গুপী-বাঘার গল্প।
এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর। গ্রাম-বিতাড়িত, সুরতালহীন দু’টি সঙ্গীত-উৎসাহী যুবক এই বরের জোরেই হয়ে বসল রাজার জামাই। বাঙালি মাত্রই গুপী গায়েন আর বাঘা বায়েনের এই অবিস্মরণীয় আখ্যান চিনে ফেলবেন। তবে এই গল্পের ঐতিহাসিকতা নিয়ে হয়তো কেউ মাথা ঘামান না। এ তো নিছক কল্পনা। এর সঙ্গে ইতিহাসের সম্বন্ধ কোথায়?
হ্যাঁ। পরবর্তী কালে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে হয়তো আমরা তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু উপস্পর্শী ইঙ্গিত খুঁজে পেতে পারি, কিন্তু সাবেক গুপী-বাঘার গল্পে ইতিহাস কোথায়? ভূতের রাজার বরের আবার ইতিহাস হয় না কি!
ইতিহাস, চলচ্চিত্র এবং কল্পনা সম্বন্ধে আমাদের কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণা বর্জন করলেই আমরা দেখতে পাব যে, গুপী-বাঘার গল্পে উঁকি দিচ্ছে নানা বিস্মৃত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে ভূতের রাজার দেওয়া বরের ভিতর নিহিত রয়েছে বাঙালির কালীপুজোর স্বতন্ত্র এক ঐতিহ্য। ভূতের রাজা ও তার দেওয়া বরগুলি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দেয় বাঙালি আধুনিকতার উনিশ শতক-কেন্দ্রিক ইতিহাসবোধের অন্তর্নিহিত আরও বহু পুরনো বঙ্গীয় তন্ত্রচর্চার ইতিহাসের সন্ধান।
প্রকৃত ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্কটিকে সাধারণত আমরা খুবই সঙ্কীর্ণ ছকে উত্থাপিত করি। মূলত চলচ্চিত্রের সঙ্গে ইতিহাসের কুটুম্বিতার হদিস করায় আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। হয় আমরা মনে করি চলচ্চিত্র হল সমকালীন ইতিহাসের উপস্থাপনা, নয়তো আমরা খুঁজি চলচ্চিত্রের মধ্যে পারিপার্শ্বিক ইতিহাসের প্রতিক্রিয়া। অমুক সিনেমাটি সেই সময়কার নির্ভরযোগ্য দলিল, না কি তার মধ্যে ধরা পড়ছে সেই সময়কার ঐতিহাসিক বাস্তবের প্রতি কোনও বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি— এই দু’টি প্রশ্নের মধ্যে ঘোরাফেরা করে ইতিহাস এবং চলচ্চিত্রের আত্মীয়তার খোঁজখবর। অনুসন্ধান কিন্তু আর এক ভাবেও সাজানো যায়। ইতিহাস তো কোনও একটি মুহূর্তে কারাবদ্ধ নয়, সেটি একটি ধারাবাহিকতার নাম। তাই আমরা চিন্তা করতে পারি যে, চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে আমরা ঠিক কী ধরনের ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। যে হেতু সিনেমা এমন একটি মাধ্যম যাতে দৃশ্য, সুর, গল্প, ভাষা ইত্যাদি নানা বস্তুর সমন্বয় ঘটেছে, তাই আমরা এর মধ্যে নানা ধারাবাহিকতার হদিস খুঁজে পেতে পারি। এমন সব ফল্গুধারার পরিচয়ও হয়তো পেয়ে যেতে পারি, যেগুলি সাধারণত আমাদের সামাজিক অবচেতনার আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে থাকে।
এ? ই রকম একটা ভাবনা নিয়ে এগোলেই আমরা মুখোমুখি হয়ে পড়ি অপর একটি সম্পর্কের প্রশ্নে— কল্পনার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক। আবার সাধারণত আমরা মনে করে থাকি, কল্পনা হল ইতিহাস-বহির্ভূত বস্তু। গল্পের গরু তাই গাছে চড়ে আর ঐতিহাসিক পয়স্বিনীরা বাঁধা থাকে গোয়ালে। একটু ভেবে দেখলেই কিন্তু দেখা যাবে যে কল্পনা, তা সে যত উদ্ভট বা উৎকটই হোক না কেন, সর্বদাই তার আকরের জন্য নির্ভরশীল থাকে ঐতিহাসিক বাস্তবের উপর। তাই গরু গাছে চড়ুক আর না চড়ুক, গরু, গাছ এবং গাছে চড়া, তিনটিই কিন্তু ঐতিহাসিক বস্তু। যে দেশে গরু নেই বা গাছ নেই, সে দেশে গরুর গাছে চড়ার কল্পনাও নেই। শুধু তা-ই নয়। আরও এক ধাপ এগোলেই আমরা দেখব যে, শুধু আকরই নয়, কল্পনার অভ্যাস বা প্রয়োগটিও আদতে ইতিহাসনির্ভর। তাই তো যদিও গরু এবং গাছ দু’টি বস্তুই বিলেত, আমেরিকা-সহ নানা দেশেই পাওয়া যায়, তবু এক বাঙালি ছাড়া কারও কল্পনাই গরুকে গাছে তোলেনি।
যাই হোক। ফেরা যাক ভূতের রাজার দরবারে। কোথায় পেলেন সত্যজিৎ ভূতের রাজার বরগুলো? আমরা জানি, মূল কাহিনিটি সত্যজিৎ রায়ের নিজের লেখা নয়। লেখা তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর। তবে সেই গল্পে, বিশেষ করে বরের ব্যাপারে সত্যজিৎ মূল কাহিনির কিছু পরিবর্তন করেছিলেন। তিনটি বরের মধ্যে দু’টিকে তিনি রেখেছিলেন অপরিবর্তিত। প্রথম বরটির দ্বারা গুপী-বাঘার সঙ্গীতসাধনা খুঁজে পেয়েছিল সুর এবং তাল। শুধু তা-ই নয়। এই বরের জোরেই তাঁরা এমন ক্ষমতাও অর্জন করেন যে তাঁদের গান চলাকালীন শ্রোতৃবৃন্দ, সে যেই হোক না কেন, চিত্রবৎ বসে সেই সঙ্গীত শুনতে বাধ্য হবেন। শ্রোতারা চলৎশক্তিরহিত হবেন। অপর একটি বরের মাধ্যমে গুপী-বাঘা এক জোড়া ঐন্দ্রজালিক জুতো পান। এই জুতো পায়ে দিয়ে তাঁরা নিমেষে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এই দু’টি বরের ব্যাপারেই সত্যজিৎ মোটামুটি উপেন্দ্রকিশোরকেই অনুসরণ করেছেন।
তৃতীয় বরটির বেলায় কিন্তু তা হয়নি। উপেন্দ্রকিশোরের গল্পে পাচ্ছি একটি মায়াঝোলা। তার ভিতরে হাত দিলেই বেরিয়ে আসে নানা রকম চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। কিন্তু শুধু তা-ই নয়। রাজকীয় পোশাক-আসাকও পাওয়া যায় ঝোলার অন্তরালে। সত্যজিৎ কিন্তু ঝোলার জায়গায় কেবল হাততালি দিয়েই কাজ সেরেছেন। এই পরিবর্তনের কারণ যা-ই হোক না কেন, এই পরিবর্তনের ঘটনা থেকে এটুকু প্রমাণ হয় যে, সত্যজিৎ এই বরের বিষয়ে অন্ধ ভাবে তাঁর ঠাকুরদার অনুসরণ করেননি। তা হলে প্রশ্ন ওঠে যে, প্রথম দু’টি বরকে কেন তিনি অপরিবর্তিত রেখে দিলেন এবং সেগুলির অন্তর্নিহিত ইতিহাসই বা কী?
প্রথমেই দেখা যাক জুতোজোড়া। মায়াজুতোর ভাবনার উৎস কোথায়? দেশভ্রমণের কল্পনা তো নানা সময় নানা দেশে নানা ভাবে হয়েছে। ইউরোপের লোককথায় যেমন বার বার উল্লেখ রয়েছে ডাইনি বা ‘উইচ’দের ঝাঁটায় চেপে দেশবিদেশ ঘোরার কাহিনি। ইউরোপেরই অন্যত্র আবার দেখতে পাই, ডাইনিরা ছাঁকনি চড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের তিন ডাইনিকে তাই দেখতে পাই ছাঁকনিতে করে স্কটল্যান্ড থেকে আলেপ্পো যাওয়ার পরিকল্পনা করতে। সতেরো শতকের ভাগ্যান্বেষী নিকোলাও মানুচ্চির লেখা থেকে জানতে পারি, ছাঁকনিতে চেপে ডাইনিদের দেশভ্রমণের গল্প পর্তুগিজ বণিকদের হাত ধরে পৌঁছে গিয়েছিল মোগল ভারতেও। অন্যত্র, ষোলো শতকের জার্মানভাষী মধ্য ইউরোপে পাই ফোরটুনাটুসের মতো গল্প, যাতে রয়েছে ঐন্দ্রজালিক টুপির সাহায্যে দেশভ্রমণের উপায়।
আমাদের বাংলা দেশেই ছিল অপগমনের একাধিক কল্পনা। যেমন ডাইনিদের গাছে করে উড়ে যাওয়ার নানা গল্প প্রচলিত ছিল বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালের কথা বলতে গিয়ে তাঁর নিজের দেখা এমনই একটি অশ্বত্থ গাছের উল্লেখ করেছেন। লোকের বিশ্বাস ছিল যে, কামাখ্যার ডাকিনীবিদ্যা জানা ডাইনিরা ওই গাছটি চেপে যাতায়াত করত। এ ছাড়াও অবশ্যই রয়েছে পক্ষিরাজ ঘোড়া থেকে দাঁড়কাকের মতো নানা কল্পিত মায়াবাহন, যারা মানুষকে এক দেশ থেকে আর এক দেশে নিয়ে চলে যেতে পারে।
মোদ্দা কথা, অপগমনের কল্পনা যতই সুদূর প্রসারিত হোক, সেই কল্পনার সব সময়ই কিছু বিশেষ ঐতিহাসিক লক্ষণ থাকে। কে ওড়ে? কিসে করে ওড়ে?— এ সব প্রশ্ন কাল্পনিক হলেও তার মাত্রা আঁকা থাকে ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যে। তাই গুপী-বাঘার মায়া জুতোজোড়ার খোঁজে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে বাংলার পুরনো ইতিহাসের দিকে।
এই অনুসন্ধানে প্রথমেই চোখে পড়ে, বাংলা মুদ্রণের পথিকৃৎ উইলিয়াম কেরি সাহেবের লেখা অভিধানে রয়েছে ‘যোগপাদুকা’ বলে একটি শব্দ। কেরি সাহেব এই বাংলা শব্দটির ইংরেজি অর্থ করেছেন ‘ম্যাজিক্যাল শুজ়’। তাঁরই সমসায়িক স্যর গ্রেভস হাউটন তাঁর লিখিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানেও স্থান দিয়েছেন এই অদ্ভুত শব্দটিকে। হাউটন সাহেব এর ইংরেজি অর্থ লিখেছেন: ‘অ্যান এনচ্যান্টেড স্লিপার দ্যাট ক্যারেড দ্য ওয়্যারার হোয়্যারএভার হি উইশড’। ১৮২০-র দশকেরই আর একটি অভিধানে শুধু যোগপাদুকাই নয়, ‘যোগপাদুকারোহণ’ বলেও একটি শব্দ পাই। এর থেকে এটুকু নিশ্চয়ই প্রমাণিত যে, উনিশ শতকের গোড়ায় বহুলপ্রচলিত বাংলা শব্দাবলির মধ্যে একটি ছিল ‘যোগপাদুকা’। এবং এমন একটি শব্দের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, এই ধরনের ঐন্দ্রজালিক জুতোর কল্পনা তৎকালীন বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এই প্রচলিত কল্পনা আরও দৃঢ় হয় ১৮৫৩ সালে, যখন ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’-র ছাপা স্কুলছাত্রদের জন্য বাংলা অভিধানে স্থান পায় যোগপাদুকা। অভিধান-প্রণেতা শব্দটির মানে বোঝাতে গিয়ে লেখেন, ‘বিশেষগুণাক্রান্ত পাদুকা’।
এখানে এটাও মনে রাখা উচিত যে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘যোগ’ শব্দের অর্থ আজকের ‘ইয়োগা স্টুডিয়ো’-র বিজ্ঞাপনের চাপে মেদ ঝরানোর প্রকল্প হয়ে ওঠেনি। ‘যোগ’ শব্দের সঙ্গে তখন তন্ত্রচর্চা ও মায়াবী সিদ্ধি লাভের একটি গাঢ় সম্পর্ক ছিল। যোগ তখন সাধনার ব্যাপার, আজকের মতো ‘জিম মেম্বারশিপ’ নয়। যোগবলে সাধক লাভ করেন নানা অতিমানবীয় সিদ্ধি। এবং এই সাধনা সাধারণত শাক্ত বা তান্ত্রিক সাধনারই অঙ্গ ছিল। তাই ঐন্দ্রজালিক জুতোর নাম যোগপাদুকা রাখার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে এই কল্পনার সঙ্গে যোগসাধনার সম্পর্কের ইঙ্গিত।
সেই ইঙ্গিত আরও প্রচ্ছন্ন ভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের লেখা বত্রিশ সিংহাসনের গল্পের বইতে। বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ সিংহাসন ও রাজা ভোজের কাহিনি আজকের নয়। তার উৎস রয়েছে বহু প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে। কিন্তু আঠারো শতকের শেষের দিকে সেই গল্প বাংলা দেশে যে রূপ নিয়েছিল, তার মধ্যে অনেক উপাদানই ছিল দেশজ। বিদ্যালঙ্কার মশাইয়ের বইয়ের একবিংশতি পুত্তলিকার গল্পে আমরা জানতে পারি যে, মহারাজা বিক্রমাদিত্যের এক জোড়া যোগপাদুকা ছিল এবং তিনি সেটি পরে দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তবে আখ্যানটির সবচেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ দিক হল, বিক্রমাদিত্যের যোগপাদুকারোহণে গন্তব্যস্থল। বিদ্যালঙ্কার মশায়ের গল্পে এই মায়াজুতো পায়ে দিয়ে বিক্রমাদিত্য যান কামাখ্যা এবং সেখানে দেবী স্বয়ং তাঁকে দেখা দেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, যোগপাদুকার উল্লেখ সরাসরি যুক্ত হয়েছে কালীপুজো বা শক্তিসাধনা এবং তন্ত্রচর্চার অন্যতম প্রধান পীঠস্থানের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে।
বিদ্যালঙ্কারের বইটি ছাপা হয় উনিশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে। ১৮১৬ সালে। তখন এ দেশে বাংলা ছাপার তেমন সুবিধা না থাকায় বইটি লন্ডন থেকে ছাপা হয়ে আসে এবং নবাগত ইংরেজ অফিসারদের বাংলা শিক্ষার জন্য তা ব্যবহৃত হত। বিদ্যালঙ্কার নিজে ছিলেন কেরি সাহেবের পার্শ্বচরদের মধ্যে অন্যতম। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিদ্যালঙ্কারের লিখিত ‘রাজাবলি’ গ্রন্থের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, বিদ্যালঙ্কার ছিলেন আঠারো শতকের বাংলার পণ্ডিতশ্রেণির ঐতিহাসিক স্মৃতির ধারক। তাঁর মতামত শুধু তাঁরই নয়, বরং তা ছিল তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি সমাজের বিচারবুদ্ধির প্রতিভূ। তাঁর লিখিত বত্রিশ সিংহাসনের গল্প এবং সেই গল্পে নিবদ্ধ দেশজ বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত মনোজগতেরই ঠিকানা পাই না, তখনকার শিক্ষিত বাঙালিদের ভাবনাচিন্তায় যোগপাদুকার স্থানও নির্ধারণ করতে সক্ষম হই।
কিন্তু যোগপাদুকা বাদেও তো রয়েছে আর একটি আরও চমৎকার বর। যে বরের দ্বারা গুপী-বাঘা সুরতালহীন সঙ্গীত-উৎসাহী থেকে পরিণত হন রীতিমতো মধুর গায়ক ও বাজনদারে। তাঁদের গান যে শুধু মানুষের শ্রুতিমধুর লাগত তা-ই নয়, শ্রোতারা গান চলাকালীন চলৎশক্তিরহিত হয়ে পড়তেন। এমন শক্তির কল্পনা এল কোথা থেকে?
আবারও এই অনুসন্ধিৎসা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই আঠারো শতকে, বাংলার কালীসাধনার ইতিহাসে। আঠারো শতকের বাংলা কালীসাধকদের মধ্যে যে নামটি নিঃসন্দেহে সর্বোপরি, তা হল সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের। সত্যজিৎ রায় নিজেই ‘দেবী’ ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলার কালীসাধনার ভাবমূর্তি খুঁজতে ফিরে গিয়েছিলেন রামপ্রসাদের কাছে। এমন কি ‘দেবী’-তে যখন তিনি স্বয়ং একটি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেটি করেছিলেন রামপ্রসাদী ধারা মেনেই। রামপ্রসাদ সেনের জীবিত অবস্থায় তাঁর কোনও প্রামাণ্য জীবনী লেখা হয়নি, তবে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে বিখ্যাত সাংবাদিক, কবি এবং ঐতিহাসিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বিভিন্ন দলিল এবং রামপ্রসাদী গানের পুঁথির উপর নির্ভর করে রামপ্রসাদের জীবনী লিখতে সচেষ্ট হন। সেই প্রচেষ্টার ফলেই রামপ্রসাদ সম্বন্ধীয় বেশ কিছু লোকশ্রুতিও সংগৃহীত হয়। এর মধ্যে দু’টি আমাদের আজকের আলোচনার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
দু’টির উল্লেখই আমরা পাই গুপ্তকবি সম্পাদিত বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ, ১৩ জানুয়ারি ১৮৫৪ তারিখে মুদ্রিত একটি পত্রের মাধ্যমে। পত্রপ্রেরক নিজের নাম না জানালেও জানিয়েছেন যে, তিনি রামপ্রসাদেরই গ্রামের লোক এবং তাঁর পত্রের আধার হল স্বগ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচলিত জনশ্রুতি।
সেই জনশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি জানিয়েছেন যে, রামপ্রসাদের “মিষ্টস্বর ছিল না তথাচ যখন তিনি গান করিতেন শ্রোতৃগণের শ্রবণে সেই স্বর মধুর স্বর বোধ হইত।” ঈশ্বর গুপ্ত নিজে একই ধরনের, তবে স্বতন্ত্র আর একটি জনশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন যে “কাকের ন্যায় অতি নীরস কর্কশ-কণ্ঠ কোনো মানুষ (যাহার তাল, রাগ, সুর কিছুই বোধ নাই) তাহার কণ্ঠ হইতে রামপ্রসাদী পদ নির্গত হইলে বোধ হইবে যেন কোথা হইতে অকস্মাৎ অমৃত বৃষ্টি হইতেছে।”
তবে এখানেই শেষ নয়। অনামা পত্রপ্রেরকের চিঠি থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, লোকশ্রুতি অনুযায়ী রামপ্রসাদ “যতক্ষণ গান করিতেন ততক্ষণ তাঁহারা [মায় শ্রোতারা] চিত্র পুত্তলিকার ন্যায় স্তব্ধ থাকিতেন, ঐশ্বরিক অনুকম্পা ছাড়া আর এবিষয়ে কি অনুমান করা যাইতে পারে।”
অবশেষে এমনও একটি লোকশ্রুতির কথাও আমরা জানতে পারি যে, এক বার নাকি স্বয়ং নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে শ্যামাসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন রামপ্রসাদ এবং তা শুনতে শুনতে নবাব নাকি চিত্রবৎ বসে থাকলেও তাঁর চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রুবর্ষণ হয়ে চলেছিল। এখানে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় এই যে, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক থেকে মোটামুটি উনিশ শতকের মধ্যভাগ অবধি সিরাজউদ্দৌলাকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী শাসক রূপে দেখতেন। উনিশ শতকের শেষে, জাতীয়তাবাদী আবেগের ছোঁয়ায় সেই মনোভাব বদলে যায়। সিরাজউদ্দৌলা সত্যি অত্যাচারী ছিলেন কি না, সেই আলোচনার স্থান এটা নয়। এই বিষয় উত্থাপন করার একমাত্র কারণ, যাতে পাঠক তৎকালীন জনশ্রুতির ইঙ্গিতগুলো ঠিকঠাক ধরতে পারেন। তাই তো সেই বেনামা পত্রলেখক পাঠকদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন যে, ‘বিবেচনা করুন যে রামপ্রসাদ কি রূপ মানুষ ছিলেন’ যে সিরাজের মতো ‘দুর্দান্ত ও পাষণ্ড’ নবাবের কাছেও দৈবশক্তির জোরে স্বীকৃতি আদায় করে নেন।
এ? ই পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ-সম্বন্ধীয় লোকশ্রুতিটি শুনলেই আমাদের মতো একুশ শতকের বাঙালির মানসচক্ষে হাল্লার রাজার চেহারাটি ভেসে উঠতে বাধ্য। আপাতদৃষ্টিতে অত্যাচারী রাজা গান শুনে এক দিকে যেমন চলৎশক্তিরহিত হয়েছেন, অন্য দিকে তাঁর চোখ থেকে অবিরাম অশ্রুবৃষ্টি হচ্ছে।
সঙ্গীতের মাধুর্য এবং শ্রোতাদের উপর তার ঐন্দ্রজালিক প্রভাবের যে বরটি ভূতের রাজা গুপী-বাঘাকে দেন, সেটির মধ্যে তাই ভেসে উঠতে দেখি আমরা রামপ্রসাদী কালীভক্তির ইতিহাস।
উপেন্দ্রকিশোর যত দিনে গুপী-বাঘার গল্প লেখেন, তত দিনে গুপ্তকবি প্রয়াত হলেও তাঁর সাহিত্যকীর্তি বঙ্কিমীযুগে এমনই জাজ্জ্বল্যমান ছিল যে, উপেন্দ্রকিশোরের অবশ্যই সে বিষয় জ্ঞাত ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। ফলে গুপ্তকবি রচিত রামপ্রসাদের জীবনচরিতের মাধ্যমেই তিনি কালীসাধনার ইতিহাস সম্বন্ধে এ সব লোককথার সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকতে পারেন।
আবার এও সম্ভব যে উপেন্দ্রকিশোর স্বতন্ত্র ভাবেই এ সব গল্প শুনেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোরের পিতামহ, লোকনাথ রায়, ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক। এমনকি তাঁর পিতা রামকান্ত রায়, পুত্রের তন্ত্রসাধনা বন্ধ করার জন্য তাঁর সাধনার উপকরণ— ডামরগ্রন্থ, নরকপাল এবং মহাশঙ্খের মালা— ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার পর, ক্ষোভে লোকনাথ প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করেন। এ সব গল্প পারিবারিক পরম্পরায় সত্যজিতের সময় অবধি চলে এসেছে। অতএব হতেই পারে যে কালীসাধনার অন্যতম পরাকাষ্ঠা রামপ্রসাদ সেন সংক্রান্ত কিছু গল্পও রায় পরিবারের ভিতরেই চালু ছিল।
যে ভাবেই এই গল্প উপেন্দ্রকিশোরের কানে পৌঁছে থাক, এ সব গল্পের অবয়ব ও গুপী-বাঘার মূল ছকের মধ্যে এত মিল যে, এগুলো উপেক্ষা করা দুষ্কর। তা ছাড়া উপেন্দ্রকিশোর শুনে থাকুন বা না থাকুন, সত্যজিৎ যে হেতু রামপ্রসাদ নিয়ে বিস্তর লেখাপড়া করেছিলেন এবং গুপ্তকবি রচিত রামপ্রসাদের জীবনী যে হেতু প্রায় আকর গ্রন্থ বলা যায়, তিনি অবশ্যই এ সব গল্পের কথা জানতেন। এক দিক না এক দিক দিয়ে তাই রামপ্রসাদের পরোক্ষ ছায়া গুপী-বাঘার উপর অবশ্যই পড়ে ছিল।
সাধারণত আমরা উপেন্দ্রকিশোর বা সত্যজিৎকে বাঙালি আধুনিকতার ইতিহাসের মধ্যেই দেখি। তাদের তন্ত্রসাধনা বা তার ঐন্দ্রজালিক দিকগুলোর সঙ্গে যোগসূত্রের কথা গ্রাহ্য করি না। প্রাচীন পারিবারিক সম্পর্কের কথা উঠলেও তাকে নিছক অসার তথ্য জ্ঞানে হেয় করে থাকি। অথচ সত্যজিৎ নিজেই কিন্তু এক বার একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর অলৌকিক বিষয়ে কৌতূহলের কথা বলতে গিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন লোকনাথ রায়ের কথা। বলেছেন তাঁর রক্তে তন্ত্রচর্চা আছে। প্রফেসর শঙ্কুর একটি গল্পে প্রায় একই ভাবে তিনি শঙ্কুর এক তান্ত্রিক পূর্বপুরুষের ভূতের অবতারণা করে তন্ত্রের অতিমানবীয় সিদ্ধির সন্ধান এবং আধুনিক বিজ্ঞানের নিত্যনতুন সব আবিষ্কারের খোঁজের মধ্যে একটা আপাত সাযুজ্য লক্ষ করেন। ‘প্রফেসর শঙ্কু ও ভূত’ নামক গল্পটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ অলৌকিকের আলোচনা করতে গিয়ে ওই গল্পে শঙ্কুর মুখে সত্যজিৎ যে সংলাপ আরোপ করেন, পরবর্তী কালে বিলেতে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে নিজের মনোভাবের কথা জানাতে গিয়ে প্রায় হবহু একই কথা বলেন। ফলে কাহিনিটিতে তান্ত্রিক পূর্বপুরুষের সঙ্গে উত্তরসূরির যে নিকট বৌদ্ধিক সম্পর্কের ছবি তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে হয়তো সত্যজিতের নিজের ব্যক্তিগত অবস্থানের হদিসও তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন।
ত-বে সত্যজিৎ, উপেন্দ্রকিশোর বা রায় পরিবারের পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ইতিহাসের ঊর্ধ্বে উঠে গুপী-বাঘার গল্পে তন্ত্রচর্চার ইতিহাসের প্রভাবটি চিহ্নিত করার মধ্যে আরও কয়েকটি সার্বিক বা সার্বজনীন মাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাঙালি আধুনিকতার সাধারণ চরিত্রায়ণ। বাঙালি আধুনিকতাকে আমরা প্রায়শই দেখি উনিশ শতকের ব্রাহ্মধর্মের উত্থান বা যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতার বিবর্তনের ঘেরাটোপের মধ্যে। এই ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকের কালীসাধনার তেমন কোনও জায়গা নেই। বরং ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে এই আধুনিকতার ইতিহাস হয়ে ওঠে রামকৃষ্ণদেব বা স্বামী বিবেকানন্দের শাক্ত সাধনাকে সমাজমুখী করে তোলার আখ্যান। সেখানে তন্ত্রসাধনার পুরনো মায়াসাধনার দিকগুলো বর্জিত হয়। ধীরে ধীরে উঠে আসে এক আধুনিক, প্রগতিশীল এবং সমাজসেবী ধার্মিক কাঠামো। সাধনা হয়ে ওঠে সমাজসেবা কিংবা ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা। অলৌকিক বা অতিমানবীয় সিদ্ধি লাভের উদ্যম হয়ে দাঁড়ায় প্রান্তিক ব্যাপার— হয় তা নিছক বুজরুকি, নচেৎ আধ্যাত্মিক অর্বাচীনতার দ্যোতক। তাই স্বামী বিবেকানন্দের মতো আধুনিক সাধকরা দৈবঘটনা, যেমন সঙ্গীতের দ্বারা চলৎশক্তি হৃত হওয়া বা যোগপাদুকারোহণ দ্বারা আর তাঁদের ঐশী শক্তি প্রদর্শন করেন না। এ ধরনের প্রদর্শনকে তখন হাস্যকর বা হীন নিম্নস্তরের সিদ্ধাই বলে দেখা হয়।
এই পরিবর্তন কখনও পুরোপুরি সার্বিক নয়। বাংলা সংস্কৃতির আনাচে কানাচে তাই কালীসাধনার ঐন্দ্রজালিক দিকগুলি আজও কিছুটা টিকে রয়েছে। তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর লেখা বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প আজও পাঠকের মনোরঞ্জন করছে। তবে মধ্যবিত্ত সমাজে কালীসাধনার মূল ছবিটি যে আজ পরিবর্তিত, তা অনস্বীকার্য। এও অবিতর্কিত যে, অলৌকিক সিদ্ধি লাভের জন্য করা সাধনাকে ঠিক বাঙালি আধুনিকতার আঙ্গিক হিসেবে দেখা আজ সুকঠিন।
গুপী-বাঘার গল্পে অষ্টাদশ শতকীয় কালীসাধনার সন্ধান খুঁজে পাওয়া আমাদের এই আধুনিকতার পরিচয়ে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হই যে বৌদ্ধিক আধুনিকতা যতই প্রাগাধুনিক, অলৌকিক ধার্মিকতার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিক না কেন, নব্য আধুনিকতার কুশীলবদের মানসজগৎ আচ্ছন্ন থাকে পুরনো গল্পে, দৃশ্যে। বিশ্বাস হয়তো বদলে যায়, কিন্তু ছোটবেলায় শোনা গল্পগুলো অত সহজে ঝেড়ে ফেলা যায় না। পৌরাণিক জনশ্রুতির জায়গায় হয়তো আসে আধুনিক ফ্যান্টাসি। কিন্তু চরিত্রগুলির কল্পনা, তাঁদের মনুষ্যত্ব বা তাঁদের অতিমানবীয় শক্তির কল্পনা, এ সবই থেকে যায় অপরিবর্তিত। এক বা দুই প্রজন্মে ট??? পকে সেই চরিত্রগুলিই আবার নতুন বিশ্বাসের গোড়ায় সংশয়ের বীজ বপন করে বসে। লোকনাথের বিশ্বাস প্রথমে উপেন্দ্রকিশোরের ফ্যান্টাসি গল্প হিসেবে পুনঃস্থাপিত হয় এবং তারও পরে হয়ে দাঁড়ায় সত্যজিতের পারলৌকিক কৌতূহলের ভিত্তি। একই কাহিনি বার বার উপস্থাপিত হয় নব রূপে, নব কলেবরে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বার বার গতি বদলায়, কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন হয় না।
বাঙালির নিজস্ব কালীসাধনার ঐতিহাসিক ধারাটি আজ যখন অবাঙালির ‘দিওয়ালি’ আর ‘ধনতেরস’-এর আড়ম্বরে বিলীন হতে বসেছে, তখন এই ইতিহাসের প্রতি আমাদের ঋণস্বীকার করা বিশেষ জরুরি। তাই তো আজ ভূতের রাজার আশ্বাস সেই আশ্বাসবাণী, ‘আমি আছি, আমি আছি’ এক মাত্র ভরসা। ইতিহাস যখন বর্তমানের চাপে ক্ষয়িষ্ণু, তখন ভবিষ্যৎ তো এক ভূতের অস্তিত্বের উপরেই আস্থা জ্ঞাপন করতে পারে।
(মূল ছবি: সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির একটি দৃশ্য।ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়)