আমার পড়ুয়া জীবনটা কেটেছে উদয়পুর, রাজস্থানে। সে সময় অসিত সেনের ‘শরাফত’ ছবিটা মুক্তি পেয়েছে। এক দিন বন্ধুদের মধ্যে ছবিটা নিয়ে তর্ক করছিলাম। এই সময় এক জন আমাকে বলে উঠল, ‘বড় বড় কথা তো বলছিস। আগে নিজে একটা ছবি কর।’
মানে লেগে গেল। ঠিক করলাম, মুম্বই যাব। ছবি পরিচালনা শিখব। তখন আমার বছর কুড়ি বয়স। গুলজার সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম, তাঁর অধীনে কাজ করব। দেখা করব বলে অফিসে ঢুকছি, তিনিও সেই সময় অফিস ঢুকছেন। সুতরাং, দরজার সামনে মুখোমুখি পড়ে গেলাম। কথাবার্তাও সেখানেই হল। ইচ্ছেটা খুলে বললাম। উনি আমাকে পরের দিন দেখা করতে বললেন। চার-পাঁচ মিনিট কথা বলবেন আমার সঙ্গে। পরের দিনের সেই কথাবার্তা গড়াল আড়াই ঘণ্টা। আসলে, আমার কথা শুনে ওঁর খুব ভাল লেগে যায়। তখন সহকারী পরিচালকের একটা পদ ফাঁকা ছিল। উনি সেখানে আমাকে নিয়ে নেন। আমি মূলত সেখানে অনুবাদকের কাজ করতাম।
তখন ‘অঙ্গুর’ ছবিটার শুটিং চলছে এসএল স্টুডিয়োয়। শেক্সপিয়র-এর ‘কমেডি অব এরর্স’ অবলম্বনে ছবি। বাংলায় ‘ভ্রান্তিবিলাস’। শুটিং চলার সময় এক দিন তুমুল বৃষ্টি। মুম্বইয়ের বিখ্যাত বৃষ্টি। এমনিতেই এসএল স্টুডিয়োটা এমন জায়গায় যে, সেখানে পৌঁছনোটা খুব ঝকমারি ব্যাপার ছিল। যাই হোক, কোনও রকমে তো পৌঁছেছি। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দেখি, অনেকেই আসতে পারেননি। সে দিন আবার আমাদের দুটো সিন তোলার কথা। একটা সঞ্জীবকুমারের সঙ্গে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের, আর একটা সঞ্জীবকুমারের সঙ্গে জনৈক অভিনেতার। তো, সেই অভিনেতা সে দিন পৌঁছতে পারেননি। এ দিকে সঞ্জীবকুমার পরের দিন দিল্লি চলে যাবেন, ‘সিলসিলা’র শুটিংয়ের জন্য। গুলজার সাহেব তো মহা বিপদে পড়লেন। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘তোর সিনটা মুখস্থ আছে তো? তুই বরং দাঁড়িয়ে পড় মুখটুখ মুছে।’
আমি তো অবাক, গোটা ফ্লোরও হাঁ হয়ে গিয়েছে। কী আর করা, মেক-আপ ছাড়াই মুখটা একটু মুছে নিয়ে শুটিংয়ে নেমে পড়লাম। খুব মজার ছিল সিনটা। ছবিতে আমি সঞ্জীবকুমারের অ্যাসিসট্যান্ট। সঞ্জীবকুমার বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে অফিস গিয়েছেন। তিনি চান না, বউ অফিসে ফোনটোন করুক। ফলে তিনি অফিসের ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছেন। এ দিকে ঠিক সেই সময়ই আমার গার্লফ্রেন্ডের ফোন আসার কথা। ফলে আমি বার বার রিসিভারটা ক্রেড্লে রেখে দিচ্ছি। এমন সময় সঞ্জীব আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘তুমি কি বিয়ে করেছ? কখনও কোরো না। বিয়ে খুব খারাপ জিনিস...’ এই সব বলেটলে ফের রিসিভারটা নামিয়ে রাখছেন। আর আমিও ‘ইয়েস স্যর’ বলে আবার রিসিভারটা তুলে ক্রেড্লে রেখে দিচ্ছি। ছোট্ট রোল। কিন্তু বেশ টেনশনে ছিলাম। অত বড় এক জন অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করব! তা-ও আবার জীবনে প্রথম বার। কিন্তু আশ্চর্য, গোটা সিনটাই, একটামাত্র শটে চমৎকার উতরে গেল। অনেক ক্ল্যাপ পড়ল। দেখি, সঞ্জীবকুমার এগিয়ে আসছেন। বললেন, ‘খুব ভাল করেছিস।’ তার পর গুলজারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গুল্লু, এর মধ্যে ট্যালেন্ট আছে। একে কাজে লাগা। শুধু সহকারী করে রাখিস না।’
এর কিছু দিন পরেই দেবেন বর্মা আমায় ৫০১ টাকা দিয়ে ‘জয় রামজি কি’ নামে একটা ছবির জন্য সই করালেন। আমি আর পদ্মিনী কোলাপুরি অভিনয় করব। দেবেন বর্মারই প্রোডাকশন হাউসের ছবি। আমার সে কী উত্তেজনা! রাতে ভাল করে ঘুমোতেই পারলাম না। কিন্তু এ ছবিটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। এই প্রোডাকশন হাউসেরই আগের একটা ছবি বক্স অফিসে এমন বিচ্ছিরি ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল, তারা প্রোডাকশনই বন্ধ করে দেয়।
এর পরের ছবি কে বালাচন্দর-এর। ‘এক দুজে কে লিয়ে’র পরিচালক। তাঁকে তখন দক্ষিণের সত্যজিৎ রায় বলা হয়। কমল হাসন, রজনীকান্তের মতো সুপারস্টারদের তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। আমি দেখেছিলাম, বালাচন্দরের সামনে কমল হাসন, রজনীকান্তরা বসতেন না। দাঁড়িয়ে থাকতেন। ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। তো, এই বালাচন্দর তখন ‘জরা সি জিন্দেগি’ নামে একটা ছবি বানাচ্ছিলেন। তাতে গুলজার সাহেব ডায়ালগ লিখছিলেন। তিনিই আমার নাম সুপারিশ করেন। সুতরাং একটা প্যারালাল রোলে বালাচন্দর আমাকে নিয়ে নিয়ে নেন। সে দিক থেকে দেখলে, এটাই আমার প্রথম ছবি। সেটা ১৯৮৩ সাল।
‘জরা সি জিন্দেগি’ একটা জনপ্রিয় তামিল ছবির রিমেক। বালাচন্দরই ১৯৮০ সাল নাগাদ সেটির পরিচালনা করেন। লিড রোলে ছিলেন কমল হাসন আর শ্রীদেবী। এই ছবিতেও কমল হাসন ছিলেন। সঙ্গে অনিতা রাজ, করণ রাজদান, শ্রীরাম লাগু-র মতো দিকপালরা। চেন্নাই আর দিল্লিতে হয়েছিল শুটিং। কাজের খোঁজে দিল্লিতে আসা তিনটি বেকার ছেলের গল্প। তাদের জীবনের নানা ওঠাপড়া, প্রেম। এদের মধ্যে আমি ছিলাম এক পঞ্জাবি ছেলের ভূমিকায়। ছবির শেষে আমি প্রচণ্ড ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগে পাগল হয়ে যাব। আমাদের পরিচালক ছিলেন দারুণ খুঁতখুঁতে। কাজের সঙ্গে কোনও রকম আপোস করতেন না। যেটা চাই, সেটা চাই-ই। শুটিংয়ের জন্য যদি উনি একটা বাস চেয়ে থাকেন, ঠিক সেটাই জোগাড় করতে হবে। সেটা না পেয়ে শুটিং ক্যানসেল করে দিয়েছেন, এমনও হয়েছে। ফলে, ঠিকমত কাজ না করলে উনি ভীষণ বকতেন। আবার ভালওবাসতেন। অদ্ভুত এক মানুষ। খুব তারিফ করেছিলেন আমায় এই কাজটার জন্য। মনে আছে, গুলজার সাহেবকে ফোন করে আমার সম্পর্কে তিনটি শব্দ বলেছিলেন, ‘হি ইজ দ্য টলেস্ট, ইয়াংগেস্ট অ্যান্ড বেস্ট।’
আর এর পরই ‘অঙ্কুশ’। নানা পটেকরের সঙ্গে। অসাধারণ জনপ্রিয়। আর বাংলায় তো এলাম মৃণালদার হাত ধরে।