ধর্মসমন্বয়: সিদ্ধেশ্বরী তলার পঞ্চমুণ্ডির আসন। ডান দিকে, মহাপ্রভুর দাদামশাই নীলাম্বর চক্রবর্তী পূজিত মদনগোপাল জিউ বিগ্রহ।
রাত গভীর হলে আসর বসল বাইরের ঘরে। হরদা গান ধরলেন। আদিরসের খেউড়। তাই ছোটদের প্রবেশ নিষেধ। সকলেই কারণসুধায় টইটম্বুর। মায়ের প্রসাদ নিতেই হয় পুজোর রাতে। বাবার প্রসাদ কল্কেয় দু’টান দিয়ে হরদা গেয়ে উঠলেন ‘আমি মিলিটারিতে চাকরি করি/ শনিবারেতে বাড়ি ফিরি/ ঘরটা আমার একটুখানি/ বৌয়ের জন্য যত্ন করি...’।
গানের আওয়াজ মিলিয়ে গেল দিগন্তজোড়া কালো ও গভীর অন্ধকারে। এই রাত দীপান্বিতা অমাবস্যার। সারা গ্রামেই আজ কালীপুজো। একটা গ্রামে কমবেশি দু’শোর বেশি কালীপুজো হয়। গ্রামটার নাম বেলপুকুর। তান্ত্রিক গ্রাম। নদিয়া জেলার এক প্রাচীন গ্রামও। ধুবুলিয়া রেল স্টেশন থেকে একটু দূরেই এই গ্রাম। শোনা যায় এক সময় প্রচুর বেলগাছ আর অনেক পুকুর ছিল গ্রামটায়। তাই থেকে এই গ্রামের নাম হয়েছিল ‘বিল্বপুষ্করিণী’। তা থেকে ‘বেলপুখুরিয়া’, আর তাও লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে ‘বেলপুকুর’। গ্রামের পুরনো মানুষরা বলেন, এক সময় গঙ্গা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত। আর গঙ্গার ধারে ছিল ‘বিল্বেশ্বর’ আর ‘পক্ষেশ্বর’ নামে দুই শিবের মন্দির। সেই থেকে গ্রামের নাম ‘বিল্বপক্ষেশ্বর’। সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে ‘বেলপুকুর’।
গঙ্গা এখন এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে। কথায় বলে নদী সরে যায়। সোঁতা থেকে যায়। গঙ্গার ফেলে যাওয়া সোঁতা এখনও এই গ্রামের পাশে। লোকমুখে মরা সোঁতার নাম গুড়গুড়ে খাল। গঙ্গা থেকে বেরিয়ে সুজনপুর, বহিরগাছির পাশ দিয়ে আবার গঙ্গার সঙ্গেই মিলেছে। এই গুড়গুড়ে খালের এলাকা ভিত্তিতে নানা জায়গায় নানা নাম। বেলপুকুর গ্রামের কাছে গুড়গুড়ে খালের একটা অংশের নাম মালসা দহ। আর পাশের অংশটির নাম চিলতে দহ। গরমে চিলতে দহ শুকিয়ে গেলেও মালসা দহ থেকে জল আসে। গ্রামের লোকে বলে মালসা দহের জল কখনও ফুরোয় না। মানুষের বিশ্বাস রয়েছে, এখানে অধিষ্ঠান করছেন স্বয়ং শিবঠাকুর আর তাঁর সোনার ষাঁড়। সেই ষাঁড় গ্রামকে পাহারা দেয়।
বেলপুকুর গ্রামটি যে হেতু কালীক্ষেত্র, কাজেই শিবঠাকুর গ্রামের পাশে মালসা দহে অবস্থান করছেন। এই মালসা দহে শিব থাকলেও শিবের আরাধনা হয় না। এখানে পূজিত হন গঙ্গা। বেলপুকুর গ্রামকে ভাবা হয় বারাণসীর সমতুল্য। এই গ্রামের প্রাচীন পণ্ডিত বলরাম তর্কপঞ্চাননের লেখা ‘সত্যপীরের পাঁচালী’-তে এই বিশ্বাসের কথা লেখা আছে।
বেলপুকুর গ্রামটি আবার চৈতন্যদেবের মামার বাড়ি। চৈতন্যদেবের দাদামশাই শ্রীনীলাম্বর চক্রবর্তী শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ হয়ে এই গ্রামে স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য আসেন। বেলপুকুর গ্রামে গেলে নীলাম্বর চক্রবর্তীর আদি ভিটে দেখা যায়। সেখানে আছে একটা ছোট্ট টিনের চালের মন্দির। এ ছাড়াও নতুন একটা মন্দির তৈরি হয়েছে গ্রামে। যেখানে নীলাম্বর চক্রবর্তীর পূজিত ‘মদনগোপাল’ জিউ নিত্য পূজিত হন। লোক বিশ্বাস মতে, সতেরোশো বছরের পুরনো এই বিগ্রহটি নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। ইতিহাসের বিস্ময় হল, একটি তান্ত্রিক গ্রামে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মামার বাড়ি। যে মহাপ্রভু বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছেন। তন্ত্রের পীঠস্থান হয়ে উঠছে বৈষ্ণব ধর্মের আঁতুড়ঘর। কারণ শচীমাতা যে এই গ্রামেরই মেয়ে।
গঙ্গাপারের এই গ্রামটির খোঁজ কী করে পাওয়া গেল, তার কাহিনি এই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তখন মোগল আমল। নদিয়ার রাজা রুদ্র রায়। তিনি খোঁজ পেলেন মহাশক্তিশালী এক কালীসাধকের, বেলপুখুরিয়া গ্রামে। মহারাজা পঁচিশ জন বন্ধুবান্ধব, পাইক নিয়ে বজরায় চড়ে এলেন এই গ্রামে। দেখলেন এক জন সাধক বেলগাছ দিয়ে ঘেরা একটি জলাশয়ের ধারে সাধনা করছেন। মহারাজ এসেছেন দেখে সেই সাধক মহারাজ-সহ পঁচিশ জনের খাওয়ার বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু সেই সাধকের থাকার জায়গা ছিল না। রাজা রুদ্র রায় এই অদ্ভুত কাজটি দেখে অবাক হলেন। কথাপ্রসঙ্গে সাধক রাজাকে জানলেন, সাধকের উপর গৃহী হওয়ার আদেশ আছে। রাজা গঙ্গার ধারে পাঁচশো বিঘা দান করলেন। ঘটনাটি ষোড়শ শতকের শেষের দিকের। এই সিদ্ধ সাধক ছিলেন রামচন্দ্র ঠাকুর।
ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে পূর্ববঙ্গে মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে রামভদ্রপুর গ্রামে গোঁসাই ভট্টাচার্য নামে এক জন বড় সাধক বাস করতেন। তাঁর কাছে একান্নটি করোটি নির্মিত মহাশঙ্খের মালা ছিল। তাঁর কন্যার নাম লীলাবতী, জামাতার নাম যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদুনাথের বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের কনকসার গ্রামে। এঁদের পুত্রই রামচন্দ্র ঠাকুর। পনেরো বছর বয়েসে তিনি পিতার কাছে বিদ্যাশিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর জলপথে আসেন নবদ্বীপে। সেখানে তিনি শঙ্কর তর্কবাগীশের কাছে শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে লাগলেন। পাঠ শেষে মহাশঙ্খের মালা নিয়ে তিনি গেলেন তারাপীঠে। সেখানে সাধনা শেষ করে তিনি এলেন বেলপুকুর গ্রামে, যেখানে রাজা রুদ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।
এর পর রামচন্দ্র ঠাকুর নিজের জন্মভিটে রামভদ্রপুরে গিয়ে নিজে বিবাহ করেন। বোনদের বিয়ে দেন। ভাইদের নিজের সম্পত্তি দান করেন। তার পর নিজের গ্রাম থেকে এক ঘর তাঁতি, নাপিত, ধোপা, ভূঁইমালী (গৃহ নির্মাণের জন্য) শ্রেণির লোকদের নিয়ে তিনি উঠে আসেন রাজার দান করা বেলপুকুর গ্রামের জমিতে। গ্রামের ঠিক মাঝামাঝি ব্রাহ্মণদের পাড়া স্থাপন করেন। তার পর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ দিয়ে গ্রামটিকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিলেন।
রামচন্দ্র ঠাকুরের নয় পুত্র ছিল। তার মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র রামগোবিন্দ ন্যায়ালঙ্কার এবং তৃতীয় পুত্র রত্নেশ্বর ন্যায়বাগীশ বেলপুকুর গ্রামে থাকতে আরম্ভ করেন। বাকিরা ঢাকার ফরিদপুরে চলে যান। রামচন্দ্র ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র যে পাড়ায় থাকতেন, সেই পাড়ার নাম হল বিদ্যালঙ্কার পাড়া। রামঠাকুরের তৃতীয় পুত্র রত্নেশ্বর ন্যায়বাগীশের বংশধর রঘুরাম বিদ্যাবাচস্পতির নাম অনুযায়ী গ্রামের একটি পাড়ার নাম হয় বাচস্পতিপাড়া। সাধক রামচন্দ্রের পরিবারের উত্তরসূরিদের বাড়িগুলোর কালীপুজো এই গ্রামের বড় আকর্ষণের। রঘুরামের চার পুত্র। তাঁর মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিল নিঃসন্তান। বাকি তিন পুত্র কালীশঙ্কর, গোপীকান্ত ও রুক্মিণীকান্ত থেকে যথাক্রমে বড় বাড়ি, ন’বাড়ি ও ছোট বাড়ির নামকরণ হয়। এই তিন বাড়ির পুজোকে ঘিরে উৎসাহের অন্ত নেই। গ্রামের সকলেই জানে মহাশঙ্খের মালা রয়েছে ন’বাড়িতে। কালীপুজোর দিন গভীর রাতে এই মালা সকলের সামনে আসে। এই মালা নিয়ে নানা কাহিনি গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে। বছরে একমাত্র কালী পুজোর রাতে এই মালা প্রাণ পায়। সেই রাতে মালা পান করে ‘কারণবারি’। ন’বাড়িতে এই মালার বিশেষ পুজো হয় কালীপুজোর গভীর রাতে।
বেলপুকুর গ্রামের সিদ্ধেশ্বরী তলার কালীপুজো হয় দিনের বেলা। এখানে মাতৃপূজার বেদি পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। গ্রামে প্রথম এই পুজোটি হয়। এর পর সন্ধে থেকে গ্রামের অন্যান্য পুজো শুরু হয়। বড় বাড়ি, ন’বাড়ি ও ছোট বাড়ির পুজো হয় গভীর রাতে। বেলপুকুর ও তার আশপাশের গ্রামের কালীরা বোন হিসেবে থাকে। যেমন সর্দারপাড়ার কালী বড় বোন। সিদ্ধেশ্বরী বারোয়ারি তলায় কালী মেজ বোন। এই দুই কালীর উচ্চতা হয় কুড়ি হাত। গাবতলার কালী ন’বোন। আর নাথ বাড়ির কালী ছোট বোন।
পুরনো মানুষদের কাছে শোনা যায়— বেলপুকুর গ্রামে সাতটি টোল ছিল। প্রথম টোলটি ছিল মাঝেরপাড়া বা সিদ্ধান্ত পাড়াতে। টোলটি চালাতেন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত প্রসন্নকুমার ন্যায়রত্ন। এঁর কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয় এসেছিলেন বিধবা বিবাহ সম্পর্কে মতামত নেওয়ার জন্য। দ্বিতীয় ও তৃতীয় টোলটি ছিল চূড়ামণি পাড়ায়। দ্বিতীয় টোল চালাতেন শ্রীক্ষেত্র চূড়ামণি। চতুর্থ ও পঞ্চম টোল ছিল বাচস্পতি পাড়ায়। আর ষষ্ঠ টোলটি ছিল বিদ্যালঙ্কার পাড়ায়। এই টোলটি চালাতেন দেবীপ্রসন্ন স্মৃতিরত্ন। আর সপ্তম টোলটি ছিল বিদ্যালঙ্কার পাড়ায়। টোলটির নাম দেবীপ্রসন্ন চতুষ্পাঠী। এই টোলটির ভগ্নাবশেষ এখনও বেলপুকুর গ্রামে রয়েছে। এই বাড়িটি টোলবাড়ি নামে পরিচিত। এই টোলবাড়ির অমৃতহরি স্মৃতিতীর্থ স্বপ্ন পেয়েছিলেন মা কালীর পুজো করার। প্রতি অমাবস্যায় মূর্তি গড়ে টোলবাড়িতে এখনও পুজো হয়। এই পরিবারের আগে উপাধি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের ‘ভট্টাচার্য’ উপাধি দেন। শোনা যায়, এই পরিবারের এক সিদ্ধপুরুষ অমাবস্যার রাতে রাজাকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন। তখন রাজা খুশি হয়ে তাঁকে ‘ভট্টাচার্য’ উপাধি দেন। টোলবাড়িতেই নিত্যেশ্বর মহাদেবের নিত্য পুজো হয়। এই পরিবারের দেবীপ্রসন্নের ছেলে নিত্যহরিকে শিবঠাকুর স্বপ্নে আদেশ দেন, তিনি কাশীধামে মাটির তলায় এক জায়গায় রয়েছেন। সেখান থেকে তাকে যেন উদ্ধার করা হয়। নিত্যহরি সেই শিবকে কাশীধামের মাটি থেকে তুলে মাথায় করে বেলপুকুর গ্রামে নিয়ে আসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠাও করেন। নিত্যহরির আনা শিব নিত্যেশ্বর নাম নিয়ে এখানে পুজো পান। এমন কথাই জানালেন এই পরিবারের পঞ্চাশোর্ধ্ব সদস্য অম্বরকুমার ভট্টাচার্য।
অনেকে আবার বলেন, পুরনো বেলপুকুর গ্রাম অনেক কাল আগেই গঙ্গার গর্ভে চলে গিয়েছে। বর্তমানে যে গ্রামটি বেলপুকুর নামে পরিচিত, সেটা আসলে মেঘা ডাকাতের আস্তানা ছিল। যার অতীত পরিচয় ছিল ‘মেঘার চর’। অতীতের সেই মেঘার চরই আজ বেলপুকুর। তবে এই বিষয়ে কোনও ঐতিহাসিক তথ্যাদি নেই। পুরোটাই আসলে লোকশ্রুতি। এই গ্রামে দীপান্বিতা অমাবস্যার অন্ধকার রাত মানেই এক অন্য রকম অনুভূতি। গ্রামের প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই রাতে বেলপুকুরের গ্রামবাসীদের সঙ্গে জেগে থাকে সেই অলৌকিক মহাশঙ্খের মালা।