Raja Ram Mohan Roy

রাজা রামমোহন রায়ের মরণোত্তর মুখাবয়ব

চলতি ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডেথ মাস্ক’। এটির ঢালাই মূর্তি আজও সংরক্ষিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এবং রাজা রামমোহন রায় মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ামে। রামমোহনের মৃত্যুর ৭৫ বছর পর দেশে এসেছিল সেই আকৃতিটি। আসল ছাঁচটি স্কটল্যান্ডের এক মিউজ়িয়ামে। এটিই তাঁর অন্তিম স্মৃতি।

Advertisement

পৃথা কুণ্ডু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:০০
Share:

মুখাকৃতি: কলকাতার সংরক্ষিত রাজা রামমোহনের ‘ডেথ মাস্ক’।

কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ভবনে যাঁরা যান, তাঁরা হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, শতবার্ষিকী সংগ্রহশালায় একটি বেদির উপর রাখা আছে এক বিরলকেশ ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তি। চোখ বন্ধ, মুখে দীপ্তি নেই। কাছে গিয়ে পরিচিতি পড়ার চেষ্টা করলে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। ইনি রাজা রামমোহন রায়? আমাদের চিরপরিচিত সেই মহীয়ান রাজকীয় ব্যক্তিত্বের চিহ্নমাত্রও যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল এই প্রতিকৃতিতে! আসলে এটি রাজা রামমোহনের ‘ডেথ মাস্ক’ বা মরণোত্তর মুখোশ থেকে ঢালাই করা মূর্তি।

Advertisement

রাজা রামমোহনের যে ক’টি প্রতিকৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় আঁকা হয় দু’টি, তেলরঙে। আর একটি সাদা কালো লিথোগ্রাফও পাওয়া যায়। বইপত্রে সাধারণত এই প্রতিকৃতিগুলিই ছাপা হয়, বা এগুলি দেখেই পরবর্তী কালের শিল্পীরা ছবি এঁকে দেন। একটি পূর্ণাবয়ব তৈলচিত্র ইংরেজ শিল্পী হেনরি পেরোনেট ব্রিগস-এর আঁকা, সম্ভবত ১৮৩১-৩২ সালে। এটি রাখা আছে ব্রিস্টল মিউজ়িয়ামে। রাজা রামমোহন এখানে সামনাসামনি তাকিয়ে আছেন, পরনে প্রাচ্যদেশীয় রাজপুরুষের পোশাক, পিছনে ভারতীয় দৃশ্যপট— মন্দির ও গম্বুজ, হাতে একটি বই। ভারতীয় শিল্পী অতুল বসুর আঁকা প্রতিকৃতিটি ব্রিগস-এর ছবি থেকে অনুপ্রাণিত বলেই মনে হয়, তবে পশ্চাৎপটের দৃশ্য তিনি পরিবর্তন করেছেন। অতুল বসুর আঁকা আর একটি প্রতিকৃতি আছে দিল্লির সংসদ ভবনে। আর একটি তেলরঙের আবক্ষ প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন আমেরিকান শিল্পী রেমব্রান্ড পিল, রামমোহনের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। এখানে রামমোহনের স্বাস্থ্যের অবনতি চোখে পড়ে, তবে তাতেও তাঁর মহিমাব্যঞ্জক চেহারা চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। অন্য সাদা-কালো ছবিটি প্রোফাইল-এ আঁকা, অর্থাৎ তাঁর মুখের এক পাশ দেখা যাচ্ছে। শিল্পীর নাম নিশ্চিত করে জানা যায় না। কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে আছে সাদা মার্বেল পাথরের একটি আবক্ষ মূর্তি, যা সম্ভবত জর্জ ক্লার্ক-এর হাতে গড়া একটি মূর্তির প্রতিলিপি। ১৯৩৬ সালে এটি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজকে দান করেন ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর— তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা হেমেন্দ্রনাথের পুত্র। মূল মূর্তিটি ১৮৩৪ সালে লন্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শিত হয়েছিল, কিন্তু সেটির সন্ধান এখন আর পাওয়া যায় না। সম্প্রতি জানা গেছে হাতির দাঁতের তৈরি আর একটি মূর্তির কথা, শিল্পী বেঞ্জামিন চেভারটন। তিনিও সম্ভবত ক্লার্কের গড়া মূর্তি থেকেই এই প্রতিলিপিটি তৈরি করেন। ২০১২ সালে এই মূর্তিগুলির ইতিহাস নিয়ে ডেভিড উইলসনের লেখা একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, ‘আ পোর্ট্রেট অব রাজা রামমোহন রায়: আ মাস্টারপিস ইন আইভরি’। কিন্তু সরাসরি রাজা রামমোহনের মুখের ছাঁচ থেকে নির্মিত মূর্তি যে রয়েছে আমাদের কাছাকাছিই, সে খবর অনেকেই রাখি না।

প্রাচীনকাল থেকে মিশর, গ্রিস, রোম-সহ বিভিন্ন দেশের সভ্যতায় পিতৃপুরুষদের মৃত্যুর পর তাঁদের মুখের ছাঁচ তুলে রাখার প্রথা ছিল। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকত ধর্মীয় বিশ্বাস ও নানা অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গও। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতায় এ সব অপরিহার্য না হলেও, স্মৃতিরক্ষার কারণে বিশিষ্ট মানুষদের ‘ডেথ মাস্ক’ তুলে রাখার প্রথা চালু ছিল আঠারো-উনিশ শতকেও। সম্রাট নেপোলিয়ন বা কবি কিটসের ‘ডেথ মাস্ক’ এমনই এক-একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ। রামমোহন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন ভারতের রাজদূত হয়ে, সেখানে পণ্ডিত ও সুবক্তা হিসেবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাই ব্রিস্টলে তাঁর প্রয়াণের পর গুণগ্রাহী ইংরেজ বন্ধুরা তাঁর ‘ডেথ মাস্ক’ তুলে রাখার কথা ভেবেছিলেন, বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। এই ডেথ মাস্ক কবে, কী ভাবে তোলা হয়েছিল সেই বিবরণ পাওয়া যায় ভারত-দরদি শিক্ষাবিদ ও লেখিকা মেরি কার্পেন্টার সম্পাদিত ‘দ্য লাস্ট ডেজ় ইন ইংল্যান্ড অব দ্য রাজা রামমোহন রায়’ গ্রন্থে, যা যৌথ ভাবে প্রকাশ করে লন্ডনের ট্রুবনার অ্যান্ড কোং এবং কলকাতার আর সি লিপেজ, ১৮৬৬ সালে।

Advertisement

রামমোহনের শেষ দিনগুলিতে তাঁর চিকিৎসক ছিলেন ডাক্তার এস্টলিন। রামমোহন প্রয়াত হন ১৮৩৩-এর ২৭ সেপ্টেম্বর রাত দুটো পঁচিশ নাগাদ। পরের দিন অর্থাৎ ২৮ সেপ্টেম্বর ডাক্তার এস্টলিন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “মর্মরশিল্পী পাগ (Pugh) এক ইতালিয়ান [সহকারী]কে সঙ্গে নিয়ে এসে রাজার মাথা ও মুখের ছাঁচ তুলে নিল।” এর পাদটীকায় মেরি কারপেন্টার জানাচ্ছেন, “এই ছাঁচটি মিস এস্টলিন (অর্থাৎ ওই চিকিৎসকের মেয়ে)-এর কাছে সংরক্ষিত আছে।” এই ছাঁচ অনুসারে রাজার মাথার গড়ন বিশ্লেষণ করে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এক ‘স্টাডি’ও করেছিলেন ডাক্তার এস্টলিন। উৎসাহী, বাগ্মী, জ্ঞানী, আত্মপ্রত্যয়ী— এই ধরনের কথাই লেখা আছে সেই ব্যাখ্যায়, যা রাজা রামমোহনের চরিত্রের সঙ্গে অবশ্যই মিলে যায়। এই ভাবে মাথা ও মুখের গড়ন দেখে ব্যক্তিত্বের চর্চা অর্থাৎ ‘ফ্রেনোলজি’ সে-কালে ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

রামমোহনের মরদেহ সমাহিত করা হয় ব্রিস্টলেই। এর পর তাঁর পালিত পুত্র রাজারাম ও অন্য সফরসঙ্গীরা— রামরত্ন মুখোপাধ্যায়, রামহরিদাস প্রমুখ দেশে ফিরে এলেও তাঁরা সেই ‘ডেথ মাস্ক’ বা রাজার ব্যবহৃত সামগ্রী রেখেই এসেছিলেন। যে ভাস্কর রামমোহনের মুখের ছাঁচ তুলেছিলেন, তিনিই সেই ছাঁচ ঢালাই করে আবক্ষ মূর্তিটি তৈরি করেন। মিস এস্টলিনের কাছেই তা রাখা ছিল। ১৮৮৮ সালে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী ইংল্যান্ডে যান। রাজা রামমোহনের প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর উদ্যোগে এক স্মৃতিসভার আয়োজন করা হয় রামমোহনের সমাধিস্থলে। এই স্মৃতিসভায় যোগ দিয়েছিলেন বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট ইংরেজ, যাঁরা বা যাঁদের পিতা বা পিতৃব্য কেউ না কেউ রামমোহনের ইংল্যান্ড-প্রবাসকালে তাঁকে চিনতেন, শ্রদ্ধা করতেন। এই সংবাদ তাঁদেরই মাধ্যমে কোনও ভাবে পৌঁছয় ডাক্তার এস্টলিন-এর কন্যার কাছে। তখন তিনি বয়সের ভারে জর্জরিত। তিনিই আগ্রহী হয়ে যোগাযোগ করেন শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে। শাস্ত্রী মশাই ‘আত্মচরিত’-এ লিখেছেন, “দীর্ঘকাল ধরে এই মহিলা পিতার নিকট প্রাপ্ত মৃন্নির্মিত রাজার মস্তক ও তাঁহার মাথার শালের পাগড়ী প্রভৃতি স্মৃতিচিহ্নগুলি সযত্নে রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন। বার্ধক্যে কবে চলিয়া যান, ইহা ভাবিয়া সেগুলি আমার হস্তে অর্পণ করিবার জন্য আমাকে ডাকিলেন ও সেগুলি আমার হাতে অর্পণ করিলেন। আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ করিয়া সেগুলি গ্রহণ করিলাম এবং দেশে লইয়া আসিলাম। দুঃখের বিষয় আমি নানা স্থানে বাসা নাড়িয়া বেড়াইবার সময় অপরাপর ছোট ছোট স্মৃতিচিহ্নগুলি হারাইয়া ফেলিলাম। অবশেষে তাহার মৃন্নির্মিত মূর্তিটি ও শালের পাগড়ী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের হস্তে দিয়াছি, তাহারা রক্ষা করিতেছেন।” ১৯০৯ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর হাত ধরে এ ভাবেই দেশে ফিরেছিল রামমোহনের অন্তিম স্মৃতি, যদিও মূল মাস্ক-এর ছাঁচটি রয়ে গেছে স্কটল্যান্ডের এক মিউজ়িয়ামেই।

ঐতিহাসিক এই ডেথ মাস্ক-এর আর একটি প্রতিলিপি আছে রাজা রামমোহন রায় মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ামে, যা আগে ‘সিমলা হাউস’ নামে পরিচিত ছিল। ঠিকানা ৮৫ এ, রাজা রামমোহন রায় সরণি, কলকাতা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রাখা ডেথ মাস্ক-এর আদলে এই মূর্তি ঢালাই করেন ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধান। এ ছাড়াও এখানে সংরক্ষিত রামমোহনের চুল, উপবীত এবং দুর্লভ চিঠির সংগ্রহও। উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতে নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ যিনি, তাঁর স্মৃতিরক্ষায় এখনও নিরলস এই প্রতিষ্ঠান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement