পথিকৃৎ: বিক্রম সারাভাই। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
অবশেষে সফল হল চাঁদের অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুতে রোমাঞ্চকর অভিযান। সৌজন্যে ভারতের চুয়ান্ন বছর বয়সি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’। ১৪ জুলাই শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল চন্দ্রযান-৩। ২৩ অগস্ট সন্ধে ছ’টা চার মিনিটে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদের মাটি স্পর্শ করল। আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পর চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের মাটি স্পর্শ করার কৃতিত্ব অর্জন করল।
২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর শ্রীহরিকোটা থেকে পিএসএলভি-এক্সএল রকেটে চড়ে উড়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান-১। সে বার চাঁদের মাটি না ছুঁয়েও চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জলের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এর আগে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই জিএসএলভি মার্ক-৩ রকেটের দ্বারা শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল চন্দ্রযান-২-কে। কিন্তু চাঁদের মাটি ছোঁয়ার কিছু ক্ষণ আগে চন্দ্রযান-২ মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো ফের উত্থান ঘটেছে ইসরো-র।
ভাবলে অবাক হতে হয় যে, ইসরো-র চাঁদ ধরতে যাওয়ার এই যে আকাঙ্ক্ষা, তা জন্ম নিয়েছিল কেরলের সমুদ্রতীরের একটি প্রাচীন গির্জায়, মহাকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর কয়েক জন প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর হাত ধরে।
ডঃ বিক্রম আম্বালাল সারাভাই। ভারতে মহাকাশ গবেষণার পথিকৃৎ। ভারতের মহাকাশ গবেষণায় জোর দেওয়া নিয়ে তিনিই প্রথম সরব হন। তাঁকে সমর্থন করেন বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। ১৯৬২ সালে তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই কমিটির প্রধান হিসেবে বেছে নেন ডঃ সারাভাইকে। তাঁর সঙ্গে মহাকাশ কর্মসূচিতে যোগ দেন হোমি ভাবা। তত দিনে সারাভাই কেমব্রিজে পড়াশোনা শেষ করে বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এ বিজ্ঞানী সি ভি রামনের অধীনে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণাও করেছেন। আমদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ফিজ়িক্যাল রিসার্চ লাবরেটরি’।
মহাকাশ গবেষণার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল উপযুক্ত রকেট এবং তার অনুকূল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র। বিক্রম সারাভাইয়ের পছন্দ ছিল কেরলের তিরুঅনন্তপুরমের কাছে থুম্বা-র সমুদ্রতীরবর্তী একটি স্থান। কারণ জায়গাটা চৌম্বকীয় মধ্যরেখার কাছাকাছি, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে গবেষণা চালানোর জন্য উপযুক্ত। কিন্তু সে জায়গা অধিগ্রহণ করতে গিয়ে সমস্যা দেখা দিল। সারাভাই দেখলেন, মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে গেলে সেখানে বসবাসরত মৎস্যজীবীরা আশ্রয় হারাবে। আবার সেখানকার প্রাচীন সেন্ট মেরি ম্যাগডালেন গির্জা এবং বিশপের বাসস্থানও চলে যাবে গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে। এই দু’টি কারণেই সম্ভবত স্থানীয় লোকজনের অনুমতি পাওয়া সম্ভব হবে না।
১৯৬৩ সালে সাউন্ডিং রকেট ‘নাইকি অ্যাপাশে’র সঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
তবু সারাভাই এক বার চেষ্টা করে দেখার কথা ভাবলেন। এক দিন গির্জার বিশপ ফাদার পিটার বার্নার্ড পেরেরার সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। তিনি বিশপকে আশ্বাস দিলেন যে, এক বছরের মধ্যে তাঁদের বসবাসের জন্য সমুদ্রের ধারে একটি বিকল্প জায়গা গড়ে দেওয়া হবে। বিশপ সব শুনে সারাভাইকে পর দিন সকালে আসতে বললেন।
পর দিন ছিল রবিবার। বিশপ গির্জায় বাইবেল পাঠ করছেন। প্রার্থনাসভায় উপস্থিত রয়েছেন স্থানীয় অধিবাসীদের প্রায় সকলেই। এমন সময় এসেছেন সারাভাই, সঙ্গে এপিজে আব্দুল কালাম। পরে ডঃ কালাম-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, সে দিন বিশপ গির্জায় উপস্থিত সকলকে সারাভাইয়ের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা জানালেন। বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন, তাঁদের উদ্যোগের প্রভূত প্রশংসা করলেন। সবশেষে সকলের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “তা হলে আমার সন্তানগণ, আমরা কি আমাদের ঘর, আমার ঘর এবং ঈশ্বরের ঘর এক মহান বিজ্ঞানীর মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অর্পণ করতে পারি?”
ফাদারের প্রশ্ন শুনে জনতা কয়েক মুহূর্ত নীরব। কিছু ক্ষণ পরে সকলে উঠে দাঁড়ালেন এবং সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারিত হল, “আমেন।”
সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডঃ কালাম জানিয়েছেন, সেখানকার নিরাশ্রয় মানুষরা সবাই সারাভাইয়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বিকল্প বাসস্থান পেয়েছিলেন।
সেই ছিল সূত্রপাত। অতঃপর শুরু হল ভারতের প্রথম রকেট উৎক্ষেপণের আয়োজন। সেই গির্জা হয়ে উঠল থুম্বার মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের প্রথম অফিস। বিশপের বাড়িটি হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীদের গবেষণাগার। কাজে গতি আনতে সারাভাই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীদের খুঁজে খুঁজে থুম্বায় নিয়ে আসেন। সেই তালিকায় উজ্জ্বল নক্ষত্র বসন্ত গোয়ারিকর। তিনি আগে কাজ করেছেন ইংল্যান্ডের অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটি-তে। অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন, সুসজ্জিত গবেষণাগার ছেড়ে বসন্ত গোয়ারিকর চলে এলেন থুম্বায়। তাঁর গবেষণাগার রূপে নির্দিষ্ট করা হল গির্জার পাশে গোয়ালঘরটি। গরুর খাদ্য মজুত করার গুদামটিও কাজের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতের উৎক্ষিপ্ত প্রথম রকেটটি ছিল একটি সাউন্ডিং রকেট। এটি একটি পরীক্ষামূলক রকেট, এই রকেট তৈরির খরচ কম এবং সময়ও লাগে অল্প। তরুণ বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণের জন্য এই রকেট যথোপযুক্ত। সাউন্ডিং রকেট এমন উচ্চতায় ওঠে যেখানে বেলুন উঠতে পারে না। সেই সময় মেরি ম্যাগডালেন গির্জায় নাসা-র তৈরি সাউন্ডিং রকেটের অংশগুলো জোড়ার কাজ চলছিল। দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল কালাম, ঈশ্বরদাস এবং আরাভামুদন। এর আগে এই বিজ্ঞানীরা আমেরিকার নাসা-য় গিয়ে সাউন্ডিং রকেট পাঠানোর কলাকৌশল রপ্ত করে আসেন।
১৯৬৩ সালের ২১ নভেম্বর। সে দিন সন্ধে ছ’টার সময় থুম্বা থেকে উৎক্ষেপণ করার সিদ্ধান্ত হল নাসা-র সাউন্ডিং রকেট ‘নাইকি অ্যাপাশে’। গির্জা থেকে বেশ কিছুটা দূরে লঞ্চিং প্যাড। সেখানে রকেট বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাক এবং হাতে চালানো হাইড্রলিক ক্রেনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। রকেট উৎক্ষেপণের সময় ঘটে গেল বিপত্তি। ট্রাক থেকে তুলে লঞ্চিং প্যাডে বসানোর সময় দেখা গেল, রকেট কাত হতে শুরু করেছে। কারণ হাইড্রলিক ব্যবস্থায় লিক। এ দিকে ঘড়ির কাঁটা ছ’টার দিকে ছুটছে। ক্রেন সারানোর সময় ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে নেই। সুতরাং সবাই মিলে রকেটটা ঠেলে দাঁড় করালেন। নির্দিষ্ট সময়েই আকাশে উড়ল ভারতের প্রথম রকেট।
১৯৬৫ সালে থুম্বায় স্থাপিত হয় ‘স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টার’। কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্কেত মাটি থেকে ধরার জন্য আমদাবাদে গড়ে ওঠে ‘এক্সপেরিমেন্টাল কমিউনিকেশন আর্থ স্টেশন’। ১৯৬৯ সালের ১৫ অগস্ট ভারত সরকারের আণবিক শক্তি দফতরের অধীনে গড়ে উঠল ‘ইসরো’। বিক্রম সারাভাই দেশের পূর্ব উপকূলে একটি রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র খুঁজছিলেন। শেষে চেন্নাই থেকে একশো কিলোমিটার দূরে শ্রীহরিকোটা দ্বীপটি তাঁর মনে ধরল। কারণ পৃথিবী নিজের চার দিকে পাক খাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূর্বে। শ্রীহরিকোটা থেকে রকেট উৎক্ষেপণ করলে পৃথিবীর পূর্বমুখী গতি রকেটেও সঞ্চারিত হবে। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন বিক্রম সারাভাই। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার মহাকাশ দফতর তৈরি করে ইসরো-কে তার আওতায় আনে। সে বছরেই বেঙ্গালুরুতে তৈরি হয় ‘ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টার’।
১৯৭২ সালে ইসরোর চেয়ারম্যান হন সতীশ ধওয়ান। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালে উৎক্ষেপণ করা হয় ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’। এর পর আরও অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পর চন্দ্রযান-১ ভারতের মহাকাশ অভিযানের মোড় ঘুরিয়েছে। থুম্বার গির্জা থেকে আজকের ইসরো, সাউন্ডিং রকেট থেকে চন্দ্রযান-৩, সব বাধা-ব্যর্থতা পেরিয়ে অপ্রতিহত গতিতে ছুটছে ভারতের মহাকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন।