উৎপল চৌধুরীর নম্বরটায় বার বার চেষ্টা করেও কল যাচ্ছে না। নম্বরটা তিনি নিজে দিয়েছিলেন আমায়।
ঘরের দেওয়াল জোড়া বইয়ের তাকে ধুলো-জমা হার্ডকভার বইটা অবশ্য এখনও দেখতে পাচ্ছি আমি। যে দিকে তাকালেই সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়। বইমেলা এলেই চৌধুরী দম্পতি...শমিতা-উৎপল ও তাঁদের একমাত্র মেয়ের কাহিনি এক অদ্ভুত মায়ায় পেড়ে ফেলে।
সাত বছর আগের এক সন্ধ্যায় মিলনমেলায় বইমেলার মাঠে নিজের মতো ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ আলাপ তাঁদের সঙ্গে। আটপৌরে প্রবীণ বাঙালি দম্পতি। যেমন হয়, আর কী! চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইংরেজি বইয়ের প্যাভিলিয়নের স্টলের এক কোণে। শমিতা পলিটেকনিক কলেজের অধ্যাপিকা। উৎপল সবে ড্রাগ কন্ট্রোলের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাঁদের যৌবনের প্রেম, বিয়ে আর তিস্তার গল্প শুনেছিলাম তখনই। এও এক তিস্তাপারের বৃত্তান্ত! দম্পতির ছবি, লেখায় ভরপুর শক্তপোক্ত বইটার নামও ‘অ্যান্ড দ্য তিস্তা ফ্লোজ’! বই বললেও যা আসলে বই নয় নিছকই।
ভবিষ্যতে তাঁদের ছেলে হলে তার নাম হবে রঙ্গিত, আর মেয়ে হলে তিস্তা! যাদবপুরে বি ফার্মা পড়ার সময়েই এমনটা ঠিক করে ফেলেছিলেন সেই প্রেমিক যুগল। কলেজে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের ট্রেকিংয়ে গিয়ে প্রথম বার তিস্তাকে দেখলেন তাঁরা। প্রকৃতিপাগল দম্পতির স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। এক দিন ঘর আলো করে কোলে এল একরত্তি তিস্তা! পাহাড়ি নদীর মতোই ছটফটে সে মেয়ে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে কঠিন রোগভোগে তার বিদায়। এর পরেই অন্য কাহিনির শুরু! মেয়ের খোঁজে বার বার তিস্তার কাছেই ফিরে গিয়েছেন তাঁরা। মরু পথের শুকনো ধারায় মেয়েকে হারাতে দেননি। ক্যানসার বাসা বেঁধেছিল উৎপলের শরীরে। তাও দমাতে পারেনি। আট বছর ধরে ঘুরেছেন তিস্তার পাশে পাশে! উত্তর সিকিমের বরফগলা হ্রদের বুকে জেগে ওঠা বালিকা উত্তরবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ভরা যুবতী। মিশে গেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। তিস্তার এই অদেখা বড় হওয়ার গল্প টুকরো টুকরো ছবি, লেখায় ধরেছিলেন উৎপল, শমিতা। যা সেই বইমেলায় বই হয়ে বেরিয়েছিল। এ বইয়ের মুখবন্ধে অভিভুত কুণাল বসু লেখেন, ‘এ হল উৎপল-শমিতার কন্যার নতুন করে জন্মকথা!... মানুষই পারে, তীব্র শোককে এমন সৃষ্টির আদলে পাল্টে ফেলতে!’
মানব বইয়ের মোহনা
তিস্তার বইয়ের শেষ কয়েকটি এখনও বইমেলায় পড়ে আছে। এর পরে নতুন সংস্করণ সম্ভবত বেরোবে না। কিন্তু এত দিন বাদে মনে হয়, শমিতা ও উৎপল নিজেরাই রক্তমাংসের বই হয়ে আমার কাছে এসেছিলেন সেই বইমেলায়! যেমন ভাবে বছর বছর নানা রঙের নতুন পুরনো মলাটে দেখা দেয় বইমেলা। অনেক নামী সাহিত্যিকই ইদানীং আর সব কিছু ভুলে প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে মানুষের আত্মঘাতী বিশ্বাসঘাতকতায় অস্থির। এই সন্তানহারা বাঙালি মা-বাবার যাপন, পাহাড়-নদী আঁকড়ে ধরার বাঁচা তখন জীবনের প্রতি ভরসা রাখে। ডেনমার্ক থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়া হিউম্যান বুক লাইব্রেরির ঢেউ ইতিমধ্যে কলকাতাকেও ছুঁয়ে গেছে। সাধারণ গেরস্ত মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরে কিংবা তার ভিতরেও কিছু জীবন আলাদা, অনন্য। তা নিজেই মূর্তিমান আকরগ্রন্থ। তাদের নিয়ে মাতামাতিও কম নয়। বহু যুগের ও পারে বইমেলার মাঠে একদা উত্তমকুমারের মতো বিরাজ করতেন সমরেশ বসু। অমৃত কুম্ভের সন্ধানের লেখক কালকূট! বিচিত্র মানুষ বিচিত্র জীবনের মাঝেই তিনি কুম্ভের মোক্ষ খুঁজে পেয়েছিলেন। কুম্ভের পাশে যতই অকিঞ্চিৎকর হোক, বাঙালির বইমেলাও কি টুকরো টুকরো জীবনের লাইব্রেরি নয়? খণ্ড খণ্ড যাপন চিত্রের আভাসে জীবন অনন্তের আস্বাদ সেও বুনে দিতে পারে।
উৎপলের ফোনে এ বার কিছুতেই যোগাযোগ হল না। তবে তাঁদের প্রকাশক বিকাশ নিয়োগী জানালেন, তিনি সম্প্রতি প্রয়াত। শমিতার ফোন নম্বর পাওয়া গেল খোঁজাখুঁজি করে। তিনি বললেন, “জানেন তিস্তাও কিন্তু গল্পের বইয়ের জন্য পাগল ছিল। মর্নিং স্কুলের আগেও অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে উঠত পড়বে বলে। আর ইস্কুলে একবার নিজে থেকেই রচনায় লেখে বইমেলার সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা! ওর ছোট্ট জীবনের সব থেকে নাড়া দেওয়া ঘটনা।”
সুনীল, শ্যামল, সন্দীপন
বইমেলার এত বছরের জীবনে সব থেকে বড় ঘটনা কী? তা কি ১৯৯৭-এর সেই অভিশপ্ত সোমবারের মধ্য দিন? যে দিন সকালেই বইমেলার ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় অতিথি জাক দেরিদাকে বিদায় জানিয়েছেন তৎকালীন গিল্ড কর্তৃপক্ষ। কলকাতার মুকুটে কোনও নতুন পালকের খোঁজে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার কর্ত্রী জয়েস অ্যারাভিনার সঙ্গে মিটিং করতে যাচ্ছিলেন ওঁরা। আগুনের বিষাক্ত ছোবলে হঠাৎ সব চৌপাট। গিল্ড অফিসের পাশের স্টলে রান্নার ঢালাও আয়োজন, পাম্প স্টোভ থেকে লাফিয়ে ওঠা পাবকশিখা ছড়িয়ে পড়ে নিমেষে। মুহূর্তে তা গিলে ফেলল সেই সুরম্য বই-নগরী।
একটা অনভিপ্রেত দুর্ঘটনা নিয়ে তোদের নস্ট্যালজিয়া বিরক্ত লাগে!— বছর দুই বাদেই এক সিরিয়াসমুখো চশমাধারিণী বলছিলেন জনৈক ছাগলদাড়ি ফতুয়াধারীকে।
‘সে-দিন তুই বইমেলায় যেতে পারিস ভেবে আর একটু হলেই আমার হার্টফেল হচ্ছিল। তোদের বাড়িতে ফোন বেজে যাচ্ছে বিকেল থেকে সন্ধে! পরে জানলাম, ছাতার মাথা ইউনিট মিটিং ছেড়ে এক বারটি তড়িৎদার বুথে উঠে তুই ফোন করতে পারিসনি!’ বইমেলা আসে যায়! কাউকে কাউকে এমন খুচরো গঞ্জনার কাঁটা বয়ে বেড়াতে হয়। সুগন্ধি রুমালের মতো পকেট থেকে বের করে যার ঘ্রাণ নিই বহু দিন বাদেও।
এই বইমেলা টি শার্টে তারকা লেখকের মুখের জয়নিশান ওড়ায়। নামী লেখিকার পাহারায় কঠিন বাউন্সার ব্যূহে ধাক্কা খেয়ে ডগোমগো। আবার এই বইমেলাই হামলে পড়ে শোনায়, অনেক দশক আগের রূপকথা! তখনও সন্ধে নামলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অপেক্ষা করত বইমেলা। প্রাক্-নিজস্বী যুগের এক বিকেল। অনুরাগিণী এক পাঠিকাকে দেখিয়ে ‘আমায় কিন্তু কেউ চেনে না’ বলে জনে জনে সই দিতে শুরু করলেন অন্য এক প্রবীণ লেখক। সহাস্যে লিখে চলেছেন, ‘শুভেচ্ছায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’! সুনীল তখন ধারেকাছেও নেই। সইদাতা আর কে হবেন! অননুকরণীয় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। কত জন অম্লান বদনে সেই সই নিয়ে চলে যাচ্ছেন। দৃশ্যের সাক্ষী পাঠিকা বাক্যিহারা!
আবার বইমেলা এলেই কেউ কেউ দেখতে পান, ওই তো… মাঠের ইলেকট্রিশিয়ানের মই ছিনিয়ে মাথায় উঠে তাঁর বিখ্যাত মিনি বইয়ের প্রচার করছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এক-একটা বই বিক্রি হলেই দমকলের ঘণ্টি বাজিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন সন্দীপন ও তাঁর সহচরেরা। ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার সম্পাদক প্রশান্ত মাজী শুনিয়েছেন, এই মিনি বইয়ের প্রচ্ছদেই একবার শঙ্খ ঘোষের কোট, টাই পরা ছবি ছেপে দিয়েছিলেন সন্দীপন (সন্দীপনের শরীর, সন্দীপনের মন)। মিনি বই যেন ‘চেন বাঁধা হাতির সামনে স্বাধীন পিঁপড়ে’! তার ছক-ভাঙা চলার আখরে অন্য মাত্রা পেয়েছে বইমেলার চরিত্র।
শয়তানের মুখোমুখি
বইমেলায় অবশ্য কম আশ্চর্য হইনি লালমুখো এক বিশাল বপু লম্বা দাড়ি সাহেবের মোলাকাতেও। ইনিও লেখক যশপ্রার্থী। বছর পাঁচেক আগে বোধহয় সল্টলেকের মেলাতেই ভিড়ের মধ্যে দূর থেকে চোখে পড়ছিল তাঁকে। ঠিক যেন ক্রিকেটের প্রবাদপুরুষ ডব্লিউ জি গ্রেস। কানাডার জীবনের পাট গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ব্রায়ান সালমি। চিনা ভবনের প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্র সুহৃদ তান ইয়ু শানের নাতি আনন্দ তাঁর বন্ধু। আনন্দের মা, সুধীররঞ্জন খাস্তগিরের কন্যা শ্যামলী খাস্তগিরের বাড়িতে ব্রায়ানের বসবাস। বইমেলার মাঠে বোলপুরের বাসিন্দা, কলেজ শিক্ষক, প্রকাশক পরন্তপ চক্রবর্তীর সঙ্গে ঘুরছিলেন।
পরন্তপদের কাছেই তখন ব্রায়ানের প্রথম বইয়ের তোড়জোড় চলছে। তাতে পরমাণু শক্তি, বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে স্রেফ ভালবাসার জোরে কিশোর, কিশোরী রিফ ও র্যাফের লড়াই। ইউরোপ, আমেরিকায় বই প্রকাশের পিছনে এজেন্টদের মাতব্বরি নিয়ে সারা ক্ষণ গজগজ করছিলেন ব্রায়ান। বই প্রকাশে ওরাই শেষ কথা! লেখকদের সামনে পুরী বা কাশীর মন্দিরের পান্ডার মতো দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। বার বার ব্রায়ানের কালজয়ী কত কাহিনির জন্ম ভেস্তে দিয়েছেন। নিজেকে সেটান (শয়তান) বা গডজ়িলা বলেও পরিচয় দিতেন ব্রায়ান। কম বয়সে কানাডায় সব রাজনৈতিক দলের হাড়জ্বালানে রাইনোসেরাস পার্টির পত্তন করে সবার ভোট কেটে এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কানাডায় ভোট প্রার্থী হলেই কেন ১০০০ ডলার জমা রাখতে হবে? এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে জজসাহেবকে ভড়কে দেন ব্রায়ান। তবে সদ্য খবর পেয়েছি এ দেশে ব্রায়ানের বই-অভিযান সফল হয়নি। কাহিনি যেমনই হোক, লেখার ভঙ্গি বড্ড জটিল! এ দেশের পাঠককুলের তা মনে ধরবে না বলে পিছিয়ে আসেন প্রকাশক। একেলে ‘প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড’ পদ্ধতিতে কানাডায় সাকুল্যে পাঁচ-সাত কপি ছাপিয়ে পাঠানো হয়। এর বেশি কেউ কেনেনি। ব্রায়ান অবশ্য নিজের লেখার স্টাইল বদলাতে রাজি নন! এখনও বোলপুরেই একা থাকছেন। কী-সব অনলাইন কাজে ব্যস্ত। এখন আবার ডিজিটাল আর্ট নিয়ে মত্ত। তবে আর প্রকাশক জুটছে না। নাহ, এ বার আর বইমেলায় ব্রায়ানের সঙ্গে দেখা হওয়ার চান্স নেই! তবে বোলপুরে ব্রায়ানকে প্রায়ই দেখা যায়। এখনও বন্ধুবৃত্তে মিলিয়ন ডলার রোজগারের অভিনব সব কৌশল বাতলে চলেছেন। তবে দুঃখের কথা, কেউই তাঁকে তেমন গুরুত্ব দেন না।
না-থেকেও থাকা
বইমেলায় না-থাকলেও কারও কারও ছায়া গাঢ় হয় বইমেলার মাঠে। ময়দানে ১৯৭৬ সালের প্রথম বইমেলায় সারা ক্ষণ মাইকে ঘোষণা লেগেই থাকত। গিল্ডের এক কর্তার স্ত্রী এক ধরনের বিশেষ সুরে টেনে টেনে কথা বলতেন। এর মধ্যে হিন্দিতে থেকে থেকে বলা হতো, ‘দোস্তোঁকে লিয়ে পুস্তকোঁ খরিদ কিজিয়ে!’ বিশেষ ভঙ্গির সেই কণ্ঠস্বর আজও কোনও কোনও প্রবীণের কানে বাজে। ফিক করে হেসে ফেলেন আপন মনেই।
লিটল ম্যাগাজ়িন প্যাভিলিয়নের প্রবীণ দম্পতি বিমলেন্দু ও অনিন্দিতা হালদারের উষ্ণ সান্নিধ্যও যেমন এ বার অনেকের মনে পড়েছে। বইমেলায় বিকেলে দেখা হলে বাড়িতে ভাজা এক গাল মুড়ি তাঁরা খাওয়াবেনই। রোজ ভরদুপুরে সারা দিনের রসদ বেঁধে নিয়ে আসতেন! সোনারপুরের দম্পতির এ বার বইমেলায় আসা হচ্ছে না। ঢাউস ট্রলি ব্যাগ ঠেলে গাদাগুচ্ছের সাধের বই কিনতে আসা সৌমেন নাথ শুনে হতাশই হলেন।
নিম্ন গাঙ্গেয় সুন্দরবন সংস্কৃতি বার্তা-র সম্পাদক বিমলেন্দু হালদারের বয়স ৭৬ পার হয়েছে। বাড়িতে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট লেগেছিল। ফলে লিটল ম্যাগাজ়িনের ফর্ম তুলেও জমা দিতে পারেননি। গত বছর ওমিক্রনের ভয়ে মেলায় আসা হয়নি। এ বারও হল না। তার আগে প্রায় সিকি শতকের সম্পর্ক তাঁদের পত্রিকা ও বইমেলার। ইলাহাবাদ ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী বিমলেন্দু। অনিন্দিতারও ৬৬ হয়েছে। ছেলে, মেয়েরা মুম্বই, বেঙ্গালুরুবাসী। বিমলেন্দু কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলেন, “আমরা আজেবাজে পত্রিকা নই! এর আগের নদী সংখ্যাটার খুব নাম হয়েছিল, জানেন! মাছ ধরা, কাঠ কাটা, কাঁকড়া ধরা, মধু ভাঙা লোকজনের কথা আমাদের পত্রিকায় পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, মাস্টারমশাইরাও। সুন্দরবনবাসী স্কুল শিক্ষকদের অনেকের লেখাই নিয়মিত প্রকাশিত হয়। নামী পরিবেশকর্মীরা অনেকেই এই পত্রিকা কিনে লেখার বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেন।”
এ বার বইমেলায় স্পেনের প্যাভিলিয়নে দাঁড়িয়েও বন্ধু শুভেন্দু সাহার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দীপাঞ্জন সুর। বলেন, “ওর কাজটাই আমায় শেষ করতে হল। হাসপাতালে শুয়ে শুভেন্দুই স্প্যানিশদের সঙ্গে শেষ মিটিংটা করেছিল। তার কিছু দিন বাদেই সব শেষ!” ২০০৬-এ প্রথম বার স্পেন থিম থাকার সময়েও ময়দানে শুভেন্দুরাই বইমেলার কাজ করেন। ১৭ বছর বাদে কলকাতায় এসে তাঁকে খুঁজছিলেন স্পেনের মেয়ে, সরকারি দলের প্রতিনিধি ইরিনেও। সেই তখন থেকে বছর বছর স্পেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, মেক্সিকো বিদেশি অতিথিদের মণ্ডপ সাজানোর কাজটা করে আসছেন ওঁরাই। গত বইমেলা থেকেই শুভেন্দুর শরীরটা বিগড়োনোর শুরু। ৪৮ বছরের যুবকের সারা শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। শেষ মুহূ্র্তের আগে ঠিকঠাক ধরা পড়েনি।
কী পেলি, এ বার?
হাঁটতে হাঁটতে সুবর্ণরেখার স্টলে এসে দাঁড়ালেও ফ্রিজ শটে স্তব্ধ হয় বইমেলার অনেকগুলি বছর। বসন্ত চৌধুরীর পুত্র সঞ্জিত ওরফে জিৎ চৌধুরী কেন, কে জানে বাবার বন্ধু ইন্দ্রনাথ মজুমদারকে ‘ইন্দ্রদা’ বলেই ডাকতেন। বইমেলা শুরুর পরে দিন তিনেক পার হয়েছে। আগে আসতে পারেননি। সুবর্ণরেখা-য় ইন্দ্রদার মুখোমুখি দাঁড়ালে তিনি টেবিলের নীচ থেকে দড়ি বাঁধা এক গুচ্ছ বই বের করে ঠিক বলবেন, ‘আগে আসতে পারো না, জলদি দেখে নাও এর মধ্যে কী লাগবে তোমার!’ জিতের শখ, ভোজ-সংস্কৃতি এবং বায়োস্কোপ বিষয়ক বই সংগ্রহের। ইন্দ্রনাথ জানতেন, কোন পাঠকের কী পছন্দ! কারও কারও জন্য স্নেহসূচক স্পেশাল সস্তা দামও ধার্য করা থাকত। জিতের মতো কোনও বই রসিক দ্রুত তাঁর পছন্দের ৮-১০টা বই বেছে নিলে তবে বাকিগুলি জনসাধারণের জন্য প্রকাশ্যে আসবে।
বিখ্যাত শতাব্দী-প্রাচীন জমিদার বাড়ি ভাঙার সময়েও সেখানে হাজির হয়ে বই সংগ্রহ করেছেন ইন্দ্রনাথবাবু। পুরনো বই উদ্ধার অভিযানের সে-সব গল্প ছিল সত্যিই শোনার মতো। ইন্দ্রনাথপুত্র তুষার এখন বাবার রাজ্যপাট সামলাচ্ছেন। জিৎ বলছিলেন, ‘তখন দেশবিদেশের নতুন বইয়ের কথা ফলাও করে জানা এত সোজা ছিল না। অনেক নতুন বইয়ের খবর বইমেলায় এসেই জানা যেত।’ বইমেলা শেষে প্রিয় বন্ধু অকালপ্রয়াত যাদবপুরের অধ্যাপক সামন্তক দাসের সঙ্গেও একদা প্রাপ্তির হিসেব-নিকেশ মেলাতেন তিনি। সে সব সুখস্মৃতি এখন ধারালো ফলায় বিদ্ধ করে।
পিতৃবন্ধু বিশ্রুত পাঠক রাধাপ্রসাদ গুপ্তের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হতো জিৎকে! তবে আরপি-কাকুর মার্কামারা সংলাপ, ‘কী রে, কী পেলি?’ তিনি ভুলেও কখনও ‘কিনলি’ উচ্চারণ করবেন না। সে-সব লব্জও এখন বইমেলা থেকে উধাও!
কবিতা চাই, কবিতা কই
কুরিয়র সংস্থার এজেন্ট, অমুক আশ্রমের হিসেব খাতা লিখিয়ে কিংবা অখ্যাত পত্রিকায় রক্তদান শিবির, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার খবর লেখা সাংবাদিক তিনি। তবে এ সবের কোনওটাই তাঁর আসল পরিচয় নয়। বইমেলার দিনগুলো দুপুর থেকে রাত একটানা মেলার মাঠেই দেখা যাবে লোকটিকে। লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে কিছু ক্ষণ অন্তর ঝোড়ো আবির্ভাব। ‘কবিতা চাই, কবিতা চাই’ হাঁক দিয়ে অদ্ভুত মাধুকরী ব্রতয় মেতে থাকেন নীহাররঞ্জন মজুমদার।
ময়দানের বই পোড়ার দিনের অন্যতম সাক্ষী মধ্য চল্লিশের যুবা সগর্বে বলেন, কয়েক জন নামী কবিও কবিতা দিয়েছেন তাঁকে। ২০০৬ থেকে এ ভাবেই কবিতার বই করছেন তিনি। লাভের প্রশ্ন নেই। কলেজ স্ট্রিটের চেনা প্রেসের দামটা মিটিয়ে দেন খেপে খেপে। কাগজের দাম বেড়েই চলেছে। বাড়িতে মা, দাদাদের মুখে গঞ্জনা! নিজেও সচরাচর লেখেন না, কারণ লিখলে সেটা জোলো হয়! তবু কবিতার বইয়ের নেশা ছাড়তে পারছেন না কিছুতেই। এখন মেতে আছেন জল নিয়ে একটা কবিতার বই প্রকল্পে। তবে ৩০-৩৫টা কবিতার সঙ্গে পৃথিবীতে জলের আকাল নিয়ে দু’-একটা লেখাও ছাপবেন এ বার। এক জন প্রফেসর দাদা লিখে দেবেন বলেছেন!
বইমেলা এলে আয়ু বেড়ে যায় এই কবিতাময় জীবনে। তবে সমস্যাও আছে! মা মাঝেমধ্যে ঘটক মারফত অন্য বদল আনার চেষ্টা করছেন জীবনে। নীহার অস্ফুটে বলেন, “সাংঘাতিক কাণ্ড মশাই! সব হাই স্কুলের দিদিমণি বুঝলেন! আর আমার রোজগার মোটে মাসে পাঁচ-ছ’হাজার! থাকবে ভেবেছেন! মাকে বলেছি, রক্ষে করো! প্রেমটা এ জীবনে শুধু কবিতার বই ছাপানোর সঙ্গেই চালিয়ে যেতে চাই!”
সেই ট্র্যাডিশন
সে-বইমেলায় জাক দেরিদা থেকে রিচার্ড ডকিন্সরা উদ্বোধনে থাকলেও মঞ্চে মন্ত্রী, সান্ত্রী, কাউন্সিলরদের এমন চাঁদের হাট দেখা যেত না! বই প্রকাশের হিড়িকেও পিছিয়ে ছিল বইমেলার উদ্বোধনী মঞ্চ। শোনা যায়, দেরিদা আসার বছরে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একটি জীবনী ছাপার চেষ্টা নিয়ে বিতর্ক বাধে। সেই মঞ্চেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছু ক্ষণ বাদে বইটি প্রকাশ করা হয়। বইমেলার সাবেক কর্তারা কলার তুলে বলেন, ‘সে যুগে মেলার উদ্বোধন সাহিত্যের কেউকেটারাই করতেন। কোনও রাষ্ট্রপ্রধান এলেও এ নিয়মে নড়চড় নেই।’ ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা এলেও তাঁকে অনুরোধ করা হয়, দয়া করে শামসুর রাহমানকে সঙ্গে করে আনবেন। বইমেলার উদ্বোধনটা কিন্তু ওঁকেই করতে হবে। হাসিনা সে-কথা মেনে নিয়েছিলেন।
‘আমায় বইমেলায় ডাকছেন কেন? আমি কী করব সেখানে! আমায় তো বরং কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকা যেত!’ প্যারিসে দেরিদাকে নেমন্তন্ন করতে গিয়ে এমন প্রশ্নের মুখে পড়েন বইমেলার কত্তা অনিল আচার্য। তিনি দেরিদাকে বোঝান, বইমেলার মাঠেই সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একযোগে পাবেন তিনি। পরে কলকাতায় উদ্বোধনী আসরে এর পরে বই নিয়ে ৭০ মিনিটের বক্তৃতাও দিয়েছিলেন দেরিদা। কলকাতা বইমেলার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে মুম্বই থেকে এ শহরে চলে আসেন শাবানা আজ়মি, জাভেদ আখতার। ভিড়ের চোটে প্রথমে বসার জায়গা পাচ্ছিলেন না মৃণাল সেন। তবে সে যুগেও বিতর্কের আঁচ লেগেছে মেলার গায়ে। বিহার ‘থিম’ হয়েছিল ওই বছর! আর ‘সাবঅলটার্ন নেতা’ লালুপ্রসাদ যাদবকে নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ বক্তা তপন রায়চৌধুরী। আর লালুর বক্তৃতায় তো মহাকেলেঙ্কারি! বইমেলার মঞ্চে ‘সর্বহারার মসিহা’ জ্যোতিবাবুর নামে লালু স্লোগান শুরু করলেন। সেই সব রাজনৈতিক কাণ্ড ভাল চোখে দেখেননি বইপ্রেমীরা।
প্রেমে, প্রতিবাদে
প্রতিবাদে অবশ্য এ কালের বইমেলা অনেকটাই নিরামিষ। তখন বইমেলার উল্টো দিকে কানোরিয়া আন্দোলনের সমর্থনে প্রতিবাদ মঞ্চে গান গাইতেন সুমন। তসলিমা নাসরিন, সলমন রুশদিদের উপস্থিতি এড়িয়ে এখন খানিক নিশ্চিন্তিরই পথ নিয়েছে বইমেলা। তবে তিন বছর আগে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদে পুলিশের নিষ্ঠুর লাঠির সামনে তীব্র সংঘাতের ঘটনা ঘটে। সাহিত্য উৎসবের মঞ্চে সে দিনই কেন্দ্রের বিভেদমূলক আইন তুলোধোনা করছেন আশিস নন্দী, শশী তারুর। কিন্তু উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের উসকানিতে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদের প্রতি সদয় ছিল না পুলিশ। বইমেলার গোলমাল থেকে থানা অবরোধ, ধরপাকড়। পরের দুপুরে রিং রোড জুড়ে তরুণ প্রাণের মিছিল ছবিটাও লেখা থাকবে বইমেলার গল্পে। প্রাক্-কোভিড যুগের সেই সময়টায় তখন গোটা দেশের রক্তেই টান লেগেছিল নানা ঘটনাবলিতে।
নিষিদ্ধ স্বর
বছর বারো আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও হেসে কুটিপাটি হন বইমেলার মাঠের দুই অক্লান্ত সৈনিক মালবিকা এবং আকাঙ্ক্ষা। নিয়ম মেনে গিল্ডের হল ঘরে নিজেদের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের অনুমতি মিলেছে। কিন্তু নির্ঘণ্ট মেনে ঘোষণার সময়ে ঘোষক বার বার তাঁদের বইয়ের নামটাই বাদ দিচ্ছেন। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে সটান গিয়ে অনুযোগ জানাতে পুরুষ ঘোষক তীব্র ভাবে বিরক্ত। ইংরেজি ভাষার আড়াল থাকলেও ‘অফ হরাইজ়নস অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইটির সঙ্গে ‘লেসবিয়ান, ট্রান্স ম্যাস্কুলাইন ন্যারেটিভ’ শব্দবন্ধটি বলতে তাঁর ঘোর আপত্তি। সেই অনতি অতীতেও সমপ্রেমীদের নিয়ে ছুঁতমার্গ ছিল কলকাতা বইমেলায়। ২০০৫-এ এক বার লিটল ম্যাগাজ়িন টেবিল থেকে তাঁদের মুখপত্র ‘স্বকণ্ঠে’-এর নাম বাদ গেল রহস্যময় ভাবে। পরের বার ভোর চারটেয় লটারির লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন আকাঙ্ক্ষারা। এই অন্য রকম ‘মেয়ে’ বা ‘ছেলে’দের প্রতি একটা সময়ে পাশের টেবিলেও স্পষ্ট ঘৃণা থাকত কারও কারও। এখন তাঁরাও এক সঙ্গে টিফিন বা খুচরো ভাগ করেন। এ কালে বাংলা, ইংরেজিতে কুইয়ার সাহিত্যের ছড়াছড়ি স্টলে স্টলে। সমপ্রেমীদের অনেকের কাছেই বইমেলা গেরিলাসেনা থেকে সহযোদ্ধা, বন্ধু হওয়ারও মাঠ।
মায়া ও মুশকিল আসান
সবার রঙে রং মেশানোর ঝোঁকে বিদেশি অতিথিরাও বইমেলাকে রঙিন করেছেন। রুশদেশে বাংলার প্রখ্যাত অধ্যাপিকা ইরিনা প্রোকোফিয়েভাকে ‘আপনার প্রিয় বাংলা লেখক কে’ প্রশ্ন করে বকুনি খেতে হয়েছিল। বিদুষী নারী মুখ কঠিন করে বললেন, ‘আপনাদের মহান ভাষা, মহান সাহিত্য! আমায় এমন প্রশ্ন করবেন না! আমি এক জন স্কুলছাত্রী নই!’ পরে শুনেছি ইরিনা বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর অনুরাগী। তবে ক্লাসে সত্যজিৎ রায় পড়াতে পছন্দ করেন! কারণ তাতে পড়ুয়াদের সহজে বাংলার কাছে টানা যাবে।
সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণে মত্ত ল্যাটিন আমেরিকান যুবক বা ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃত সাহিত্যের টানে বিভোর ইউরোপীয় লেখকেরা আকছার আসেন বইমেলায়। কলকাতার স্প্যানিশ শিক্ষক দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায় নিজেও বইমেলার একটি চরিত্র। বছর, বছর কিউবা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, স্পেন নানা থিমের পিছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রতি বার বলেন, এটাই শেষ বার! পরে পীড়াপিড়িতে ফের স্প্যানিশ বিশ্বের কোনও নতুন দেশের যোগসূত্র হয়ে ওঠেন। গুয়াতেমালার মায়া সভ্যতার নারীরাও কয়েক বছর আগে বইমেলার প্রধান আকর্ষণ হয়ে ধরা দিয়েছিলেন। গুয়াতেমালার মণ্ডপে ঢুকলেই গ্লেডিস নামের হাস্যোচ্ছ্বল তরুণীকে চোখে পড়ত। এক জন ছোটগল্পকার। এক বর্ণ ইংরেজি জানে না! কিন্তু তার হাসি ও কটাক্ষের হাতছানিতে যেন অমোঘ সম্মোহন। চোখমুখের নানা অভিব্যক্তি ও হাসির বাইরে আলাপ খুব একটা এগোয়নি। তবে বলতে দ্বিধা নেই, গ্লেডিসের উপস্থিতিই অনেককে বইমেলায় গুয়াতেমালার দিকে টানত। মেলা ভাঙার দিন, সে এগিয়ে এসে একটা কাপড়ের পুতুল উপহার দিল। তার পেটের ভিতর ছোট্ট ছোট্ট আরও ক’টা কাপড়ের পুতুল। বহু কষ্টে বোঝাল, এ হল প্রাচীন মায়া সমাজের মুশকিল আসান পুতুল। কোনও সমস্যা সেই পুতুলের কাছে জানালে সে শুনতে পাবে! সমস্যা মিটেও যাবে দ্রুত। খেয়াল হল, পুতুলটি সঙ্গে থাকলেও তার সঙ্গে সমস্যার কথা বলা এখনও বাকি রয়েছে। অবশ্য জানি না, তাকে সব কথা খুলে বলতে কোন অচিন ভাষা রপ্ত করতে হবে!