Bengali Feature

সযত্নে চেনাতেন আকাশ এবং অনন্ত নক্ষত্রবীথি

তিনি সৌমেন মুখোপাধ্যায়। ‘স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শান্ত সরল স্বভাবের মানুষটির ব্যক্তিত্ব ছিল তারার আলোর মতোই স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল। বাড়ির রাস্তা চেনানোর মতোই সহজে চেনাতেন মহাকাশের অলিগলি। গত ১৭ মার্চ প্রয়াত হলেন তিনি।

Advertisement

অরূপ রায়চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১৮
Share:

আকাশবিদ: সৌমেন মুখোপাধ্যায়।

সে  এক হিমঝরা সন্ধ্যার কথা। সালটা ১৯৯৫। হঠাৎ এসে হাজির দিলীপ দাস। প্রকৃতি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যেতে হবে। রাজি হয়ে গেলাম এক কথায়।

Advertisement

২৪ ডিসেম্বরের রাত। হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির সামনে অপেক্ষায় করছি দিলীপ দাসের। দেখলাম এক জন বেশ ছিপছিপে লম্বা চেহারার মানুষ। গায়ে সবুজ উইন্ডচিটার। পরনে ধূসর ট্রাউজ়ার্স। চোখে চশমা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। হাতে একটি কাপড়ের পুঁটুলি সযত্নে ধরা। পায়ের কাছে পেল্লায় এক কার্ডবোর্ডের বাক্স, মাটিতে শোয়ানো। উপস্থিত সকলের মধ্যে তিনি যেন বেশিই নীরব, সামনের জড়ো হওয়া ক্যাম্পারদের থেকে দূরের দেয়ালে ট্রেন আসার নির্ঘণ্ট, সবই দেখে চলেছেন নিখুঁত পর্যবেক্ষণে।

আদ্রা-চক্রধরপুর ট্রেন এল। দিলীপ এলেন। আলাপ করিয়ে দিলেন সেই দীর্ঘদেহীর সঙ্গে। উনি সৌমেন মুখোপাধ্যায়। অবাক হয়ে গেলাম! এঁকে তো কলকাতার জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার প্রাণপুরুষ বললেও একটু বেশি বলা হয় না। শহরে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রণী সংগঠন ‘স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই মানুষটি এমন সহজ, সাধারণ! প্রণাম করতে যেতেই বাধা দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “পায়ে হাত দেবেন না স্যর। ঢাকুরিয়া থেকে হাওড়া, সব মাইক্রোব-ই এ পায়ে পাবেন।” গলার স্বর স্নিগ্ধ, জড়তাবিহীন উচ্চারণ আর ঠোঁটের কোণে আশ্চর্য স্নিগ্ধ এক হাসি।

Advertisement

রাতের ট্রেন। সৌমেনদা আর আমি স্থান পেলাম পাশাপাশি দু’টি আপার বার্থে। লক্ষ করলাম, উনি সেই লম্বা বাক্সটি সোজা তুলে নিলেন তাঁর পাশে। জুতোটি খুলে মাথার কাছে রেখে নীরবে শুয়ে পড়লেন। মধ্যরাত, ২৫ ডিসেম্বর পড়ে যেতেই কে যেন হাঁক পাড়ল, “ও সৌমেনদা!”

নিমেষে উত্তর এল, “বলুন স্যর?”

“একটা গান হোক না!”

শুয়ে শুয়েই পুরুলিয়ার দেহাতি ভাষায় শুনিয়ে দিলেন এক ছড়া গান। বুঝলাম, সৌমেন মুখোপাধ্যায় নীরব বটে, নীরস নন।

পুরুলিয়া স্টেশন। পুলিশ জিপে চেপে জঙ্গলের পথ ধরলাম। সৌমেনদা বসলেন খোলা জিপে, বাচ্চাদের সঙ্গে। গল্পে মেতে উঠলেন। কোলের ওপর সেই লম্বা বাক্স। শিশুরাও সে বাক্স তাদের কোলে নিয়েছে। অপার কৌতূহলে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “বাক্সে কী আছে সৌমেনদা?”

স্মিত হাসি-সহ জবাব পেলাম, “টেলিস্কোপ! আর পুঁটুলিতে লেন্স।”

শিশুদের অজস্র প্রশ্ন, বহু বার একই কথা, এলোমেলো প্রশ্ন, সবেরই উত্তর দিয়ে গেলেন সৌমেনদা। ওঁর মুখের হাসি, গলার স্বর আর অসীম ধৈর্য অবাক করল।

জঙ্গলের ভিতর ক্যাম্প। আমি আর সৌমেনদা একই তাঁবুতে রয়েছি। নীচে খড়, তোশক। তার উপর স্লিপিং ব্যাগ পেতে বিছানা। দিনের বেলায় বেশ গরম, রাতে হাড়হিম ঠান্ডা। পুরুলিয়ার জঙ্গলে এ রকমই হয়। সৌমেনদা সকাল থেকে আমাদের সঙ্গে। চলছে রক ক্লাইম্বিং, রিভার ক্রসিং, ফরেস্ট কুকিং, রক স্টাডি, ভিলেজ সার্ভে। অসীম আগ্রহে সৌমেনদা আমাদের সঙ্গী। স্বল্পবাক মানুষ, পকেটে একটি বড় কাগজ আট-দশ ভাঁজে মুড়ে ছোট নোটবুকের আকারে রাখতেন। নোট নিতেন। যেন তিনিও শিক্ষার্থী। বড়দের স্বভাব, ছোটদের সঙ্গে থাকলে তাদের শাসন করা। সৌমেনদা আশ্চর্য ভাবে ব্যতিক্রমী। হাসিমুখে তিনিও শিশুদের সঙ্গী। নির্লিপ্ত স্বভাব, সূক্ষ্ম রসবোধ। তীব্র জ্ঞানপিপাসা আর পরিস্থিতি অনুধাবন ক্ষমতা।

এক দিন দেখলাম, ক্যাম্পে কাঠ কেনা হল, গ্রামীণ লোকটি কিছু বেশিই চাইল। রাঁধুনি বেশি দিতে অস্বীকার করলেন। সৌমেনদা ক্যাম্পের পিছন দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু দূরে লোকটিকে ডেকে কী যেন দিলেন। দুপুরে বিশ্রামের ফাঁকে সে কথা জিজ্ঞেস করাতে অকপটে বললেন, “এক দিনই তো কিনব। লোকটার পায়ে একটা আঘাত আছে, খেয়াল করেছেন? ওর গ্রামে যেতে প্রায় দশ-বারো মাইল হাঁটতে হবে।”

আর কিছু বললেন না।

মুখের হাসিটি কখনওই ম্লান হত না। চকচকে চোখ দু’টি জিজ্ঞাসু ভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। যেন নীরবে প্রশ্ন করলেন। এক দিন এদের কয়েকটা টাকা বেশি দিলে অসুবিধে কী!

জঙ্গলের রোদ গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের পিছনে। নেমে আসে সন্ধ্যা। লক্ষ করতাম, ক্যাম্পে সবার আগে সব নির্দেশ মেনে চলার এক ব্যতিক্রমী আগ্রহ তাঁর। সন্ধে হতেই সৌমেনদা মিলিয়ে যেতেন জঙ্গলের অন্ধকারে। ক্যাম্পফায়ারের আলোর থেকে দূরে, নিকষ অন্ধকারে সাজিয়ে বসতেন তাঁর টেলিস্কোপ। বহু ক্ষণ ধরে নীরবে নিমগ্ন হয়ে দেখে যেতেন রাতের আকাশ। তার পর ডাক পড়ত ক্যাম্পারদের।

সকলে অপেক্ষা করে থাকতাম তাঁর ডাকের। সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকারে চলত সৌমেনদার আকাশ দেখার ক্লাস। যত্ন করে, অসীম ধৈর্য নিয়ে উনি বুঝিয়ে দিতেন আকাশের পথ চেনার সুলুকসন্ধান। কথা শুনে মনে হত যেন পাড়ার অলিগলি মুখস্থ করা মানুষটি তাঁর বাড়ির পথ চেনাচ্ছেন আমাদের সকলকে। কঠিন নামগুলি কত সহজে মনে রাখা যায়, তার উদাহরণ দিয়ে যেতেন একের পর এক। কখন কোন কোন মাসে রাতের আকাশ পাল্টে যাবে, তার সঙ্গে বাংলার পার্বণ অনুষ্ঠান জুড়ে, মনে রাখার সহজ পথ শুনিয়ে দিতেন। নীরব শ্রোতাদের মাঝখানে বসে এক সৌম্যকান্তি মানুষ বুঝিয়ে চলতেন আকাশের আলপনা। আজ একান্তে বসে মনে হয়, সেই অন্ধকারে সৌমেনদার ক্লাসগুলির চেয়ে বেশি আলোকোজ্জ্বল কোনও ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়নি আর কখনও।

মাঝেমধ্যে বিড়ি খেতেন। পায়ে মোজা দিতেন না। কঠিন শীতেও বর্ষার উপযোগী প্লাস্টিকের চটি পরে চলতেন অনায়াসে। সমবয়সি বা ছোট, ক্যাম্পে সকলকেই ‘স্যর’ বলে সম্বোধন করতেন। অতীব সহনশীল এক মানুষ। এক রাতে একটি যুবক ক্যাম্পের সমবয়সিদের সঙ্গে মজা করে কিছু র‌্যাগিং করার চেষ্টা করে। ভুলবশত সৌমেনদার সঙ্গেও কিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলে। পরদিন, বড়রা তাকে বেজায় বকুনি দিয়ে সৌমেনদার কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠান। ওকে ক্ষমা চাইতে আসতে দেখে, সৌমেনদা এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে শিশুর মতো হাসতে শুরু করেন যে, ক্ষমাপ্রার্থী ছেলেটিও হেসে ফেলে। সে দিন তার পর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সৌমেনদা বলেছিলেন, “ও কিছু নয় স্যর!”

প্রতি বছর এই ক্যাম্প-জীবনের গল্প শেষ হওয়ার নয়। শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক গড়াল সৌমেন মুখোপাধ্যায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও। সেখানে এক অন্য অনুভূতি। অপার স্নেহ-মমতায় সৌমেনদা আর তাঁর মায়ের সান্নিধ্যলাভ। নিরীশ্বরবাদী সৌমেন মুখোপাধ্যায়ের মাতৃভক্তি বিস্ময়কর।

সৌমেনদা বরাবরই স্পষ্টবক্তা, অথচ বিনয়ী। ভারতের জনজাতি ও সাধারণ মানুষের কথা বলে যেতেন অবাধ গতিতে, অগাধ পাণ্ডিত্যের সঙ্গে। তাঁর আকাশচর্চার জ্ঞান ও কৌতূহল অবাক করার মতো। পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে বুনে দিতে চেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ। সৌমেন মুখোপাধ্যায়ের সহজ-সরল ভাষায় লেখা ‘এক আকাশ তারা’, ‘আকাশ চেনার হাতেখড়ি’ (খালি চোখে ও বাইনোকুলারে), ‘আকাশ দেখা’ (টেলিস্কোপে), ‘ক্যালেন্ডার কথা’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলিই তার প্রমাণ। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ কিংবা বৃহস্পতি গ্রহে শুমেকার-লেভি ধূমকেতুর পতন, বিরল নাক্ষত্রিক ঘটনার সংযোগ তৈরি হলেই তিনি মাঠে-ময়দানে, মহানগরীর চত্বরে মহাকাশবীক্ষণ যন্ত্র ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে জমা হতেন।

এক দিনের ঘটনা খুব মনে পড়ছে। সে বার ছবি তুলতে গিয়েছি। সৌমেনদার ছবি অন্ধকারে একদম ভাল আসছে না। হতাশ আমাকে দেখে, সৌমেনদা রসিকতা করে বলে উঠলেন, “এখানে ছবি পাচ্ছেন না, স্যর? আমি আকাশের গায়ে পৌঁছলে তবে হয়তো পেতে পারেন।”

গত ১৭ মার্চ, ৮১ বছর বয়সে সেই আকাশের গায়েই চলে গেলেন তিনি। খবর পেয়ে মনে পড়ছিল তাঁর বলা সেই কথাগুলো। স্নিগ্ধ দ্যুতিময় জীবনে তারার আলো ছড়িয়ে বেঁচে ছিলেন সৌমেন মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রয়াণে শোকের সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করি যে, আমরা তাঁকে কাছে পেয়েছিলাম। এমন এক আশ্চর্য সরল সুন্দর জীবন সত্যিই ঈর্ষণীয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement