ঘরছাড়া: সত্যাজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ছবিতে সদ্য শহরে আসা অপু। ছবি: সংগৃহীত।
ছেলে কলকাতায় পড়তে যাবে। শুনেই মায়ের কান্না। বাবার হাত ধরে কলকাতায় এল ছেলে। ওই বছরই সতীদাহ রদ আইন পাশ হবে। এশিয়াটিক সোসাইটির দরজা খুলে যাবে দেশের মানুষের জন্য। এমন আবহে বড়বাজারের বাসায় উঠল ছোট্ট ছেলেটি। প্রতিদিন থালা-বাসন মাজে, রান্নাঘর ঝাড়পোঁছ করে। কোনও-কোনও দিন খাবারও জোটে না। কিন্তু বেলা ন’টা বাজলেই ছাতা মাথায় কলেজ, সংস্কৃত কলেজে যাওয়ায় খামতি নেই। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। বন্ধুরা এ জন্য মাঝেমধ্যে ওকে ‘ঢিপলে’ বলে।
কিন্তু ওই ঢিপলেরই ক্লাসে অন্য রূপ। কত বৃত্তি পায়। কত শাস্ত্রে দড় হয়। পরবর্তী জীবনে এই কলকাতা শহরই হল মেদিনীপুরের বীরসিংহ থেকে আসা ছেলেটির কর্মভূমি। গল্পটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। ১৮২৯-এ ছোট্ট বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কলকাতায় আসছেন, গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিত কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় আশীর্বাদ করলেন, ‘বেঁচে থাকলে ও মানুষের মতো মানুষ হবে।’ আর ঠাকুরদাসের ইচ্ছে, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে পণ্ডিত হয়ে ঈশ্বর দেশে ফিরে একটি টোল চালু করুন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবনকে নারী-শিক্ষা, বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের সূত্রে ধরে অন্য খাতে বওয়াল এই মহানগর।
বস্তুত গ্রাম, মফস্সল থেকে কলকাতায় পড়তে আসার ফলশ্রুতিতে নজরে পড়ে দু’টি বিষয়— এক, যিনি আসছেন, তাঁর ধ্যানধারণা, কর্মকাণ্ডে বদল ঘটছে। আর সে সূত্রে বদলের ছোঁয়া, নিদেনপক্ষে নগরকেন্দ্রিক আলোচনা শুরু হচ্ছে গ্রাম, মফস্সলের জীবন ও চিন্তায়। পাশাপাশি, যিনি শহরে পড়তে আসছেন, তাঁর সঙ্গে অনেক সময়েই মহানাগরিক সংস্কৃতির একটি সংঘাত তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে লগ্ন থাকছে নগর-জীবন নিয়ে এক অপার বিস্ময়। দুই, একটি নতুন জীবনকে আবাহন করছে ব্যক্তি মানুষ। সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের জীবনে এই দু’টি বিষয়েরই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে বার বার।
*****
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’। কলকাতা ও এই নারীশিক্ষার সূত্রে এটিকে দেখা যায়। ‘বন্য প্রদেশ’ কুসুমঘাটী গ্রাম। ক্ষেত্র বা খেতু চরিত্রটিকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে লেখাপড়া করাতে চান আত্মীয় রামহরি। তা-ই হল। খেতুর মা বৈধব্য-যন্ত্রণা ভোগ করছেন। ছেলে কলকাতায় যাবে ভেবে দুশ্চিন্তা। কিন্তু ছেলেকে বলছেন, “না পড়িলে শুনিলে মূর্খ হয়, মূর্খকে কেহ ভালবাসে না...।” অর্থাৎ উনিশ শতকের অন্তিম-লগ্নেই ওই ‘মানুষ হওয়ার’ নেপথ্যে আর একটি কারণ যোগ হচ্ছে। সেটি হল, সামাজিক মর্যাদা। কিন্তু গ্রামের সমাজে কলকাতাকে নিয়ে নানা আশঙ্কাও আছে। গ্রামেরই ষাঁড়েশ্বর যে কলকাতা গিয়ে মদ গেলা, অখাদ্য মাংস খাওয়া ধরেছে।
তবুও খেতু কলকাতায় যায়। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় গ্রামে নারীশিক্ষার পদধ্বনি। খেতু ছুটিতে এসে কঙ্কাবতীর হাতে তুলে দেয় বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। শহর থেকে পাঠাতে থাকে পাটিগণিত, বইপত্র, খবরের কাগজ। আবার বিদ্যাসাগরের আন্দোলনও যে কলকাতা ছাড়িয়ে গ্রামে পৌঁছচ্ছে, তা-ও দেখা যায় তনু রায়ের স্ত্রীর কথায়। খেতুর মা’কে সে বলে, “এক এক বার মনে হয় যে, যদি বিদ্যাসাগরী মতটা চলে...”। যদিও, স্বামীহীনার বিয়ে বিষয়টি নিয়ে খেতুর মায়ের মনে তখনও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই এটিকে ‘ছি ছি’-ই বলছে।
এই ‘ছি ছি’র অন্য অনুরণন অন্য ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চতুরঙ্গ’-তেও। শ্রীবিলাস ‘পাড়াগাঁ’ থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছে। শচীশের সঙ্গে আলাপ। বিএ ক্লাসে পড়ছে। শচীশ সম্পর্কে শ্রীবিলাসের ধারণায় শুরুতেই ধাক্কাটি লাগল। শচীশ নাস্তিক হতেই পারে না, এই মর্মে শ্রীবিলাস ঝগড়া করেছিল মেসে। কিন্তু শচীশ জানাল, সে নাস্তিক। পাশাপাশি, শ্রীবিলাস মনে করেছে শচীশ ব্রাহ্মণ। কিন্তু জানল সে ‘সোনার-বেনে’। এর পরেই কলেজ ছাত্র শ্রীবিলাস নিজের নিষ্ঠাবান কায়স্থ পরিচয়কে সামনে এনে ফিরে যাচ্ছে আজন্ম-লালিত বিশ্বাসে: “জাতি হিসাবে সোনার-বেনেকে অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করিয়া থাকি। আর, নাস্তিককে নরঘাতকের চেয়ে, এমন-কি, গো-খাদকের চেয়েও পাপিষ্ঠ বলিয়া জানিতাম।” আবার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নাগরিক শিক্ষা বাড়ির ধ্যানধারণা-সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে অনেক সময়। ‘নৌকাডুবি’। সেখানে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতী’র অকুণ্ঠ আশীর্বাদধন্য রমেশকে বাবা ব্রজমোহন আচমকা ‘দেশে’ ডেকে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে রমেশ শুনল, তার বিয়ে। কিন্তু রমেশ তার পূর্ব-প্রণয়ানুভূতির কথা সঙ্কোচের সঙ্গে হলেও বাবাকে জানাচ্ছে।
সময় আর একটু গড়ালে দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় পড়তে আসা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ অপুর মধ্যে এক দিকে এই মহানগর নিয়ে তীব্র বিস্ময়, অন্য দিকে নাগরিক সংঘাত যৌথ ভাবে কাজ করছে। প্রথমে বিস্ময়ের প্রসঙ্গ। অপুর কলকাতা-যাত্রার প্রস্তুতিতে থাকে একটি আকাঙ্ক্ষা। থাকে সামাজিক মর্যাদালাভের ইচ্ছাও: “কলেজে পড়িলে মানুষ বিদ্যার জাহাজ হয়। সবাই বলিবে কলেজের ছেলে।” অপুর টিনের তোরঙ্গের ভিতরে থাকে ঝাপসা হয়ে যাওয়া কলকাতার নকশা।
অর্থাৎ কলকাতায় পড়তে আসা নিয়ে একটা ‘মোহ’ দেখা যাচ্ছে অপু বা বিংশ শতকের তরুণদের মধ্যে। সেই মোহ বিস্ময়ে পরিণত হচ্ছে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেরিয়েই। কল্পনার রঙের সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে অপু ট্রামগাড়ি, মোটরগাড়ি চেনে। ইচ্ছে হয় জাদুঘর, বায়োস্কোপ দেখার। আর পড়াশোনা? প্রেসিডেন্সি দূর গ্রহের। মেট্রোপলিটন বা সিটি নয়, রিপন কলেজে ভর্তি হল। অর্থাৎ শিক্ষাগ্রহণের স্থানটির অনেকগুলি বিকল্প সাজিয়ে রেখেছে এই কলকাতা। প্রথম দিন কলেজে গিয়েই অপুর কী আনন্দ, বিজলিতে পাখা ঘুরছে!
এই অপুই আবার সুরেশের শহুরে গলার সুর আর উচ্চারণ শুনে ভয় পায়। অথচ, দু’জনেরই ভাষা বাংলা। এখান থেকেই কি তার মধ্যে বর্তমান ছাত্রজীবন ও ফেলে আসা জীবনের মধ্যে ভাষাগত সংঘাত ঘটছে? একটি ভিনদেশি লেখার উল্লেখ করা যায়। জেমস জয়েসের উপন্যাস। আলো জ্বালানোর কায়দা কেমন, তা নিয়ে ডিন অব স্টাডিজ়ের সঙ্গে কথা বলছে স্টিফেন। ইংরেজ মাস্টারমশাই বদলি হয়ে এসেছেন ডাবলিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইরিশ ছাত্রের মুখে একটা শব্দ শুনে চমকে গেলেন, ‘টান্ডিশ’। ফানেলের মতো একটা জিনিস, যা দিয়ে ল্যাম্পে তেল ভরা যায়। মাস্টারমশাই শব্দটি আগে কখনও শোনেননি।
‘তোমাদের’ আয়ারল্যান্ডে এমনটা বলে বুঝি? ছাত্র স্টিফেনের মনখারাপ এবং ছাত্র অপুর ভয় পাওয়া— দু’টি কি এক সূত্রে গাঁথা?
বিষয়টি একটু অন্য ভাবে ধরা পড়েছে কবি শঙ্খ ঘোষের চোখে। ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ: গ্রাম থেকে উঠে আসা সদ্য যুবকেরা পড়তে আসছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘জাঁকজমকের শহরকেন্দ্রে’। কিন্তু এই যুবকদের সঙ্গে নাগরিক সংস্কৃতির দূরত্ব, সেটিকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, কখনও আবার ‘আধোজানা সংস্কৃতির সংঘর্ষে’ উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ার চিত্রটি আঁকছেন শঙ্খ। আঁকতে গিয়ে উঠে আসছে শান্তিনিকেতনে একটি ছাত্রের কথা। যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন ২৫ বৈশাখ। আর বাবার উদ্দেশে চিরকুটে বলে গিয়েছেন, ‘...ভুল করে যেন ভাইকেও’ এখানে না পাঠানো হয়।
*****
এ বার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। অর্থাৎ নতুন জীবনে ডুব দেওয়ার কথায়। বিহার থেকে পড়তে এসেছিলেন তিনি। সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। পড়ছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। থাকেন বোর্ডিংয়ে। সঙ্গী তিন জন। সে ঘরে উঁকি দিলে, বাড়ির আরাম ও ধারণার বিপ্রতীপে একটি যৌথ জীবনের গল্প দেখা যায়।
তিনটি তক্তপোশ। তলায় কয়েকটি হাঁড়ি। সেখানে ফর্মালিনে চোবানো ‘মানুষের মগজ, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড প্রভৃতি’! কলেজ থেকেই আনা। পড়াশোনার নিমিত্ত! সেখানে দেখা যায়, এক দিকে শতরঞ্চিতে বসে মানুষের ফুসফুস কাটা চলছে। অন্য দিকে প্রেশার কুকারে রান্না হচ্ছে! যাঁকে নিয়ে কথা, তিনি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল। তবে শুধু যৌথ জীবন নয়, নাগরিক ক্লেদের সঙ্গেও এই ছাত্রজীবনেই পরিচয় ঘটল বনফুলের। এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ওঁর বেশ ভাব জমেছে। বনফুল বললেন, “ইংরেজের যতই দোষ থাকুক তারা দুষ্টের শাসন করে।” সেই অফিসার বললেন, “হ্যাঁ গরিব দুষ্টদের।” প্রমাণও দিলেন অফিসার। দেখালেন প্যাকিং বাক্স। তাতে অপহৃতা এক নারী, অজ্ঞান অবস্থায়। দেশীয় মহারাজার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে মেয়েটিকে। বনফুল ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন ‘জঙ্গম’-এ।
ডাক্তারি পড়তেন বিমল করও। পড়তে এলেন আর জি কর (তখন নাম কারমাইকেল) মেডিক্যাল কলেজে। গায়ে মফস্সলের গন্ধ। ধানবাদ, হাজারিবাগ, কুলটি, আসানসোল, ডিসেরগড়, কালীপাহাড়ি, কুলটি...। কলকাতাকে মনে হল ‘স্বপ্নের রাজ্য’। তবে ডাক্তারির ক্লাসে নয়। বরং গ্রেটা গার্বো, ক্লোদেত কোলবার্ট, মার্লিন ডিয়েট্রিচের ছবি দেখতে, টকি শো হাউসেই বেশি দেখা যেত বিমলকে। দেখলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, রাণীবালার মঞ্চাভিনয়। হাতে এল জীবনানন্দ দাশ থেকে আনাতোল ফ্রাঁস, এজ়রা পাউন্ড, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ থেকে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’। ডাক্তারি আর পড়া হল না, বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করলেন বিমল।
ইতিমধ্যে এল সেই দিনটা— ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮। মহানগর সে দিন উথালপাথাল। রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত। কবি ভেসে চললেন জনতার শোভাযাত্রায়। সে সমুদ্রের তরঙ্গে যেন ভেসে যাচ্ছে হাজারীবাগ, আসানসোল, কুলটি। বিমলও সে শোভাযাত্রার অঙ্গ। চশমা ভাঙল। চটিজোড়াও গেল ছিঁড়ে। ‘অনাথ বালকের’ মতো শহরের অলিগলি ঘুরে ফিরলেন। শুনলেন, “ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি/ চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে...।” আবার এই বিমলই প্রত্যক্ষ করছেন বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাগরিক জীবন। দেখছেন ’৪৩-এর নিরন্ন, নগ্ন, আবর্জনার স্তূপে কাতরাতে থাকা কলকাতাকে।
এই শহরেই পড়তে এসেছিলেন রমাপদ চৌধুরীও। ‘মিশ্র সংস্কৃতি’র খড়্গপুর থেকে। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির ছাত্র। কলেজ, হিন্দু হস্টেল, কলেজ স্ট্রিট জাদুর ঝাঁপি উজাড় করে দিল রমাপদকে। কলেজ জীবনে এসে শিখলেন নতুন একটি শব্দ। কলেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। দেখলেন লেখা ‘BURSAR’। বারসার মানে ক্যাশিয়ার বা হিসাবরক্ষক। শিখলেন ক্লাসে ‘প্রক্সি’ দেওয়া। শিখলেন কলেজ ফাঁকি দিয়ে মেট্রো, লাইটহাউস, এলিটে সিনেমা দেখতে যাওয়া। কামড় দিলেন অনাদি কেবিনের মোগলাইয়ে। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার সূত্রেই রমাপদ হিন্দু হস্টেলের খাবার ঘরে দেখলেন একটি জিনিস। সে ঘরের মাথায় লেখা, ‘For Bramhins Only’! মহানগরের গত জনমের স্মৃতি!
কিন্তু এ সবের মধ্যেও কোথাও একটা মূল্যবোধের শিক্ষা আর আস্থা হারানোর আশঙ্কা কাজ করে ছাত্রজীবনে। এক দিন শীতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন রমাপদ। হঠাৎ খড়্গপুর থেকে এলেন ওঁর বাবা। ছেলেকে কিনে দিলেন কাশ্মীরি আলোয়ান। সেটি চুরি হয়ে যায়। ধার করে প্রায় সে রকমই একটি শাল কিনলেন রমাপদ। কিন্তু ঘটনাটার কথা বাবাকে কোনও দিন বলতে পারেননি রমাপদ। কেন? রমাপদর উত্তর, “আত্মসম্মান? অথবা আমার ওপর বাবার আস্থা হারানোর ভয়ে?”
আসলে এ ভাবেই মূল্যবোধ টেনে বেঁধে রাখে নগরজীবন এবং তার আত্মীয় গ্রাম, মফস্সলকে। সমরেশ মজুমদার। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় পড়তে আসবেন। ওঁর মাস্টারমশাই বললেন, “...বাবা এই জন্মস্থানটাকে কখনও ভুলিস না।” সমরেশ ভোলেননি। স্কটিশ চার্চ ও লাগোয়া এলাকার বাম-রাজনীতির অলিগলি, অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন, ‘মহেশ্বর দাসের হস্টেলে’ থাকা, ‘এই আমি রেণু’ বলে প্রেমের বাহুডোরে জড়িয়ে থাকা এ সবই ছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গও তাঁর মধ্যে নাগরিক ভাবে ধরা দেয়। আসে ‘কালবেলা’র অনিমেষও।
*****
মহানগরে দূর থেকে আসা প্রতিটি ছাত্রই আসলে একা, বিচ্ছিন্ন। অনেক সময়ে তাই তাঁদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় স্ব-ভূমির মানুষের সংস্পর্শ। আচার্য সুকুমার সেনের জীবনে এমন একটি ঘটনা আছে। বিদ্যার হর্ম্যপ্রাসাদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে রাখা ‘কৌস্তুভ মণি’। জার্মান দেশের প্রকাণ্ড পণ্ডিত রিচার্ড পিশেলের যাবতীয় বইপত্র ও পুস্তিকার সংগ্রহ সেটি। সেখানে শিক্ষক আর গবেষক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু ছাত্র সুকুমারকে গ্রন্থাগারিক বসন্তবিহারী চন্দ্রের ঘরে সংগ্রহটি নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। কী ভাবে? সুকুমার নিজেই জানাচ্ছেন, গ্রন্থাগারিক তাঁকে একটু ‘বিশেষ অনুগ্রহ’ করতেন। কারণটা কি সুকুমার বর্ধমানের গোতান এবং বসন্তবিহারী কাটোয়ার মানুষ বলে?
শুধু স্থান-গুরুত্ব নয়, অনেক সময় সমমনের দু’টি মানুষের বন্ধুতার বিস্তৃতি ঘটায় কলকাতার শিক্ষা-প্রাঙ্গণ। গল্পটা পরবর্তী জীবনের সাহিত্যের দুই ডাকসাইটে মাস্টারমশাইয়ের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা এমএ-র ক্লাস। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এসেছেন সুধীর চক্রবর্তী। একটি ছাত্রকে নিয়ে সবারই খুব কৌতূহল। তার উপরে প্রমথনাথ বিশী রোলকল করার সময়ে, বিশেষ ভাবে ছেলেটির দিকে নজর দিয়েছেন। ক্লাসের ফাঁকেই সেই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন সুধীর। বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।’ ছাত্রটির জবাব, ‘আপনি-আজ্ঞে কেন?’ সুধীর নেমে এলেন তুমিতে। না তা-ও চলবে না। অগত্যা তুই। এবং দুই ‘তুইতে’ মিলে সোজা ক্যান্টিন। সামনে এল দু’প্লেট পুরি-কারি। সুধীরের সেই বন্ধুর নাম শিশিরকুমার দাশ।
বস্তুত, আমাদের, দূর-দূরান্তের ছেলেমেয়েদের এই শহরে পড়তে আসার কেন্দ্রে থাকে কলকাতা। কারণটা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’য় শিবনাথ যেন স্পষ্ট করে দিচ্ছে। কলকাতা সম্পর্কে বলছে, “...দেশের যেন হৃৎপিণ্ড এটা; সমস্ত রক্তস্রোতের কেন্দ্রস্থল।”— এই স্রোতে ভাসতে-ভাসতেই মহানগরের বিদ্যামঠতলে আমাদের আসতে থাকা।