সীমান্তলগ্ন: বসিরহাটে ইছামতী নদী। এপার ও ওপার বাংলার দুর্গাপুজোর বিসর্জনের জন্য এই নদী বিখ্যাত।
অনেক নদী সব কিছুতে আলাদা হলেও, নামে এক। তার মধ্যে প্রথম নাম উঠে আসে ইছামতীর।
নদিয়ার পাবাখালির কাছে মাথাভাঙা নদী থেকে নির্গত ইছামতী মাঝদিয়া রেলস্টেশনের পশ্চিমে ১১৮ নম্বর রেলসেতুর তলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে গিয়ে ঢুকেছে। তার পর আবার কুষ্টিয়া থেকে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে প্রবেশ করে কিছুটা পথ বেয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে। এর পর নদীটা আবার দত্তপুলিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বাগদা, বনগাঁ, গাইঘাটা, বাদুরিয়া, বসিরহাট হয়ে সুন্দরবনে ঢুকে পড়েছে। হিঙ্গলগঞ্জ বাজার পর্যন্ত এই নদীর নাম ইছামতী। এর পর ইছামতী নদীর নাম হয়েছে কালিন্দী। তার পর গোসাবার কাছে নদীর নাম হাড়ভাঙা ও মোহনায় বঙ্গোপসাগরে মেশার আগে রায়মঙ্গল। ইছামতী নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২৮ কিলোমিটার।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাতেও ইছামতী নামে একটি ছোট্ট নদী রয়েছে। দৈর্ঘ্যে ১০-১২ কিলোমিটার। জাখিরপুর ও মোহনা অঞ্চল হয়ে পতিরামের কাছে রাধানগরে আত্রেয়ীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে এই ইছামতী। একটা ছোট্ট খাঁড়ি ইছামতী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনাতুল্লাপুর গ্রামের কাছে।
আবার বাংলাদেশেও ইছামতী নামে কিছু নদী আছে। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার কাছে যমুনা থেকে জন্ম নিচ্ছে ইছামতী। তার পর ঘিওর, শিবালয়, হরিরামপুর, নবাবগঞ্জ হয়ে লৌহজং-এর কাছে পদ্মা নদীতে মিশছে। যদিও বর্তমান সময়ে পদ্মা ও কালীগঙ্গা নদী ইছামতীর প্রাচীন প্রবাহ অনেকটা গ্রাস করে ফেলেছে।
পাবনা শহরের কাছে পদ্মা থেকে বেরোচ্ছে আর এক ইছামতী। সেই ইছামতী আতাইকুলা, ভুলবাড়িয়া, বেড়া হয়ে ত্রিমোহনীতে হুরাসাগর নদীতে মিলিত হয়েছে। এই ইছামতী নদী নিয়ে এক ঐতিহাসিক ঘটনা লোক মুখে ঘুরে বেড়ায়। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকের ঘটনা। সময়কাল ছিল ইসলাম খাঁ চিশতির। সেই সময় বাংলা শাসন করার জন্য নানা প্রান্তে যেতে হত, কিন্তু স্থলপথে রাজমহল থেকে ঢাকা যাতায়াতের সুবিধে ছিল না। তাই ইসলাম খাঁ ঈশা খাঁ-কে নির্দেশ দিলেন একটা খাল কাটার জন্য, যে খালটা পদ্মা ও যমুনা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। ঈশা খাঁ-র কাটা খালটি ‘ঈশামতী’ খাল নামে পরিচিতি পায়। পরে লোক মুখে সেই নদীটিই এই ইছামতী।
বাংলাদেশের রাঙামাটিতেও রয়েছে একটি ইছামতী। ঠান্ডাছড়ি পাহাড়ি এলাকার এই নদীটি কর্ণফুলি নদীর উপনদী। এখানকার নদীপাড়ের মানুষেরা বিশ্বাস করেন, কোনও বন্ধ্যা নারী সন্তান কামনা করলে, ইছামতী নদী সেই নারীর মনের বাসনা পূরণ করে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের দিনাজপুরেও একটি ইছামতী নদী আছে, এর ডাক নাম তুলসীগঙ্গা।
এবার আসা যাক যমুনা নদীর কথায়। ব্রহ্মপুত্র নদী বাংলাদেশে যমুনা নামে পরিচিত। তিব্বতে এই নদীর নাম সাংপো, অসমে ব্রহ্মপুত্র ও ডিহং। আবার বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় আছে আরও একটা যমুনা। সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বসন্তপুরের কাছে ইছামতী নদীতে মিশেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলে ধুমঘাট নামের এক স্থানে রাজা প্রতাপাদিত্য নতুন এক নগর স্থাপন করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঈশ্বরীপুর হতে ধুমঘাট পর্যন্ত গোটা এলাকাটি যশোহর নামে পরিচিত হয়ে পড়ে। অতীতে সাতক্ষীরায় যমুনা নদীর জলে স্রোত ছিল প্রবল। এখন নদীতে আর জল নেই বললেই চলে। এক সময় প্রবল স্রোতবতী এই যমুনা নদীর সঙ্গে তুলনা টানা হত প্রবল পরাক্রমী রাজা বিক্রমাদিত্যের।
নদিয়াতেও রয়েছে এক যমুনা। মদনপুরের কাছে ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে চণ্ডীরামপুর, বিরহী, সীমহাট, হরিণঘাটা, নগরউখড়া, চৌবেড়িয়া, গাইঘাটা হয়ে গোবরডাঙার কাছে ইছামতী নদীতে পড়েছে। অতীতে কল্যাণী স্টেশনের একটু দূরে কুলিয়া বিলের পথ ধরে যমুনা প্রবাহিত হত। শোনা যায় কুলিয়াতেই চৈতন্যদেব যমুনায় অবতরণ করেছিলেন। যে ঘাটে তিনি অবতরণ করেছিলেন, তা ‘অপরাধ ভঞ্জনের ঘাট’ নামে পরিচিত। এই স্থান বৈষ্ণবদের পরম তীর্থস্থান ‘কুলিয়া পাট’।
যমুনা নামের একটি নদী আছে আবার দক্ষিণ দিনাজপুরেও। বাংলাদেশ থেকে উৎপত্তি লাভ করে হিলি থানার পাশ দিয়ে সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে রাজশাহীর কাছে আত্রেয়ী নদীর সঙ্গে মিলেছে।
উত্তর ভারতেও একটি যমুনা। যমুনা নদীর জন্ম মধ্য হিমালয়ের যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে। তার পর যমুনা উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির পাশ দিয়ে এসে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। হিন্দু পুরাণ অনু্যায়ী যমুনা সূর্যকন্যা আর যমের ভগিনী। অনেকের বিশ্বাস, মৃত্যুর আগে যমুনার জল পান করলে মৃত্যুযন্ত্রণা কমে।
বর্ধমানের সরাইটিকর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেহুলা নদী। আবার মালদহ শহরের বাইরে দিয়েও বয়ে যায় বেহুলা। দুই নদীই আজ বড় বিপন্ন। দুই নদী নিয়েই একই লোকবিশ্বাস— বেহুলা তার মৃত স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে ভেলায় চেপে এই নদী দিয়ে ভেসে গিয়েছিল, তার নামেই পরে নদীর নাম হয় বেহুলা।
পদ্মা থেকে জন্ম নিয়ে নদিয়া মুর্শিদাবাদের সীমান্ত ধরে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে তেহট্ট ধুবুলিয়া কৃষ্ণনগরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবদ্বীপের কাছে গঙ্গায় মিশছে জলঙ্গি। আবার মালদহ জেলার চাঁচল ব্লকেও একটি ছোট্ট নদীর নাম জলঙ্গি।
গঙ্গার প্রবাহিত প্রধান ধারা পদ্মা নামে পরিচিত। ঠিক তেমনি পদ্মা নামে আর একটি নদীর খোঁজ পাওয়া যায় উত্তর চব্বিশ পরগনায়। শ্বেতপুর, মালিগ্রাম, জীবনপুর, মগরার ওপর দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত। এই পদ্মা নদী তার উৎস অনেক দিন আগেই হারিয়ে ফেলেছে।
সরস্বতী নামের নদী হাওড়ার সাঁকরাইলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। নদিয়ার চাপড়ার কাছেও একটা সরস্বতী নদী আছে।
উত্তর ভারতের লখনউ-এর পাশ দিয়ে বয়ে যায় গোমতী নদী। শাস্ত্রমতে গোমতী নদী হল ঋষি বশিষ্ঠের কন্যা। গোমতী নামের আরও একটি নদী রয়েছে বাংলাদেশের কুমিল্লাতে। আবার নদিয়া জেলাতে বৈদ্যপুরের কাছে হাঙর নদী থেকে গোমতী নদীর জন্ম হচ্ছে। সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জ এলাকাতেও গোমতী নামের একটি ছোট নদী রয়েছে।
আদিগঙ্গা নামে যেমন একটি নদী কলকাতা শহরের বুকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত, তেমনি বাংলাদেশের ঢাকাতেও রয়েছে একটি আদিগঙ্গা। নদিয়ার চাকদহের পাশ দিয়ে যেমন বইছে বুড়িগঙ্গা, তেমনই বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জেও রয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী।
ভৌগোলিক ভাবে কোনও যোগ না থাকলেও একই নাম নিয়ে বয়ে চলেছে এই নদীগুলি।