ভূগর্ভপথ: গঙ্গার নীচ দিয়ে হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত মেট্রো রেলের রাস্তা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
সম্প্রতি কলকাতায় গঙ্গার প্রায় ৩৩ মিটার নীচের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত ভারতে মেট্রোর প্রথম ট্রায়াল রান সম্পূর্ণ হল। আর সেই বিচারে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো ইতিহাসও গড়ল। সংবাদটি আমাদের কাছে শুধু আনন্দেরই নয়, গর্বেরও বটে।
অনেকেরই হয়তো মনে নেই, এখন থেকে ৯২ বছর আগে, কলকাতায় গঙ্গার নীচ দিয়ে এক সুড়ঙ্গপথ চালু হয়েছিল। ১৯৩১ সালে তৈরি, কলকাতার গঙ্গার নীচ দিয়ে সেটাই প্রথম সুড়ঙ্গপথ। শুধু কলকাতা নয়, এটি ছিল এশিয়ার প্রথম নদীগর্ভের সুড়ঙ্গপথ। তারও আগে, ১৯১৯ সালে কলকাতায় গঙ্গার নীচ দিয়ে লন্ডনের টিউব রেল বা মেট্রো রেল চালু করার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। সে কথা আগে বলে নেওয়া যাক।
১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সিমলায় ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল-এর অধিবেশন চলছে। সেখানে স্যর ডব্লিউ ই ক্রাম-এর অধীনে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতে ১৪টি বৈঠকের পর কলকাতার জন্য মেট্রো রেল চালু করার সুপারিশ করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, তখনকার মেট্রোর লাইনের পথ আর আজকের মেট্রোর লাইনের পথ কি একই ছিল?
না। এখনকার মেট্রোর লাইনের পথ সম্পর্কে সকলেই জানি। কিন্তু তখনকার মেট্রোর লাইনটি পূর্ব কলকাতার বাগমারি থেকে গঙ্গার নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গপথে হাওড়ার সালকিয়া বেনারস রোড পর্যন্ত প্রায় ১০.৪ কিমি দূরত্ব পর্যন্ত ভাবা হয়, বর্তমানের পথ থেকে প্রায় ৪ কিমি কম। সেই কাজটি ১৯২১ সালে শুরু করে ১৯২৫-২৬ সালের মধ্যে মোটামুটি সাড়ে চার বছরে শেষ করার কথাও হয়। তার জন্য খরচ বাবদ ৩৫ লাখ ২৬ হাজার ১৫৪ পাউন্ড ধার্য করা হয়েছিল।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেট্রোর ভাড়া বাবদও তিন আনা পয়সা ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু শেষে তহবিলের ঘাটতি এবং অন্যান্য কয়েকটি প্রযুক্তিগত কারণে প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার লন্ডন টিউব রেলের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার হার্লে হিউ ডালরিম্পল-এর লেখা ‘ক্যালকাটা টিউব রেলওয়েজ়’ বইটিতে এই প্রসঙ্গে বিশদ বিবরণ আছে।
এর কয়েক বছর পর, বিশেষ প্রয়োজনে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে কলকাতায় গঙ্গার নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গপথ তৈরির পরিকল্পনা করেন। এটিই কলকাতায় গঙ্গার নীচ দিয়ে তৈরি প্রথম সুড়ঙ্গপথ। কিন্তু এই সুড়ঙ্গপথ জনগণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য তৈরি হয়নি। ১৯২৯ সালের ৬ ডিসেম্বর কলকাতায় গঙ্গার প্রায় ৯০ ফুট নীচ দিয়ে হাওড়ার বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৩১ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ প্রায় আঠেরো মাস পর কাজটি শেষ হয়।
বর্তমানে গঙ্গার মাটির নীচ দিয়ে মেট্রোর ট্রায়াল শুরু হলেও, ১৯৮৪ সালে কলকাতায় প্রথম মেট্রোর কাজ চালু হয়। আর সেই সময়ে চালু হওয়া কলকাতার মেট্রো ও গঙ্গার নীচের প্রথম সুড়ঙ্গপথ প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থ ঘোষের ‘কলের শহর কলকাতা’ বইতে পাই— মেট্রো রেলপথ চালু হওয়া ইস্তক কলকাতার অহঙ্কার। ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের এক বিস্ময় হিসাবেই তার বেশি আকর্ষণ। কিন্তু নির্মাণকৌশলের বিচারে এর চেয়ে অনেক জটিল ও শ্রমসাধ্য আর একটা সুড়ঙ্গ ষাট বছর ধরে (বর্তমানে প্রায় বিরানব্বই বছর) এই কলকাতাতেই আছে সাধারণের চোখের আড়ালে। সুড়ঙ্গটি বিস্তারিত হয়েছে হুগলি নদীর তলা দিয়ে। ১৯২৯ সালে ইলেকট্রিকের তার টানার জন্য সিইএসসি এই সুড়ঙ্গপথ তৈরি করে। এর এক প্রান্তে কলকাতার সাদার্ন জেনারেটিং স্টেশন ও অন্য প্রান্তে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন। ৬ ফুট ব্যাসের প্রায় ৬০০ গজ লম্বা সুড়ঙ্গটি মাটির প্রায় নব্বই ফুট নীচে চুড়ির মতো ঢালাই লোহার অসংখ্য রিং পর পর জুড়ে তৈরি। কয়লাখনির গহ্বরে নামার মতোই খাঁচায় চড়ে সুড়ঙ্গে নামতে ও উঠতে হয়।
আসলে কলকাতা ও হাওড়ায় দিন দিন উন্নতির পাশাপাশি বিদ্যুৎ-চাহিদা বাড়তে থাকে। কলকাতায় সিইএসসি পরিচালিত বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে বিদ্যুতের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে, গঙ্গার নীচ দিয়ে এবং এত কষ্ট করেই বা কেন এই সুড়ঙ্গপথ করা হল?
১৮৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ, যা পরে সুভাষ সমাজদার মহাশয়ের ‘কলকাতা কলহকথা’ বইয়ে পাই তা হল, ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির এজেন্ট মেসার্স কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানিকে টাউন কলকাতার বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক লক্ষ স্টার্লিং পাউন্ড খরচ করে বিদ্যুৎবাহী নল বসানো হয়েছিল, যাতে সাধারণ ভাবে ৬০,০০০ ল্যাম্প এবং প্রয়োজন হলে ২,০০,০০০ ল্যাম্প জ্বালানো যায়। এতে কলকাতার বিভিন্ন অংশে সারা দিন ও রাতে চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুতের সরবরাহ অব্যাহত থাকবে এবং গ্রীষ্মের গরমে পাখাও চালানো যাবে। দিনে এবং রাতে সেই পাখার জন্য বিদ্যুতের খরচ, পাংখাপুলার বা টানা পাখার বেয়ারাদের খরচের চেয়ে কম পড়বে। কলকাতায় সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল ১৯১১ সালে। আবার গার্ডেন রিচে ডক তৈরি হলে দক্ষিণ কলকাতায় বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯২৬ সালে কোম্পানি ১৫০ মেগাওয়াট হাইটেনশন পাওয়ার স্টেশন বসিয়ে স্থির করে, হাওড়ায় আর একটা হাই ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি না করে হুগলি নদীর দক্ষিণ তীর (মেটিয়াবুরুজ) থেকে উপর দিয়ে তার টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।
গঙ্গার উপর দিয়ে ইলেকট্রিক তার টেনে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয়! গঙ্গায় তখন প্রতি দিন অসংখ্য বড় বড় জাহাজ আকাশছোঁয়া মাস্তুল উঁচিয়ে চলাফেরা করে। তখন কোম্পানির লন্ডনের বড়কর্তারা হুকুম দিলেন, নদীর তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নেওয়ার। ইংরেজ সরকার পত্রপাঠ অনুমতি দিল এবং ১৯২৯ সালের ৬ ডিসেম্বর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শুরু হল। কলকাতায় গঙ্গার নীচ দিয়ে প্রথম সুড়ঙ্গপথের সুন্দর বর্ণনা ব্রেন পল বাক-এর লেখা ‘ক্যালকাটা’জ় এডিফিস’-এর বইয়ের ‘দ্য হাই টেনশন ইলেকট্রিক সাপ্লাই টানেল’ অংশে এর বিবরণ পাওয়া গিয়েছে। লেখা আছে, “এক অদ্ভুত ও অজানা পথ জেনারেটিং স্টেশনের উত্তর থেকে শুরু করে হুগলি নদীর নীচ দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুরনো জলের ফটকের ঠিক পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছে। এটি ১৯২৯-৩১ সালের মধ্যে ইলেকট্রিক তার সরবরাহের জন্য তৈরি। পথটি ৬২৮ মিটার দীর্ঘ, ২ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট এবং হুগলি নদীর জলের উপরিভাগ থেকে ২৭ মিটার নীচ দিয়ে গেছে। এটি তৈরির পিছনে বেশ নাটকীয় ঘটনা থাকলেও খুবই অল্প সংখ্যক জনগণ এটির কথা জানেন। এই সুড়ঙ্গের বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রান্তে প্রবেশঘরটি খুবই সুন্দর। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ওর ভিতরকার পেঁচানো পথ দিয়ে গঙ্গার ২৭ মিটার নীচে নেমে যেতে পারবেন।”
হুগলি নদীপথে নৌ-চলাচলের ফলে যাতে জাহাজগুলো ওই পথে না চলে আসে, তার জন্য এক বিরাট আকারের চেন দিয়ে ঘিরে রাখা হত। তবে আঠেরো মাসের মধ্যে এই সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। আঠেরো মাসের মধ্যে প্রথম চার মাস গর্ত খুঁড়তেই সময় চলে যায়। তার পর সুড়ঙ্গের কাজ শুরু হয়। আজকের মতো উন্নতমানের যন্ত্রপাতি না থাকার ফলে এই কাজের জন্য পঞ্জাব থেকে শক্তসমর্থ শ্রমিকদের আনা হয়েছিল।
এই সুন্দর কাজের মধ্যেও দুঃখের ঘটনা জড়িয়ে আছে। নদীগর্ভে সুড়ঙ্গের কাজের সময় দু’জন ভারতীয় শ্রমিক ও এক জন ইংরেজ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা এই কাজ শেষ হওয়ার পর এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, আবার লন্ডন টিউবের মতো ডালহৌসি থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত একটা মেট্রো লাইন তৈরি করার পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। সেটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, শেষে কলকাতায় গঙ্গার নীচে সুড়ঙ্গপথে মেট্রো চলাচল শুরু হয়েছে। কলকাতায় গঙ্গার নীচে দু’টি সুড়ঙ্গপথই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল।