Bengali Feature

দেশ বদলে যায়, মেশিন থামে না সেলাইদিদির

তাঁর নাম মনোয়ারা। তাঁর বড় হয়ে ওঠার পুরোটাই সীমান্ত, ছিটমহল আর কাঁটাতারের গল্প। সে সবের বিরুদ্ধেই তাঁকে লড়তে হয়েছে বরাবর। মেয়েদের সেলাই শেখান তিনি। স্বপ্ন দেখেন, একটি সেলাই স্কুল গড়ার। ছাত্রীরা আসবে সেই স্কুলে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে আর কষ্ট হবে না তাদের।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৫২
Share:

স্বনির্ভর: সেলাই-মেশিনকেই জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার করে এগিয়ে চলেছেন মনোয়ারা। ছবি: লেখক।

হাত-পা যেন সমানে চলছে মনোয়ারার। তার মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে চোখ। বলে উঠছেন, “কী রে অসীমা, এই তো শেখালাম! ভুলে যাচ্ছিস কেন?” তার পর কাছে ডেকে নিচ্ছেন তাকে। ফের হাতে ধরে শিখিয়ে দিচ্ছেন, কী ভাবে করতে হবে টানা আর পড়েনের কাজ।

Advertisement

বয়স বছর তিরিশ। পরনে সালোয়ার-কামিজ। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই রয়েছে। গরমে ঘেমে যাচ্ছে মুখ। মাঝে মাঝে পাশে রাখা কাপড় তুলে মুছে নিচ্ছেন ক্লান্তি। সঙ্গে কি একটু একটু করে মুছে ফেলতে চাইছেন পুরনো কষ্টও? মুখ তুলে তাকালেন মনোয়ারা। হাসি ফিরে এসেছে ঠোঁটের কোণে।

গ্রামের মানুষজন অবশ্য জানেন সে সব কষ্টের কথা। তাঁদের মুখে মুখে মনোয়ারা ‘সেলাই দিদিমণি’। তাঁর কথা উঠলেই বলতে শুরু করেন লোকজন, “আমরা খেটে-খাওয়া মানুষ। এক সময় কোনও অধিকারই ছিল না আমাদের। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারত না। তার মধ্যেই কয়েক জন লড়াই করে পড়াশোনা করেছে। তাদেরই এক জন মনোয়ারা। সে আদর্শ শিক্ষিকা।”

Advertisement

সে সব শুনে থমকে বসে থাকেন মনোয়ারা। একটু থেমে বলেন, “চেয়েছি অনেক কিছুই। পাইনি। এই লড়াইটা জারি রেখেছি। আগামী দিনে একটি সেলাইয়ের স্কুল গড়ে তোলার ইচ্ছে আছে আমার।”

কোচবিহারের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম বামনহাট। সেখান থেকে হাত কয়েক দূরে পোয়াতের কুঠি, সাবেক ছিটমহল। সেই ছিটমহলেই থাকেন মনোয়ারা। তাঁদের বাড়ি থেকে খানিক দূরেই কাঁটাতারের বেড়া। সীমান্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা। সে সবের ফাঁক গলে আকাশপথে হল্লা করতে করতে এক দেশ থেকে আর এক দেশে উড়ে যায় পাখিদের দল। আধভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে সে দৃশ্য কত বার যে চোখে পড়েছে মনোয়ারার। আর ভেবেছেন, ‘পাখির মতো মানুষেরও যদি দু’টি পাখা থাকত!’

মনোয়ারা জানেন, কাঁটাতার কতটা যন্ত্রণা দিতে পারে। তাঁর বড় হয়ে ওঠার পুরোটাই সীমান্ত, ছিটমহল আর কাঁটাতারের গল্প। সে সবের বিরুদ্ধেই তাঁকে লড়তে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এক সময় পোয়াতের কুঠি ছিল ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে ঘেরা বাংলাদেশি ছিটমহল। অর্থাৎ, বাংলাদেশের এক খণ্ড ভূমি। কিন্তু ওই অংশের লোকেরা কোনও ভাবেই বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে যেতে পারতেন না। সেখানে যাওয়ার কোনও রাস্তা ছিল না। চার দিকে ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে ঘেরা। ছিটমহল থেকে বেরিয়ে ভারতের ওই ভূখণ্ডে পা রাখলেই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা ছিল তাঁদের। বেশ কয়েক জন গ্রেফতারও হয়েছিল।

তবে সবটাই বাঁধাবাঁধি নয়। ওই বাসিন্দাদের জীবন যাপনের কথা ভেবে ভারতীয় পুলিশ-প্রশাসন কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের ছাড় দিত। চাল, ডাল, আনাজপাতি কিনতে ওঁরা পুরোপুরি ভারতীয় বাজারের উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কত মানুষের বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেতে পেতে মৃত্যু হয়েছে। ছিল না রাস্তাঘাট। আলপথ ধরে যাতায়াত করতে হত মনোয়ারাদের। ছিল না পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা। সন্ধে নামলেই গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে থাকত। সঙ্গে ছিল চোর-ডাকাতের ভয়। চুরি-ডাকাতি বা কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটলেও, সেখানে পুলিশ পৌঁছত না। ছিল না আইনের শাসন। বাঁচার তাগিদে স্থানীয় মানুষ নিজেরাই আইনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই ছোট্ট ভূখণ্ডে তা দিয়ে আর কতটুকু এগোনো যায়!

মনোয়ারাই শোনাচ্ছিলেন তাঁর গল্প, তাঁদের গল্প। তিনি তখন খুব ছোট। তাঁর বাবা আজ়গর আলি সেলাইয়ের কাজ করতেন। একে-ওকে ধরে বামনহাট বাজারে একটি ছোট্ট দোকান দিয়েছিলেন। সে দোকানের উপরে নির্ভর করেই চলত সংসার। তাঁরা ছয় ভাই-বোন। প্রত্যেককেই স্কুলে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু সে-ও এক লড়াই। বাংলাদেশি সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায়, ওই সময়ে ভারতীয় স্কুলে পড়াশোনার অধিকার ছিল না ওঁদের। আর বাংলাদেশের কোনও স্কুলে যাওয়া তো কার্যত অসম্ভবই। এই অবস্থায়, অধিকাংশ বাসিন্দা নিজের সন্তানের অভিভাবকের নাম পাল্টে দিয়ে স্কুলে ভর্তি করাতেন। আদতে ভারতীয় পরিচয়েই পড়ত সেই ছেলেমেয়েরা। এলাকার ভারতীয় বাসিন্দারাও তা নিয়ে কোনও আপত্তি করতেন না। আসলে একই জায়গায় পাশাপাশি থাকার ফলে একে অন্যের দুঃখ-সুখের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন। আইনি অধিকারে ছিটমহলের মানুষ পিছিয়ে থাকলেও, বন্ধুত্বের অধিকারে ভারতীয়দের আপন হয়ে উঠেছিলেন ওঁরা।

আজ়গর অন্যের পরিচয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় রাজি ছিলেন না। তাই এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, মনোয়ারাদের পড়াশোনা হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। অবশেষে, তাঁর মত বদলায়। খাতায়-কলমে বামনহাটের দোকানকেই বাড়ির ঠিকানা দেখিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করান আজ়গর। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে লেখাপড়ায় মনোয়ারা ছিলেন এগিয়ে। পড়াশোনার প্রবল খিদে ছিল তাঁর। প্রাথমিক পাশ করে হাই স্কুলে ভর্তি হন মনোয়ারা। সে সময় তাঁর বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কাজ কমে আসে। এক সময় আজ়গরের দোকান রেললাইন তৈরির জন্য ভাঙা পড়ে। নতুন করে আর দোকান করতে পারেনি। তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ভাইয়েরাও বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতেন। বাবা-মাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে যান মনোয়ারা।

তবু হাল ছাড়েননি। উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে পড়তে হাতের কাজ শেখা শুরু করেন। ২০১২ সালে সেলাইয়ের কাজও শেখেন। বাবার কাছে হাতেখড়ি আগেই হয়েছিল। তাই সেলাইয়ের কাজে পারদর্শী হতে সময় লাগেনি। প্রশিক্ষণ শেষ করেই তিনি প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে ভর্তি হয়ে যান। স্থানীয় একটি বড় দোকানে ওই ক্লাস করতেন তিনি। দোকানের মালিক ওই কাজের জন্য সামান্য পারিশ্রমিকও দিতে শুরু করেন মনোয়ারাকে। যা তখন তাঁর কাছে সব অর্থেই আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। সেলাইয়ের কাজ করতে করতেই দিনহাটা কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি।

তাঁদের কৃষিজমি ছিল না। তাই তাঁর বাবার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এমনও দিন গিয়েছে, এক বেলা করে না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। এরই মধ্যে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে তৈরি হওয়া একটি সেলাইয়ে স্কুলে প্রশিক্ষকের কাজ পান মনোয়ারা। নতুনদের শেখানোই তাঁর কাজ। সেই থেকেই তিনি ‘সেলাই দিদিমণি’। প্রায় ন’মাস ওই স্কুলে কাজ শেখান তিনি। পরে তা কোনও কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তখন আর একটি জায়গায় পাট দিয়ে নানা জিনিস তৈরির কাজে যোগ দেন তিনি। পাট দিয়ে সেখানে পাপোশ, ব্যাগ তৈরি হত। সে কাজও খুব দ্রুত রপ্ত করে নিয়েছিলেন। সেটাও পরে এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

তবে মনোয়ারা থেমে থাকেননি। এর মধ্যে ছিটমহল হস্তান্তর হয়ে গিয়েছে। মনোয়ারা পাকাপাকি ভাবে ভারতের বাসিন্দা। কিছুটা থিতু হয়েছেন। বাড়িতেই সেলাই মেশিন কিনে কাজ শুরু করেন। গ্রাম থেকে সপ্তাহে-দু’সপ্তাহে এক বার করে দিনহাটা-আলিপুরদুয়ারের মতো শহরে গিয়ে কাপড় কিনে আনেন তিনি। তা দিয়ে নানা ধরনের জামাকাপড় তৈরি করে তা বাজারে বিক্রির কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে, তেমন চাহিদা না থাকলেও, ধীরে ধীরে তাঁর পসার জমতে শুরু করে। তাতে কিছু লাভ হতে থাকে। তা দিয়ে সংসার গুছিয়ে নিতে শুরু করেন। তবে ছাড়েননি কাজ শেখানো। নিজের কাজের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার মেয়েদেরও কাজ শেখাতে শুরু করেন তিনি। যাঁরা ওই কাজে আগ্রহী, যোগাযোগ করেন মনোয়ারার সঙ্গে। মনোয়ারা শুরু করেন তাঁদের কাজ শেখানো। প্রশিক্ষণ শেষে অনেকেই নিজেরা আলাদা কাজ শুরু করেছেন।

বাবা-মাকে নিয়ে এখন মনোয়ারার সংসার। বয়সের ভারে এখন দু’জনেই ন্যুব্জ। সকাল থেকে তাঁদের দেখাশোনার পাশাপাশি, সেলাইয়ের কাজও করে চলেন মনোয়ারা। ফাঁক পেলে চোখ যায় আকাশে। সীমান্ত পেরিয়ে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে মনোয়ারা ভাবেন, এখন আর পরাধীন নন।

২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পরে ওই ভূখণ্ড ভারতের অংশ হয়েছে। সেখানকার মানুষেরা এখন ভারতের নাগরিক। এই কয়েক বছরে এলাকায় উন্নয়নের কাজও হয়েছে। রাস্তা হয়েছে, পানীয় জল পৌঁছেছে গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে-বাড়িতে এখন বিদ্যুৎ। গ্রামের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে, এখনও আর হাসপাতালে পৌঁছতে সমস্যা নেই। এখন প্রত্যেকেই রেশন পান। গ্রামে কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটলে ছুটে যায় পুলিশ। এখন ওঁদের জন্য আইন-আদালত আছে।

সে সব নিয়ে খুশি মনোয়ারা। শুধু তাঁর মনে হয়, এ বার যদি একটু পড়াশোনা আর কাজকর্মের দিকে বাড়তি নজর দিত সরকার, তা হলে পাল্টে যেত আরও অনেক কিছু। মনোয়ারা স্বপ্ন দেখেন, এক দিন একটি সেলাই স্কুল গড়ে তুলবেন তিনি। যেখানে পর পর সাজানো থাকবে সেলাই মেশিন। জল-কাদা পেরিয়ে এক দল ছাত্রী আসবেন স্কুলে। যাঁরা সকলেই প্রায় সাধারণ, খেটে খাওয়া ঘরের মেয়ে। সেলাই-যন্ত্রে কাজ শেখাবেন তিনি।

সবে চাঁদে পৌছেছে চন্দ্রযান। মনোয়ারা তাঁর ছাত্রীদের চন্দ্রযানের গল্প বলেন। বলেন, “আমরা চাঁদে পৌঁছে গিয়েছি। কত গর্বিত মনে হয় নিজেকে। এ বারে হয়তো আমাদের জীবনও পাল্টে যাবে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement