‘জয়দেবের মন্দির’ নামে পরিচিত রাধাবিনোদের দেবালয়। নিজস্ব চিত্র।
সারা বছর যেন প্রায় ভূশণ্ডীর মাঠ। কতিপয় বাউলগান পিপাসু মানুষ তমালতলায় লক্ষ্মণ দাস বাউল কিংবা শ্মশানঘেঁষা পাগলা কুটিরে বাউলগান শুনতে আসেন। কখনও মনের মানুষ আখড়ায় সাধন দাস মাখি কাজুমিরা আছেন কি না দেখতে যান। যদি তাঁরা থাকেন তা হলে তো কথাই নেই, দু’কলি বাউলগানে মন ভরানোই যায়। কিন্তু মকরসংক্রান্তিতে এই জয়দেব-এর ছবি পুরোপুরি আলাদা। অজয়ের যৎসামান্য জলে পুণ্যস্নান করে রাধাবিনোদের মন্দিরে পুজো দিয়ে নদীর ধারে রোদে গা এলিয়ে চপ-মুড়ির স্বাদ, আর বাউলরসে মজতে রাঢ়বঙ্গ যেন ভেঙে পড়ে।
বীরভূমের ইলামবাজার থানার অন্তর্গত অজয় তীরবর্তী ক্ষুদ্র জনপদ জয়দেব। দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের নামানুসারেই স্থাননাম। এখানেই বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুর প্রতিষ্ঠিত রাধাবিনোদের মন্দির, যা জয়দেবের মন্দির নামেই পরিচিত। উল্টো দিকে ধর্মমঙ্গল কাব্যের ইছাই ঘোষের দেউল, গভীর অরণ্যে শ্যামরূপার মন্দির, আবার এ পারে লাউসেন ডাঙা। গঙ্গাসাগরের অনুকরণে অজয়-দামোদর তীরবর্তী অনেক স্থানে মকর সংক্রান্তির মেলা দীর্ঘ দিন ধরে হয়ে আসছে। জয়দেবের মহান্তরা পরে এই মকরসংক্রান্তির মেলাকে ‘জয়দেবের মেলা’ বলে আখ্যায়িত করেন বলে স্থানীয় মত। রাধাবিনোদ মন্দির সংলগ্ন নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মহান্তরাই জয়দেবের মেলা পরিচালনা করে এসেছেন। মাঝ-জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডায় হাজার হাজার মানুষ মকরের পুণ্যস্নানের উদ্দেশ্যে হাজির হয়ে যান অজয়ের তীরে। বলা হয়, এই দিন নাকি মা গঙ্গা অসুস্থ জয়দেবের আকুতিতে সাড়া দিয়ে উজানে বয়ে অজয়ের কেন্দুলি পর্যন্ত এসেছিলেন। সে দিনের অজয়ে স্নান গঙ্গাস্নানের সমতুল ভেবে সাধ মিটিয়ে পুণ্যার্থীরা স্নান করেন। কানে ভেসে আসে দূরে কোনও আখড়া থেকে বাউলগান—“আয় রে ছুটে বীরভূমের এই গ্রাম কেঁদুলিতে/ যেথা প্রেমের উজান বয় অজয়ে/ পৌষের শেষে হিম শীতে।”
পাগল রামদাস, সুধীর দাস, নবনী দাস, ব্রজবালা দাসী, রামদাস বাউল, কবি কুমুদ কিঙ্কর, দামোদর চন্দ্র ব্রজবাসী, ফণিভূষণ দাস, ঠাকুর হরিদাস, পূর্ণদাস বাউল, গৌর ক্ষেপা, তারকদাস বাউল, লক্ষ্মণদাস বাউলদের স্মৃতি বিজড়িত এই মেলা। জয়দেবের মেলায় জনারণ্যে সেখানকার জীবন্ত কিংবদন্তির গান আপনাকে মোহিত করবে। তিনি অনাথবন্ধু ঘোষ। মেলার পর জয়দেব ফাঁকা হয়ে যায়, কিন্তু সেই ফাঁক পূরণ করে রাখেন ‘গুরুজি’। স্থানীয় বাউলরা তাঁকে গুরুজি বলেই সম্বোধন করে থাকেন। এখনও প্রতি একাদশীতে প্রায় সারা রাত জয়দেবের রাধাবিনোদ মন্দিরে ‘গীতগোবিন্দ’ পরিবেশন করেন। ছোটবেলায় অনাথবাবু হারিয়েছেন তাঁর মাকে, দৃষ্টিশক্তিকেও। প্রায় জন্মান্ধ এই শিল্পী গ্রামোফোনের মাধ্যমে সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। সঙ্গীত শিক্ষা সুধীর দাস বাউল, টিকরবেতা গ্রামের বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী সুধীর মণ্ডল, বিশিষ্ট তবলাশিল্পী শ্রীধর ঘোষ ও পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর জয়সওয়ালের কাছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেই স্বচ্ছন্দ, কিন্তু মাটির অমূল্য সম্পদ বাউলগান জড়িয়ে আছে তাঁর সত্তায়। শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ দাসের প্রেরণা ও শিক্ষায় অনাথবন্ধুর গীতগোবিন্দ-চর্চার সূত্রপাত। দশাবতার স্তোত্র থেকে বসন্তবন্দনা অবলীলায় গেয়ে যেতে পারেন পঁয়ষট্টি পেরনো অনাথবন্ধু।
বলে রাখা ভাল, বর্তমানে খুব জনপ্রিয় একটি গান ‘তু কেনে কাদা দিলি সাদা কাপড়ে’ গানটি বহু আগে রচনা করেন সাধক কবি কুমুদ কিঙ্কর (নূরুল ইসলাম), আর সুর দেন শান্তি রজক। শান্তিবাবু বর্তমানে জয়দেব সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি। তাঁদের উদ্যোগে স্থানীয় ভক্তিভবনে বাউল ও গীতগোবিন্দের আসর বসে এখনও। প্রতি ইংরেজি মাসের দ্বিতীয় রবিবার বাউল এবং শেষ রবিবার গীতগোবিন্দের আসরে স্থানীয় ও বাইরে থেকে আসা শ্রোতাদের জমায়েত। প্রশ্ন হতে পারে, জয়দেবের বাউলদের সঙ্গে জয়দেব ও তাঁর গীতগোবিন্দের কী সম্পর্ক? কেনই বা তাঁরা জয়দেবে ফি-বছর আসেন? আসলে বাউলরা জয়দেবকে নবরসিকের অন্যতম মনে করেন। দেহকে ভালবেসে দেহাতীতের সন্ধানের পথ জয়দেবে তাঁরা খুঁজে পান, তাই বিনা নিমন্ত্রণেই ছুটে আসেন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এ ছাড়াও চৈতন্য-নিত্যানন্দ-বীরচন্দ্রকে বাউলরা তাঁদের আদি গুরু মনে করেন। তাই চৈতন্য-আস্বাদিত গীতগোবিন্দের রচয়িতা জয়দেবও তাঁদের আপনজন। সব কিছুর ঊর্ধ্বে এক বৃহত্তর মানবমনের অনুসন্ধান এখানে। ‘বলি ও ননদি আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে’— বহুল জনপ্রিয় গানটির লেখক বীরভূমেরই ভূমিপুত্র আশানন্দন চট্টরাজের লেখা একটি বাউলগান এ যুগের কোনও বাউল যখন গেয়ে ওঠেন— ‘আমি মরছি খুঁজে সেই দোকানের সহজ ঠিকানা/ যেথা আল্লা হরি রাম কালী গড/ এক থালাতে খায় খানা’— ঠিক তখনই এই বীরভূমের ক্ষুদ্র জনপদেই পাতা হয়ে যায় বিশ্বময়ীর আঁচল।
বিভোর: স্বর্গীয় তারকদাস বাউলের বাড়ির আখড়ায় গানের আসর।
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় বাউল নবনী দাস এই মেলায় নতুন বাউলদের কণ্ঠে ধরা দেন। তাঁর ‘আমার যেমন বেণি তেমনি রবে/ চুল ভেজাবো না’ গানে এখনও আসর মেতে ওঠে। নবনী দাসের মতো এখনও দু’-এক জন বাউল আছেন, যাঁরা পয়সার জন্য নয়, ভাব এলে তবেই গান গেয়ে থাকেন। এই ভাবতত্ত্বের অনুসন্ধানেই বাউল সঙ্গ করতে এক সময় ছুটে এসেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিশ্বভারতীর একদা অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি। ক্ষিতিমোহন সেন, রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়রা জয়দেবে বহু বার এলেও রবীন্দ্রনাথ কখনও বাউল মেলায় আসেননি। বাউলগান সংগ্রহে আগ্রহ থাকলেও সাধনতত্ত্ব নিয়ে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না বলে ধারণা অনেক রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞের।
তবে এখনকার বাউলরা যুগরুচি বোঝেন। বুঝতে হয়। তাই ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’, ‘ও কনটাকটার বাবু গো’ ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’... টিভিতে সিনেমায় পরিবেশিত এমন গানই তাঁরা বেশি গাইছেন। তাঁদের চিরাচরিত বাদ্যযন্ত্র খমক, একতারা, দোতারা, ডুবকি ইত্যাদির সঙ্গে আখড়ায় আখড়ায় হাজির ম্যান্ডোলিন, হাওয়াই-গিটার, নাল। অর্কেস্ট্রায় উঠে আসছেন ভবা পাগলা থেকে গৌর ক্ষেপা। ‘নাচো গো নাচো গো কালী’ গানের সঙ্গে চলছে নৃত্য। বাউল মেলায় শাহ আব্দুল করিমের ‘আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে’ গান যখন কোনও নবীন বাউল গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠেন, তখন মেলায় যাওয়া কিশোরী রিয়ালিটি শোয়ে শোনা গান খুঁজে পায়। চমকিত হয়। তার গান শেখানোর ক্লাসে দিদিমণিও এই গানটা তুলিয়েছেন যে! নবীন কিশোর বাড়ি ফেরার পথে গাইতে থাকে ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’।
এই মেলায় যেমন রসিকরা থাকেন, পাশাপাশি থাকেন মধ্যস্থতাকারীরা। তাঁদের হাত ধরেই বর্তমানের বাউলশিল্পীরা বায়না পান দেশের কোনও সমুদ্র সৈকতের উৎসবে, রাজধানীর কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে বা ফ্রান্স-আমেরিকার শহরে। হাতে বেশ ভাল টাকা আসে। আর ট্রেনে ট্রেনে মাধুকরী করতে হয় না। এক বাউলপ্রেমীর কথায় উঠে এল আক্ষেপ, “ওদের নেশাতেই চলে যায় অনেক টাকা।” এক বাউল এক যুবকের সঙ্গে সেলফি তুলতে তুলতে বলে নিজের মনেই বলে ওঠেন, “নেশাতেই তো ভাব আসে গোসাঁই।”
জয়দেবের মেলায় ভাল লাগবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্নসত্রগুলো। এই আক্রার বাজারেও কানে পৌঁছবে সরল আন্তরিক আবেদন, “আমাদের আখড়ায় একটু অন্নগ্রহণ করে যান।” পায়ে পায়ে অন্নসত্র। বাউলদের বাড়িতেও উঠোনভরা কুটুম। সবাই যে পরিচিত তা-ও নয়। সবাই প্রসারিত উঠোনে এক সঙ্গে খাবেন, বাউলগানে আনন্দ করবেন। গভীর রাতে খড়-বিছানো শয্যায় নিদ্রা যাবেন।
এই জয়দেবের মেলায় খোঁজ মেলে অন্য এক বীরভূমের। বাউল মনের বীরভূম, রসিক বীরভূম।