ক্রীড়াভূমি: ইন্টার অ্যালায়েড গেমসে ১০০ মিটার দৌড়ের ফাইনালে প্রতিযোগীরা। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
২৪৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দূরত্বে গ্রেনেড ছুড়েছিলেন মার্কিন সেনা আধিকারিক এফ সি টমসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে এটি ছিল সৈন্যদের অন্যতম হাতিয়ার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট যত সেনা মারা গিয়েছিলেন, তার প্রায় ২.৫ শতাংশ এই গ্রেনেডের শিকার। টমসন কাউকে মারতে নয়, গ্রেনেডটি ছোড়েন খেলার সূত্রে। গ্রেনেড ছোড়ার প্রতিযোগিতা। ‘ইন্টার অ্যালায়েড গেমস’-এ অন্যতম ইভেন্ট ছিল এই খেলা। সালটা ১৯১৯।
ইন্টার অ্যালায়েড গেমস-এর প্রসঙ্গটা উঠল কিছু দিন আগে এক বছরের জন্য এ বারের টোকিয়ো অলিম্পিক্স পিছিয়ে যাওয়ার সূত্রে। করোনা অতিমারির ফলে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটির এই সিদ্ধান্তে ক্রীড়াবিশ্ব তোলপাড়। কিন্তু উপায় ছিল না। বলা হচ্ছে, অলিম্পিক্স বাতিল হওয়ার ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি বহন করতে হবে সে দেশের সরকারকে। যদিও প্রতিযোগিতার ইতিহাসে এমন সিদ্ধান্ত নতুন নয়। ১৯১৬ সালে জার্মানির বার্লিনে অলিম্পিক্স হওয়ার কথা ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য বাতিল হল। ১৯১৮-র নভেম্বরে জার্মানি যখন নতিস্বীকার করল, তত দিনে গোটা ইউরোপ বিধ্বস্ত।
এ দিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে নতুন বিপত্তি। বিশ্বের নানা স্থানে এক অজানা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হতে শুরু করল মানুষ। এক সময় এই রোগ মহামারির আকার ধারণ করল। বিশ্বযুদ্ধের ফলে আরও ছড়িয়ে পড়ল এই রোগ। বিশ্বের তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হল। মারা গেলেন দুই থেকে পাঁচ কোটি মানুষ! বলা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত মার্কিন সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছিলেন, তার আরও অনেক গুণ বেশি মারা গিয়েছিলেন এই ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ইতিহাসে এই মহামারির নাম ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। ব্রিটিশ শাসিত ভারতেও দু’কোটির কাছাকাছি মানুষ এর শিকার হয়। কে জানত, ১০০ বছর পরে অন্য রূপে ফিরে আসবে আর এক মহামারি!
১৯১৮-র নভেম্বরের মধ্যেই যুদ্ধ যে শেষ হয়ে যাবে, তা ভাবতে পারেনি জার্মানির প্রতিপক্ষ দেশগুলি। বিশেষত, আমেরিকা। কী ভাবে অত সৈন্য ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ইউরোপ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে— এই নিয়ে কোনও পূর্বপরিকল্পনা ছিল না মার্কিন সেনা আধিকারিকদের। অন্য দিকে, তখন আমেরিকায় ইনফ্লুয়েঞ্জার থাবা। জার্মানির সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, মার্কিন নেতারা নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়? তা ছাড়া, সেনাবাহিনীকেও ব্যস্ত রাখতে হবে। ফলে তাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ চালাতে বলা হয় প্রতি দিন। কিন্তু অযথা যুদ্ধ প্রশিক্ষণ চালাতে চালাতে এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠল সৈন্যরাও। বিষয়টা নজর এড়ায়নি সেনা আধিকারিকদের। ঠিক হল অলিম্পিক্সের সমতুল্য একটি সামরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এতে সৈন্যদেরও ব্যস্ত রাখা যাবে, আর অন্য দিকে সৈন্যদের ফেরানোর একটি পরিকল্পনাও গড়ে তোলা যাবে। আয়োজনের ক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব পড়ল ইয়ং মেনস ক্রিশ্চান অ্যাসোসিয়েশন (ওয়াইএমসিএ)-এর উপর। প্রতিযোগিতার সূত্রে তৈরি হল একটি আন্তর্জাতিক অ্যাডভাইসরি কমিটি। বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সেনা প্রধান (কমান্ডার অব আমেরিকান এক্সপিডিশনারি ফোর্স ইন ইউরোপ) জন জে পেরসিং-এর পক্ষ থেকে ২৯টি বন্ধু দেশ ও উপনিবেশের কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হল। বাদ থাকল যুদ্ধে পরাজিত জার্মানি-সহ অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের দেশগুলি। চিঠিতে বলে দেওয়া হয়, জুন মাসে প্যারিসে হবে এই প্রতিযোগিতা। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ১৮টি দেশ জানিয়ে দেয়, তারা যোগ দিতে আগ্রহী। বাকিদের ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না। কারণ, যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা দেশে ফিরে গিয়েছিল। আর প্রতিযোগিতার জন্য হাতে যা সময় ছিল, তাতে সৈন্যদের খেলার প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে ফ্রান্সে পাঠানো সম্ভব ছিল না। প্রতিযোগী দেশ গুয়াতেমালা যেমন ফ্রান্সে তাদের প্রতিযোগী পাঠাতে পারেনি। কিন্তু তাদেরই এক সামরিক আধিকারিক লেফটেন্যান্ট আগির্রে ওই সময়ে প্যারিসে পড়াশোনা করছিলেন। ছাত্রাবস্থায় নিজের দেশে দৌড়বীর হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁকেই শেষ পর্যন্ত দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। খেলার প্রথম দিনে ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন আগির্রে।
প্রতিযোগিতার জন্য প্যারিস শহরের বাইরে তৈরি হয় পেরসিং স্টেডিয়াম। স্টেডিয়াম তৈরির কাজ যখন শুরু হয়, তখন হাতে মোটে কয়েক মাস সময়। কিন্তু মাঝে তা থমকে যায় ফরাসি শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে। মার্কিন ও ফরাসি সৈন্যদের সাহায্যে শেষমেশ সময়ের আগেই তৈরি হয় স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটিকে সাজানোর জন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলির পতাকা লাগানো হয় চারপাশে। অধিকাংশ দেশের পতাকা সংগ্রহ করতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এমন কিছু দেশও ছিল, যেগুলি তার আগে লোকে চোখেই দেখেনি। যেমন, ‘চেকোস্লোভাকিয়া’, ‘হিজাজ়’। ফলে অনুষ্ঠানের আগে উদ্যোক্তাদের ফরাসি মহিলা দর্জিদের দিয়ে তড়িঘড়ি ওই সব দেশের পতাকা তৈরি করতে হয়েছিল। যদিও তাঁরা শুধু ওই পতাকাই নয়, বাকি দেশের পতাকা এবং স্টেডিয়াম সাজানোর জন্য রংবেরঙের কাপড়ের ফিতেও তৈরি করেন। হিজাজ় পরে সৌদি আরবের অংশ হয়ে যায়। তাদের হাতে-গোনা প্রতিযোগী এসেছিলেন খেলায়। প্রতিযোগিতা চলাকালীন তলোয়ার চালনা, উটের দৌড়ের মতো তাঁদের দেশের কয়েকটি খেলা দেখিয়েছিলেন হিজাজ়-এর খেলোয়াড়রা।
ইংরেজি এবং ফরাসি ছিল প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক ভাষা। আমন্ত্রিত দেশগুলি থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই দুটোর মধ্যে একটা ভাষা জানতেন। কিন্তু যাতে কারও কোনও অসুবিধে না হয়, তার জন্য উদ্যোক্তারা দোভাষীরও ব্যবস্থা রেখেছিলেন। মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন ইটালীয় বা গ্রিক ভাষা বলতে পারতেন, তেমনই দু’-এক জন জানতেন স্লোভাকীয়র মতো কম পরিচিত ভাষাও। শোনা যায়, মুশকিলে পড়েছিলেন এক চিনা-মার্কিন রাঁধুনি। বেচারা নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার মতো কোনও লোক পাননি, কারণ চিন তো খেলোয়াড় পাঠায়নি!
খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণপর্ব এবং প্রতিযোগিতা মিলিয়ে প্রায় ৩৯,০০০ লিটার আইসক্রিম এবং ৭,৫৮,০০০ লিটার লেমোনেড বিনামূল্যে পরিবেশিত হয়েছিল। আয়োজন করেছিল ওয়াইএমসিএ। অন্যান্য খাবারের ব্যবস্থাও ছিল প্রচুর। মার্কিন সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য আনা রসদ যেমন কাজে লাগানো হয়, তেমনই প্রতিযোগিতার জন্য আরও খাদ্যসামগ্রী আনানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মার্কিন সেনারা যে দামে খাবার কিনতে পারত, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও ছিল একই দাম। ইন্টার অ্যালায়েড গেমস খেলতে এসে খাবারের প্রাচুর্য দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ার খেলোয়াড়রা। তখন তাদের দেশে তীব্র খাদ্যসঙ্কট। মার্কিন ও ফরাসি বাদে বহু বিদেশি খেলোয়াড় এমন ভাবে আইসক্রিম ও মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে শুরু করেন, তাঁদের প্রশিক্ষকরা চিন্তায় পড়ে যান, খেলার আগেই খেলোয়াড়দের শরীর খারাপ না হয়ে যায়।
অ্যালায়েড গেমস-এর প্রচারও করা হয়েছিল বেশ পরিকল্পিত ভাবে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী দেশের পত্রপত্রিকায় খেলার খবর বেরয়। এমনকি প্রতিযোগিতা চলাকালীনও প্রতিটি দিনের খবর সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে পৌঁছে যেত জনসাধারণের কাছে। বলা হয়, উদ্যোক্তারা এমন ভাবে প্রচার করেছিলেন যে ফ্রান্সের দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ এই খেলা দেখতে আসেন। প্যারিস শহরের প্রধান কিছু জায়গায় তৈরি করা হয় টিকিটের বুথ। জনসাধারণকে টিকিট বিতরণ করা হয় বিনামূল্যেই।
১৯১৯ সালের ২২ জুন অলিম্পিক্সের ধাঁচের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয় ইন্টার অ্যালায়েড গেমস প্রতিযোগিতা। ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি-সহ ১৮টি দেশের ১৫০০-রও বেশি প্রতিযোগী। মহিলা প্রতিযোগীদের কিন্তু এই গেমস-এর বাইরে রাখা হয়। বাস্কেটবল, বেসবল, বক্সিং, ফুটবল, গল্ফ, সাঁতার, টেনিসের মতো নানা খেলায় তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। অ্যালায়েড গেমস-এই ইটালীয়রা প্রথম বাস্কেটবল খেলার সুযোগ পায়। প্রতিযোগিতার বিভিন্ন খেলায় মার্কিনদেরই আধিপত্য ছিল বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিযোগী সলোমন ‘সল’ বাটলার লং জাম্পে শুধু স্বর্ণপদকই জেতেননি, নিজের দেশের মধ্যে ওই ইভেন্টে রেকর্ড গড়েছিলেন। সাঁতারে মার্কিনদের হয়ে একাধিক জয় এনে দেন তৎকালীন নামী সাঁতারু নরম্যান রস। টেনিসে অস্ট্রেলিয়ার জি এল প্যাটারসন ও প্যাট ও-হারা উড এবং ফ্রান্সের আন্দ্রে গোবেয়ার, ঘোড়দৌড়ে ইটালীয় মেজর উবারতালি তাঁদের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করে নেন। দু’সপ্তাহ শেষে ৬ জুলাই এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে ইন্টার অ্যালায়েড গেমস-এর। ফ্রান্স বাদে স্টেডিয়ামের অন্য সব পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। মার্কিন সেনা ওই স্টেডিয়ামটি উপহার দেয় ফরাসি সরকারকে। এই প্রতিযোগিতার পিছনে আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল মার্কিনদের— বেসবল, বাস্কেটবলের মতো তাদের দেশীয় খেলাকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরা। সেই উদ্দেশ্যে খুব একটা অসফল হয়নি তারা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ওই গেমসই মানুষকে যুদ্ধের আতঙ্কের মধ্যে খানিক বিনোদনের সুযোগ করে দিয়েছিল। এক সময় যে দেশগুলির সৈন্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করেছিলেন, তাঁদেরই এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে দেখা গিয়েছিল। যদিও খেলার স্মৃতি মানুষের মনে বেশি দিন থাকেনি। ১৯৬০-এর দশকে ভেঙে ফেলা হয় ওই স্টেডিয়াম। তত দিন মানুষের মন থেকেও হারিয়ে গিয়েছে এই প্রতিযোগিতার স্মৃতি।