Holi 2024

আমাদের সেই সব রং-আলো-জ্যোৎস্না

পড়ে আছে বেশ কয়েক দশক পিছনে, তবু মনে হয় এই তো সে দিন। দোলখেলা তো আসলে রোজকার সাদা-কালো মনখারাপ ঢেকে দেওয়ার চাদর। খেলার শেষে চাতালে পড়ে থাকে শুকনো রঙের দাগ।

Advertisement

রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

ছবি: কুণাল বর্মণ।

আমার দোল নিয়ে লিখতে গেলে আমি নিজের পাড়াতেই ফিরে ফিরে যাই। কিন্তু এ বার যাদের কথা লিখতে চলেছি, তারা আমার আত্মার অংশ। আমার অতি শৈশবে যাদের আনাগোনা। আমাদের বিজয়গড়ের বেশ কিছু চরিত্র স্মৃতির ছাই ঝেড়ে আমার ল্যাপটপের সামনে ভিড় করে এল। এই গল্প তাদের, যার অনেকটা জুড়ে রয়েছি আমিও, কারণ আমার সবটা জুড়েই ওরা। লেখার খাতিরে নাম ও ঘটনা একটু অদলবদল করা হয়েছে। তাই, এটা সত্যি হলেও গল্প।

Advertisement

তাতিন

ঘুম থেকে উঠেই ভয়টা আবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাতিনকে। আজ দোল, কিন্তু সামনের দেওয়ালটা আগাম হোলি খেলে ফেলেছে। তার গা জুড়ে এবড়োখেবড়ো মাছের ঝোলের দাগ। গতকাল রাতে মা-বাবার ঝগড়া হয়েছে। বাবা মদ খেয়েছিল, সসপ্যান তুলে ছুড়ে দিয়েছে। দেওয়ালের কান থাকার অপবাদ থাকলেও, ত্বক থাকার নেই। কাজেই তার কংক্রিটে সব সয়ে যায়, কিন্তু এই মাছের ঝোলের দাগ এঁটো করে দেয় একটা কৈশোর, তাতিনের। একটা বারো বছরের ছেলে ঘুম থেকে উঠে কোথায় আনন্দে লাফাবে, তার বদলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, কারণ বাবার আজ হ্যাপি হোলি। তাই বাবা দিনের বেলা থেকেই মদ খাবে। শুরুর দিকে হাসিমুখে থাকবে, তার পর যত দুপুর গড়াবে বাবার হাসি বদলে যেতে থাকবে। বাবা প্রত্যেক বার দোলে খাসির মাংস নিয়ে আসে, কিন্তু খাওয়া আর হয় কই? শেষ কবে দোলে শান্তি করে দুপুরে খেয়েছে, আজ আর তাতিনের মনে পড়ে না। বাবাকে তাতিন খুব ভালবাসে, বাবাও। মা তো সবাইকে ভালবাসে, মায়ের কষ্ট সবচেয়ে বেশি।

Advertisement

“কী রে, কখন উঠলি?”

মা-র ডাকে তাতিন চমকে তাকায়। এই সকালের আলোতেও মাকে বড় ক্লান্ত লাগে তাতিনের। বাঁ কানের পাশ থেকে চিবুক বরাবর দাগটাও তাতিনের নজর এড়ায় না। মা তাতিনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চলে তাতিনকে, “পাউরুটি জিলিপি এনেছি, দাঁত মেজে খেয়ে নিবি, আর খারাপ গেঞ্জি বের করে রেখেছি, পরে নিবি।”

তাতিন হঠাৎ মাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “মা, বাবা ওইটা না খেলে চলে না?”

প্রশ্নটা যেন শতকের পর শতক ধরে শুনে আসছে সুরঞ্জনা, তাতিনের মা। তাকে আর একটু ক্লান্ত লাগল যেন। শুধু বলল, “তূর্য আর তানিয়া কিন্তু বলেছে দশটায় চাতালে তোর জন্য অপেক্ষা করবে। যত দেরি করবি, লস তোরই।”

এত ক্ষণে তাতিনের বিষণ্ণ সকালটার গা থেকে মাছের ঝোলের দাগ মুছে দিয়ে কেউ আবির মাখিয়ে দিল। তাতিন যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সেই বাড়িতে আরও চারটে পরিবার ভাড়া থাকে। ওদের সবার একটা এজমালি চাতাল আছে। দোলের দিন সবাই ওখানে জড়ো হয়, খুব মজা হয়। তূর্য পাশের বাড়ির ছেলে, কিন্তু ওরা বন্ধু বলে সবাই এক সঙ্গে ওই চাতালেই দোল খেলে।

সবাই আসে, শুধু শাম্মি কপূর নামে না। শাম্মি কপূর মানে তাতিনদের বাড়িওয়ালা। উনি মাসে এক দিন বেরিয়ে সবার থেকে ভাড়া নেন, হরিণঘাটা থেকে দুধ নেন, সাহার দোকান থেকে মুদির যাবতীয় জিনিস নেন। কিন্তু কখনও কারও সঙ্গে অতিরিক্ত কথা বলেন না। বিশাল লম্বা-চওড়া চেহারা, উল্টে আঁচড়ানো চুল আর এক গাল কাঁচাপাকা দাড়ি। এই জন্য তাতিনরা ওকে লুকিয়ে ডাকে শাম্মিকপূর বলে।

এটা ১৯৯৮ সাল চলছে। পাঁচ বছর হল তাতিনরা এসেছে, শাম্মি কপূরকে কখনও চাতালে নেমে দোল খেলতে দেখেনি। যেমন ও দেখেনি, ওদের বাড়িতে বড় করে দোল উৎসব পালিত হতে। আগে নাকি খুব ধুমধাম হত, যখন তাতিনদের নিজেদের বাড়ি ছিল। ও তখন খুব ছোট, তাই ওর মনে নেই। তাতিনের বাবা অয়ন খুব বড় ফাংশন অরগানাইজ়ার ছিল, বাড়িতে আর্টিস্টদের আনাগোনা লেগেই থাকত। দোলের দিন ঢালাও বিরিয়ানি, মদ আর দেদার গান বাজনা হত।

সবই তাতিনের শোনা কথা। এখন আর কোনও শিল্পী আসে না। আসে অন্য কিছু লোক, যারা এলে তাতিনের ঘর থেকে বেরোনো বারণ। কিছু কিছু কাকু রাত করে আসে, মাকেও তখন ওদের সঙ্গে গ্লাস নিয়ে বসতে হয়। তাতিন জানে মায়ের মদ ভাল লাগে না। তাও কেন খায়? বাবা, মায়ের ঝগড়াতে তাতিন বুঝেছে কাকুরা বাবার থেকে টাকা পায়। বাবার কাছে কাকুরা টাকা পায় বলে মাকে কেন মদ খেতে হবে, তা তাতিনের ছোট্ট মাথা বুঝতে পারে না। একদম যে বুঝতে পারে না তাও নয়, সবটা বুঝলে মুখ তেতো হওয়ার ভয়ে বুঝতে চায় না। বাবা এখনও ঘুমোচ্ছে, ঠোঙা থেকে আবির নিয়ে মার পায়ে দিল তাতিন, মা-ও ওর গাল গোলাপি করতে ছাড়ল না।

তূর্য

তূর্য তখনও ঘুমোচ্ছিল, দোষ বলতে এটুকুই। দাদু বলল, “একটু ই করো তো বাবু!”

সরল বিশ্বাসে মুখটা হাসি-হাসি করেছে, দাদু মশারির ভিতর হাত ঢুকিয়ে দাঁতে আবির মেজে দিয়ে ধাঁ। তূর্য তো কেশেটেশে অস্থির। গোলাপি দাঁত নিয়ে বাবাকে নালিশ করতে গিয়ে দেখে বাবা স্নান সেরে উঠেছেন, সব ঠাকুর সেরে মায়ের ছবির সামনে দাড়িয়ে। তূর্য বুঝল এখন বাবার অনেকটা সময় লাগবে, কারণ বাবার হাত-ভর্তিলাল আবির।

খানিক পরের কথা।

“রান্নার বই পড়ে পড়ে আপনার মাথা গেছে!”

“সব কিছুকে এত হেয় চোখে দেখো না হে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু কথাটা ভুল নয়!”

এই মুহূর্তে বাবা আর দাদুর মধ্যে বিশাল ঝামেলা চলছে সিন্নিতে লেবুপাতা দেওয়া নিয়ে। দাদু কোথাও একটা পড়েছে লেবুপাতা সিন্নিতে দিলে নাকি স্বর্গীয় স্বাদ হয়। বাবা কোথাও পড়েনি। ইনফ্যাক্ট, বাবা বিশ্বাসই করে না ডেয়ারি প্রডাক্টে সাইট্রাস কিছু ঢুকতে পারে। এই নিয়ে বাবা আর দাদুর লেগে গেছে সকাল-সকাল। বাবা আর দাদু, ছাত্র শিক্ষক। সবটাই শোনা কথা।

বাবা যখন গ্র্যাজুয়েশন করতে কলেজে ঢোকে, তখন দাদু প্রিন্সিপাল। বাবার তিন কুলে কেউ ছিল না। দাদুর ছিল সব। বাবার থাকা-খাওয়ার অসুবিধে বুঝতে পেরে দাদু সব রকম সাহায্য করার চেষ্টা করেন বাবাকে। সব ছাত্রের জন্যই করতেন দাদু, যার মধ্যে তিনি সম্ভাবনা দেখতেন। যা তিনি দেখেছিলেন তপনের মধ্যে। তূর্যর বাবা তপন। কিন্তু এক দিন সব বিশ্বাস ভেঙে গেছিল। এই তপনের প্রতি বিশ্বাসের কথা বলছি।

বিপত্নীক আমার দাদুর পূর্ণ ভরসা ছিল নিজের ছাত্রের প্রতি। কিছুটা তূর্যের মায়ের ভাল আর কিছুটা এক্সট্রা ইনকাম তূর্যর বাবার, এই ভেবে তপনের কাছে টিউশনে দিয়েছিলেন মেয়েকে। বয়স নিজের নিয়মে খেলা খেলে, প্রেম হয় দু’টি মনে। ঠিক সেই সময় দাদু সম্বন্ধ দেখেন চিত্তরঞ্জন কলোনির এক প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে। তূর্যর বাবা জানতে পেরে সরে আসে। শিক্ষককে তিনি কষ্ট দিতে পারেন না।

এ দিকে তূর্যর মা তপনবাবুর জন্য পাগল, আশীর্বাদের আগের দিন বাবাকে সব বললেন খুলে। দাদুর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। উনি সোজা বাবার মেসে গিয়ে বললেন, “আমার মেয়ের মা নেই, কিন্তু বাবা আছে। ওকে কষ্ট দেবে না। আমি জানতাম না বলে পালিয়ে যাবে?”

তপন বলার চেষ্টা করেছিল, “স্যর, আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলেই …”

“এক থাপ্পড় মারব, আমার মেয়ে তোমাকে ভালবাসে, আর কোনও কথা নয়। তা, তুমি ওকে ভালবাসো তো হে?”

তার পর নাকি দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অনেক ক্ষণ। তূর্যর মায়ের মুখ তেমন মনে পড়ে না। গন্ধ মনে পড়ে। কিছুটা পান-পান, কিছুটা পাউডার-পাউডার।

দাদু ঢোল টাইট দিতে বসে গেছে। বাবারও ব্যস্ততার শেষ নেই। নাটকের দলের কাকুরা সব আসতে শুরু করে দিয়েছে। তূর্যর বাবার নাটকের দল আছে, দাদু আবার তার প্রেসিডেন্ট। আজ সবাই জমায়েত হবে, দাদুর দারভাঙার এক বন্ধু সিদ্ধির হুজুগ তুলেছেন। তিনি আবার দারুণ হোলির ছড়া কাটেন। বাবা হারমোনিয়াম নামিয়ে ঝাড়ছে। মলিনকাকু খুচরো বাজায়। সে অনেক খুচরো জড়ো করেছে। দীপকাকু শিলনোড়ায় সিদ্ধিপাতা বাটছে। বাবার এ সব পছন্দ না হলেও, উৎসবের দিন বলে ক্ষমাঘেন্না করে দিচ্ছেন। দাদুর সঙ্গে দাদুর বন্ধুর এ বার লেগে গেছে তামার পয়সা ঘষা নিয়ে।

এরই মধ্যে তূর্য বাবাকে বলল, “বাবা, চাতালে দোল খেলতে যাব।”

তূর্যর বাবা জানতই প্রত্যেক বারের মতো তূর্য এ বারও চাতালেই দোল খেলবে। খেলবে না-ই বা কেন, ওর বয়সি বন্ধুরা তো সব সেখানে। বাবা বলল, “মায়ের ফোটো আর বড়দের পায়ে আবির দিয়ে বেরোবে।”

দীপকাকু বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “কোন চাতালের কথা কয় ও?”

বাবা বলল, “বিজয় সরকারের বাড়ির চাতাল।”

দীপকাকু অত্যুৎসাহে বলে ফেলল, “বিজয় সরকার মানে? শাম্মি কপূর? যার মেয়ে...”

দাদু বিরক্ত হয়ে বলল, “আঃ দীপ! তূর্য আছে।”

তূর্য দেখল, এই প্রথম বার বাবা দাদুর কথায় কোনও প্রতিবাদ করল না।

শাম্মি কপূর

জানলাটা খুলে দিলেন বিজয়বাবু। জানলা উনি সচরাচর বন্ধ করেন না। খুব ঝড় বৃষ্টি হলেও না। শুধু কালকের দিনটা ব্যতিক্রম ছিল। গত আট বছর এই একটা দিন উনি জানলা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। এই জানলাটুকুই বলতে গেলে বিজয়বাবুর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র। কিন্তু দোলের আগের দিন পৃথিবীর সঙ্গে সামান্য যোগাযোগটুকুও ঘুচিয়ে দিতে ইচ্ছে করে বিজয়বাবুর। বিজয়বাবুর স্ত্রী মারা গেছেন বছর তিনেক হল। নাকি উনিও বিজয়বাবুর মতো আট বছর আগের সেই সন্ধেতেই মরে গেছিলেন? বয়ে বেড়িয়েছেন শুধু শরীর, যেমনটা বয়ে বেড়াচ্ছেন বিজয়বাবু।

রিঙ্কু কলেজ শেষ করার আগেই শুভর প্রেমে পড়ে। শুভ পাড়ার নিত্য ডাক্তারের নাতি, ব্যাঙ্কের পরীক্ষায় বসছে। বিজয়বাবুদের আপত্তির কিছু ছিল না। দিব্যি চলল ওদের প্রেম, পরের দিকে রিঙ্কু আর লুকোছাপা করত না, বলেই বেরোত শুভর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। শুভ বরোদা ব্যাঙ্কে চাকরিও পেয়ে গেল। উত্তরপ্রদেশের ফৈজ়াবাদে বদলি নিয়ে চলে গেল। চিঠিচাপাটি প্রথম ছ’মাস স্বাভাবিকই ছিল। তার পর তা অনিয়মিত হল এবং অবশেষে বন্ধই হয়ে গেল। সবটাই হল শুভর তরফ থেকে, মাঝখান থেকে রিঙ্কু শুকিয়ে যেতে লাগল। বিজয়বাবু বুঝতেন সবই, জানতেনও অনেক কিছুই। কিন্তু ভেবেছিলেন, সময় ক্ষত সারিয়ে দেবে, যেমনটা দেয় সবার। সময়, এই সময়টাই যে ফুরিয়ে আসছে, সেটা যদি এক বার বুঝতে পারতেন!

শুভর বিয়ের তখন আর তিন মাস বাকি, পাশের পাড়ার মন্টু মাস্টারের নাতনি স্নেহার সঙ্গে ওর বিয়ে ফাইনাল। ও এসেছে তিন মাস আগে কিছু কেনাকাটা সারতে, তা ছাড়া দর্জিকে মাপ দেওয়ারও তো আছে। রিয়া এসে শুভকে বলল, রিঙ্কু শেষ বার শুভর সঙ্গে দেখা করতে চায়, ওকে রিঙ্কুর কিছু দেওয়ার আছে। শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রিঙ্কুর বাড়ির সামনের গলিতে।

শুভর তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু পুরনো প্রেমের খাতিরে এটুকু তো করতেই হয়। সেই ভেবে রাজি হতে হল। সে দিনও এ রকম বাসন্তী বিকেল ছিল। রিঙ্কু নিজের গায়ে আগুন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শুভর গায়ে, দু’জন জড়াজড়ি করে পড়ে গেছিল ব্যানার্জিদের বেড়া ভেঙে। বিজয়বাবুরা খবর পেয়ে দৌড়ে এসে শুধু লেলিহান শিখা দেখেছিলেন আকাশচুম্বী। জীবন যা পারেনি, আগুন তা করছিল— দুটো শরীরকে মিশিয়ে দিচ্ছিল।

তাই আজও দোলের আগের দিন, যখন ছোকরারা ডালপালা জড়ো করে প্রবল উৎসাহে নেড়া পুড়িয়ে আগুন উদ্‌যাপন করে, উনি জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন। ওই লাল আকাশের স্মৃতি তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ করে দেয়।

তেষ্টার কথায় মনে পড়ল, বেলের পানা বানিয়ে রেখেছেন, খেয়ে নিতে হবে। উনি উঠে পড়লেন, আজ আর হরিণঘাটার ডিপো থেকে দুধ আনার কারবার নেই। ভালই হয়েছে, বেরোতে হবে না। চালে-ডালে ফুটিয়ে নেবেন যা হোক। এক চিলতে বাড়ির কোণে মূর্তিমান মস্করার মতো পড়ে রয়েছে ঠাকুরের সিংহাসন। শেষ তিন বছর ওই দিকে কেউ ঘুরে তাকায়নি বেশ বোঝা যাচ্ছে, নিত্যকর্ম পদ্ধতির উপর জমে থাকা ধুলো অবিশ্বাসের মতো এই বাড়ির ঈশ্বরকে ঢেকে দিয়েছে যেন।

তানিয়া

সকালে উঠেই খুব একচোট হয়ে গেছে মায়ের সঙ্গে। মা বলে কি না, শুধু আবির খেলতে! ইল্লি রে, চাতালে তানিয়ার একটা সুনাম আছে না? তানিয়ার দেওয়া রং যার গালে লেগেছে, সে পরের দিন সম্পূর্ণ ভদ্র ও পরিষ্কার অবস্থায় কাজে বা স্কুলে যেতে পেরেছে, এই বদনাম অতি বড় শত্রুও দিতে পারবে না। সবার আগে তানিয়া সব সময় দাঁত টার্গেট করে, ভাবতেই শরীর চনমন করে উঠল তানিয়ার। মা অশান্তি করছিল বাঁদুরে রং নিয়ে, বাবা আর ঠাকুমা এসে তানিয়াকে ভোটে জিতিয়ে দিয়েছে।

বিজয়গড়ের বেশির ভাগ বাড়ির মতো ওদের বাড়িও রামঠাকুরের দীক্ষিত। তাই তানিয়াদের বাড়িতেও সিন্নি হয়েছে। সেই সিন্নি সবাইকে দিয়ে এসেছে তানিয়া। তাতিন, তূর্য আরও সব প্রতিবেশীদের, শুধু দেয়নি শাম্মি কপূরকে। বাড়ি থেকে কেউ বলেওনি। ছোটবেলা থেকে এই লোকটাকে সমঝে চলে তানিয়া। লোকটার বিশাল চেহারা, গাম্ভীর্য, মূল্যবান অনুপস্থিতি— ছোটবেলা থেকেই একটা ভীতি-মেশানো সম্ভ্রম জমিয়ে রেখেছে তানিয়ার মনে। আর হ্যাঁ, অতীতও। মা-বাবা যতই চাপার চেষ্টা করুক, শাম্মি কপূরের অতীত প্রায় পুরোটাই জানে তানিয়া, তাতিন, তূর্য। তাই লোকটাকে দেখলে কেমন একলা, ঘাস বড় হয়ে যাওয়া, দোলনা-ভাঙা পার্কের মতো দেখতে লাগে, কাছে যেতে ইচ্ছে করে না।

যাক গে, চাতালে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করে নিতে হবে, তাতিন-তূর্য তো বটেই, বেপাড়ার সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে তানিয়া কী জিনিস! তাতিন, তূর্যর কথা মনে পড়তেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এটাই হয়তো তানিয়ার ওদের সঙ্গে শেষ দোল। বাবার বদলির কথা চলছে। এখনও ওরা জানে না, জানলে কী বলবে? ভাবতে ভাবতেই মা তেল নিয়ে মুখে মাখিয়ে দিল, যাতে রং মুখে না বসে। উফ, মা না! চাতালে বেরোনোর আগে সবাইকে নিয়ম করে ভূত বানাল ও। ঠাম্মিকে শুধু আবির যদিও। কিন্তু মা-বাবাকে ছাড়া নেই। পুরোদস্তুর ভূত বানাল তানিয়া। ওরাও বিশেষ আপত্তি করল না, চাতালে নেমে এমনিতেও ভূত হতেই হবে সবাইকে।

হ্যাঁ, এই বাড়ির সব ভাড়াটে চাতালে একত্রিত হয়ে দোল খেলে। আসেন না শুধু বাড়িওয়ালা। তাতে আনন্দে অবশ্য বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে না। বেলুন, পিচকারিকে দিন গ্যয়ে, আভি তানিয়া কা হাত হি কাফি হ্যায়! যুদ্ধং শরণং বাঁদরামি! তানিয়া বেরিয়ে পড়ল চাতালের উদ্দেশে।

চাতাল

চাতালে আসর জমজমাট। সবাই সবাইকে জাপ্টে ধরে র‌ং মাখাচ্ছে। কে বলবে, কালকেই হয়তো পাম্প চালানোর সময় নিয়ে দু’জন মাথা ফাটাফাটি করবে। তার জন্য আজকে ভালবাসার সুযোগ তো ছেড়ে দেওয়া যায় না! অচিরেই হারমোনিয়াম, ঢোল নিয়ে তূর্যর বাবা, দাদু চলে এলেন। তপনবাবু, তূর্যর বাবা অসাধারণ মান্না দে-র গান গাইতে পারেন, তিনি গাইলেন কয়েকটা। দাদু আর দাদুর বন্ধু দারভাঙার হোলির ছড়া কাটলেন আর ভোজপুরি গান গাইলেন জমিয়ে। মুখার্জিকাকু নবদ্বীপ হালদারকে নকল করে দেখালেন, উনি এই এক জনকেই নকল করতে পারেন। আর তাতেও একটাই চুটকি— নবদ্বীপ হালদারকে হাতে মগ ধরিয়ে বলছে তাকে বাথরুম উদ্বোধন করতে হবে। এই একই চুটকি তিনি বলেন সব জায়গায়, ও ঠিক আছে, বুরা না মানো হোলি হ্যায়। উপরের মিষ্টুকাকিমা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ বলতে গিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলেন, শেষের দিকে হিক্কা তুলে “উফ বড় কষ্টের...” বলে শিবনেত্র হলেন।

আসর আরও চলত।

“আমরা কি সার্লি স্যাপলিনরে আদৌ বুঝছি?” এই বলে সবে গম্ভীর আলোচনা করতে উদ্যত হয়েছিলেন বসাকজেঠু, ডুকরে কেঁদে উঠলেন তূর্যর দাদু। তানিয়ার মাকে নাকি অবিকল তাঁর কাশিমবাজারের পিসির মতো দেখতে। যে যা-ই বলুক তানিয়ার মাকে উনি প্রণাম করবেনই।

তূর্যর বাবা ঘোষণা করল, “ক্যানাবিস কিক-ইন করেছে, বাড়ি নিয়ে যেতে হবে, কুইক!”

বসাকজেঠু অবাক হয়ে, “কী হইসে?”

বলায় তূর্যর বাবা গনগন করে ওঠেন, “হবে আবার কী! বুড়ো বয়সে সিদ্ধি গিলেছেন, এ বার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে!”

বলে নাটকের দলের লোকসমেত দাদুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেলেন। চাতাল আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল, তার পর আস্তে আস্তে শুরু করল শব্দ। তাতিনের মায়ের মার খাওয়ার। ওরা তিন জন ঝিম ধরে বসেছিল টিউবওয়েলের সামনে। তাতিন মুখ নিচু করে বসেছিল। তানিয়া খুব আস্তে কেটে কেটে বলল, “এটা আমাদের এক সঙ্গে শেষ দোল। বাবা বদলি হয়ে যাচ্ছে...” তানিয়া উঠে দাঁড়ায়, “তার আগে আমাকে আমার ভয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার,” বলে তানিয়া হনহন করে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

একটা বোমার মতো খবরের অভিঘাতেই ওরা দু’জন বোবা হয়ে গিয়েছিল, ওরা বোকার মতো ওকে অনুসরণ করল শুধু। এক হাতে আবির আর এক হাতে সিন্নির বাটি নিয়ে বেরিয়ে এল তানিয়া, সোজা উপরের দিকে রওনা দিল। শাম্মি কপূরের ফ্ল্যাটের দরজায় ঠকঠক করল। দোলের আওয়াজ দুপুরের দিকে যেমন মরে আসে, ঠিক তেমনই ঝিমঝিম করছে দুপুর। শাম্মি কপূর বেরিয়ে এলেন, চন্দ্রাদিদের বাড়ির নিমগাছে একটা একবগ্গা পাখি ডেকে চলেছে।

তানিয়া বলল, “ঠাম্মি এই সিন্নি পাঠাল...”

উনি ইতস্তত করে বাটিটা নিতেই ‘হ্যাপি হোলি’ বলে পুরো দাড়িতে আবির মাখিয়ে দিল তানিয়া। পাখিটা তখনও ডেকে চলেছে, একটা একলা মাতাল বাড়ি ফিরতে পারছে না বলে রাস্তাকে গালিগালাজ করছে, তাতে দুপুরের নৈঃশব্দ্য আরও প্রকট হচ্ছে। তাতিন আর তূর্য সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দেখছে, ওদের সময় থমকে গেছে যেন। শাম্মি কপূর যেন প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন, এ রকম একটা শব্দ করে তানিয়ার কাঁধ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন, খালি বলতে লাগলেন, “মা...মা...”

তূর্য পাশে তাকিয়ে দেখল, তাতিন নেই।

তাতিন

বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাতিনের দিকে। তাতিন বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। না, মাকে আর মার খেতে দেবে না ও। বাবাকে মারতে ও পারবে না, চায়ও না, শুধু প্রতিরোধ করবে। বাবা তাতিনকে দেখে ভয় পেয়ে গেছিল বোধহয়, নিজের মনে কী সব বিড়বিড় করতে গিয়ে প্রথমে লুঙ্গি খুলে গেল, তার পর চাটনির বাটিতে পা লেগে উলঙ্গ হয়ে উল্টে পড়ল বাবা। তাতিনের খুব কান্না পেল। প্রথমে এই দৃশ্যটা দেখে, তার পর মায়ের দিকে তাকিয়ে, তার পর এটা মনে পড়া-য় যে, তানিয়া চলে যাচ্ছে। তার পর, তার পর কী? ও নিজেই কি ছাই জানে? ছাদের দিকে ছুটে গেল ও, সোজা।

কলতলা

তূর্য আর তানিয়া অনেক ক্ষণ চুপ করে বসে। কেউ কোনও কথা বলছে না। দুপুর মাথাভর্তি আবির মেখে ঘুমকাতুরে হয়ে রয়েছে। তানিয়াই প্রথম বলল, “তাতিনের বাড়িতে কোনও শব্দনেই, শুনেছিস?”

তূর্য মাথা নিচু করেই বলল, “ওর চলে যাওয়ার ধরন দেখেই বুঝেছি, আজ ও কিছু একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে।”

আবার দু’জন চুপচাপ। নিমগাছের বেয়াড়া পাখিটার থামার কোনও লক্ষণ নেই।

তূর্য বলল, “হ্যাপি হলি?”

অন্যমনস্ক গলায় তানিয়া বলল, “হ্যাঁ রে,হ্যাপি হোলি।”

তূর্য আবার বলল, “না রে, আমি বলছি, এ ভাবে আমাকে, তাতিনকে ফেলে চলে যেতে কতটাহ্যাপি হলি।”

তানিয়া টের পাচ্ছিল, মাধ্যাকর্ষণ তার চোখের জলকে ভারী করে তুলছে, তাই মুখটা যথাসম্ভব উপরের দিকে তুলে ও বলল, “আমার কী করার আছে বল?”

দু’জন তার পর আরও কিছু ক্ষণ বসেছিল, কিন্তু দু’জনেই টের পাচ্ছিল মনখারাপ একটা নচ্ছার রঙের মতো গোটা দিনটার শরীরে বসে গেছে।

শুধু শেষ বার তূর্য জিজ্ঞেস করেছিল,“কোথায় যাচ্ছিস?”

তানিয়া বলেছিল, “আগরতলা।”

তূর্য হঠাৎ বলেছিল, “প্রচুর বাঁশ ওখানে।”

তার পর দু’জনেই হাসার চেষ্টা করল। জমল না। পাখিটাও তত ক্ষণে থেমে গেছে।

শাম্মি কপূর

আজ ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে ধূপ জ্বলছে। চার পাশ একটু পরিচ্ছন্নও লাগছে যেন।

তূর্য

সারা বিকেল ঘুমিয়ে দাদু সন্ধেবেলা উঠল। বাবা ঘি দিয়ে চিঁড়ে ভাজছে। বাগানের নারকেলকোরা আর চিনি দিয়ে বিকেলে খাওয়া হবে। টিভি চলছে, ‘জন্মভূমি’ শেষ হয়ে খবর শুরু হবে। আলো চলে গেল। দাদু বসার ঘরে কেঁদে উঠল, “আমার জগৎ অন্ধকার হয়ে গেল!”

বাবা খবর শুনতে পাবেন না বলে এমনিতেই খেপে ছিলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “ইনকরিজিবল! আর এক বার উনি সিদ্ধি খেলে আমি বেরিয়ে যাব।”

তূর্য বাইরে বেরিয়ে এল। অন্য দিন বাবা আর দাদুর কাণ্ড-কারখানা দেখে হাসি পায়, আজ এ রকম কান্না পাচ্ছে কেন? কেন মনে হচ্ছে আজ হঠাৎ এদের এই প্রবল হুল্লোড় মায়ের শোক ঢাকার একটা প্রক্রিয়া। এগুলো তো কই আগে মনে হয়নি! বারান্দা ধুয়ে দিচ্ছিল সদ্য-ওঠা জ্যোৎস্না। হঠাৎ তূর্য খেয়াল করল, পূর্ণিমার চোখ লাল। নতুন সন্ধ্যায় সদ্যডিউটি করতে আসা চাঁদের চোখ লাল কেন? ও-ও কি কেঁদেছে? না হলে চোখ লালের কারণ? আবির, না আগরতলা?

দূরে কোথাও পূর্ণিমা টের পাচ্ছিল, আরও তিন জন মানুষ এই বসন্তে বড় হয়ে গেল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement