Bengali Story

‘কাজলাদিদি’ রচয়িতার বিস্মৃত প্রায় জন্মভিটে

কবির নাম যতীন্দ্রমোহন বাগচী। আজ তাঁর জন্মদিন। প্রকৃতি ও মানুষদ্রষ্টা এই কবির কবিতায় বার বার উঠে এসেছে তাঁর জন্মস্থান নদিয়া জেলার যমশেরপুরের পল্লিপ্রকৃতি। তাঁর জন্মস্থান, প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন জমিদারবাড়ির পরতে পরতে আজও ভাস্বর ইতিহাসের সাক্ষ্য।

Advertisement

শ্রেয়া ঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২২ ০৮:৪৩
Share:

পল্লিকবি: যতীন্দ্রমোহন বাগচী। ডান দিকে, যমশেরপুরের পুরনো জমিদারবাড়ি ও দুর্গাদালানের অংশবিশেষ ।

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!/ আস্তে একটু চল্‌ না ঠাকুর-ঝি/ ওমা, এ যে ঝরা-বকুল, নয়?”

Advertisement

‘অন্ধ বধূ’র আর্তি ঝরা বকুলের মৃদু ঘ্রাণের মতো পাঠকের সমস্ত অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়ে যাঁর কবিতা, তিনি যতীন্দ্রমোহন বাগচী। তাঁর সঙ্গে বাঙালির পরিচয় শৈশবে, ছোট্ট শিশুর কাজলাদিদিকে ফিরে পাওয়ার আকুতিতে। ‘শোলোক বলা কাজলাদিদি’-র খোঁজ আমাদের চিরকালীন। নেহাত জীবনের কুড়ি কুড়ি বছর পার হয়ে যাওয়ায় সেই আকুলতা শিশুটির মতো করে প্রকাশ করতে পারা যায় না।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যতীন্দ্রমোহন রবীন্দ্রানুসারী হিসাবে পরিচিত। যদিও অনেক সময়েই তর্কের খাতিরে সেই বিষয়টিতে সহমত হননি বিশেষজ্ঞেরা। এই প্রসঙ্গেই কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, “...রবির তেজ নিজের বুকে সম্পূর্ণ ধারণ করে তাকে শীতল সুন্দর ও সাধারণের চোখে গ্রহণযোগ্য করে জ্যোৎস্নারূপে এই ধরণীতে পাঠিয়ে দেয় আকাশের চন্দ্র। চন্দ্রের নিজের আলো নেই, সে সূর্যের আলোয় আলোকিত মাত্র, কিন্তু তারাগুলি এক-একটি বৃহৎ সূর্য। এতে রসরাজ্যে পূর্ণচন্দ্রের গৌরব ক্ষু্ণ্ণ হয় না, মিটমিটে তারাগুলিরও গৌরব বাড়ে। সূর্য— সূর্য, চন্দ্র— চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ; যতীন্দ্রমোহন, যতীন্দ্রমোহন।”

Advertisement

লেখায় রবীন্দ্রঘেঁষা ‘সেনসেশনাল ট্রুথ’ থাকলেও যতীন্দ্রমোহন বরাবর একটি স্বতন্ত্র মাত্রা রেখে এসেছেন। ‘লেখা’ (১৯০৬), ‘রেখা’ (১৯১০), ‘অপরাজিতা’ (১৯১৩), ‘নাগকেশর’ (১৯১৭) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি, মানবজীবন ও প্রেম বার বার ফিরে আসায় অনেকে তাঁকে পল্লিকবিও বলেন। আর এই তকমাটির পিছনে রয়েছে তাঁর জন্মস্থান নদিয়া জেলার যমশেরপুরের বিশেষ ভূমিকা। শ্যামল গ্রামটির মাঝে ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল জমিদারবাড়ি, যে বাড়ির সন্তান স্বতন্ত্র ছাপ রেখে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের জগতে।

একদা বাংলাদেশের প্রধান জমিদারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন যমশেরপুরের এই বাগচী পরিবার। বিত্তের পাশাপাশি মুক্ত চিন্তা, লেখাপড়া ও সাহিত্যচর্চাও ছিল পরিবারে। যতীন্দ্রমোহনের পিতামহ রামগঙ্গা বাগচী ছিলেন নসীরপুর-রাজের দেওয়ান। ১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর জন্ম হয় যতীন্দ্রমোহনের। মা গিরিশমোহিনী দেবী, পিতা হরিমোহন বাগচী। তিনি পাঁচ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ। ছেলেবেলা যমশেরপুরেই কাটিয়েছেন কবি। তাঁর মনে প্রাথমিক সংস্কৃতির বীজ রোপণ হয়েছিল পৈতৃক বাড়িতেই। কবির নাতি মলয় বাগচীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাগচী পরিবারের মধ্যম তরফের সন্তান যতীন্দ্রমোহন। মধ্যম তরফের বাড়ি দু’টি, একটি ‘পুরাতন বাড়ি’, যেটি তৈরি করেছিলেন রামগঙ্গা বাগচী। আর একটি ‘নূতন বাড়ি’।

পুরনো বাড়িটির বয়স আনুমানিক আড়াইশো বছর। যতীন্দ্রমোহন সেই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করলেও পরে হরিমোহন তাঁর পরিবার-সহ বসবাস করতে শুরু করেন পাশের নতুন বাড়িটিতে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কবির লেখাপড়ার শুরু। পরে তিনি বহরমপুরের খাগড়ার বাড়িতে চলে আসেন। সেখানকার মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। পরে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে ১০/১ আরপুলি লেনে বসবাস শুরু করেন কবি। তবে, যমশেরপুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কখনওই বিচ্ছিন্ন হয়নি। যখনই তিনি গ্রামে যেতেন, মিশে যেতেন সেই জীবনে। গ্রামের পরিবেশকে আপন সত্তায় আত্তীকরণ করতেন, যার প্রকাশ দেখা যায় তাঁর কবিতায়। মলয় বাগচী জানালেন, এখনও যতীন্দ্রমোহনের লেখাপড়ার ঘরটি রয়েছে। যদিও সে ঘরে আসবাবপত্র নেই, তবে ঘরটি দেখাশোনা করা হয়। বাড়িটি দেখাশোনা করার জন্যও এক জন নিযুক্ত রয়েছেন।

‘হেরিটেজ করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেননি?’

প্রশ্নের উত্তরে সহাস্যে মলয় বাগচী জানালেন, এত বড় পরিবার ছড়িয়ে রয়েছে চার দিকে, সকলকে এককাট্টা করে ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট পেলেই পদক্ষেপ করা হবে।

লেখাপড়া ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁচও পড়েছিল বাগচী-পরিবারে। সেই কারণেই, দুর্গাপুজোয় প্রতিমা বিসর্জনের পর বাড়ির নাটমন্দিরের সামনে বাড়ির লোকেরা সোচ্চার হতেন ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে। এখনও রবীন্দ্রনাথের ‘এক বার তোরা মা বলিয়া ডাক্, জগতজনের শ্রবণ জুড়াক’ গানটি গেয়ে শেষ হয় এই বাড়ির পুজো। গ্রামের মানুষের কাছে সেই পুজোর মাহাত্ম্যও কম নয়। যাঁরা ঠাকুর তৈরি করতেন, তাঁদের বলা হত মালাকর। মলয় বাগচীর স্মৃতিচারণে ফিরে এল ব্রজেন মালাকরের নাম। তিনি জানালেন, পুরনো বাড়ির নাটমন্দিরে দুর্গামূর্তিতে মাটি পড়েছে মানে গ্রামে পুজো শুরু। আর বাগচী বাড়ির দুর্গাপুজো মানে সারা গ্রামের দুর্গাপুজো। একই কথা প্রযোজ্য নতুন বাড়ির কালীপুজোর ক্ষেত্রেও। পুজো নয়, আসলে ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরা। ফলে, বিসর্জনের সময় গোয়ালারা কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে যান। যেন বাড়ির মেয়েকে ফের শ্বশুরবাড়ি রওনা করে দেওয়া। জানা গেল, প্রাচীন জমিদারবাড়ির নীতি মেনেই পুজোর সব পদ্ধতি এখনও পালন করেন বাড়ি ও গ্রামের মানুষ। ফিরে ফিরে আসে দুর্গাপুজোর সময় হওয়া গানের আসর ও যাত্রাভিনয়ের কথাও। পুরনো বাড়ির সাজঘরে যাত্রার আগে সেজেছেন বহু বিখ্যাত নট, গানের আসরের আগে তৈরি হয়েছেন বহু সঙ্গীতজ্ঞ। শোনা যায়, মহারাজ জগদিন্দ্রনাথও ওই বাড়িতে অতিথি হয়ে এসে মজলিশে পাখোয়াজ বাজিয়েছিলেন। পরে যতীন্দ্রমোহনও রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের বহু নাটক তাঁর পরিজনকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। সাহিত্যিক নলিনীকান্ত সরকার এক বার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে নাটকে অভিনয় করেছিলেন। নিজের স্মৃতিকথায় সে কথা তিনি লিখেছেন।

গ্রামে প্রবেশ করলে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘পুরাতন বাড়ি’ ও ‘নূতন বাড়ি’। বড় বড় থাম, টানা বারান্দা, সাজঘর, দরবার, লাইব্রেরি... পরতে পরতে কত গল্প। পরিবারের কত হাসি, কান্না, শোক, উচ্ছ্বাস। গ্রামের মানুষের কত স্মৃতি। কত লোককথা। যে লোককথায় ফিরে ফিরে আসে বাগচীবাড়ির হাতিশালের কথা। মলয়বাবু জানালেন, তাঁরা হাতি দেখেননি। তবে, পুরনো হাতিদের দাঁত ও হাড় বহু দিন পর্যন্ত বাড়িতে সংরক্ষিত ছিল। ছোটবেলায় দেখেছেন এক বৃদ্ধ মাহুতকেও, গল্প শুনেছেন তাঁর কাছে। হাতি প্রসঙ্গে করিমপুর নিবাসী রণজিৎ ও রথীজিৎ বিশ্বাস জানালেন, তাঁদের পূর্বপুরুষ শক্তিপদ বিশ্বাসের বিয়ের সময় বাগচীবাড়ি থেকে হাতি পাঠানো হয়েছিল বরের জন্য। মেহেরপুরের জমিদার ভূপতি বিশ্বাসের বাড়ির কর্মচারী ছিলেন শক্তিপদর বাবা বিহারীলাল বিশ্বাস, সেখান থেকেই বাগচীবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ। গ্রামে এঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান ১৮৯৯-এ যমশেরপুর ভূপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও আবাসিক হস্টেলের পত্তন। বাড়ির এক সন্তান ভূপেন্দ্রনারায়ণের অকাল প্রয়াণের পরেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ইউরোপে প্রচলিত ধারণা, এক জন ব্যক্তির কবি বা সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর পরিবেশের গুরুত্ব অসীম। তাই বলা চলে, যতীন্দ্রমোহনের অনুভূতিপ্রবণ, প্রকৃতিবিলাসী কবিতার উৎস যমশেরপুর, যে গ্রামে তাঁর জন্ম, যে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়। তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রেখা’ (১৯১০) পড়ে লেখেন, “...এক একটি ছোট-খাটো রেখার টানে গ্রাম্য দৃশ্যগুলি কেমন ফুটিয়া উঠিয়াছে। তোমার কবিতায় ‘ফড়িং’ ও ‘প্রজাপতি’ আদর পাইয়াছে।...” তখন বোঝা যায়, সুললিত ভাষায় রচিত কবিতাগুলোর মধ্যেও কী নিপুণ ভাবে নিজের জন্মস্থানের বিবরণ দিচ্ছেন কবি। পাঠকের মননে গেঁথে দিচ্ছেন খণ্ড খণ্ড গ্রামচিত্র।

ঋণস্বীকার: যতীন্দ্রমোহন: কবি ও কাব্য: অলোক রায়; ‘দর্পণ... মুখের খোঁজে’ সাহিত্য পত্রিকা; দেবজ্যোতি কর্মকার ও অমিতাভ বিশ্বাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement