বন্যা যখন আসে, সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জীবন ভেসে যায়। জল জীবনের ভাষা বলে, জীবনে চলিষ্ণুতা দেয়। আবার সেই জলই বন্যার সময় মানুষের ঘরের দোরগোড়ায় মৃত্যুর শমন পাঠায়। জলের চরিত্রের এই বৈপরীত্য আমাদের ভয় দেখায়। প্রকৃতির ক্ষমতার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।
আগে মানুষ বন্যাকে ভয় পেত না, উদ্যাপন করত। বন্যার সঙ্গে বাঁচার অভ্যাসটাও তারা করে নিয়েছিল। এখন বন্যা মানুষের কাছে ভয়ের কারণ। বন্যা মানে জীবনহানি। তবে শুধু ধ্বংস নয়, বন্যা জুড়ে দেয় এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষকে। এক মানুষকে বাঁচাতে অন্য মানুষ পাশে দাঁড়ায়। তখন মানুষ নিজেকে আর সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নিয়েই ব্যস্ত থাকত না, রাস্তায় নেমে মানুষের জন্য সত্যি কিছু করার কথা ভাবত।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ-ছ’দশক আগে দেশের যে কোনও প্রান্তে বন্যার ঘটনা ঘটলে বাংলার মানুষ বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতেন। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা গান বাঁধতেন। একটা কাপড় কিংবা বিছানার চাদর নেওয়া হত। দু’জন দু’দিক থেকে সেই চাদর ধরে সবার প্রথমে হাঁটত। আর পিছনে থাকত লম্বা লাইন। সবাই এক সুরে গান গাইত। সেই গানগুলোকে বলা হত ‘ত্রাণের গান’। কৃষ্ণনগর, ভাটপাড়া, চন্দননগর, বর্ধমান ছাড়াও বাংলার ছোট-বড় শহরগুলোয় গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করা হত।
১৯৫৪ সাল। আকাশের অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না। বৃষ্টি শুরু হল। আর সেই বৃষ্টিতে ভেসে গেল অসম। ২০২২ সালের এই বন্যার মতো সে বারের বন্যাতেও বহু মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বাংলার মানুষ তখন গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করেছিলেন। চাল, টাকা, পুরনো কাপড় সংগ্রহ করা হত অসহায় মানুষদের জন্য। ত্রাণের এমন একটি গান হল— ‘নদীর জলে বান ডেকেছে/ সেই জলেতে বন্যা আসে/ সেই জলেতে ঘর ছেড়েছে/ হাজার নর নারীর দল/ কাঁদছে দেখো কোলের শিশু/ কাঁদছে বনে প্রাণীর দল/ বাঁচাও ওদের জীবনটাকে/ বাঁচলে হবে নতুন বল।’
আবার সেই সময়ে ছাত্ররাও এগিয়ে আসত বন্যার ত্রাণ সংগ্রহের ব্যাপারে। তারাও এই ধরনের গান বাঁধত, কবিতা লিখত। সেই গান গেয়ে সংগ্রহ করা হত ত্রাণ। ছাত্রদলের তৈরি এ রকমই একটি গণসঙ্গীত হল, ‘ছাত্রদল ছাত্রদল/ আমরা হলাম ছাত্রদল/ দেশের বল ছাত্রদল/ বন্যাত্রাণে এগিয়ে চল।/ দিচ্ছে ডাক কাঁদছে শিশু/ ভবিষ্যৎ এরাই যীশু/ বানের জলে প্রাণ হানে/ প্রাণ বাঁচাতে ছাত্রদল/ এগিয়ে চল ছাত্রদল।’
বন্যার প্রসঙ্গেই ১৯৬৮ সালের কোজাগরীর সেই রাতের কথা মনে পড়ে। রাতের আকাশের গোল চাঁদ সাক্ষী ছিল উত্তরবঙ্গের বন্যার। তিস্তা নদীর বন্যায় ভেসেছিল সব। জলপাইগুড়ি তখন বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। টেলিফোন নেই। নেই টেলিগ্রাফ। এমনকি পুলিশ-বেতারও অকেজো। ওয়্যারলেস স্টেশন জলের তলায়। রেল লাইন ও রেলপুল ছিন্নভিন্ন। মোটরের রাস্তা আর রাস্তা নেই। এমন ভাবেই এক বর্ণনা উঠে এসেছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র ১৯৬৮ সালের ৭ অক্টোবরের পাতায়। আর ৮ অক্টোবর ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় বেরিয়েছিল ‘জলপাইগুড়ি টাউন অব দ্য ডেড’ শিরোনামে খবর। সেই বন্যা নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’-এর প্রতিবেদনে জানা গেল, মাতব্বর অফিসারেরা সেচ বিভাগের বিপদসঙ্কেত পেয়ে শহরবাসীদের সতর্ক করেননি, কিন্তু নিজেরা শিলিগুড়ি পালিয়ে গিয়েছিলেন।
‘সাপ্তাহিক বসুমতী’-র ডাকে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, গোপাল ভৌমিক, সিদ্ধেশ্বর সেন প্রমুখ। নীহার মুন্সী, অমিয়কুমার কাটি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তিপদ রাজগুরুর মতো মানুষেরা কলকাতার পথে নেমেছিলেন। কাজী সব্যসাচী, ইন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরাও পথে নেমেছিলেন ভিক্ষে করতে। তিন দিন ধরে চলেছিল পথ পরিক্রমা। বসুমতীর ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে’। গানও গাওয়া হয়েছিল পথ-পরিক্রমায়। যেমন, ‘বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো/ মোদের ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া/ নয়া বাংলা গড়ব।’
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় এই ঘটনার কথা। উত্তরবঙ্গের বন্যায় বহু মানুষের মৃত্যুর খবর তখন সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক করা হল, কলকাতার সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে একটা মিছিল বেরোবে। ত্রাণ সংগ্রহের মিছিল। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে প্রায় ঘণ্টাচারেক টানা রোদে হেঁটেছিলেন সকলে। মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও আশা দেবী।
পরিতোষ দত্তের তখন অল্প বয়স। গণনাট্য সঙ্ঘের তিনি সক্রিয় কর্মী। তিনি ১৯৬৮ সালের বন্যা নিয়ে একটা গান বেঁধেছিলেন। মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল সেই গান, ‘তোমরা শুনেন দ্যাশের ভাই/ তিস্তা নদীর বানার কথা/ খবর আসিল দুই দিন আগে/ তাঁহো সরকারের নিন না ভাংগে/ ভাসিল গরু ছোওয়ায় পুত্তায় রে/ ওরে আন্ধার আইতে আসিল্ বানা/ সরকার হামার হইছে কানা।’
আজ সমাজমাধ্যম খুবই শক্তিশালী। যে কোনও খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ তা দেখে নানা রকম প্রতিক্রিয়া জানায়। এবং সব কিছু এখানেই শেষ হয়। সমাজের বড় অংশের মানুষেরাই অন্যের দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে ভাবতে পারেন না আর। যাঁরা পারেন তাঁরা নেহাতই নগণ্য, আতশকাচের তলায় তাদের দেখতে হয়। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ। সমাজমাধ্যমের বাইরে যে আর একটা বাস্তবের পৃথিবী আছে, সেটাই ভুলে যাচ্ছে মানুষ। রাস্তায় এক মাত্র রাস্তা হয়ে দাঁড়ায়। মাসখানেক আগে অসমের ভয়াবহ বন্যার কথা সমাজমাধ্যম ও মিডিয়ার দৌলতে আমরা জানতে পারি ঠিকই। বন্যার বীভৎসতার ছবি নানা মাধ্যমে শেয়ার হয়। জানতে পারি ধস ও বন্যায় ভেসে গিয়েছেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১১ জন। ৪২ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যাকবলিতদের উদ্ধার করতে গিয়ে ভেসে গিয়েছেন এক পুলিশ আধিকারিক। তবু আমরা কিছু করি না। দূরে থাকা বন্ধুর জন্য কাছে থাকা বন্ধুদের হাতে হাত মিলিয়ে বন্যাপীড়িতদের জন্য কিছুই কি করা যায় না? ‘শেয়ার’ আর ‘লাইক’ বাদে? প্রশ্ন অনেক। উত্তরগুলো বন্যার ঘূর্ণিতে পাক খেতে খেতে ফের জলেই মিশে যায়। জল সরে গেলে পড়ে থাকে মনুষ্যত্বের কঙ্কাল।