Bengali Feature

কবির কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া

মানুষ রোনাল্ড রসকে মনে রেখেছে ম্যালেরিয়ার পরজীবী খুঁজে পাওয়ার জন্য। তাঁর কবিত্বের কথা কেউ মনে রাখেনি। কবির সৃজনশীল মন নিয়েই বিজ্ঞানের সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি।

Advertisement

অরুণাভ সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০২
Share:

আবিষ্কারক: রোনাল্ড রস। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

সালটা ১৮৯৭। জ্বরে কাতরাচ্ছেন কবি, থুড়ি বিজ্ঞানী! ম্যালেরিয়া। কোন এক ঘোর থেকে যেন জ্বরের অনুভূতিই প্রকাশ করছেন— ‘দ্য স্কাই ইজ় রেড অ্যাজ় ব্লাড;/ দ্য ভেরি রকস ডিকে/... দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ় হোয়াইট উইথ হিট/... দ্য লস্ট স্টারস ক্রাই ইন হেভেন।’ (‘ইন এগজ়াইল’)

Advertisement

মহৎ কবিসত্তাই যেন তাঁকে বিজ্ঞানের এক মহান মানুষ হিসেবে নির্মাণ করেছে। ওঁর যে সূক্ষ্ম ও প্রত্যয়ী প্রয়োগকৌশল মশার মধ্যে পরজীবী খুঁজে পেয়েছে, তা-ই যেন ছুঁতে চেয়েছ ওঁর কবিতার সুনির্দিষ্ট শব্দের দলকে। যে মানুষটিকে নিয়ে এই কথা, তাঁকে সভ্যতার ইতিহাস মনে রেখেছে ম্যালেরিয়ার রহস্য উন্মোচনের শার্লক হোমস হিসেবে। পেয়েছেন নোবেলও। তিনি স্যর রোনাল্ড রস।

রোনাল্ড রসের মননশীলতার উৎসমুখে যেতে হলে, উঁকি দিতে হয় তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের দিকে। জন্মসূত্রে, পরে কর্মসূত্রেও রোনাল্ড রস ভারতের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে। জন্ম, সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক তিন দিন পরে, ১৩ মে, ১৮৫৭ সালে। হিমালয়ের কোলে, আলমোড়ায়। বাবা ক্যাম্পবেল ক্লে গ্রান্ট রস ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির বেঙ্গল স্টাফ কর্পস-এর আধিকারিক। সুন্দরের পূজারি। প্রকৃতিপ্রেমী ও চিত্রশিল্পী মানুষটি সময় পেলেই মন দেন বাদ্যযন্ত্র বাজানোয়। সপরিবার বেরিয়ে পড়েন জঙ্গল সফরে। ছোট্ট রোনাল্ড ও অন্য সন্তানদের বিভিন্ন ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে শোনান গল্প। আর রোনাল্ড দেখেন, সারা দিনের ঘটনা বাবা লিখে রাখছেন। বাড়ির হিন্দুস্থানি আর্দালিদের থেকে শোনা হয় রাম, কৃষ্ণের কাহিনি, নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান।

Advertisement

তবে আট বছর বয়সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ছেলেকে ইংল্যান্ডে পাঠালেন ক্যাম্পবেল। বছর চোদ্দোর মেধাবী রোনাল্ড অঙ্ক কষে পুরস্কার হিসাবে পেলেন ‘অর্বস অব হেভেন’। এই বইটির সূত্রেই অঙ্কের সঙ্গে ঘরবসত। পরে রোনাল্ড রসের অসামান্য অবদান লেখা থাকবে ম্যালেরিয়া-সহ বিভিন্ন রোগ বিস্তার সংক্রান্ত বিদ্যায় (এপিডেমিয়োলজি) গাণিতিক মডেলের ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও। তিনি এর নাম দেন ‘প্যাথোমেট্রি’। এরই সঙ্গে ষোলো বছর বয়সে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম, রাফায়েলের ‘টর্চ বেয়ারার’ ছবিটি কয়েক মিনিটে নকল করে ফেলা— এ সবও চলতে থাকল সমান গতিতে।

অথচ, যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য রোনাল্ড রসকে মনে রেখেছে সভ্যতা, সেই শাস্ত্রটাই নাকি পড়ার তেমন ইচ্ছে ছিল না ওঁর। ইচ্ছে, একই সঙ্গে লেখক ও চিত্রশিল্পী হবেন। যদিও বাবা চাইতেন, রোনাল্ড যেন চিকিৎসক হয়ে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন। বাবার ইচ্ছে আর কিছুটা জোরাজুরিতেই রোনাল্ড ভর্তি হলেন সেন্ট বার্থেলোমিউ মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু সেখানেও ক্লাসের ফাঁকে, খাবার টেবিলে এ ছেলে কী যেন আঁকিবুকি কাটে খাতা-পেনসিল নিয়ে। ফলও মিলল হাতেনাতে! ডাক্তারি পরীক্ষায় মাঝারি ফল হল। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে চাকরি হল, তবে দ্বিতীয় চেষ্টায়।

এই সূত্রেই ভারতে ফেরা। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম চাকরি। রোনাল্ড রসের কবিতায় দার্শনিক বোধের রসায়নে ফুটে ওঠে সময়, প্রকৃতি, প্রেম, মূল্যবোধ। শোক-হতাশা, দুঃখ-মুগ্ধতা, ব্যর্থতা-আনন্দ— সবই ফুটে ওঠে কবিতায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিষবাষ্পে যেন মন অসাড় হয় কবির। লেখেন ‘ডিউটি’, ‘ফেয়ারওয়েল’, ‘ব্ল্যাক অগস্ট’, ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’ ইত্যাদি। ১৯১৪ সালে তৃতীয় পুত্র সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ক্যাম্পবেল অকালে প্রয়াত হলে লিখলেন ‘দ্য ফাদার’ কবিতাটি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘সিলেক্টেড পোয়েমস’, ‘ইন এগজ়াইল’, ‘ফিলসফিজ়’, ‘দ্য সেটিং সান’ ইত্যাদি। লিখেছেন উপন্যাসও। তবে সেগুলি পাঠকমহলে তেমন সমাদৃত নয়।

১৮৮১ থেকে সাত বছর ভারতে কাটানোর পরে ছুটি নিয়ে ফিরলেন ইংল্যান্ডে। ফেরার পথে জাহাজে তাঁর মানসিক অস্থিরতার ছবি নিয়ে লিখলেন ‘ফিলসফিজ়’। তাঁর ভারতবাসের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ভাবলেন, যে সব অসুখ জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করছে, সেগুলি নিয়ে গবেষণা করলে কেমন হয়। এই রোগগুলির অন্যতম ম্যালেরিয়া। রোনাল্ডের জীবনেও এই রোগটি নানা ভাবে এসেছে। ছোটবেলায় ভারতবর্ষে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখেছেন। তাঁর বাবাও বিপজ্জনক ভাবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

তিনি ম্যালেরিয়াকেই বেছে নিলেন গবেষণার বিষয় হিসেবে। ১৮৮৮-তে লন্ডনে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স করলেন। মাইক্রোস্কোপ ও ল্যাবরেটরির কাজে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। বেঙ্গালুরুতে এসে মশা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। কবিতায় ম্যালেরিয়াকে চিহ্নিত করলেন ‘মিলিয়ন মার্ডারিং কজ়’ হিসেবে: ‘ও গড রিভিল থ্রু’ অল দিজ় থিংস অবসকিয়োর/ দি আনসিন, স্মল বাট মিলিয়ন-মার্ডারিং কজ়।’ (‘ইন্ডিয়ান ফিভারস’)

১৮৯৪-এ আবার ইংল্যান্ডে গেলেন। দেখা করলেন ট্রপিক্যাল ডিজ়িজ-এর দিকপাল প্যাট্রিক ম্যানসনের সঙ্গে। তাঁকে পেলেন গবেষণার পথপ্রদর্শক হিসেবে। ১৮৯৫-এ ফিরে এসে পূর্ণোদ্যমে চলল গবেষণা— ম্যালেরিয়া রোগী ও মশার মধ্যে সম্পর্কের খোঁজ। গবেষণা নিয়ে রোনাল্ড রসের আশা-হতাশার টানাপড়েন আর প্যাট্রিক ম্যানসনের প্রেরণা ও দূরশিক্ষণের ভূমিকা কোন পর্যায়ের, সে সাক্ষ্য দেয় ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যে তাঁদের মধ্যে চালাচালি হওয়া ১৭৩টি চিঠি।

বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা মিলছে না। নেমে আসছে বদলির খাঁড়া। তবু প্রতিকূল আবহাওয়ায়, কঠিনতর পরিবেশে সেকেন্দ্রাবাদের বেগমপেট হাসপাতালে মশার ব্যবচ্ছেদ করে চলতে থাকল গবেষণা। ১৮৯৭-এর জুনে দুঃসহ গরমে সাফল্য পাওয়ার দু’মাস আগে তাঁর কাজের বর্ণনা মেলে আত্মজীবনীতে। তাতে থাকে সাহিত্যবোধ, রসবোধ— “বেগমপেট হাসপাতালের সেই অন্ধকার উত্তপ্ত ছোট্ট কাজের ঘরটি... বারান্দার ছাদের কার্নিসের তলা দিয়ে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু আলোর কিরণ আসছে। আমার আংশিক পর্যবেক্ষণ করা ব্যবচ্ছেদ করা মশাগুলি কোনও ‘কভার-গ্লাস’ দিয়ে ঢেকে রাখা নেই। তাই পাছে সেগুলি হাওয়ায় উড়ে যায়, সে জন্য আমি ‘পাংখা’ চালাতে দিচ্ছি না।” তাঁর সংযোজন: “ফলে প্রচুর ছোট ছোট মাছির মতো পতঙ্গ (আই-ফ্লাইজ়), যেগুলি কানে বা চোখের পাতায় ঢুকে যায়, সেগুলি আমাকে মনের সুখে জ্বালাতন করছে। কখনও কখনও দু’-একটা মশা তাদের বন্ধুদের নিধন করার জন্য আমার উপরে শোধ তোলার চেষ্টা করছে...। আমার কপাল আর আমার হাতের ঘামে আমার মাইক্রোস্কোপের স্ক্রু-তে মরচে ধরে গিয়েছে...।”

অবশেষে ১৮৯৭-এর ২০ অগস্ট সাফল্য এল। ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটকে আবিষ্কার করলেন রোগী থেকে সংক্রামিত মশার পাকস্থলীতে। স্বভাবসিদ্ধ শৈলীতে উদ্‌যাপন করলেন সাফল্য, কবিতায়— ‘আই ফাইন্ড দাই কানিং সিডস্,/ ও মিলিয়ন-মার্ডারিং ডেথ।...’

রোনাল্ড রস তাঁর অবশিষ্ট গবেষণার কাজ করেছেন কলকাতার পিজি (বর্তমানে এসএসকেএম) হাসপাতালে। সেখানে পরের বছর, ১৮৯৮-এ পাখি নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কার করে দেখিয়েছেন ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের পূর্ণ জীবনচক্র। তাঁর সম্পর্কে বন্ধু ও জীবনীকার রুডলফ লুইস মেগর্জ-এর কথাটিই ঠিক, “চিকিৎসক-বিজ্ঞানী হিসেবে রোনাল্ড রস অমর খ্যাতি পেলেও তিনি কবি হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন এবং অবশ্যই সারা জীবনই ছিলেন এক জন কবি।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement