football

আত্মঘাতী গোলের জন্য দিতে হয়েছিল প্রাণ

১৯৯৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ। মাফিয়া চক্রের হুমকি নষ্ট করে কলম্বিয়ার ফুটবলারদের স্বাভাবিক ছন্দ। মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিজের গোলেই গোল দেন অধিনায়ক আন্দ্রে এস্কোবার।

Advertisement

সূর্যশেখর‌ দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ ০৭:৩৫
Share:

হতভাগ্য: ফুটবলার আন্দ্রে এস্কোবার। ছবি: গেটি ইমেজেস।

বহু ক্রীড়ামোদী মানুষের কাছে ফুটবল বিশ্বকাপ ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। কিন্তু সেই খেলাকেই কেন্দ্র করে যখন কোনও খেলোয়াড় খুন হয়ে যান, তখন থমকে যেতে হয় আতঙ্কে! কলম্বিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক আন্দ্রে এস্কোবারের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল!

Advertisement

১৯৯৪ সালে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার অধিনায়ক ছিলেন আন্দ্রে এস্কোবার। কার্লোস ভালদেরামা, ফ্রেডি রিনকন এবং ফাউসটিনো অ্যাসপ্রিয়ার মতো কিছু অসামান্য ফুটবলার ওই দলে ছিলেন। এই বিশ্বকাপের আগে ছাব্বিশটা ম্যাচে মাত্র একটায় হেরেছিল কলম্বিয়া। আর্জেন্টিনাকে তাদেরই ঘরের মাঠে (বুয়েনস আইরেস) ৫-০ গোলে চূর্ণ করে সমগ্র ফুটবলবিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিল কলম্বিয়া। আর্জেন্টিনা তার ঠিক আগের চারটে বিশ্বকাপের মধ্যে তিন বারের ফাইনালিস্ট এবং দু’বারের চ্যাম্পিয়ন। সেই মারাদোনার দেশকে কলম্বিয়া যখন বুয়েনস আইরেসে বিধ্বস্ত করল, তখন ফুটবল-সম্রাট পেলে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ভালদেরামারা ’৯৪-এর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তো অন্তত উঠবেনই।

আন্দ্রে এস্কোবার যে সময়ে ফুটবল খেলতেন, তখন কলম্বিয়ার এক অদ্ভুত যন্ত্রণার সময়। কলম্বিয়ার সমাজ এবং ফুটবল খেলার সঙ্গে ওই দেশের কুখ্যাত ড্রাগ-চক্রের একটা যোগসূত্র ছিল। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা মানুষের লাশ, পুড়তে থাকা মোটরগাড়ি, তছনছ হয়ে যাওয়া দোকান-বাজার— এই সব দৃশ্য সেই সময়ে কলম্বিয়ায়— বিশেষত এস্কোবারের জন্মস্থান মেডেলিনে ছিল রোজকার ব্যাপার। ড্রাগ-মাফিয়ারা ফুটবল খেলার ওপর বাজি লড়তেন। বাজিতে হারলেই ওঁদের মেজাজ বিশ্রী রকম বিগড়ে যেত। তার কুফল অনেক সময় সাধারণ মানুষকেই ভোগ করতে হত। এই সব দেখে আন্দ্রে এস্কোবার হতাশ হতেন, কিন্তু হাল ছেড়ে দিতেন না। তাঁর মনে হয়েছিল, ফুটবলের মাধ্যমেই রক্তাক্ত কলম্বিয়ার শুশ্রূষা সম্ভব।

Advertisement

তখন ড্রাগ-মাফিয়াদের সম্রাট পাবলো এস্কোবার। পাবলোর একটা অন্য দিকও ছিল, তিনি বহু গরিব-দুঃখী মানুষের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অনেকেই ওঁর মধ্যে রবিনহুডের ছায়া দেখতে পেতেন। পাবলো হৃদয় দিয়ে ফুটবল ভালবাসতেন। ক্রীড়াপ্রেমী পাবলো ফুটবলের পরিকাঠামোকে প্রচুর অর্থব্যয়ে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। ‘অ্যাটলেটিকো ন্যাশিয়োনাল’ ক্লাবের মালিক পাবলো তাঁর দলের ফুটবলারদের মোটা বেতন দিতেন। তাই বেশি অর্থ এবং কেরিয়ারের মোহে নামী ফুটবলারদের ইউরোপে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাবলোর ক্লাবেই খেলতেন আন্দ্রে। এই ক্লাব ১৯৮৯ সালে ‘কোপা লিবারতাদোরেস’ খেতাব জিতে ল্যাটিন আমেরিকায় ক্লাব ফুটবলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিল। তখন কলম্বিয়ায় ফুটবলের সোনালি সময়। তাই খুন-জখমের মধ্যেও কলম্বিয়ার জনসাধারণ জাতীয় ফুটবল দলকে কেন্দ্র করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলেন।

অনেক প্রত্যাশা সৃষ্টি করে কলম্বিয়া ’৯৪-এর বিশ্বকাপে খেলতে নামল। কিন্তু রোমানিয়া তাদের প্রথম ম্যাচেই ৩-১ গোলে হারিয়ে দিল। বহু ড্রাগ-মাফিয়া কলম্বিয়ার জাতীয় দলের ওপরে প্রচুর অর্থ বাজি লড়েছিল। কিন্তু রোমানিয়ার কাছে হেরে যাওয়ায় কলম্বিয়ার কুখ্যাত মাফিয়ারা রাগে ফুঁসতে থাকে। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে শুরু করে।

ভালদেরামাদের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে। খেলতে নামার আগেই কলম্বিয়ার ফুটবলারা ভয়ঙ্কর হুমকি পেতে শুরু করেন। ফুটবলার লুই হেরেরাকে হুমকি দেওয়া হয় যে, তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হবে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেই হেরেরার দু’বছরের শিশুপুত্রকে অপহরণ করা হয়েছিল। বিশ্বকাপ চলাকালীন হেরেরার ভাই এক রহস্যজনক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। হেরেরার খাওয়াদাওয়া, রাতের ঘুম তছনছ হয়ে যায়, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। আমেরিকার বিরুদ্ধে মরণ-বাঁচন ম্যাচে যেখানে আন্দ্রে এস্কোবারদের ঠান্ডা মাথায় খোলা মনে প্রস্তুতি নিতে হত, সেখানে তাঁরা হাড়-হিম করা হুমকির সামনে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে থাকেন। খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপ খেলার আনন্দ বিভীষিকায় পরিণত হল।

পাহাড়প্রমাণ চাপ নিয়ে কলম্বিয়া আমেরিকার বিরুদ্ধে খেলতে নামল। প্রথমার্ধে কলম্বিয়ার অধিনায়ক আন্দ্রে এস্কোবার চূড়ান্ত অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আত্মঘাতী গোল করে ফেললেন। কলম্বিয়ায় এস্কোবারের ন’বছরের ভাগ্নে টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে বলে ওঠে, “মামাকে বোধহয় ওরা মেরে ফেলবে!”

ন’বছরের শিশুও বুঝে গিয়েছিল যে কলম্বিয়ার ড্রাগ-মাফিয়ারা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে! ছেলের মুখে এই কথা শুনে এস্কোবারের দিদি মারিয়া চোখের জল চেপে ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, “না বাবা, কেউ ভুল করলে তাকে তো মেরে ফেলা হয় না। তা ছাড়া তোমার মামাকে তো কলম্বিয়ার সবাই ভালবাসে।” শেষ পর্যন্ত কলম্বিয়া ১-২ গোলে ম্যাচটা হেরে যায়। পরে সুইসদের ২-০ গোলে হারালেও বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায় থেকেই বিদায় নিতে হয় কলম্বিয়াকে। প্রবল সমালোচনায় বিদ্ধ হয়ে আন্দ্রে এস্কোবাররা দেশে ফিরে আসেন। দেশের পরিস্থিতিও তখন সঙ্গিন। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের মাত্র কয়েক মাস আগে, ১৯৯৩ সালের ২ ডিসেম্বর পাবলো খুন হন। কলম্বিয়ার সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পাবলো যত দিন বেঁচে ছিলেন, সমাজে সুস্থিতি বজায় রাখতে পেরেছিলেন।

কঠিন পরিস্থিতিতেও আন্দ্রে এস্কোবার আশা হারাননি। ’৯৪-এর বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর তিনি কলম্বিয়ার খবরের কাগজ ‘এল টিয়েম্পে’-তে লিখেছিলেন, “...বিশ্বকাপে ব্যর্থতা মানেই জীবন শেষ নয়।... পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, আমাদের আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। ... আমরা কঠিন সময় কাটিয়ে উঠে পরস্পরকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করব। প্রত্যেককে আমার শুভেচ্ছা... আমাদের আবার দেখা হবে— জীবন এখানেই শেষ নয়।”

আন্দ্রের বন্ধুবান্ধব এবং বাগদত্তা পামেলা কাসকার্ডো, সকলেই চাইছিলেন যে আন্দ্রে এস্কোবার যেন বাড়ির বাইরে না বেরোন। কিন্তু মানুষের প্রতি গভীর আস্থায় আন্দ্রে এস্কোবার ঠিক করেন যে, উনি মানুষের মুখোমুখি হবেন। ২ জুলাই ১৯৯৪ তারিখে তিনি মেডেলিনের একটি পানশালায় উপস্থিত হন। সেখানে কয়েক জন আমেরিকার বিরুদ্ধে ওই আত্মঘাতী গোলের কথা তুলে আন্দ্রেকে বিদ্রুপ করতে শুরু করেন। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ড্রাগ-চক্রের সঙ্গে জড়িত জনৈক হামবার্তো কাস্ত্রো মুনোজ আন্দ্রেকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেন। আপাদমস্তক সুভদ্র, সাতাশ বছর বয়সি আন্দ্রে এস্কোবার এক আশ্চর্য স্নিগ্ধ ফুটবল খেলতেন। তিনি মনে করতেন, ফুটবল মানুষকে মূল্যবোধ ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়, সেই কারণে তাঁকে বলা হত ‘দ্য জেন্টলম্যান’। সেই ‘জেন্টলম্যান’কেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে হল!

এস্কোবারের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গিয়েছে অনেক বছর। কিন্তু ওঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রাসঙ্গিকতা আজও শেষ হয়ে যায়নি। এখনও বিভিন্ন খেলাকে কেন্দ্র করে ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে বয়ে যায় বিষবাতাস। গত বিশ্বকাপেও কলম্বিয়ার ব্যর্থতায় ভালদেরামার দেশের ফুটবলার কার্লোস সানচেজ এবং কার্লোস বাক্কাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আজও সমাজমাধ্যমে ওঠে মারাত্মক বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের ঝড়। আন্দ্রেকে গুলি করে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল, আজকাল বহু খেলোয়াড়কে বিষাক্ত কথার তিরে মানসিক ভাবে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। ফুটবলার এস্কোবার বিশ্বাস করতেন সুগভীর জীবনবোধে। খেলাকে জীবনমরণ সমস্যা কিং‌বা হিংসা হানাহানির পর্যায়ে না নিয়ে গিয়ে, এস্কোবারের চিন্তাভাবনা-আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারলেই হয়তো তাঁর প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানানো যেত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement