ভাবসমাধি: শ্রীরামকৃষ্ণের ডান হাতের নীচে, ছবির মাঝে বসে থাকা মানুষটিই ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার কাছে আবদার করে বলেছিলেন, “আমাকে রসেবশে রাখিস মা। শুকনো সাধু করিসনি।” তিনি কচুরি, জিলিপি খেতে বড় ভালবাসতেন। ঠাট্টা করে বলতেন, “আমি মায়ের নাম করি বলে এই সব জিনিস খেতে পাচ্ছি!” সাত ফোকরের বাঁশিতে বিভিন্ন রাগরাগিণী শুনতে পছন্দ করতেন। আর ভালবাসতেন গান। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও সঙ্গীতের আসরে। তাঁর শিষ্য স্বামী অভেদানন্দ জানিয়েছেন, “শ্রীশ্রীঠাকুর গান করতেন সুমিষ্ট ও সুসঙ্গতভাবে কোকিলবিনিন্দিত স্বরে।” গানের সুরে, নৃত্যের তালে আসর মাতিয়ে রাখতেন। শ্রীরামকৃষ্ণসিন্ধু মন্থন করলে উঠে আসে অনেক বিস্মৃত বাঙালির নাম, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল। কেশবচন্দ্র সেনের এই শিষ্যকে নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ‘চারণ’ বলা হত। ভক্তিমূলক গান রচনা করে তিনি সমসাময়িক সাধককুলের সমাদর পেয়েছিলেন। তাঁর সৃষ্টি আজও শ্রীরামকৃষ্ণপ্রেমীদের কাছে মন্ত্রসম।
১৮৪০ সালে নবদ্বীপের কাছে চকপঞ্চানন গ্রামে ত্রৈলোক্যনাথের জন্ম। পিতা রামনিধি সান্যাল। প্রথম জীবনে ত্রৈলোক্যনাথ যাত্রাদলে গান গাইতেন। ব্রাহ্মভক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সংস্পর্শে এসে তিনি ১৮৬৭ সালে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করার পর কেশবচন্দ্র ১৮৬৬ সালে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেছিলেন। কেশবচন্দ্রের গৃহে বাস করার সময় তিনি সঙ্গীত এবং পুঁথিগত বিদ্যা লাভ করেন। ১৮৬৮ সালের ২৪ জানুয়ারি কেশবচন্দ্র ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মমন্দিরের ভিত্তিস্থাপন করেন। বৈষ্ণবদের নগরসঙ্কীর্তন রীতি ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়, সে দিন ভোরে কলকাতাবাসী দেখেছিল— শত শত ব্রাহ্মভক্ত ব্রহ্মনামাঙ্কিত নিশান হাতে ত্রৈলোক্যনাথ রচিত ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে গাইতে মিছিল করে চলেছে— “তোরা আয় রে ভাই!/ এত দিনে দুঃখ নিশি হল অবসান, নগরে উঠিল ব্রহ্মনাম।”
কেশবচন্দ্র তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘চিরঞ্জীব শর্মা’। ত্রৈলোক্যনাথ নিজে ‘প্রেমদাস’ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। কেশবচন্দ্র তাঁকে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতাচার্যের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। ১৮৬৭ সালে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত প্রার্থনা সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কেশবচন্দ্র যখন বোম্বাই যাত্রা করেন, তখন তাঁর সঙ্গী ছিলেন গায়ক ত্রৈলোক্যনাথ। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক রূপে নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু তিনি সেই ব্রত পালন করেন। তবে ত্রৈলোক্যনাথ শুধুই যদি কেশব সেনের অনুগামী কিংবা ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক হয়ে থাকতেন, তা হলে তাঁর সৃষ্টি অমরত্ব পেত কি না বলা শক্ত। তাঁর গান অমর ও অমূল্য হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে। জানা যায়, তাঁর গানের চার জন জগদ্বিখ্যাত সমঝদার শ্রোতা ছিলেন— কেশবচন্দ্র, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ।
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের পর কেশবচন্দ্র ঠাকুরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লে কেশবের যে অনুগামীরা একে একে ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ অন্যতম। শ্রীরামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে ত্রৈলোক্যনাথের প্রবেশ সম্ভবত ১৮৭৯ সালে। সেই বছর ২১ সেপ্টেম্বর শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবচন্দ্রের ‘কমল কুটীর’ বাসভবনে ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে যোগদান করেন এবং ত্রৈলোক্যনাথের সুমধুর সঙ্গীত শুনে দিব্য আনন্দে দণ্ডায়মান অবস্থায় সমাধিস্থ হন। কেশবচন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় ঠাকুরের সেই দুর্লভ সমাধিমগ্ন অবস্থার ফোটো তোলা হয়। সেটাই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম ফোটো। তাতে দেখা যায়, “…তাঁর দক্ষিণহস্ত প্রসারিত এবং বামহস্ত বক্ষের উপর ন্যস্ত। তাঁর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল, চক্ষুদ্বয় প্রায় নিমীলিত।” বাহ্যজ্ঞানশূন্য ঠাকুর যাতে পড়ে না যান তাই ভাগ্নে হৃদয়রাম তাঁর দেহখানি আগলে ধরে রেখেছেন, এবং ত্রৈলোক্যনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের ডান দিকে ব্যবধানহীন দূরত্বে মেঝেয় বসে আছেন।
ত্রৈলোক্যনাথের গান শুনে ঠাকুর দিব্য আনন্দে বিভোর, এমন অনেক ছবি আমরা ঠাকুরের প্রামাণ্য জীবনীগুলিতে দেখতে পাই। যেমন, ১৮৮১-র জুন কিংবা জুলাই মাস। সিমুলিয়া স্ট্রিটের সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ির দ্বিতলের বৈঠকখানার ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ উপবিষ্ট। ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল ও অন্যান্য ব্রাহ্ম ভক্তেরাও আছেন। ধনী সুরেন্দ্রনাথ একটি মালা নিয়ে ঠাকুরকে পরাতে এলে ঠাকুর সেই মালা হাতে নিলেন এবং দূরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। সুরেন্দ্রনাথ মর্মাহত। পশ্চিমের বারান্দায় বসে কাঁদছেন। দামি মালা ঠাকুরকে পরাতে যাচ্ছেন ভেবে তাঁর মনে অহঙ্কার হয়েছিল। ঠাকুর তাঁর দর্প চূর্ণ করেছেন। এখন সুরেন্দ্র অনুতপ্ত। ও দিকে বৈঠকখানার ঘরে ত্রৈলোক্য গান ধরেছেন। ঠাকুর আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নৃত্য করছেন। অনুতপ্ত ভক্তের দুঃখ দূর করার জন্য যে মালা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, তা তুলে নিয়ে গলায় পরলেন।
কিংবা ১৮৮১ সালের ৩ ডিসেম্বর। শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় মনমোহন মিত্রের বাড়ির প্রাঙ্গণে বসে কেশবচন্দ্র, ত্রৈলোক্যনাথ, রাজেন্দ্রনাথ মিত্র ইত্যাদি গৃহী ভক্তদের সংসার সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছেন, “সংসারের কর্ম বড় কঠিন।… সাধন চাই। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে হয়। ভক্তি লাভ করে কর্ম করা যায়। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আর আঠা লাগবে না।” এর পর গান আরম্ভ হল। ত্রৈলোক্যনাথ গাইছেন তাঁর স্বরচিত গান, ‘জয় জয় আনন্দময়ী ব্রহ্মরূপিণী’। গান শুনে ঠাকুর নৃত্য করছেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কেশব ও অন্যান্য ভক্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যনাথের গান খুব পছন্দ করতেন। কথামৃতে আছে, ১৮৮৪ সালের ২ মার্চ ত্রৈলোক্যনাথ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে বসে গাইছেন, ‘তোর কোলে লুকায়ে থাকি মা।/ চেয়ে চেয়ে মুখপানে মা মা মা বলে ডাকি।’ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসে। তাঁর দুই চোখে প্রেমাশ্রু, বলছেন, “আহা! কি ভাব!” ত্রৈলোক্য যখন গাইলেন, ‘লজ্জা নিবারণ হরি আমার’— ঠাকুর খাট থেকে নেমে এসে মেঝেতে বসলেন। শেষে ত্রৈলোক্যের গানের সুখ্যাতি করে বললেন, “আহা! তোমার কি গান! তোমার গান ঠিক ঠিক। যে সমুদ্রে গিয়েছিল সেই সমুদ্রের জল এনে দেখায়।” ত্রৈলোক্য আবার গাইলেন, ‘(হরি) আপনি নাচো, আপনি গাও, আপনি বাজাও তালে তালে,/ মানুষ তো সাক্ষীগোপাল মিছে আমার আমার বলে।’
শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে ত্রৈলোক্যনাথ ঠাকুরের যে সমস্ত দিব্যভাব প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সে সবের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর গানে। এক বার শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যের গানের প্রশংসা করে বললেন, “আহা! ত্রৈলোক্যের কি গান!” ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত জিজ্ঞাসা করলেন, “কি, ঠিক ঠিক সব?” ঠাকুর উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, ঠিক ঠিক; তা না হলে মন এত টানে কেন?” রামচন্দ্র বললেন, “সব আপনার ভাব নিয়ে গান বেঁধেছেন। কেশব সেন উপাসনার সময় সেই ভাবগুলি সব বর্ণনা করতেন, আর ত্রৈলোক্যবাবু সেইরূপ গান বাঁধতেন। এই দেখুন না, ওই গানটা— ‘প্রেমের বাজারে আনন্দের মেলা।/ হরিভক্তসঙ্গে রসরঙ্গে করিছেন কত খেলা॥’ আপনি ভক্তসঙ্গে আনন্দ করেন, দেখে নিয়ে ওইসব গান বাঁধা।”
ব্রাহ্মরা নিরাকার ঈশ্বরের, পিতৃভাবের উপাসক। ঠাকুরের সান্নিধ্যলাভের পর কেশবচন্দ্র মাতৃভাবে উপাসনার মাধুর্য উপলব্ধি করে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে সেই ভাবের উপাসনা প্রবর্তিত করেন। ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন, “ব্রাহ্মসমাজে এক্ষণে যে ভক্তি লীলাবিলাস ও মাতৃভাবের প্রকাশ দেখা যাইতেছে তাহার প্রধান সহায় পরমহংস রামকৃষ্ণ।” কেশবচন্দ্রের চিন্ময়ী মায়ের অনুধ্যানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ত্রৈলোক্যনাথ বেশ কিছু ভক্তিরসাত্মক মাতৃসঙ্গীত রচনা করেন। ১৮৮৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, সে দিন ভক্তরা দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মমহোৎসব পালন করছেন। নরেন্দ্র, রাখাল, বাবুরাম, ভবনাথ, নিত্যগোপাল-সহ অনেক ভক্ত উপস্থিত। মধ্যাহ্নভোজের পর নরেন্দ্র গান গাওয়ার উদ্যোগ করছেন। তিনি তানপুরা বাঁধতে অনেক ক্ষণ সময় নিচ্ছেন দেখে ঠাকুর অধৈর্য। সহাস্যে বললেন, “এমনি ইচ্ছে হচ্ছে যে তানপুরাটা ভেঙে ফেলি। কি টং টং— আবার তানা নানা নেরে নূম্ হবে।” সে দিন নরেন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন ত্রৈলোক্যনাথের লেখা তিনটি বিখ্যাত মাতৃসঙ্গীত— ‘অন্তরে জাগিছ গো মা অন্তরযামিনী’, ‘গাও রে আনন্দময়ীর নাম’ এবং ‘নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি’। শেষোক্ত গানটির একটি চরণ ‘সমাধিমন্দিরে ও মা কে তুমি গো একা বসি’ নরেন্দ্র যেই গেয়েছেন, অমনি ঠাকুর বাহ্যশূন্য, সমাধিস্থ।
কখনও শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যনাথকে অনুরোধ করতেন তাঁর রচিত বিশেষ ভাবোদ্দীপক গানগুলি গাওয়ার জন্য। ১৮৮৫-র ১২ এপ্রিল, ত্রৈলোক্যনাথ জয়গোপাল সেনের সঙ্গে বলরাম ভবনে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসেছেন। ঠাকুর তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আহা, তুমি আনন্দময়ীর গান সেদিন করলে, কি গান! আর সব লোকের গান আলুনি লাগে! সেদিন নরেন্দ্রের গানও ভাল লাগল না। সেইটে অমনি হোক না।” ত্রৈলোক্য গাইলেন— ‘জয় শচীনন্দন গৌর গুণাকর’। গান শেষ হলে ঠাকুর অনুরোধ করলেন, “একটু আনন্দময়ীর গান।” ত্রৈলোক্য গাইলেন— ‘কত ভালবাস গো মানবসন্তানে,/ মনে হলে প্রেমধারা বহে দু নয়নে (গো মা)।’ তার পর ঠাকুরের অনুরোধে ত্রৈলোক্যনাথ, ‘দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞান বিচারে’ গানটিও গাইলেন। সেই গান সমাপ্ত হলে রামচন্দ্র দত্ত বললেন, “কিছু হরিনাম হোক!” ত্রৈলোক্য ধরলেন, ‘মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।’ কথামৃত প্রণেতার অনুরোধে ঠাকুর তাঁকে ‘গৌর-নিতাই তোমরা দু ভাই’ গানটি গাইতে বললেন। ত্রৈলোক্য ও ভক্তেরা সকলে মিলে সে গান গাইলেন। এমন সময় প্রেমভক্তির হাটে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ এসে উপস্থিত। ত্রৈলোক্যনাথের সঙ্গে গিরিশচন্দ্রের আলাপ হল। তার পর ঠাকুরের অনুরোধে তিনি আবার গাইলেন— ‘জয় শচীনন্দন’। গানের কথাগুলো শুনতে শুনতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট, বাহ্যশূন্য। কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হয়ে ত্রৈলোক্যকে অনুনয় বিনয় করে বললেন, “একবার সেই গানটি! কি দেখিলাম রে।” ত্রৈলোক্যনাথ গাইলেন সে দিনের শেষ গান— ‘কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে,/ অপরূপ জ্যোতি; গৌরাঙ্গ মূরতি, দুনয়নে প্রেম বহে শত ধারে।’
ত্রৈলোক্যনাথের রচিত শতাধিক গানের মধ্যে কয়েকটি ঠাকুরের বিশেষ প্রিয় ছিল। যেমন ‘চিন্তয় মম মানস হরি চিদ্ঘন নিরঞ্জন’। এই বিখ্যাত গানটির বিশেষ তাৎপর্য হল, কথামৃত প্রণেতা শ্রীম এই গানটির জন্যই প্রথম বার ঠাকুরের সমাধি দর্শন করেছিলেন। শ্রীম-র শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শনের তৃতীয় দিন। বেলা আন্দাজ পাঁচটার সময় শ্রীম পঞ্চবটীর দিক থেকে ঠাকুরের ঘরের দিকে এসে দেখেন, ঘরের উত্তর দিকের ছোট বারান্দায় এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। নরেন্দ্রনাথ গাইছেন, ‘চিন্তয় মম মানস হরি…’ আর সেই গান শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। চোখের পাতা পড়ছে না, শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না বললেই চলে। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, এরই নাম সমাধি। শ্রীম লিখেছেন, “‘নবরাগে রঞ্জিত, কোটি শশী-বিনিন্দিত; কিবা বিজলী চমকে সে রূপ আলোকে, পুলকে, শিহরে জীবন।’ গানের এই চরণটি গাহিবার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শিহরিতে লাগিলেন। দেহ রোমাঞ্চিত! চক্ষু হইতে আনন্দাশ্রু বিগলিত হইতেছে। মাঝে মাঝে যেন কি দেখিয়া হাসিতেছেন।”
আর এক বার দক্ষিণেশ্বরে শ্রীম ও নরেন্দ্রনাথ সমসাময়িক ছাত্রদের চারিত্রিক অধঃপতনের কথা আলোচনা করছেন। এমন সময় ঠাকুর এসে উপস্থিত। শ্রীমকে ভর্ৎসনা করে বললেন, “ঈশ্বরের কথা বই অন্য কথা ভাল নয়।” সে দিন ঠাকুর ত্রৈলোক্যনাথের লেখা একটি অপূর্ব ভক্তিগীতি শোনার জন্য নরেন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন, “‘চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে’ এই গানটি একবার গা না।”
ত্রৈলোক্যনাথের আর একটি গান শ্রীরামকৃষ্ণের খুবই প্রিয় ছিল। কথামৃতের পাঁচটি স্থানে গানটির উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে ১৮৮৫-র ২৫ অক্টোবরের দিনটি অভিনব। শ্যামপুকুর বাটীতে ঠাকুর গলার চিকিৎসার জন্য এসেছেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কয়েক জন ব্রাহ্ম ভক্ত সঙ্গে নিয়ে তাঁকে দেখতে এসে করজোড়ে ঠাকুরের উদ্দেশে বললেন, “বুঝেছি আপনি কে! আর বলতে হবে না!” ঠাকুর ভাবস্থ, উত্তর দিলেন, “যদি তা হয়ে থাকে, তো তাই।” বিজয়কৃষ্ণ ঠাকুরের পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ে তাঁর পদযুগল বক্ষে ধারণ করলেন। ঠাকুর বাহ্যশূন্য। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে ভূপতি নামে এক ভক্ত ত্রৈলোক্যনাথের রচিত সেই গানটি ধরলেন, ‘চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী’। সাত দিন পর এই বাড়িতেই ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের উপস্থিতিতে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের কণ্ঠে শেষ বার ওই গান শুনেছিলেন ।
ত্রৈলোক্যনাথ শুধু গীতিকারই নন, ছিলেন এক জন সাহিত্যসেবীও। ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত, শ্রীচৈতন্যের জীবন ও ধর্ম, কেশবচরিত, বিধান ভারত (কাব্য), গীতরত্নাবলী ইত্যাদি গ্রন্থের তিনি রচয়িতা। ত্রৈলোক্যনাথের লেখাও শ্রীরামকৃষ্ণ পছন্দ করতেন। এক বার তিনি তাঁর ‘ছোকরা’ ভক্তদের বলেছিলেন, “তোরা ত্রৈলোক্যের সেই বইখানা পড়িস— ভক্তিচৈতন্যচন্দ্রিকা। তার কাছে একখানা চেয়ে নিস না। বেশ চৈতন্যদেবের কথা আছে।” ত্রৈলোক্যনাথের আরও একটি অবিস্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি হল ‘নব বৃন্দাবন’ নাটক; যে নাটকের অভিনেতা ছিলেন কেশবচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দ এবং দর্শক শ্রীরামকৃষ্ণ।
এর পর ১৬ অগস্ট, ১৮৮৬। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ দেহরক্ষা করেছেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন ত্রৈলোক্যনাথ। শ্রীরামকৃষ্ণের পার্থিবদেহের সঙ্গে কাশীপুরের মহাশ্মশান পর্যন্ত গেলেন এবং সেখানে ঠাকুরের চিতাগ্নির সামনে বসে সময়োচিত তিন-চারটি গান গাইলেন। ‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “তাঁহার সুললিত কণ্ঠের সংগীত পরমহংসদেব বড়ই আদর করিতেন। অবশেষে শ্মশানে তাঁহার পবিত্র দেহের পার্শ্বে বসিয়াও তাই ত্রৈলোক্যনাথকে সংগীত করিতে হইল।” হয়তো বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আগে ব্যক্তি ত্রৈলোক্যনাথের এটাই পরম প্রাপ্তি।
তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি অব দ্য ব্রাহ্ম সমাজ (ভল্যুম ওয়ান): শিবনাথ শাস্ত্রী, ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: বারিদবরণ ঘোষ, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (শ্রীম কথিত), ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ: ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সংস্পর্শে: নির্মলকুমার রায়, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গীত: সম্পাদক স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি: সম্পাদক স্বামী চেতনানন্দ