মহীয়সী: অঘোরকামিনী দেবী।
নিজের জীবনে প্রথা ভেঙে, কুসংস্কারের বিরূদ্ধে লড়াই করে সমাজকে নতুন পথের দিশা দেখিয়েছেন এমন বঙ্গনারী বিরল হলেও আছেন। দেড়শো বছর আগে নারীশিক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতির পথপ্রদর্শক এমনই এক জন অঘোরকামিনী দেবী। ১৮৫৬ সালে তৎকালীন চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত মাইহাটির শ্রীপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। মাত্র দশ বছর বয়সে বিয়ে হয় বছর উনিশের যুবক প্রকাশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। ১৮৯৬ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক বছর পর স্ত্রীকে সম্বোধন করে প্রকাশচন্দ্র ‘অঘোর প্রকাশ’ নামে একটি পুস্তিকা লেখেন। ১৯০৭ সালে তা পারিবারিক ভাবে প্রকাশিত হয়, পরে ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে পুনর্মুদ্রিত হয়। এই বই মূলত অঘোরকামিনীর জীবনকাহিনি।
সে যুগে বহু নবশিক্ষিত স্বামী স্ত্রীদের লেখাপড়া শেখাতেন। প্রকাশচন্দ্রও ছিলেন স্ত্রীর শিক্ষক। পুস্তিকায় লিখেছেন: ‘সকলে শয়ন করিলে, যখন তুমি শয়ন করিতে আসিতে, তখন তোমার বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হইত। আমি গুরু হইয়া স্বতন্ত্র বসিতাম, তুমি ছাত্রী হইয়া ভয়ে ভয়ে দূরে বসিতে। অনুরাগের সহিত আপনার পাঠ শিখিতে। এইরূপে তোমার ক, খ, আরম্ভ হইল, ক্রমে প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইয়া গেল।’ নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর মতিহারিতে সংসার শুরু, দুই মেয়ে সুসারবাসিনী ও সরোজিনী তখন ছোট, জন্ম হল প্রথম পুত্র সুবোধচন্দ্রের। মতিহারিতে থাকাকালীন প্রকাশচন্দ্র পরিচিত চার-পাঁচ জনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্ম হলেন। মন দিলেন সমাজসেবামূলক কাজেও। লিখেছেন, ‘বুঝিলাম বাহিরের জনসমাজের সেবা না করিলে ঘরের ধর্ম্মও ঠিক থাকে না; আর বাহিরের জগৎ দেখিয়া মনটা বড় না হইলে, ভাল লোকের সঙ্গে মিশিয়া আত্মা উন্নত না হইলে, ব্রাহ্মধর্ম্ম সাধন করা যায় না।’ সেই সঙ্গেই অঘোরকামিনীকে স্মরণ করে লিখছেন, ‘তুমিও ইহা বুঝিতে লাগিলে, তাই এ সময় হইতে আমাদের চেষ্টা হইল যে কিসে আমাদের জীবন, বিশেষতঃ তোমার জীবন, সংসারের সীমা ছাড়াইয়া বাইরে গিয়া ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে।’ দাম্পত্যে এ ধরনের চিন্তাধারা সে যুগে বিরল।
অঘোরকামিনী প্রকৃত অর্থে স্বামীর সহধর্মী, সহকর্মী হয়ে উঠলেন। ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে সেবাকাজের সম্পর্ক ও তার মূল্য বুঝতে শুরু করলেন। ১৮৮০ সালে দ্বিতীয় পুত্র সাধনচন্দ্রের জন্ম উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মসমাজের প্রচারকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বাইরের জগতের সঙ্গে আদানপ্রদান তাঁর মানসিক বিকাশে পরিবর্তন আনে। ‘বাহিরে আসিয়া, তোমার মনের স্বাধীনতা বাড়িতে লাগিল, সাহস বাড়িতে লাগিল... যতই তুমি বাহিরের জগৎ দেখিতে লাগিলে, ততই বুঝিতে পারিলে, এদেশে নারীর অবস্থা কত হীন, এবং তাঁহার উন্নতির পথে পদে পদে কত বাধা— ততই তোমার মনে ক্লেশও হইতে লাগিল,’ লিখেছেন প্রকাশচন্দ্র। স্ত্রীর স্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রকাশচন্দ্র সম্মান করতেন। উপাসনায় সাধারণ প্রার্থনার শেষে পুরুষদের সঙ্গে অঘোরকামিনী দাঁড়িয়ে প্রচলিত প্রথা ভেঙে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এর জন্য তাঁকে নিন্দা ও ভর্ৎসনা সহ্য করতে হয়েছিল।
প্রকাশচন্দ্র রায়
১৮৮২ সালের ১ জুলাই জন্ম হয় বিধানচন্দ্রের। বিধানচন্দ্র রায়, ভবিষ্যতের পশ্চিমবঙ্গের রূপকার, প্রবাদপ্রতিম ডাক্তার ও মুখ্যমন্ত্রী। বিধানচন্দ্রের জন্মের সময় অঘোরকামিনীর বয়স ২৬। বড় সংসার, এত কাজের মধ্যেও মেয়েদের জন্য বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করেন অঘোরকামিনী। শুধু তা-ই নয়, বড় মেয়ের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে বিয়ে দিলেন ভিনজাতের পাত্রের সঙ্গে। আত্মীয়স্বজনদের কাছে তিরস্কৃত হন, কিন্তু সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন।
নতুন জীবন শুরু হল বাঁকিপুরে। ১৮৮৭ সালের ১২ অক্টোবর থেকে অঘোরকামিনী ব্রাহ্মিকা সমাজের কাজে যুক্ত হলেন। তাঁর উপাসনাগৃহে ব্রাহ্ম অব্রাহ্ম সকলেরই স্থান ছিল। তাঁর উদার মানসিকতায় সর্বধর্মের মানুষকে তিনি আপনার করে নিতে পারতেন। এক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের সঙ্গ তাঁর জীবনে আরও পরিবর্তন আনে। কৈলাসচন্দ্র বসুর কন্যা বিন্দুবাসিনীর বিয়ে হয় আনন্দচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে। এই পরিবারটির সঙ্গে আলাপ, একত্র ভ্রমণ, নিমন্ত্রণ, গির্জায় যাওয়ার মধ্য দিয়ে অঘোরকামিনীর সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প আরও বাড়ল। ব্রাহ্ম মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ভাবনায় বাঁকিপুরে নিজের বাড়িতে বোর্ডিং স্কুল স্থাপিত হল ১৮৯১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ভিন্ন পরিবারের মেয়েদের একত্রে রেখে এই কাজ সম্পন্ন করা ছিল খুব কঠিন। অঘোরকামিনী বুঝলেন, নিজেরও শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে হবে। বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে লখনউয়ে মিস থবার্ন প্রতিষ্ঠিত উইমেন্স কলেজে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের সংসার, পাঁচ সন্তানের দেখাশোনা, আর্থিক অসঙ্গতি— কোনও কিছুতেই পিছু হঠেননি। বিস্তর সামাজিক বিদ্রুপ সয়েও শেষে অমৃতলাল বসুর সহায়তায় ১৮৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লখনউ যাত্রা করলেন। প্রকাশচন্দ্র বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার জন্য তোমাকে আবদ্ধ রাখিতে চাহিলাম না; উড়াইয়া দিয়া, উড়িতে দিয়া আক্ষেপ করিলাম না; উড়িতে গিয়া তুমিও আক্ষেপ করিলে না।’
লখনউয়ে ইংরেজি ভাষার শিক্ষা ছাড়াও নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি। তৈরি করতে থাকেন ভবিষ্যতের কাজের রূপরেখাও। নিজেই লিখেছেন, ‘কত কাজ যে করিতে হইবে বলিতে পারি না। কেমন করিয়া হইবে, তাহাও জানি না; কিন্তু করিতেই হইবে। একটি উপাসনা গৃহ, একটি মেয়েদের স্কুল, একটি পীড়িতাশ্রম, একটি ছাত্রাশ্রম স্থাপনা করিতে হইবে। স্কুলটি তো অতি শীঘ্র করিতে হইবে। খরচ আপাততঃ মাসে প্রায় ১০০ টাকা করিয়া লাগিবে। একটা বড় বাটির প্রয়োজন।’ লখনউ থেকে ফিরে দৃঢ়সঙ্কল্প ভাবে কাজে জড়িয়ে পড়লেন। প্রকাশচন্দ্র স্ত্রীর মানসিকতার পরিবর্তন লক্ষ করে লিখলেন, ‘দেখিলাম, এই নয় মাসে তোমার অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। মন প্রশস্ত হইয়াছে; বিদুষী নারীদের সঙ্গে মিশিয়া সাহস বাড়িয়াছে; কার্য্যক্ষেত্র সম্বন্ধে মনের চিন্তা বাড়িয়াছে; হৃদয়ের কোমলতা বাড়িয়াছে; উপাসনার মধুরতা বাড়িয়াছে।’
অঘোরকামিনীর জীবনে মিস থবার্নের প্রভাব বিশেষ উল্লেখ্য। তাঁর কাছে থেকেই তিনি বুঝতে শিখলেন, মেয়েদের বাইরে যেতে হলে কী ধরনের পরিধানের প্রয়োজন। শাড়ির আঁচলে মাথা ঢেকে যাওয়ার অসুবিধে বুঝলেন— আঁচল বার বার মাথা থেকে পড়ে যায়। মিস থবার্নের দেখাদেখি গলা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা এক প্রকার গাত্রাবরণ তৈরি করলেন। তা কখনও শাড়ির ওপরে, কখনও ভেতরে পরতেন। এই সময় থেকেই জুতো-মোজা পরার অভ্যেস করলেন। প্রকাশচন্দ্র স্ত্রীর পোশাকের এই পরিবর্তন দেখে লিখলেন, ‘বঙ্গনারীর যে জড়সড় ভাব এই সময় হইতে তাহা তোমাকে ছাড়িয়া পলায়ন করিল।’
দশটি অল্পবয়সি মেয়েকে নিয়ে বাঁকিপুরে স্কুলের শুরু। কয়েক মাসের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা হল ২৯। এ ছাড়া পনেরো জন হিন্দিভাষী মেয়েও এল। মেয়েদের রান্নাবান্না শেখার চেয়ে লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে অঘোরকামিনী বিশেষ জোর দিতেন। স্বামীকে বলেছিলেন, ‘‘৭/৮ বৎসর মাত্র মেয়েরা পড়িতে পায়, তাহা হইতে যদি রান্না শিখিতে সময় কাটিয়া লওয়া যায়, তবে কিছুই শিক্ষা হইবে না। আমি ১৫ দিনের মধ্যে মেয়েদের রান্না শিখাইয়া দিব।’’ মেয়েরা যে সহজে স্কুলে আসত তা নয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মায়েদের সঙ্গে অনেক কথা বলে তাদের বুঝিয়ে এক-একটি মেয়ে জোগাড় করতে হয়েছে তাঁকে। এই সব ‘বাইরের কাজ’ ছাড়াও অন্তঃপুরে শাশুড়ির সেবা, সন্তানদের ওপর নজর রাখা, অতিথি আপ্যায়ন, সবই চলত। স্বাস্থ্য ভাল ছিল না, শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক চাপ দুই-ই ছিল। অর্থের ভাবনা, অসুস্থ পরিজনদের সেবা, এ সবের শক্তি পেতেন ব্রহ্মোপাসনার মাধ্যমে।
কারও অভাব জানতে পারলে নিজের যা কিছু থাকত তা বিলিয়ে দিতেন। অলঙ্কার, বেশভূষার কোনও চাহিদা ছিল না। এক দিন এক জন বেনারসি শাড়ি বিক্রি করতে এসেছে, দেওরের মেয়ে বসন্ত তার জেঠতুতো দিদি সরোজিনীর (অর্থাৎ অঘোরকামিনীর দ্বিতীয় কন্যা) জন্য একটা শাড়ি কেনার জেদ করলেন। অঘোরকামিনী কিন্তু সব শাড়ি দেখে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, একখানা কিনলে তো হবে না, আমার দশটা মেয়ে, দশখানা কিনতে হবে। পরিবারের সব মেয়েই তাঁর মেয়ে!
ধর্মপ্রাণ হয়েও তিনি ধর্ম ও কুসংস্কারের তফাত বুঝতেন। তাঁর জীবনের অনেক ঘটনাই চমকে দেওয়ার মতো। নিজেই লিখেছিলেন, ‘আমি নিজে ৩০ বৎসর সিন্দুর ছাড়িয়া, বিধবা সাজিয়া থাকি।’ সধবা থাকাকালীনই মাঝে মাঝে বিধবাদের মতো সাদা থান পরতেন। বলতেন, বস্ত্রে কি সধবা বিধবা হয়? প্রকাশচন্দ্রের লেখায় ফুটে ওঠে সংস্কারমুক্ত অঘোরকামিনীর কথা: ‘প্রথম প্রথম শাঁখা পরিধান করিতে, শেষে চুড়ি পরিতে, কিন্তু জীবনের শেষ কয় বৎসর শূন্য হস্তেই থাকিতে। হাতে নোয়া না থাকিলে স্বামীর অকল্যাণ হয়, এ কুসংস্কার তোমার ছিল না।’ এ ঘটনা দেড়শো বছর আগের! অঘোরকামিনীর থান পরা বা সিঁদুর নোয়া না পরা ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে, ১৮৯৬ সালের ১৫ জুন মারা যান অঘোরকামিনী। স্বল্পায়ু জীবনেও তিনি এক মহান শিক্ষাব্রতী, সমাজের পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবনদর্শন, ত্যাগ, দৃঢ় মানসিকতা নারীজাগরণের পথ প্রশস্ত করেছে। সমাজের কুসংস্কার, কুপ্রথার বিরুদ্ধে যিনি লড়েছিলেন, তাঁকে ভুলে যাওয়া বাঙালি সমাজের পক্ষে নিতান্ত লজ্জার হবে।