তিনি তুলসীদাস বলরাম। ফাইল চিত্র।
হায়দরাবাদ থেকে বর্মা খেলতে যাওয়ার পথে কলকাতার শিবিরে আটকে গেলেন এক যুবক। বছর কুড়ি বয়েস। সালটা ১৯৫৭। এর আগে কলকাতায় খেলার আমন্ত্রণ বার বার ফিরিয়েছেন। এ বার আটকে গেলেন। এ কী দেখছেন? প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আইএফএ শিল্ডের খেলা চলছে। মাঠে উপচে পড়ছে ভিড়। এখানকার মানুষ ফুটবলকে এত ভালবাসে? খেলোয়াড়দের নাম ধরে চিৎকার করছে! আর হায়দরাবাদে ফুটবলাররাই কেউ কাউকে চেনে না! কলকাতার ফুটবলের কথা শুনেছিলেন। জেনেছিলেন চোট-আঘাতের দায়িত্ব ক্লাবগুলো নেয় না। টাকা দেয় না। চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় না। এ কারণেই তাঁর ফুটবল খেলা নিয়ে মায়ের আপত্তি ছিল প্রচণ্ড। মা চেয়েছিলেন ছেলে লেখাপড়া করুক। কিন্তু ছেলের মাথায় শুধুই ফুটবল। কলকাতার ফুটবল দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন, খেলতে হলে এখানেই খেলবেন। আজিজ ও নুরভাইয়ের পরামর্শ মেনে ইস্টবেঙ্গলে জে সি গুহর কাছে গেলেন যোগ দিতে। তিনি তুলসীদাস বলরাম। এ দেশের সর্বকালের সেরা স্কিলফুল স্ট্রাইকারদের অন্যতম।
১৯৩৭ সালের ৪ অক্টোবর সেকেন্দ্রাবাদে তুলসীদাসের জন্ম। চার ভাই, চার বোনের সংসারে কঠিন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া। বাসভাড়ার অভাবে দু’কিমি পথ হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন। বড় বল কেনার পয়সা ছিল না। খেলতেন টেনিস বলে। সে কারণেই বলের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল দারুণ। দু’পায়ে সমান ড্রিবলিং-এর দক্ষতা ছিল। চুনী গোস্বামী এবং নিজের থেকেও বলরামকে এগিয়ে রেখেছিলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, “ও এক অসাধারণ ফুটবলার। আমিও ওর মতো দু’পায়ে অত ভাল ড্রিবলিং করতে পারতাম না। চুনীও না। চুনীর মধ্যে গতি ছিল। বলরামের মধ্যে দুটোই ছিল। যাকে কাটিয়ে চলে যেত তার অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকত না।”
সেকেন্দ্রাবাদে ফুটবলের পরিবেশ ছিল না। হায়দরাবাদের ফুটবলারদের নিয়েই রাজ্য দল গঠন হত। বলরামের সুযোগ পাওয়া অনেকটাই আচমকা। হায়দরাবাদের লিগের ফাইনালে উঠেও শক্তিশালী দল গড়তে ব্যর্থ হচ্ছিল আর্মি কমব্যাট ফোর্স। বলরাম, নারায়ণন ও কান্ননকে খেলিয়ে দল চ্যাম্পিয়ন হয়। বলরাম বলেছেন, “খেলার পর এক জন বেঁটেখাটো মানুষ আমাকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, যদি সু্যোগ পাই হায়দরাবাদে খেলতে যেতে পারব কি না। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। তিনি যদি সে দিন আমাকে না দেখতেন, আজ আমার বলরাম হওয়াই হয়তো হত না। তিনি ছিলেন হায়দরাবাদ এবং ভারতীয় দলের কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিম।”
রহিম সাহেবই বলরামের প্রথম প্রশিক্ষক। তাঁর চেষ্টাতেই ১৯৫৫ সালে হায়দরাবাদের রাইডার্স ক্লাবে যোগ দেন বলরাম। ১৯৫৬-তে তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে প্রথম সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় হায়দরাবাদ।
রহিম সাহেবের প্রচেষ্টাতেই সে বছর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অলিম্পিক্সে খেলার সুযোগ এসে যায়। “বিদেশে প্রথম খেলার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেকটাই পরিণত করেছে। অনেক কিছু শিখেছি এখানে। ফুটবলকে আরও বেশি করে আঁকড়ে থাকার জেদ আমাকে পেয়ে বসে। দেশ অলিম্পিক্স ফুটবলে চতুর্থ হওয়ার পর বাড়ি ফিরছি ভয়ে ভয়ে। সে দিনটার দৃশ্যের কথা আমি সারা জীবনে কখন ভুলতে পারব না...” বলেছেন বলরাম, “সেকেন্দ্রাবাদের ছোট্ট গ্রাম আম্মুগুডায় রটে গেছে আমার বাড়ি ফেরার খবর। মাঠের উপর দিয়ে যাচ্ছি। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। দূর থেকে দেখছি সাদা শাড়ি পরে মা ছুটে আসছে। ফুটবল খেলা মা একদম পছন্দ করতেন না। প্রচণ্ড মারতেন। আজও মার খাব এই ভয়ে এগোচ্ছি, দেখি মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছেন। বলছেন, ‘এই ছেলেকে ফুটবলের জন্য এত মেরেছি! যদি উৎসাহ দিতাম, আগেই অনেক দূর যেতে পারত।’ মা কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানতাম না।’ মায়ের সেই কান্না মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মনে রাখব।”
বলরাম ফুটবল জীবন শুরু করেছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ডে। পরে চলে আসেন লেফ্ট উইং-এ। ডান প্রান্ত থেকেও গোল করেছেন বহু। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে খেলার পর ১৯৫৭-তে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন। টানা পাঁচ বছর খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলে। ক্লাবের হয়ে গোল করেছেন শতাধিক।
১৯৬০-এর রোম অলিম্পিক্সেও তিনি ভারতীয় দলের অপরিহার্য ফুটবলার। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে বলরামেরই গোলে ভারত ম্যাচ শেষ করে ১-২ গোলে। অচেনা ভারতীয় দলের পারফরম্যান্সে হতবাক হয়ে যায় গ্রুপের অন্য দুই দল ফ্রান্স ও পেরু। ১৯৫৮-র বিশ্বকাপ সেমিফাইনালিস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ভারত জিতেই যেত। এক গোলে এগিয়ে থাকা ভারতীয় দল শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে যায়। ড্র হয় খেলা।
বলরাম বলেছেন, “খেলার পর ফ্রান্সের কোচ আমাদের কাছে স্বীকার করেন যে, তাঁরা খেলাটা ড্র করতে পেরে খুশি হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের লাকি মনে করেছিলেন। তার মানে আমরা ভারতীয় ফুটবলকে একটা মাত্রা দিতে পেরেছিলাম। পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম বিশ্বমানে।”
১৯৫৮ এশিয়াডে হংকং-এর বিরুদ্ধে ভারত ৫-২ গোলে জিতেছিল। বলরাম করিয়েছিলেন দুটো গোল, নিজে করেছিলেন একটা। তিনি মনে করতেন, ১৯৬০ অলিম্পিক্সের পর একটু চেষ্টা করলেই ভারতীয় দল বিশ্বকাপ খেলতে পারত। বলেছেন, “আমাদের ফুটবলারদের দক্ষতা ছিল। অভাব ছিল উদ্যোগের। যদি যেতে পারতাম একটা দৃষ্টান্ত থেকে যেত।”
১৯৬১ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অধিনায়ক হয়েছেন বলরাম। লিগে ২৩ গোল করে সে বছরই পেয়েছিলেন সেরা ফুটবলার সম্মান। তাঁর নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল শিল্ড জয় করে সে বছরই। ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬২ সালে সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন বাংলা দলের অপরিহার্য ফুটবলার তিনি। অধিকাংশ জাতীয় দলের ফুটবলারে সমৃদ্ধ বাংলা দলের নেতৃত্ব দিয়ে চ্যাম্পিয়ন করার কৃতিত্ব তাঁর। বলেছেন, “হায়দরাবাদে যে সম্মান পাইনি তা দিয়েছে বাংলা।” ১৯৬২ জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী ভারতীয় দলের অন্যতম ফুটবলার। তাইল্যান্ড, জাপানের বিরুদ্ধে তাঁর পা থেকেই আসে গোল। সে বছরই পান দেশের সর্বোচ্চ ক্রীড়াসম্মান ‘অর্জুন’।
১৯৬৩ সালে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে, ন’বছরের ফুটবল জীবনে ইতি টেনেছিলেন বলরাম। বলেছেন, “উপায় থাকলে কিছুতেই অবসর নিতাম না। ১৯৬৪-তে খেললে আমার তিনটে অলিম্পিক্সে খেলা হয়ে যেত। কিন্তু টিবি, সঙ্গে হার্টের সমস্যা। দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। ফর্ম ধরে রাখতে পারব না জেনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছি প্রিয় ফুটবলকে।”
বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার অজয় বসু বলেছিলেন, “বলরাম ভারতীয় ফুটবলের রূপকার, ফুটবলের শৈল্পিক ভাবনার পথিক। তার কার্লিং শট আর কোনও ফুটবলারের পায়ে দেখিনি।”
ত্রিমূর্তি: বাঁ দিক থেকে, চুনী গোস্বামী, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ও বলরাম।
নিজের খেলা নিয়ে বলরামের উক্তি, “টেনিস বলে খেলা শুরু করায় স্কিলটাকে ডেভলপ করতে পেরেছিলাম। বিপক্ষের ফুটবলারকে ফাউল করার ইতিহাস আমার, পিকে বা চুনী কারওই নেই। দুটো পা-ই ব্যবহার করে বিপক্ষকে কী ভাবে বিপাকে ফেলা যায় সেই অনুশীলনই করে গেছি বরাবর। শুনেছিলাম আমার হেড নাকি দুর্বল। তার পর এত প্র্যাকটিস করেছি যে, হেডেই গোল পেয়েছি প্রচুর।” আর এক বিশিষ্ট ফুটবলার অরুণ ঘোষ বলেছেন, “বলরামের মাথার পিছনেও দুটো চোখ ছিল। সারা মাঠটাকে তিনি দেখতে পেতেন। দলের প্রতিটি আক্রমণের নেতৃত্ব দিতেন।”
ন’বছরের ফুটবল জীবনে সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট কোনটি? প্রশ্নের উত্তরে আচমকা বেরিয়ে আসে ক্ষোভ। “আমি ফুটবল খেলেছি মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। আনন্দ দিতে পেরেছি, সেটাই আমার কাছে বড় অ্যাচিভমেন্ট। আমি কী করেছি, কী করিনি, আমার উপর কতটা অন্যায় হয়েছে, কতটা অত্যাচার হয়েছে মানুষ জানে। এগুলো বলতে গেলে আবার আমার কষ্ট বেড়ে যাবে। বিচারটা মানুষই করুক, আমি নিজে থেকে বলব না।”
১৯৮৯ সালে মনোনয়ন হয়েছিল পদ্মশ্রীর জন্য। দুঃখটা তা হলে ভুলতে পারেননি? প্রশ্নটার জন্য যেন তৈরি ছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “আমি আজও বুঝতে পারিনি কেন দেওয়া হল না। সংবাদপত্র, সব মানুষ জেনে গেল বলরাম পদ্মশ্রী পাচ্ছে। ভবানীপুর থানার ওসি বাড়ি এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, কোনও ভেরিফিকেশন ছাড়াই তিনি আমার ফাইলে সই করে দিয়েছেন। পরে শুনলাম, ফাইল যাওয়ার আগের দিন সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী হয়েছে, কেন হয়েছে জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি। ভাগ্যে ছিল না, পাইনি। ব্যস।”
মোহনবাগানে খেলার জন্য ধীরেন দে আপনাকে ডেকেছিলেন। ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে গেলেন না কেন? তাঁর উত্তর, “তখন ফুটবলাররা খুব বেশি ক্লাব বদল করতেন না। ক্লাব সমর্থকরাই ভালবাসা দিয়ে টেনে রাখতেন প্রিয় ফুটবলারদের। এক বার রটে গিয়েছিল আমি নাকি মোহনবাগানে যাচ্ছি। সমর্থকরা ছুটে এল। পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। বুঝলাম কারও চোখের জলে আমার মঙ্গল হবে না। এই ভালবাসা ছেড়ে কী করে চলে যাব? ওদের দুঃখ দিয়ে ছেড়ে যেতে মন চায়নি। ইস্টবেঙ্গলেই থেকে যাই শেষ পর্যন্ত।”
শুধু ইস্টবেঙ্গলে ফুটবলার হিসেবেই নয়, সারা জীবন থেকে গেলেন বাংলায়। খেলার শেষে ঘরে ফেরার মন থাকে সবারই। ব্যতিক্রম বলরাম। সেই যে ১৯৫৭ সালে বাংলার প্রেমে পড়ে থেকে গেলেন, গত বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর দুপুরে জীবনে যবনিকা পতন পর্যন্ত থেকে গেলেন সেখানেই। বাংলায় পাকাপাকি থাকবেন বলেই রেলে চাকরি নিয়ে নেন।
বার বারই বলেছেন, “পুরস্কারের আশায় কোনও দিনই ফুটবল খেলিনি। ভালবেসে খেলেছি। যেখানেই গিয়েছি, মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণের চেয়েও তা আমার কাছে অনেক বেশি দামি। বাংলার জন্য যতটুকু করতে পেরেছি, পেয়েছি তার শতগুণ বেশি। তাই তো কখনও বাংলা ছাড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। বাংলাই আমার দেশ। এখানেই থাকতে চাই আমৃত্যু।”
১৯৫৬-র অলিম্পিক্সের পর থেকেই চুনী, পিকে, বলরামের নাম ভারতীয় ফুটবলে একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। প্রদীপ বন্দোপাধ্যায় ও চুনী গোস্বামী ২০২০-তে প্রয়াত হয়েছেন। এ বার চলে গেলেন তৃতীয় নক্ষত্র তুলসীদাস বলরামও।
(লেখক রাজ্য ক্রীড়া পর্ষদের প্রাক্তন ক্রীড়া সাংবাদিক)