহরের তো বটেই, যে ৬০০ দ্বীপে মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে, সেখানে যে কোনও কাফে অথবা রেস্তরাঁয় গেলে ইউরোপ-আমেরিকার চেনা গন্ধটা টের পাওয়া যায়। তার ফলে যেমন মলদ্বীপীয়রা পরিবার এবং পরিবারের বাইরে একে অপরকে শুধু নাম ধরে ডাকতেই স্বচ্ছন্দ হয়ে গিয়েছে, তেমনই তাঁদের সঙ্গে আবার একটু মিশলেই বোঝা যায় মন-মানসিকতায়, আমাদের মতোই পারিবারিক বন্ধনের ধারণা কত প্রবল। ‘বে’ (ভাই) বা ‘ধাত্তা’ (দিদি) শুনলে আপ্লুত হয়ে পড়েন মানুষজন। দক্ষিণ ভারত থেকে ভৌগোলিক ভাবে এত কাছে হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিক বিনিময় অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক। আমাদের দক্ষিণের লক্ষদ্বীপ এবং মলদ্বীপের উত্তরের দ্বীপগুলি ভাষায়, সংস্কৃতিতে, পোশাকে প্রায় সহোদর-সহোদরা। তাই ‘আইডেন্টিকাল টুইন’, সেই যমজ লক্ষদ্বীপ থেকেই শিল্পীদের নিয়ে আসা হয় মলদ্বীপের উৎসবের মরসুমকে ভারতীয় স্পর্শ দিতে।
আমরা যারা কলকাতায় থাকি, তারা যেমন নিউ মার্কেট এবং তার আশপাশের এলাকা মারকুইস স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিটকে চিনি বাংলাদেশি পর্যটকদের ‘ডেরা’ হিসেবে, জানি কোন রেস্তরাঁয় কচু-চিংড়ি কিংবা শুঁটকির ভর্তা পাওয়া যায়, ঠিক তেমনই দক্ষিণের শহর কোচিতে গেলে এ রকমই মলদ্বীপীয় মহল্লা দেখতে পাওয়া যাবে। মারকুইস স্ট্রিটে যদি সাইন বোর্ডে ‘ঢাকাই কাচ্চি’ কিংবা ফালুদা খাওয়ার জন্য সাদর আমন্ত্রণ থাকে, তা হলে কেরলের ওই শহরেও নির্দিষ্ট এলাকায় রেস্তরাঁর সাইনবোর্ডে খাঁটি মলদ্বীপীয় খাবার রোশি (রুটি), মাসহুনি (মাছ এবং কোরা নারকেলের একটি পদ) এবং গারুদিয়া (মাছের ঘন ঝোল) এবং রিহাকুড়ু (মাছের একটি ঝাঁঝালো পদ) চাখার ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ থাকে। সাইন বোর্ডগুলি ‘দিভেহি’ ভাষায় লেখা থাকে। আসলে বেনাপোল পেরিয়ে যেমন বাংলাদেশের মানুষরা আসেন কলকাতা কিংবা এই শহরকে ‘ট্রানজ়িট’ করে দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার জন্য, ঠিক তেমনই পশ্চিম পারের এই প্রতিবেশী দ্বীপপুঞ্জ থেকে হাজারে হাজারে মানুষ কর্নাটক, কেরল বা তামিলনাড়ু যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে। আর মলদ্বীপ তো শুধু নামে রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র নয়, রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাদের স্বাচ্ছন্দ্যই সেখানে সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পায়। মলদ্বীপে ‘আসান্ধা’ বলে একটি জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার প্রকল্প রয়েছে। মলদ্বীপের এই স্বাস্থ্যবিমা বা ‘আসান্ধা’ দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলিতে এতটাই পরিচিত যে, সেখানকার হাসপাতালে কেউ ‘হেলথ কার্ড’ নিয়ে পৌঁছলেই হল, নিখরচায় চিকিৎসা হয়ে যায়। দক্ষিণের ওই হাসপাতালগুলি জানে, মলদ্বীপ সরকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বকেয়া অর্থ চলে আসবে।
যে ‘দিভেহি’ ভাষার সাইনবোর্ড দক্ষিণ ভারতের শহরগুলির অনেক রেস্তরাঁয় দেখা যায়, সেই ‘দিভেহি’ ভাষার সঙ্গে আমাদের দেশের নিবিড় আত্মীয়তা। দিভেহি ভাষায় আরবি, ফারসি বাদ দিলে শুধু তামিল, মালয়ালম শব্দ তো আছেই, সংস্কৃত ও পালিরও অনেক শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের ‘দিবস’ যেমন দিভেহি ভাষায় ‘ধুবস’, ‘শুক্র-শনি’ ‘হুকুরু-হোনি’, তেমনই ‘রবিবার’ ‘আদিত্থ্’। রাস্তা অর্থে ‘মার্গ’ দিভেহি ভাষায় ভেঙে হয়েছে ‘মাগু’ আর ‘গৃহ’ দিভেহি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ‘গে’ বলে পরিচিত। এই ভাষায় পোশাকের প্রতিশব্দ ‘লিবাস’। ভাষা এবং সংস্কৃতি ভারত আর মলদ্বীপে এ রকম হাত ধরাধরি করে চলে বলেই বোধহয় দ্বীপরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি করে ভারতীয়দের দেখা যায়। মলদ্বীপের শিক্ষামন্ত্রকের অধীনে চলা স্কুল বা কলেজে শুধু মলে শহর নয়, দূরান্তের দ্বীপগুলিতেও ভারতীয় শিক্ষকই বেশি সংখ্যায় চোখে পড়ে। প্রায় শ্রীলঙ্কা ছুঁই-ছুঁই আড্ডু শহরে পৌঁছে দেখেছি, যে শহর তথা দ্বীপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের ঝোড়ো আক্রমণের প্রতিরোধে ব্রিটিশদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘আউটপোস্ট’ ছিল, সেই দ্বীপেও ইংরেজি বা কম্পিউটার সায়েন্স পড়ানোর জন্য কাশ্মীর কিংবা কেরল থেকে শিক্ষক নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আসলে প্রথমেই বলেছিলাম না, মলদ্বীপীয়দের অস্থিমজ্জায় যদি থাকে বলিউডের সুর, তা হলে রাষ্ট্রের ডিএনএ পর্যন্ত ভারতের প্রভাব রয়েছে। সমুদ্রের থেকে জমি উদ্ধারের জন্য আমাদের দেশ থেকে যেমন বোল্ডার যায়, তেমনই জুনে বা ডিসেম্বরে ভেলানা বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভারতীয় পর্যটক গিয়ে পৌঁছোয়। রাঘব চড্ডাকে বিয়ের পর পরিণীতি চোপড়া গেলে আমরা আজকাল ‘এক্স’ হ্যান্ডলের মাধ্যমে জানতে পারি। বলিউডের যে যুগল এখনও বিয়ে সেরে উঠতে পারেননি, তাঁদেরও সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট দেখে বুঝে নেওয়া যায়, তাঁরা কোথায় ‘আদরের নৌকো’য় ভেসেছেন। কিন্তু এর বাইরেও রয়েছেন অসংখ্য ভারতীয় যাঁরা বেহিসাবি হতে, খোলা আকাশ আর দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে জীবনের সব ‘স্ট্রেস’ ভুলতে এই দ্বীপরাষ্ট্রের প্রায় ২০০টি নির্জন দ্বীপে তৈরি হওয়া কোনও না কোনও রিসর্টে যান। অবগুণ্ঠনবতী তরুণী ফ্লাইটে উঠেই হট প্যান্টসে চলে যান, জৈন খাবারের জন্য পাচক সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বিরাট দলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বিমানবন্দরে ওয়েটিং লাউঞ্জে।
করোনা-পরবর্তী সময়ে মলদ্বীপ পর্যটন নিজেদের ছাঁচ অনেকটা ভেঙেছে। লক্ষ টাকার, সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে রাখা ব্যালকনিওয়ালা রুমের পাশাপাশি ‘বাজেট গেস্ট হাউস’ এসেছে, আছে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ডর্মিটরিতে রাত কাটিয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধে। টম ক্রুজ় এবং শাহরুখ খান তো যাবেনই, ফ্রন্ট রোয়ে বসে যাঁরা তাঁদের সিনেমা দেখেন, সেই মধ্যবিত্তদেরও হাতছানি দিচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্র।
সাম্প্রতিক ভারত মহাসাগরে মলদ্বীপের ‘স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন’ বা ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অনেক তোলপাড় হলেও, ওয়াশিংটন কিংবা বেজিংয়ের বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক দিস্তা দিস্তা গবেষণাপত্র লিখে ফেললেও, নৌ পরিবহণের ইতিহাসের সঙ্গে মলদ্বীপের ইতিহাসের প্রায় ২০০০ বছরের সম্পর্ক। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেশে বণিকরা যেমন তাঁদের যাত্রাপথে এখানে কিছু কালের জন্য নোঙর করেছেন, তেমনই মলদ্বীপীয়রা পূর্ব উপকূল ধরে বাণিজ্যের জন্য পৌঁছে গিয়েছেন বাংলায়। এই বাণিজ্যের প্রধান উপাদান ছিল কড়ি। মলদ্বীপীয় শ্বেতশুভ্র কড়ির কদর ছিল বাংলার অর্থনীতিতে। বন্দর থেকে বন্দরে, তাম্রলিপ্ত বা আদি সপ্তগ্রামে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন হত না, সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ছিল অবিরাম। মলদ্বীপে থাকাকালীন মৎস্যজীবী জীবন থেকে উঠে আসা একটি লোকগান আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলাম। বন্ধুদের মন্তব্য এবং আলোচনা প্রসঙ্গে উঠে এল— এই গানের সুর বাংলাতেও আজও বিশেষ ভাবে পরিচিত, হয়তো প্রচলিত কোনও অতীত সূত্র ধরেই। সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। আর এক স্তরের মানুষ এই সাংস্কৃতিক বিনিময় দেখে অভিভূত, চমৎকৃত হয়।
শহরের যে মেয়র আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাঁর জায়গায় পরে যিনি মেয়র হয়েছিলেন— মহম্মদ মুইজ্জু— বিশ্বাসে কিছুটা কট্টরপন্থী। সেই মুইজ্জুর নির্বাচনে জয় নিয়েই সাম্প্রতিক কালে চলেছে এত আলোড়ন। তিনি বর্তমান মলদ্বীপের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে মহম্মদ মুইজ্জু অনড়, কিন্তু মলদ্বীপবাসীর হৃদয়ে, মননে, যাপনে যে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি, তার থেকে ভারতকে তিনি বাদ দেবেন কী করে?