Incense Sticks

ধূপের ধোঁয়ায় বিশ্বজয়

করেছিলেন কলকাতার এক বাঙালি। সতীশচন্দ্র ঘোষ। গত বিশ শতকের প্রথম পর্বে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকার শিকাগো শহরে। পেশায় পশুচিকিৎসক হলেও সেখানে খুলে ফেলেন ধূপ প্রস্তুতকারক সংস্থা। নতুন গন্ধের ফর্মুলার জন্য বেশ কয়েকটি পেটেন্টও পান। বাঙালি স্রষ্টার সেই ধূপ আজও বেঁচে জাপানি সংস্থার হাত ধরে।

Advertisement

প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:৪৬
Share:

ফাইল চিত্র।

সুগন্ধের সঙ্গে ধর্ম বা দৈবের আত্মীয়তা প্রায় চিরায়ত বললেই চলে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা শিখ, যে কোনও ধর্মের উপাসনাস্থলে গেলেই নাকে আসে সুঘ্রাণ। দেবতা থেকে পয়গম্বর, বুদ্ধ থেকে ঈশ্বর-প্রেরিত মহাপরিত্রাতা, সকলকেই আহ্বান করতে প্রয়োজন হয় ধূপ, ধুনো, ফুল, চন্দন ইত্যাদি সুগন্ধি দ্রব্য। গন্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে দৈবের এই আদান-প্রদানের ব্যাপকতাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঘ্রাণেন্দ্রিয় নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা যেমন প্রাচীন তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ। সুন্দর গন্ধ মনকে সন্নিবিষ্ট করে, কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে নিবদ্ধ বা সংযুক্ত হতে সাহায্য করে।

Advertisement

ভিতর বাহির, এ পার ও পার

গন্ধ যে মোটেই বাহ্যিক বা গৌণ ব্যাপার নয় তা বার বার আমরা দেখতে পাই প্রাক্‌-আধুনিক কালের দার্শনিক এবং ধর্মীয় চর্চার মধ্যে। মধ্যযুগে বিক্রমাদিত্যের সমতুল্য বিখ্যাত ভোজরাজ স্বয়ং লিখে গেছেন যে, গন্ধ হল এমন একটি অদ্ভুত অলঙ্কার যা একাধারে বাহ্যিক এবং আন্তরিক। শারীরিক এবং মানসিক জগতের মধ্যে এটি একটি সেতু রচনা করতে সক্ষম। অন্য দিকে আবার পার্থিব জগতের সঙ্গে দৈব জগতের যোগসূত্রও এই গন্ধেরই মাধ্যমে। তাই তো রাজা ভোজ লিখিত ‘শৃঙ্গারপ্রকাশ’ গ্রন্থের প্রায় পাঁচশো বছর পরে বিজাপুরের সুলতানের আদেশে লিখিত ‘নুজূম উল উলুম’ নামক কুহক বিষয়ক গ্রন্থে দেখতে পাই সবিস্তার আলোচনা— কোন গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করে কোন জিন বা হুরিকে বশে আনা যাবে। গন্ধ প্রস্তুত করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে পার্থিব মানুষ গায়েবি দুনিয়ার উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে। আজকাল সুগন্ধির বিজ্ঞাপনেও অনেকটা সে রকমই ব্যাপার আমরা দেখতে পাই। ধূপের বিজ্ঞাপনে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও, সেন্ট বা পারফিউমের ক্ষেত্রে কিন্তু ‘বশীকরণ’-এর ধারণাটিই প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে।

Advertisement

সুগন্ধির বিবর্তন

গন্ধের তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্য বুঝলে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, বিশ্বের প্রায় সকল প্রাচীন সভ্যতাই গন্ধদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও লিপ্ত ছিল গন্ধের বিশ্লেষণ এবং উৎপাদনের কাজে। বিশেষ করে আশু-আধুনিক যুগে, অর্থাৎ ইংরেজি সতেরো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত সময়, গন্ধদ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে নানা প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং আবিষ্কার হতে থাকে। চিরাচরিত গন্ধ-প্রস্তুতির পাশাপাশি উঠে আসে নানা নতুন গন্ধ। এর পিছনে এক দিকে ছিল ইউরোপীয় বণিক এবং ঔপনিবেশিকদের দ্বারা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নতুন সমস্ত গাছগাছড়া বিস্তৃত করা, যেমন ফিরিঙ্গিদের দ্বারা বাংলাদেশে জবাফুল আনা, য়োহান্না ইবনে মাসাবায়হর মতো আরব চিকিৎসকদের দ্বারা নানা প্রযুক্তিগত উন্নতি। এ সব নতুন প্রযুক্তির মধ্যে ছিল ফুলের নির্যাস বার করার নতুন উপায়, তা ছাড়াও সেই নির্যাসকে আরও পরিশীলিত, পরিবর্তিত, প্রতিফলিত করার সব উপায়। আতরের বাহার তাই এই সময় বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে।

প্রসাধন থেকে ঈশ্বরসাধনা

আধুনিক যুগে ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উদয়ের সঙ্গে এই সব সুগন্ধি উৎপাদন ধীরে ধীরে পণ্যরূপ ধারণ করতে শুরু করে। সুন্দর বোতলের গায়ে নজরকাড়া লেবেল জড়িয়ে, বিজ্ঞাপনের সুললিত মহিমাকীর্তনে বন্দিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে একাধিক সুগন্ধি। যা আগে ছিল ওস্তাদ কারিগরের হাতে তৈরি অপ্রতিম আতর, তা বিবর্তিত হল গণ-উৎপন্ন ব্র্যান্ডেড পারফিউমে। শীঘ্রই বিদেশি পুঁজির পাশাপাশি এই ব্যবসায় নেমে পড়েন ছোট-বড় নানা ভারতীয় ব্যবসায়ী। হেমেন বোসের ‘দেলখোশ’ কিংবা পি এম বাগচীর ‘ভুলো না আমায়’-এর মতো আধুনিক যুগের গোড়ার দিকের বাঙালির আপন সুগন্ধি পণ্যের ঘ্রাণ হয়তো আজও অনেকের নাসিকাগ্রে টিকে আছে। তবে এই নব্য ঘ্রাণ-সংস্কৃতির প্রায় চোদ্দো আনা পণ্যই ছিল প্রসাধনী বস্তু। ধর্মাচরণের মধ্যে গন্ধের যে বহুল ব্যবহার, তাকে পণ্যায়িত করতে আরও কিছু সময় লেগেছিল। তাই পারফিউমের ইতিহাসে হেমেন বোস বা পি এম বাগচীর নাম আমাদের জানা থাকলেও, ধূপ-প্রস্তুতকারক কোনও ঐতিহাসিক পুঁজিপতির নাম করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়। আর ধুনো, লোবান কিংবা খুচরো ফুলের ক্রয়-বিক্রয় তো আজও ব্র্যান্ডিংকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে অনামা বাজারের বিক্রেতাদের হাতেই রয়ে গেছে।

স্মৃতির গন্ধ, শিকড়ের টান

তবে আধুনিক যুগে গন্ধের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা দেখা দিল। আধুনিক মানুষ যতই পরিযায়ী হয়ে উঠল, নিজের শহর ও দেশের সীমা ভেঙে অন্যত্র যেতে শুরু করল, ততই গন্ধ আর স্মৃতির বহু পুরনো সম্বন্ধটি একটি নতুন রূপ ধারণ করতে থাকল। ফেলে আসা দেশ বা সময়ের দূত রূপে গন্ধের নতুন এক চরিত্র দেখা দিল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে তাই দেশের গন্ধ, দেশের মাটির গন্ধ, ছেলেবেলার গন্ধ ইত্যাদি বহুব্যবহৃত শব্দবন্ধ। ছেড়ে আসা গ্রাম বা ফেলে আসা দেশের পাশাপাশি শৈশবের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার, জাগিয়ে রাখার বা উস্কে দেওয়ার দায়িত্ব গন্ধের আধুনিক সামাজিক ক্রিয়ার একটি অন্যতম কার্যকরী দিক হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ইউরোপের কয়েক জন বিজ্ঞাপন গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্বদেশ থেকে বিতাড়িত যে সব বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা আজ শেষ বয়সে এসে স্মৃতিবিভ্রাটে আক্রান্ত, তাঁদের স্মৃতি কিছুটা হলেও জেগে ওঠে যদি তাদের ছেলেবেলার স্বদেশি ফুলের বাগানে মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হয়। যুদ্ধের বিধ্বংসী আগুন, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিটে ত্যাগ, প্রবাসে বার্ধক্য— এই সবই তো আমাদের আধুনিক জীবনের অতি পরিচিত সব ঘটনা। বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পোল্যান্ড আর দেশভাগের সময়কার পিরোজপুর কি পাবনাই হোক। অনৈচ্ছিক চলমানতা এবং তার দ্বারা নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় আত্মসত্তার উপর যে চরম আঘাত লাগে, তা আজ প্রায় সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ বা দেশভাগ বাদেও মানুষ আজ প্রায়শই জীবিকার সন্ধানে তার পরিচিত পরিবেশ এবং পরিজনের থেকে বিচ্ছিন্ন। তার সত্তার ভিত টলমল করে টিকে থাকে ক্ষয়িষ্ণু নস্ট্যালজিয়ার উপর ভর করে। আর সেই নস্ট্যালজিয়ার উপকরণই জোগায় চেনা সব গন্ধ।

শিকাগোয় সতীশবাবু

হয়তো সেই কারণেই, সুদূর মার্কিন মুলুকে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ডাক্তার সতীশচন্দ্র ঘোষ ফেঁদে বসেছিলেন ধূপের ব্যবসা। সতীশবাবুর জন্ম ঢাকা শহরে, জন্মতারিখ ১৮৮২ সালের ২ অগস্ট। তবে তাঁর প্রথম জীবন সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। কোনও এক সময় তিনি শিক্ষার জন্য ঢাকা থেকে কলকাতা আসেন এবং পেশা হিসেবে পশুচিকিৎসা বেছে নেন। কলকাতায় কিছু কাল তিনি ভেটেরিনারি সার্জেন রূপে কর্মরত ছিলেন। তবে ১৯০৮ সালে কোনও অজ্ঞাত কারণে তিনি কলকাতা ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দেন। সে কালের আমেরিকা আজকের মতো ছিল না, সে দেশে ভারতীয় তখন মুষ্টিমেয়। তাদের মধ্যেও বেশির ভাগই হয় অবাঙালি, নয় শ্রমজীবী, কিংবা দুই-ই। সতীশবাবুর মতো শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক তখন আমেরিকায় সম্ভবত হাতে গোনা কয়েক জন মাত্র। কেন তিনি এমত অবস্থায় সে দেশে পাড়ি দিলেন, তা আমার জানা নেই। তবে সেখানে তিনি আস্তানা গাড়লেন শিকাগো শহরে।

সুগন্ধপণ্য: সতীশচন্দ্র ঘোষ উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধূপের লেবেল। শুধু ধূপ নয়, ধূপদানির নানা ডিজ়াইন কিংবা ‘ডিফিউজ়ার’ জাতীয় যন্ত্রের পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি।

বাঙালির ধূপ-বিপ্লব

দুঃখের বিষয়, আরও নানা ঘটনার মতো সতীশবাবুর শিকাগো-জীবনের প্রথমার্ধও কালের ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। তিনি সেখানে গোড়ায় পশুচিকিৎসক রূপেই কাজ করেছিলেন, না কি অন্য কোনও বৃত্তি সম্বল করে প্রবাসে টিকে ছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নাগাদ তিনি ধূপ প্রস্তুত করতে শুরু করেন। পশুচিকিৎসক হিসবে কিছুটা বিজ্ঞান তাঁকে কলকাতাতেই পড়তে হয়েছিল। সম্ভবত সেই রসায়নের জ্ঞান কাজে লাগিয়েই তিনি এই কাজে হাত দেন। তবে শীঘ্রই তিনি নিজের উদ্ভাবনী শক্তি ও কল্পনার জোরে তাঁর উদ্যোগটিকে একটি সম্পূর্ণ নতুন রূপ দিতে সক্ষম হন। আমাদের পরিচিত ধূপের পরিবর্তে তিনি তৈরি করেন এক ধরনের ছোট ত্রিকোণ ধূপের ঢেলা। আগেকার দিনে বাড়িতে তৈরি কালীপুজোর বাজির মতো দেখতে এই ত্রিকোণ ঢেলাগুলো ধীরে ধীরে জ্বলে ঘর সুগন্ধে পূর্ণ করে তুলত। তবে এখানেই থেমে থাকেননি সতীশবাবু। ধূপের ডিজ়াইন ছাড়াও তিনি ধূপদানিরও একাধিক নতুন ডিজ়াইন প্রবর্তন করেন। তবে সব থেকে উল্লেখযোগ্য এই যে, তিনি পুরো উৎপাদন পদ্ধতিটিকে যন্ত্রায়িত করতে সচেষ্ট হন। সেই কারণে তিনি বেশ কিছু নতুন মেশিনও তৈরি করেন। সতীশবাবুর হাত ধরে শিকাগোর ধূপ শিল্প ১৯২০-র দশক নাগাদ বেশ জমে ওঠে।

‘হিন্দু’ হল ‘ইন্ডিয়া’

সতীশবাবুর প্রথম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘হিন্দু ইনসেন্স কোম্পানি’। তাঁর তৈরি ‘গণেশ ইনসেন্স’ অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছিল। ১৯২৩ নাগাদ তিনি এই সংস্থানটি লাটাভিয়া থেকে আগত এক ইহুদি ব্যবসায়ীকে বেচে দেন। রাডকিন্স নামে এই পরিবারটি ১৯৭০ অবধি সিদ্ধিদাতা গণেশের নামাঙ্কিত ধূপ বেচে রমরমা ব্যবসা করে গিয়েছে। তার পর যদিও কোম্পানির মূল মালিকানা চলে যায় জাপানি এক পুঁজিপতির হাতে, সতীশবাবুর দেওয়া নাম এবং গন্ধ আজও বাজারে টিকে রয়েছে। রাডকিন্সরাও জাপানি মালিকদের অধীনে আরও প্রায় এক প্রজন্ম কোম্পানির দায়িত্বে কাটিয়ে দিয়েছে।

ও দিকে ‘হিন্দু ইনসেন্স’ বেচে দিয়ে, সতীশবাবু সেই পুঁজি দিয়ে আবার ব্যবসা ফাঁদেন। এ বার কোম্পানির নাম দেন ‘ইন্ডিয়া ইনসেন্স’, সঙ্গে নতুন সব গন্ধও বাজারে আনেন তিনি। এর মধ্যে ছিল ‘হিন্দু রোজ়’ আর ‘গোল্ড সিল স্যান্ডালউড’-এর মতো সব গন্ধ। তবে এ বার তিনি নানা রকম যান্ত্রিক ধূপদানি নিয়েও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। আজকালকার ‘ডিফিউজ়ার’ জাতীয় একটা যন্ত্র তৈরি করেন ‘ভেপোরাইনসেন্স’ নাম দিয়ে। ধূপের পাশাপাশি সুগন্ধি তেলও তিনি বাজারে আনেন। তবে তাঁর আবিষ্কৃত সব থেকে উদ্ভট বস্তুটি নিঃসন্দেহে ধূপের সিগারেট বা ‘ইনসেন্সিগারেট’। এই সব নতুন গন্ধের ফর্মুলা ও যন্ত্রের ডিজ়াইনের জন্য সতীশবাবু বেশ কয়েকটি পেটেন্টও লাভ করেন। তাঁর ব্যবসা আবার ফুলেফেঁপে ওঠে। নিত্যনতুন আবিষ্কার এবং তাঁর ব্যবসায়ী বুদ্ধির জোরে এ বার ‘ইন্ডিয়া ইনসেন্স’ হয়ে ওঠে মার্কিন ধূপের জগতের অন্যতম নাম। হিন্দু ইনসেন্সের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে চলে এই দ্বিতীয় উদ্যোগটি।

গন্ধে মজেনি স্বদেশই

১৯৩৫ সাল নাগাদ তাঁর ব্যবসা যখন আবার মধ্যগগনে, তখনই দেশের টানে তিনি কলকাতা আসেন। বছর খানেক শাঁখারিটোলাতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকে তিনি চেষ্টা করেন তাঁর আমেরিকান কর্মকাণ্ডের দেশীয় শাখা গড়ে তুলতে। তবে স্বদেশি নেতারা তখন শিল্পায়ন বলতে বোঝেন ‘হেভি মেশিনারি’। কারখানা বলতে তাঁরা চান ইস্পাত বা যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক বিশাল কারখানা। ধূপকাঠি তৈরি বা লঘু শিল্পের দিকে তাঁদের তেমন আগ্রহ নেই। বরং রয়েছে কিছুটা তাচ্ছিল্য। সতীশবাবু তাই বছর খানেক কলকাতায় থেকেও তেমন কিছু করতে না পেরে আবার ফিরে যান শিকাগোতে। তার এক যুগ পরে, ১৯৪৭ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার এক বার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফল আবারও সেই এক। বিমানযোগে ফেরার পথে সিঙ্গাপুরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “ভারতে ব্যবসার তেমন অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে এখনও কিছু সময় লাগবে।” এর পর তিনি আর ভারতে এসেছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৬৯ সালের ১৪ অক্টোবর।

ফেলে আসা দেশ ও অতীত

আমৃত্যু সতীশবাবু যে সব গন্ধ প্রস্তুত করেন, তার প্রত্যেকটাই ছিল ফেলে আশা দেশের ইঙ্গিতে পূর্ণ। পরিচিত বাঙালি গন্ধ, যেমন জুঁই, চন্দন, হাসনুহানা, এমনকি মৌরি, জাফরান ইত্যাদি ছাড়াও তাঁর নাম আর বিজ্ঞাপনের মধ্যে বার বার তিনি যেন ধরে রাখতে চেয়েছেন ফেলে আসা দেশকে। প্রতিটি বাক্সের উপরে তাঁর নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা থাকত ‘ডাঃ সতীশচন্দ্র ঘোষ অব কলকাতা’। এ ছাড়া ছিল ‘দিল্লি স্যাফ্রন’, ‘গান্ধী’ ইত্যাদি নামের গন্ধদ্রব্য। এমনকি স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পরেও সতীশবাবুর ধূপের বাক্সের উপরে অবিভক্ত ভারতের মানচিত্র দেখে ভারতীয় এক সাংবাদিক কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই প্রশ্ন করেন, প্রবাসী সতীশবাবু কি জানেন না যে, জিন্না সাহেব দেশের কয়েক টুকরো কেটে নিয়েছেন?

শুধু নাম, মানচিত্র বা ছবির মতো তির্যক ইঙ্গিতই নয়, তাঁর প্রস্তুত করা অনেক দ্রব্যের সঙ্গেই দেওয়া হত ছোট্ট একটি ছাপা লিফলেট। সেই লিফলেটে লেখা থাকত বিশ্বে গন্ধদ্রব্যের সার্বিক ইতিহাস। সতীশবাবু সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইতিহাস শুরু করতেন একটি বিশাল দাবি করে। তাঁর মতে, ‘সভ্যতার উন্নতির ইতিহাস ও ধূপের উন্নতির ইতিহাস পরস্পরের দ্যোতক’ এবং সেই মহান ইতিহাসের হোতা যে কয়েকটি জাতি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিশরীয়, ইহুদি, আসিরীয়, ফার্সি, জৈন এবং হিন্দুরা। তবে বাকি জাতির তুলনায় হিন্দুদের নিয়েই চর্চা বেশি করা হয়েছে। তাদের পূজায় এবং মৃতের সৎকারে যে সুগন্ধির ব্যবহার অনিবার্য, সেই উল্লেখ ছাড়াও সতীশবাবু ভারতে ধুনোর উৎপাদন নিয়েও যৎসামান্য লিখেছেন। তাঁর লিখিত ইতিহাস নিসন্দেহে একপাক্ষিক এবং নানা ভুলভ্রান্তিতে ক্লিষ্ট। তবে সে সব দোষ সত্ত্বেও এই লিফলেটের মধ্য দিয়ে সতীশবাবু তাঁর উৎপন্ন পণ্যটির মধ্যে নিজের সত্তাকে জুড়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর ফেলে আসা দেশের কল্পিত অতীত মাহত্ম্যের সঙ্গে। জাতীয় গৌরবের একপাক্ষিক ইতিহাসের মধ্যেই গ্রাহকদের জানিয়েছেন যে, তিনি নিজেও সেই মহান ভারতেরই কলকাতা শহরের মানুষ এবং এই পণ্যটি তাঁর সম্মুখ তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা হয়েছে।

গন্ধের নিত্যতা সূত্র

প্রবাসের অভিজ্ঞতা বা সতীশবাবুর প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক না কেন, গন্ধের মধ্যে দিয়ে ফেলে আসা দেশের সঙ্গে একটা সম্পৰ্ক জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টার তল পেতে গেলে কিন্তু আমাদের ঘুরে দেখতে হবে সংস্কৃত গন্ধশাস্ত্রের দিকে। ইতিহাসবিদ জেমস ম্যাকহিউ সংস্কৃত শাস্ত্রে গন্ধ সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা নিয়ে লিখিত তাঁর তথ্যবহুল বইতে লিখেছেন যে, আদি যুগের শাস্ত্রকার এবং গন্ধদ্রব্য প্রস্তুতকারক— দু’জনেই গন্ধের কথা ভাবতেন ‘বাসন’-এর ধারণার মাধ্যমে। কথাটি শুনতেও যেমন বাসনার মতো, এর অর্থও বাসনার সমগোত্রীয়। সংস্কৃত দর্শনের বলয়ে বাসনা বলতে যেমন গত জন্মের কর্মের এক ধরনের অঙ্গীভূত স্মৃতির ধারণা বোঝায়, গন্ধের ক্ষেত্রে বাসন বলতেও বোঝায় এক রকমের মূর্ত কণানির্ভর প্রকরণ, যার মাধ্যমে একটি জিনিসের গন্ধ আর একটি জিনিসে স্থানান্তরিত হয়। ম্যাকহিউ এই ধারণা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, বাসন কিছুটা আমাদের কালের ‘রেকর্ডিং’-এর সঙ্গে তুল্য হলেও, এর মাধ্যমে গন্ধের যে বিস্তার ঘটে তা কিন্তু কখনওই এই প্রতিচ্ছবি, অনুলিপি বা ‘কপি’ নয়। বরং গন্ধকণাগুলোর মূর্ত পরিবর্তনের দ্বারা মূল বস্তুটির একটি অংশ টিকে থাকে তার গন্ধের মধ্য দিয়ে। ফলে, ধরা যাক একটি সুগন্ধি ফুলের গন্ধ যদি বাসনের দ্বারা একটি তেলে পরিবর্তিত হয়, তা হলে ফুলটি শুকিয়ে গেলেও তার একটি মূর্ত অংশ তেলের মধ্যে বেঁচে থাকবে।

বাসনের এই ধারণাটি বুঝে ফেললে দেখা যাবে যে, আমাদের আধুনিক ছেড়ে-আসা দেশের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং গন্ধের মধ্যে সেই দেশের ছোঁয়া খোঁজার মধ্যে কাজ করছে এমনই একটা চিন্তা। গন্ধ সেখানে স্রেফ স্মৃতিচিহ্ন নয়। বরং গন্ধ হল এক ধরনের জীবিত, আঙ্গিক সাঁকো। সেই সেতুর মাধ্যমে মানুষ প্রবাসের দৈনন্দিনতাকে অতিক্রম করে যেতে চায়। সেই সেতুর এক দিকে যেমন নস্ট্যালজিয়ার ক্ষীণ আভা, তার অন্য পারে কিন্তু বাসনের মূর্ত যোগসূত্রের প্রতিশ্রুতি। এই দোটানার মাঝেই দেখা মেলে সতীশবাবুর বিস্মৃত জীবন এবং কর্মকাণ্ডের। সে কর্মকাণ্ডে একই সঙ্গে রয়েছে এক বাঙালির বিদেশে লক্ষ্মীলাভের বিস্মৃত আখ্যান, আর দেশের জন্য এক প্রবাসীর আবেগের বেদনাদায়ক মেদুরতা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement