যূথবদ্ধ: জঙ্গলের সবুজ চিরে চলে যাচ্ছে বুনো হাতির একটি দল। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক
নদীটার শরীরে কি এতটুকু মায়া নেই! নদী পেরোতে গিয়ে একটি শিশু কাদায় আটকে গিয়েছে। আর নিষ্ঠুর নদী প্রবল বেগে বয়েই চলেছে। স্রোতের এতটুকু বিরাম নেই। বর্ষার ভরা তিস্তা, তোমার কি মন নাই? কতই বা বয়স হবে শিশুটির, মাস তিন বা চারেক! ছোট্ট হস্তিকন্যাটি গজলডোবা ব্যারাজের কাছে তিস্তা নদীতে কাদায় গেঁথে রয়েছে। প্রাণভয়ে শুঁড় তুলে কাদের ডাকছে? কে কে ছিল ওর সঙ্গে? নদীতে আটকে পড়া ছোট্ট মেয়েটিকে রেখে ওরা নিজেদের মতো চলে যেতে পারল! মা ছাড়া অন্য কাউকে চেনার বয়সটুকুও ওর হয়নি। মা কি টেরই পায়নি একরত্তি মেয়েটা হারিয়ে গেছে! তত ক্ষণে খবর গিয়েছে বন দফতরে। বনকর্মীরা এসে নদী থেকে টেনে তুলেছে হস্তিকন্যাকে। তিস্তা নদী থেকে পাওয়া হস্তিকন্যার নামও রাখা হল নদীর নামেই, তিস্তা।
গরুমারার পিলখানায় কেটে আনা কচি সবুজ ঘাস আছে, দুধ আছে, প্রোটিন পাউডার আছে। কিন্তু তিস্তার মা নেই। বালতিভরা দুধ দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেয় তিস্তা, কচি ঘাসে শুঁড়ই ছোঁয়ায় না। চার পাশের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকে, যদি গামারি গাছের আড়াল করা রাস্তা থেকে হঠাৎ মা বেরিয়ে আসে, দূরের মূর্তি নদীর পাশে রাখা সরকারি নুন খেতে এসে যদি মা তার গন্ধ পায়। কিন্তু এ সবের কিছুই হয় না। তিস্তার খোঁজ নিতে মা আসে না। পেটে খাবার নেই, মনে ফুর্তি নেই, প্রাণে কোনও ইচ্ছে নেই, মেয়েটা বাঁচবে তো! তখন ডাক পড়ে শীলাবতীর। শীলাবতীর কোনও সন্তান নেই। তিস্তার পিঠে শুঁড় বুলিয়ে দেয় শীলাবতী। আদর পেয়ে শীলাবতীর চার পায়ের নীচে জড়সড় হয়ে ঢুকে পড়ে তিস্তা। শুঁড় দিয়ে খুঁজে চলে মাতৃস্নেহ, মাতৃস্তন্য। কিন্তু শীলাবতী মা নয়। বনকর্মীরা যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তিস্তা যখন শুঁড় দিয়ে মায়ের স্নেহের বিন্দু শুষে নিতে চাইছে, তখনই আড়াল থেকে তিস্তার মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পাইপ। যে পাইপের আর একটা মুখ তৈরি করা পুষ্টিকর দুধ-ভরা বালতিতে ডোবানো। পিপাসায় আকুল তিস্তা শীলাবতীর বুকে যত বার মুখ রেখেছে, তত বারই পেয়েছে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে আসা তৈরি করা দুধ। সেই দুধে তিস্তার শরীর পুষ্টি পেয়েছে। তার পর থেকে শীলাবতী আর তিস্তাকে ছাড়েনি। তিস্তা দস্যি হয়েছে, বৃষ্টি নামলে পিলখানার উঠোনে প্রজাপতির পিছু ধাওয়া করেছে, শুঁড়ে জল নিয়ে পিলখানার অন্য কুনকি হাতিদের গায়ে ছিটিয়ে পালিয়ে এসেছে। তিস্তা এখন বড় হয়েছে। কুনকি হাতির প্রশিক্ষণ নিয়েছে। বনকর্মীরা বলেন, যেমন মা তেমন বেটি। শীলাবতী বন দফতরের প্রিয় কুনকি। দামাল বুনো হাতি তাড়াতে তার খুব নামডাক। তিস্তাও তেমনিই। তাই প্রিয় তিস্তাকে ঘটা করে জঙ্গলের নিয়মে বিয়েও দেওয়া হয়েছে। কদিন আগেই তিস্তা মা হয়েছে। শীলাবতী দূর থেকে দাঁড়িয়ে এখন দেখে, কী যত্নে তিস্তা স্তন্যপান করাচ্ছে তার ছোট্ট মেয়েটিকে।
শ্রাবণের রোদে জঙ্গল তেতে ওঠে। বিকেলের পরে আরও গরম। তখন জঙ্গলের ভেতরে টেকাই দায়। বৃষ্টিতেও স্বস্তি নেই। পাতা থেকে গড়ানো টুপটাপ বৃষ্টিবিন্দু গায়ে পড়বে। তা বুনোদের খুব একটা পছন্দ নয়। বর্ষাকালে তাই হাতি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। সে দিনও এসেছিল। প্রায় পনেরো বছর আগে। তখন ধূপঝোরায় সদ্য গাছবাড়ি তৈরি হয়েছে। পর্যটকরা থাকতে আসছেন। সন্ধেয় আদিবাসী নাচ-গানের অনুষ্ঠান, ধামসা-মাদল। সেই গান শোনার নেশা ধরে গিয়েছিল আবুল হোসেনের। কে আবুল হোসেন? গোটা ধূপঝোরার বনবস্তির বাসিন্দারা এক ডাকে চেনেন আবুল হোসেনকে। তখন অবশ্য চিনতেন না। সেই সন্ধের পর চিনেছে। সেই সন্ধে, যে দিন একটা দাঁতাল বুনো হাতি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল ধূপঝোরার লোকালয়ের রাস্তায়। যে রাস্তা দিয়ে আবুল হোসেন চলেছিলেন গান শুনতে। হঠাৎ সামনে বুনো হাতি।
আশপাশের সকলে ভেবেছিলেন, এই বুঝি আবুলের প্রাণ গেল। অনেকে বলেন, হাতি সামনে মানুষ দেখলে নাকি খেপে যায়। আবুলও হোসেনও এক খেপা, তাঁর সুরের নেশা। তিনি পালাননি। বুনো হাতির সামনে গড় করে বলেছিলেন, “এই মহাকাল, তুই মোক মারিস না। সরি যা।”
বুনো হাতি কি মানুষের ভাষা বোঝে, না কি মিনতি বোঝে! হাতিটি সে দিন রাস্তা থেকে নেমে উল্টো পথে হেঁটে জঙ্গলে ফিরে যায়। তার পর যত দিন বেঁচে ছিলেন আবুল হোসেন, এলাকায় বীরের সম্মান পেয়েছেন। আবুল সবাইকে বলতেন, “এই যে আমি বেঁচে আছি, এটা কিন্তু আমার না, মহাকালের ফেরানো প্রাণ।”
জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের হিন্দু হোক বা মুসলমান, কবিরাজ হোক বা রাজমিস্ত্রি সকলের কাছেই, হাতি মানে মহাকাল। সন্ধের পরে কেউ কেউ আবার মহাকাল শব্দটিও মুখে আনেন না, বলেন, “নাম নেব না, নিলেই ঠাকুর আসবে।” এতই আতঙ্ক যে কোলের শিশুকে ফেলে রেখে মা পালিয়ে যায়। আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটের সুভাষপল্লি এমন একটি ঘটনা জানে। ঘটনাটি ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে কোনও এক সময়ের। ধান কাটা হয়ে গেছে, গ্রামে গ্রামে গোলা ভরা ধান। যাদের গোলা নেই, তাদের শোয়ার ঘরেই বস্তা ভরা ধান। পাকা ধান খেতে রাতে গ্রামে ঢুকেছে হাতির দল। একটি বুনো বেড়া ভেঙে এসে হাজির এক বাড়িতে। মধ্যরাতে হুড়মুড়িয়ে হাতি ঢুকে পড়েছে, টের পেয়েই শুয়ে থাকা মহিলা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালিয়ে যান। তাঁর শিশুকন্যা যে পাশে শুয়ে ছিল সে খেয়ালটুকুও নেই। বেড়া ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে পাশে মাকে না পেয়ে কান্না জুড়ে দেয় শিশুটি। হাতিটি এগিয়ে যায় শিশুর দিকে। শুঁড় দিয়ে তুলে নেয় শিশুটিকে। ঘরের বাইরে এসে উঠোনের এক কোণে শিশুটিকে শুইয়ে রেখে হাতি ফিরে যায়। তবে যাওয়ার আগে বাড়িতে থাকা সব ধানটুকু খেয়েছিল বুনো হাতিটি। খবর পেয়ে পরদিন আশপাশের সব গ্রাম ভেঙে পড়েছিল শিশুটিকে দেখতে।
জল-জঙ্গল নিয়ে উত্তরবঙ্গের ঘরকন্নায় একটি টোটকার কথা অনেকেই ছোটবেলায় জেনে যায়। সামনে হঠাৎ হাতি চলে এলে যদি বলা যায়, ‘হাতি তোর পায়ের তলায় কুলের বিচি’ তা হলে নাকি হাতি চলে যায়। অত বড় শরীরটির নীচে ছোট্ট একটি কুলবীজ পড়লেই বা কী হবে, সে সব নিয়ে বালক-বালিকা মন প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু যাঁরা জানার তাঁরা জানেন, হাতির পায়ের তলাতেই তার জীবনকাঠি। সারা শরীরে আঘাত লাগুক, দাপুটে হাতিরা তেমন একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু পায়ে সামান্য ক্ষত হলেই সে কাবু হয়ে পড়ে। সে কারণে হাতি নিজের চলার পথ আগে বুঝে নেয়। জলদাপাড়ার জঙ্গলের তিতি বিট অফিসের সামনে একটি হাতি রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকত। খুঁড়িয়ে হাঁটত। বনকর্মীরা বুঝেছিলেন, হাতিটির পায়ে ক্ষত হয়েছে, সে চিকিৎসা চায়। বিশাল দাঁতাল হাতিটির কাছে গিয়ে বনকর্মীরা গায়ে হাত বোলায়, সে কিচ্ছুটি করে না। চিকিৎসক ডেকে এনে টানা কয়েক দিন ধরে চিকিৎসা করা হয়। সুস্থ হলে হাতিটি জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে যায়।
এ রকমই ঘটনা আছে মালঙ্গি বিটেও। সেখানেও পায়ে ক্ষত থাকা একটি হাতির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন বনকর্মীরা। তার পর মাঝেমধ্যেই ভোরে বা বিকেলে বিট অফিসের সামনে নানা রকমের ফল, গাছের ডাল দেখতে পেতেন বনকর্মীরা। কে রাখে এ সব? বনকর্মীরা তক্কে তক্কে থেকে আড়াল থেকে দেখেন, একটি বুনো হাতি এসে বিট অফিসের সামনে ফল, গাছের ডাল ফেলে যায়। কেউ কেউ চিনতেও পেরেছিলেন তাকে। সেই চিকিৎসাপ্রাপ্ত হাতিটিই। বনের ফল, গাছের ডাল রেখে দিয়ে সে কি চিকিৎসার ঋণ শুধছে? প্রকাশ
করছে কৃতজ্ঞতা?
সেই জলদাপাড়া জঙ্গলের পিলখানার মাহুত দরবেশ। এক বিকেলে মালঙ্গি বিটে বড়কর্তা এসেছেন থাকতে। সেখানে কুনকি হাতি নিয়ে ‘ডিউটি’তে গিয়েছিলেন দরবেশ। ডিউটি শেষ হতে রাত, এ দিকে পরিশ্রমী দরবেশ আবার একটু তরলমতি। সন্ধের পরে বিঘ্ন ঘটার কারণ না থাকলে, তিনি কারণ পান করে সুখ সন্ধান করেন। সেই রাতে মাত্রা খানিকটা বেশিই হয়ে গিয়েছিল। টলমল পায়ে দরবেশ কোনও রকমে নিজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হাতির পিঠে উঠে শুয়ে পড়েন। ঘুমিয়ে পড়ার আগে দরবেশ হাতিকে হাত দিয়ে গুঁতো মেরে বলেছিলেন, “চল,
ফিরে চল।”
ভোরবেলায় যখন দরবেশের ঘুম ভাঙে, দেখেন হাতির পিঠেই তিনি শুয়ে, কিন্তু হাতিটি দাঁড়িয়ে রয়েছে জলদাপাড়ার পিলখানায়। মালঙ্গি বিট বাংলো থেকে জলদাপাড়া পিলখানা অন্তত কিলোমিটার সাতেক দূরে। গভীর রাতে তোর্সা নদী পেরিয়ে হাতি একা একা পথ চিনে ফিরল কী করে? বুনো পথে এক বারও পিঠ থেকে দরবেশকে পড়ে যেতে দেয়নি পোষা হাতিটি। সবচেয়ে বড় কথা, হাতিটি দরবেশের কথা বুঝল কী করে? দরবেশ মাহুতের সেই আশ্চর্য হাতিটির নাম হয়তো অনেকেই ভোলেননি। তার নাম যাত্রাপ্রসাদ।
হাতিরা মানুষের কথা বোঝে। হাতিরা নিজেদের মধ্যে কথাও বলে। জংলি হাতি কথা বলে কুনকি হাতির সঙ্গে, কুনকি হাতি কথা বলে মাহুতের সঙ্গে। সে সব মোবাইল ক্যামেরা বাগিয়ে হাতির পিঠে চেপে জঙ্গল ভ্রমণ করা পর্যটকদের বোঝার কথা নয়। সেখানে কোনও নিয়ম নেই, বাঁধাধরা পথ নেই। তাই চৈত্রের এক ঝড়ের সন্ধেয় হাতির পিঠে চেপে টহলদারি চালানো বনবাবু, বনকর্মীদেরও পথ ভুল হয়ে গিয়েছিল। কিছুতেই চেনা রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। এ দিকে ঝড়ে জঙ্গল পাগল-প্রায়। হঠাৎই তাঁরা চলে আসেন মূর্তি নদীর পাড়ে। সামনে হাড়হিম করা দৃশ্য। অন্তত চল্লিশটি বুনো হাতির দল মূর্তির পাড়ে। সকলেই জানেন, কুনকি হাতি দেখলে বুনোরা ক্ষিপ্ত হয়। এক সঙ্গে অনেক বুনো হাতি থাকলে একা কুনকিকে হামলা করবে, এটা জঙ্গলেরই নিয়ম। যদিও সে দিন হাতির পিঠে থাকা মাহুত আশ্বস্ত করেছিলেন বনকর্তাদের। বলেছিলেন, “কিচ্ছু হবে না, আমার সূর্য ঠিক নিয়ে যাবে।”
সূর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে মাহুত বলে, “সামহালকে লে চল।”
সূর্য শুঁড় ওঠায় শূন্যে। মাহুত বলেন, “দেখুন, ওরা কথা বলছে।”
তার পর বুনো হাতির দলের মাঝখান দিয়ে সূর্য এগোতে থাকে। সেই বনকর্তা স্মৃতিচারণ করেন, “সে দিন মাঝপথে বুনো হাতির দলের মধ্যে এসে হঠাৎ হাতি থামিয়ে দিয়েছিলেন মাহুত। বলেছিলেন, ‘স্যর, ইচ্ছে করলে বুনো হাতিদের ছুঁয়েও দেখতে পারেন, ওরা কিছু করবে না। সূর্য ওদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে।’” এক অবিশ্বাস্য ঘটনাকে সত্যি করে সে দিন বুনোদের পাশ দিয়ে হেঁটে কুনকি হাতি সূর্য সকল সওয়ারিকে নিরাপদে
নিয়ে গিয়েছিলেন।
মাহুতরা বলেন, বুনো হোক বা কুনকি, হাতিরা খামোকা রাগ করে না। সেই সূর্যের বিয়ে হয়েছিল গরুমারার কুনকি হাতি আমনের সঙ্গে। বৃষ্টিভেজা এক সকালে আমন সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। প্রবল বৃষ্টির সেই দিনে ধূপঝোরার গাছবাড়ির সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সদ্যোজাত সেই কন্যাসন্তানের নাম রেখেছিলেন, বর্ষণ।
তথ্য সহায়তা: বিমল দেবনাথ, প্রাক্তন বনাধিকারিক