Rabri Village

রাবড়িগ্রাম

নীচে গনগনে আঁচ। উপরে পাখার হাওয়া। নরমে-গরমে রাবড়ির নির্মাণকৌশলেই যেন নিহিত জীবন-দর্শন। বাংলার এই গ্রাম্যপল্লির জীবনযাপনও শুধুই রাবড়িময়।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৪০
Share:

সরসন্ধান: চেঁছে তোলা সর মিশে গিয়েছে ঘন লালচে দুধের আশ্রয়ে। সব ছবি: দীপঙ্কর দে।

এমন ননী, ছানার গাঁয়ের কথা জানতেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! যার হদিস পেলে অবলীলায় সুসভ্যতার আলোক ছেড়ে দিতেও রাজি ছিলেন তিনি। না, বৃন্দাবন নয়! কলকাতা থেকে মোটে সওয়া ঘণ্টার রাস্তা! আর ননী-ছানা না-হলেও দুধ-সর তো বটেই! রাবড়িগ্রামে পৌঁছে ব্রজের গোপবালকের বদলে গোড়াতেই ছোট্টু কামুড়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

Advertisement

ভরদুপুরে খালি গায়ে ঘেমে চান করে তখনও এক সঙ্গে দু’-দু’টো প্রকাণ্ড কড়ায় রাবড়ির সর টানছেন তিনি। এমন দশ-বারোটা কড়ার সর না-নিংড়ে শান্তি নেই। সরসন্ধান চলবে রাত বারোটা অবধি। দিন শুরু হয়েছে ভোর পাঁচটায়, রাবড়ির ক্যান নিয়ে কলকাতা-অভিযানে। দুপুরে ফিরেও ছুটি নেই। ফুরসত পেলে বিকেলে ভাত খেয়ে বড়জোর এক ঘণ্টাটাক গড়িয়ে নেবেন। সন্ধ্যায় আবার রাবড়ির জন্য ফ্রেশ দুধ চলে আসবে। বছর চারেক আগে বিয়ের পরে দু’দিনের জন্য সপরিবার অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে গেছিলেন ছোট্টু। সম্ভবত সেটাই প্রথম এবং শেষ। তার আগে ডানকুনির কাছে আঁইয়া গ্রামের গনগনে ‘ভেনঘর’ ছেড়ে কবে কোথায় বেড়াতে গিয়েছেন, চেষ্টা করেও মনে পড়ে না! মধ্য-তিরিশে পৌঁছে দু’বছরের পুত্রের পিতা ছোট্টুর কৈশোর-যৌবন সবই রাবড়িপুজোয় উৎসর্গীকৃত।

এমনটা যে হবে, বিয়ের আগে হবু স্ত্রীকে খুলে বলেছিলেন তো!

Advertisement

শুনে কড়ার গায়ে ঘ্যাসঘ্যাস করে চৌকো চৌকো সর কাটা থামিয়ে ফ্যালফেলিয়ে তাকান ছোট্টু। নাগাড়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে এ সব বদ রসিকতায় বিরক্তি ধরা স্বাভাবিক! তবে সম্ভবত ক্লান্তিতেই ছোট্টুর প্রতিক্রিয়া ভোঁতা। পাশে ঠোঁট উল্টে ফিক করে হাসেন স্ত্রী কুহেলিকা। সকাল থেকে রাত এই গ্রামীণ গেরস্থালির রাবড়ি যজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তিনি নিজেও। রাবড়ি সৃষ্টি চলছে ছোট্টুর বাবা ভুবন ওরফে বংশী কামুড়ের যুবক বয়স থেকে। বাড়ির সক্কলে রাবড়ি-শৈলীতে সড়গড়। রোজ কম-বেশি ২০-২৫ কিলো রাবড়ি নির্মাণ এবং তা কলকাতায় সরবরাহের জোয়াল পরিবারটির ঘাড়ে রয়েছে। জীবন বলে আর কী-ই বা অবশিষ্ট থাকে! তাই সংসার ছেড়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, এমনকি পুজোয় ঠাকুর দেখা, সবই বিলাসিতা এই রাবড়ি-সর্বস্ব জীবন যাপনে।

রোজ কাকভোরে দু’হাতে বালার মতো ভারী ক্যানের হাতল ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরোতে দেখা যায় ছোট্টুকে। গ্রামের ঠিক বাইরে পিচরাস্তায় ২৬সি বাস ধরার তাড়া। ক্যানে রাবড়ির সর, ঝোল খলবল করে। কাকভোরে রাবড়ি-শিল্পীর ভিড়ে (না কি শ্রমিকদের) বাস সরগরম। বনহুগলি পৌঁছনোর পরে দুপুর পর্যন্ত রাবড়ি সাপ্লাইয়ে ব্যস্ত ছোট্টুকে ‘গেছোদাদা’ নাম দিলেও ভুল হবে না!

*****

মানে সকালে কলকাতায় পৌঁছে ছোট্টু কখন কোথায় আছেন ঠাহর করাই এক উদ্ভট অঙ্ক। ধরা যাক, আপনি যখন ধরে নিলেন ছোট্টু বাগবাজারে, তখন হয়তো তিনি রয়েছেন বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ে, কিন্তু ছোট্টুকে ধরতে বি কে পালে এসে আপনি শুনলেন তিনি বাগবাজার হয়ে টালার সরকারবাগানে পৌঁছে গেছেন। আবার টালা থেকে ছোট্টু কখন গৌরীবাড়ি বা রাজাবাজার বড় মসজিদ হয়ে শিয়ালদহে কোলে মার্কেটের দিকের ভিড়ে মিশে যাবেন, তা ঠাহর করাও সোজা কাজ নয়।

ঠিক কোন কোন ঠিকানায় রাবড়ি কাঁধে ছোট্টুর পদার্পণ ঘটে, তা অবশ্য খোলসা করে বলা নিষেধ! চণ্ডীতলার আঁইয়া বা জাঙ্গিপাড়া ব্লকের গাংপুর গ্রাম থেকে কলকাতার কোন কোন দোকানে রোজ রাবড়ি সাপ্লাই হয়, সে কথা শুনলেও ‘উচ্চারণ করব না’ কথা দিয়ে মন্ত্রগুপ্তি মেনে চলার আশ্বাস দিতে হয়েছিল। রাবড়িগ্রামের হাঁড়ির খবর জানার এ হল প্রাথমিক শর্ত।

উত্তর কলকাতা ছাড়িয়ে ঠাকুরপুকুর বা তারাতলার মিষ্টির দোকানেও সকাল-সকাল আঁইয়া বা গাংপুরের কোনও প্রতিনিধির দেখা মিলবে। দক্ষিণ কলকাতার নামজাদা মিষ্টি হেভিওয়েটরাও অনেকেই নিয়মিত শো-কেসে রাবড়ি রাখেন। কিন্তু তাঁদের কারখানায় সচরাচর রাবড়ি সৃষ্টির জায়গাটি দেখা যায় না। আর বিশেষ দরকারে রাবড়িগ্রামের শরণাপন্ন হওয়ার লিস্ট ঘাঁটলে বোধহয় গোটা দক্ষিণবঙ্গই ছেয়ে যাবে। পিচরাস্তার ধারে দেবদেবীর ছবি-আঁকা দোতলা পাকাবাড়ির বাসিন্দা শৈলেন্দ্রনাথ বালতি সগর্বে বলেন, “কত লোক এসে বহু দূরে ভিন রাজ্যেও আমাদের রাবড়ি নিয়ে যায়। রাবড়ি নিয়ে আমি ডায়মনেও গেছি (ডায়মন্ড হারবার)! আমতলা থেকে বারাসত, হাওড়া এমনকি বাঁকুড়াতেও আমাদের রাবড়িগ্রাম পাড়ি দিয়েছে।” রাবড়িগ্রাম নামটাও মোটে ঠাট্টা নয়! সবজান্তা গুগল বাবাজির ম্যাপ পর্যন্ত তাকে মান্যিগন্যি করে। ‘রাবড়িগ্রাম’ লিখে কলকাতা থেকে গাড়িতে ডানকুনি হাউজ়িং মোড় হয়ে বাঁয়ে ঢুকুন! মশাট বাজার পেরিয়ে চোখ বুজে সিধে রাস্তায় আপনি এই রাবড়ি-রাজত্বে এসে পৌঁছবেন।

বাবা ও মা রাবড়ি তৈরি করছে দুই মেয়ে পাশে বসে।

*****

কাশীর কচৌরি গলির হনুমান হালুইকরের রাবড়ি নিয়ে লাখ কথার এক কথা বলেছিলেন লালমোহনবাবু বা জটায়ু। রাবড়ির আবিষ্কারটা টেলিগ্রাফ-টেলিফোন আবিষ্কারের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়! কথাটিতে সত্যজিতের পিসি লীলা মজুমদারের মতেরই প্রতিধ্বনি। লীলা লিখেছেন, রান্না-খাওয়াই মানুষের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাজমহল, পিরামিড বা পিসার বাঁকা মিনারের থেকেও তা ঢের কাজের! রাবড়িগ্রামে ঢুকে ঘরে ঘরে রাবড়ির আঁতুড়ে কিছু ক্ষণ কাটালে আবার বুদ্ধদেব বসুর উপলব্ধি অমোঘ হয়ে ওঠে। বাঙালি গৃহিণীর হেঁশেলে বিবিধ সৃষ্টি আচার, মোরব্বা তৈরির ‘ললিত-কলার’ ধকলের সঙ্গে তিনি একদা যন্ত্রযুগেরও ঢের আগে পিরামিড তৈরির গাধা-খাটুনির তুলনা করেছিলেন। এ কালে বাঙালি ময়রার মিষ্টি সৃষ্টির ‘ভেনঘর’ নানা যন্ত্রের উদ্ভাবনে কারখানার চেহারা নিয়েছে। কিন্তু রাবড়ি-শৈলীতে বদল নেই।

এখনও উনুন বা গ্যাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুধের কড়াই বসিয়ে হাতপাখার হাওয়া দিতে হয়। ঠান্ডা-গরমের এক অদ্ভুত ভারসাম্যে তপ্ত দুধের স্তরে সরের গাঢ় পরত পড়ে। বাখারি বা বাঁশ-ছেঁচা কাঠিতে সেই সর চকিতে তুলে নিয়ে কড়ার গায়ে ধাতব পাতে জড়িয়ে দিতে হবে। রাবড়িগ্রামের কণিকা বালতি, মিঠু বালতিদের চোখ বেঁধে দিলেও হাত চলবে। পর পর রাবড়ির সর ওঠাতে ভুল হবে না! গাংপুরের গিন্নি সীমা ঘোষকে দেখি জ্বর গায়ে রাবড়ির তপ্ত কড়াইয়ের ধারে পাখা হাতে বসে। বর শিশিরকুমার ঘোষ সোদপুর থেকে ডানলপ রাবড়ি পৌঁছে বিকেলের মুখে জল-ঢালা ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু সীমার ছুটি নেই! অনেকে বলেন, রাবড়ি তৈরি মেয়েদেরই কাজ! টানা গরমে বসে দুধের কড়াইয়ে খুন্তি নাড়া বা সাবধানে সর টানার কাজে মেয়েদের সহজাত ধৈর্যই সম্পদ। সীমাকে সাহায্য করতে আসা পড়শিনি মধুমিতা ঘোষ বললেন, “জ্বর না-হলে ও একাই দু’টো কড়াই টানতে পারত!”

*****

একদা কলকাতার ডাকসাইটে রাবড়ি বিশারদ চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভান্ডারের নিতাই ঘোষের দেশের বাড়ি মশাটের আশপাশে। আঁইয়া, গাংপুরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর বহু দিনের পরিচয়। জটায়ু যেমন রাবড়ির সঙ্গে টেলিফোন-টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের তুলনা করেছিলেন, তেমনই নিতাইবাবু বলেন রাবড়ি-বিজ্ঞানের কথা। তাতে একটাই লক্ষ্য, দুধের সুষম ভাঙা-গড়া। বাঙালির ভাঁড়ারে কাশীর হালুইকরের মতো উচ্চাঙ্গের দুধ নেই। তা বলে বাঙালির রাবড়ি-শৈলী কারও থেকে কম নয়। কাশীর অপূর্ব স্বাদের রাবড়ি সর-ঘাঁটা থকথকে! আবার দুধকে সর, ঝোলে ভেঙে ভাগাভাগির কসরতেই বাঙালির হাতযশ। সদ্য কড়া থেকে নামার পরে বুড়বুড়ি-কাটা কুলীন দুধের কুলীন রাবড়ি মুখের ভেতর কুলকুচি করেন পুণ্যবান! তার পর আর আঁচাতে ইচ্ছে করবে না। মোষের দুধে ক্রিম ভাব বেশি হলেও অভিজ্ঞদের মতে রাবড়ির স্বাদ-মাহাত্ম্য গরুর দুধেই! এ কালে বটের রসের মতো আঠালো দুধের কদাচ দেখা মেলে।

বড়বাজারের রাবড়ি হেভিওয়েট তারাসুন্দরী পার্কের বিনোদ ঘোষের রাবড়িতে গরুর সঙ্গে মোষের দুধও মেশে। কলকাতার কয়েকটি অবাঙালি দোকান তাদের থেকে রাবড়ি কিনে অন্য রকম প্যাকেজিংয়ে বেচেন। রাবড়ির গায়ে পেস্তা, কাঠবাদামের গয়না ছড়িয়ে দামটা বাড়িয়ে নেন তাঁরা। তবে শুধুমাত্র দুধ-চিনির উপাদানে এমন আশ্চর্য সৃষ্টি সম্ভব, ভাবলে অবাক হতে হয়।

রাবড়ির স্বাদ-মহিমায় আমরা অনেকেই বাঙালি ঘরানার অনুরাগী। রাবড়িগ্রামও সেই পথ অনুসারী। কিন্তু রাবড়ির স্বাদ? সৃষ্টির কঠোর পরিশ্রমকে কুর্নিশ করেও ভাল বা সেরা জাতের রাবড়ির জন্য হাহাকার এড়ানো মুশকিল।

*****

এ যুগে ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে রিল, ভ্লগে রাতদিন খাবারের চর্চায় মশগুল বাঙালি। তবে রাবড়ির সঙ্কট নিয়ে সম্ভবত কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। পদ্মার ইলিশের আকালে ফি-বর্ষায় এই বঙ্গে যে পরিমাণ কান্নাকাটি শোনা যায়, তা বহু পীঠস্থানে রাবড়ি সৃষ্টি বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে বিস্ময়কর ভাবে নীরব। শ্যামপুকুরের চিত্তরঞ্জনই ২০২০-র পরে কালেভদ্রে রাবড়ি তৈরি করেন। এর পিছনে অনেক কারণ। দুধের মানের দৈন্যদশা। কারিগরের অভাব। তবে সব মিলিয়ে মনে হয়, বাঙালি ময়রাকুল থেকে গড়পড়তা মিষ্টিখোরের রুচির অবক্ষয়টাই আসল কারণ। নইলে ‘শিব্রাম চকরবরতি’ যে রাবড়ির নেশা করার কথা বলতেন, এত সহজে তা কী করে ভুলে গেলাম আমরা? নেশা করার মতো রাবড়ি এখন কোথায়! শিব্রামের প্রিয় কলেজ রো-এর সন্তোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারও আজ ইতিহাস। বাংলার বাঘের মতোই ভাল রাবড়িও বিরল থেকে বিরলতর হচ্ছে বললে ভুল হবে না।

বলা যায় এই সঙ্কটেই রাবড়িগ্রামের উত্থান! উৎকর্ষে আপস করব না বলে অনেক মিষ্টি-স্রষ্টা রাবড়ি সৃষ্টিই বন্ধ করেছেন। যৎসামান্য রাবড়ি হয়তো উৎসব-অনুষ্ঠানে গৃহদেবতার সেবা বা সাধুসেবার জন্য তোয়ের হল। ব্যস! কিন্তু তা দিয়ে বাণিজ্য করা চলে না! রাবড়ি নিয়ে ছেলেখেলা না-করে রাবড়ি ঐতিহ্যেই কেউ কেউ যবনিকাপাতে বিশ্বাসী। তবে বেশির ভাগ মিষ্টি-কারবারিই অন্য রাস্তা নিয়েছেন। দোকানের এক জন কারিগরকে দিয়ে সারা দিন ধরে দফায় দফায় দশ-বারো কিলো রাবড়ি তৈরি করানোর বিস্তর হ্যাপা! তার থেকে রাবড়ি তৈরির প্রক্রিয়াটাই আউটসোর্স করে দেওয়া ভাল। গ্যাসের খরচ, কারিগরের উপরে খবরদারি, দুধের মান নিয়ে দুশ্চিন্তা— কত কিছু থেকে মুক্তি।

রাবড়িগ্রামের রাবড়ি বিক্রির পাইকারি হার কমবেশি ৩০০ টাকা কেজি। সেই রাবড়িই অন্য অনেক ময়রা মোটা টাকা লাভ রেখে বেচছেন। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু কলকাতায় বিক্রির জন্য যে রাবড়ি এক দিন আগে তৈরি হয়, তাতে চিনির ভাগটা অত্যধিক বললে কম বলা হয়। রাবড়িগ্রামে পাতলা রাবড়ির রসে ভারী, মোটা সর ডুবে থাকে। দেখলেই চেনা যায়, গরুর দুধের হালকা লালচে ভাব। তবু মোলায়েম সরের চাদর-বিছানো ঘন দুধের সেই ধ্রুপদী রাবড়ি আর কোথায়, দুধের গন্ধেই যার বিভোর হতে হয়! দুধের মান আগের থেকে সর্বত্রই খারাপ হয়েছে, সে কথা এক বাক্যে মানেন অনেকে। এ কালের রাবড়িতে সে কালের গন্ধ নেই! সুতরাং ঠেসে চিনি-গোলা পাতলা দুধের রাবড়ি তিন-চার দিন ধরে খাওয়াই আজকের বাঙালির ভবিতব্য।

*****

নবাব সিরাজউদ্দৌলার ‘রোজের পথ্যি’ গোলাপি গরুর দুধের সরভাজা একমাত্র স্বপ্নেই চাখা সম্ভব। কোনও ইতিহাসবিদের খুঁজে আনা নথি নয়, পরশুরামের ‘রাজভোগ’ গপ্পে তার খুঁটিনাটি মালুম। সত্যিকারের গোলাপি রঙের গরু ভাববেন না! ধর্মতলার অ্যাংলো-মোগলাই হোটেলের ম্যানেজার রাইচরণ চক্কোত্তির নিদান, একটি ভাল জাতের গাইগরুকে সাত দিন ধরে সেরেফ গোলাপ ফুল, গোলাপজল আর মিছরি খাওয়াতে হবে। খড়, ভুসি, জল খাওয়ানো একদম বারণ। তবেই সে গরু এমন খুশবুদার দুধ দেবে যার রং একেবারে গোলাপি। সেই দুধ ঘন করে সর নিতে হবে, এবং সে দুধ থেকে তৈরি ঘিয়েই ভাজতে হবে। সেই সরভাজা চিনির রসে ফেলারও দরকার নেই। কারণ গরুর টানা মিছরি সেবনে দুধটাই মিঠে। আর গরুকে সিদ্ধি খাওয়ানো হলে যা মজাদার হবে সরভাজা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!

আঁইয়া, গাংপুরে আঁচে পোড়া বাস্তবে এ সব গালগল্পের রোম্যান্স নেই! মা কালী, শ্রী দুর্গা, মহাপ্রভু, লক্ষ্মী গণেশ, শান্তি কালী রাবড়ি ঘর, ভান্ডার বা রাবড়ি হাউসের ছড়াছড়ি। মেনুতে সরভাজা, মরসুমি নলেন গুড়ের রাবড়ি, ম্যাঙ্গো রাবড়ি, শুগার-ফ্রি রাবড়ির ফিরিস্তি। আবার অর্ডার পেলে স্পেশাল গাওয়া ঘি-ও বানিয়ে দেন রাবড়ি-শিল্পীরা। এক জন দর হাঁকালেন, ঘি কিন্তু ১২০০ টাকা কেজির কমে হবে না। মাঠা-তোলা গরুর দুধে পনেরো দিন লাগে ঘি বানাতে। তৈরির খরচাই ১১০০ টাকা।

রাবড়িগ্রামের আদি নির্মাতা মনসাচরণ বালতির পুত্র নেপালচন্দ্র বলেন, “শুগার-ফ্রি রাবড়ি বা কম মিষ্টি রাবড়ি আমরাও পারি বইকি! বিয়েবাড়ির জন্য তো কত করি! তবে দাম বেশি পড়বে।”

রাবড়িগ্রামই কলকাতার রাবড়ি বাঁচিয়ে রেখেছে। আবার রাবড়িগ্রামের নিন্দুকেরও অভাব নেই। ছোট্টু রেগে কাঁই, “যত্ত উল্টোপাল্টা কথা, আমরা না কি অ্যারারুট দিয়ে রাবড়ি বানাই! কী করে রাবড়ি হয় এসে দেখে যাক!” রাবড়িগ্রামের বেশির ভাগ ঘরেই চার-পাঁচটা গ্যাসের চুল্লিতে সারা দুপুর কড়াই ভরা দুধে সর টানা চলছে। ছোট্টুরা এখনও কয়লার উনুন ছাড়েননি। ২০ টাকা কেজি কয়লায় রোজ উনুন ধরানোর ধকল বনাম চলতি জমানায় গ্যাসের দাম— এটা অর্থনীতির প্রশ্ন। তবে কাঠকয়লার আঁচে কাবাবের মতো ছোট্টুরা রাবড়ির উৎকর্ষেও কয়লার কার্যকারিতায় বিশ্বাসী।

তারাসুন্দরী পার্কের বিনোদ ঘোষের নাতি, সর ও রাবড়ি বিশারদ অশোক ঘোষেরও টান কয়লার উনুনের রাবড়ির দিকেই। তবে তিনি বলেন, “আমরা কিন্তু লিটার-পিছু ২৫ গ্রামের বেশি চিনি দিই না! মিষ্টি নয়, রাবড়ির ঘন হওয়া দুধের স্বাদই শেষ কথা!” রাবড়িগ্রামে কড়াই ভর্তি ৬-৭ লিটার দুধের সঙ্গে ৪০০-৫০০ গ্রাম চিনি দেওয়াই দস্তুর। ফারাকটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট! ছোট্টুর বাবা বংশী বালতি বলেন, “আমরা চাইলে ২০০-২৫০ গ্রাম চিনিতেও কেজি দুয়েক রাবড়ি করে দিতে পারি! অপূর্ব স্বাদ! তবে দিনের দিন খেয়ে ফেলা চাই! কলকাতার মিষ্টির দোকান তা নিতে চাইবে না!”

*****

জন্মাষ্টমীর সময়ে বালি থেকে উজিয়ে মোটরবাইকে বাড়ির পুজোর রাবড়ির জন্য এসেছিলেন দুই বন্ধু অনিরুদ্ধ জাটি আর মানস চক্রবর্তী। দোরে দোরে ঘুরেও কেজি দেড়েকের বেশি রাবড়ি মিলল না। বিষ্টুপদ বালতি আফসোস করেন, গোটা ফ্যামিলি মিলে দিনে ১০০ লিটারের কাছাকাছি দুধের কাজ করে থাকি! পুজোপার্বণের দিনে চাহিদা ডবলের কাছাকাছি ছুঁতে চায়। খেটেখুটে নামাতেই পারি! কিন্তু অত দুধ কই? কলকাতায় সন্দেশ থেকে রাবড়িতে আজকাল মোষের দুধেরই রমরমা। মিষ্টির প্রোডাকশন বাড়াতে এ ছাড়া গতি নেই। তবে রাবড়িগ্রামে স্থানীয় দুধওয়ালার গোদুগ্ধই ভরসা।

রাখাল বালতির বৌ কণিকা আবার বোঝান, কী ভাবে খাঁটি ম্যাঙ্গো রাবড়ি তৈরি হবে! এসেন্স-টেসেন্স নয়! নামানোর আগে কড়ায় একটা করে ভাল হিমসাগর ফেলেই রাবড়ির রং-গন্ধে বদল আসে! এই রাবড়ির জোরেই টিভিতে ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ অবধি পৌঁছে গেছেন কণিকা। ভেনঘরের উত্তাপ আর উত্তেজনায় গাঁয়ের বধূর চোখমুখ টকটক করে।

*****

নেপাল ও রাখাল বালতির বাবা মনসাচরণ বালতিই ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে এ তল্লাটে রাবড়ি তৈরি শুরু করেন। মনসাচরণ ভবানীপুরে মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। কাজের ফাঁকে নিজে রাবড়ি বানিয়ে খদ্দেরদের বেচতে শুরু করলেন। তখনই বোঝেন, পরের গোলামির থেকে নিজে রাবড়ি ভান্ডার খোলাই ঢের ভাল! পাড়াতুতো ভাইপো পান্না বালতির সঙ্গে মনসার শেয়ারের ব্যবসা শুরু হল গ্রামেই। গাঁয়ে বেশির ভাগই জাতে গয়লা! ময়রার দোকানে চাকরি, ছানা সরবরাহের কাজ করতেন। এখন গাংপুর, আঁইয়া মিলে কম করে পঞ্চাশটি ঘরে দুপুরে রাতে সারা ক্ষণ রাবড়ির গন্ধ। বিষ্টু বালতি বলেন, “গয়লার আভিজাত্য কিন্তু আলাদা! তবে আমাদের দেখাদেখি গাঁয়ে অন্য জাতেরাও রাবড়ির কারবার করছে!” রাবড়িগ্রামের নামডাক শুনে ফি-রবিবার অনেকেই সস্তার রাবড়ির লোভে অজ গাঁয়ে চলে আসেন। তবে রাবড়ি-স্রষ্টারা বোঝেন, তাঁদের আসল ভরসা কলকাতার মিষ্টান্ন ভান্ডার।

মিষ্টির দোকানের খাটনির থেকে নিজের হাতে গড়া রাবড়ি-কারবার ভাল হলেও সেই মিষ্টির দোকানে সাপ্লাইয়ের আশায় বাঁচতে হচ্ছে। তা ছাড়া মিষ্টির দোকানের মজুরির থেকে আয় বাড়লেও গোটা পরিবারের সবার পরিশ্রমের মজুরি ধরলে টাকাটা এমন কিছু নয়! তবু তো হদ্দ গাঁয়ে চাঁদার টাকায় রংচঙে কালী মন্দির, দুর্গাদালান সব উঠেছে। একদা হরিদাস মোদকের ম্যানেজার, আঁইয়ার শৈলেন বালতি ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল রাবড়িকে ‘মা লক্ষ্মী’ বলেন। তবু তিনিও জানেন, ফাঁকে ফাঁকে কোর্টের মুহুরিগিরি, জমিবাড়ির কাজ না-করলে বিষয়সম্পত্তি, কোঠাবাড়ি কিছুই হত না! শুধু রাবড়ির ভরসায় জীবন পাল্টায় না কারওই।

*****

রাবড়ি বা রাবড়িময় জীবন নিয়ে বাঙালির গালগল্প তবু এক বিচিত্র জীবন-দর্শন। একটি গল্প নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে শোনা। সে হল, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের গোড়াপত্তনের সময়ের কাণ্ড। দেশ-বিদেশের গুণিজনের সেখানে তখন নিত্য আনাগোনা, এবং তাঁদের বিচিত্র মেজাজমর্জি সামলাতে গলদঘর্ম আইএসআই প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। তিনি নাকি এই ‘ম্যান ম্যানেজমেন্ট’কে ‘রাবড়ির ট্রিটমেন্ট’ বলতেন। অর্থাৎ রাবড়িরই মতো নরমে-গরমে রাখার টোটকা। রাবড়িকে যেমন একই সঙ্গে আঁচের মধ্যে রেখেও পাখার হাওয়ার ছিটেয় নিরন্তর ঠান্ডা করতে হয়। খাঁটি দুধের সেরা উৎকর্ষ সর, তাতেই জমাট বাঁধবে। মানবসম্পদের সেরাটা ছেঁকে নিতেও এটাই কসরত। জীবনে কাজের চাপ থাকবেই, তা বলে ফুরফুরে হাওয়ার আরামটুকু থেকে বঞ্চিত করলে চলবে না। এ দুটো থাকলেই যে কোনও কাজে সময়মতো মানুষের সেরাটা বেরিয়ে আসে। রাবড়ি-দর্শন আর জীবন-দর্শন আদতে একাকার।

রাবড়িগ্রামের রাবড়িসিক্ত জীবনে রাবড়ি-পরম্পরার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু প্রশ্নের কাঁটা তবু বিঁধে চলেছে। প্রশান্ত বালতি-তাপসী বালতির মেজো মেয়ে মৌমিতা কল্যাণীতে বিএসসি নার্সিং ফার্স্ট ইয়ার। ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল। বাড়ি থাকলে মৌমিতা বা তাঁর বিএসসি-পাশ দিদি মধুমিতা মা-বাবার রাবড়ির কাজে হাত লাগান। কিন্তু বাবার রাবড়ির পেশার থেকে হবু নার্স হওয়ার জীবনই হাতছানি দিচ্ছে। “হাসপাতালের ডিউটিতে তাও সময়ের মাথামুন্ডু আছে। এখানে ভোর থেকে ডেলি মাঝরাত অবধি খাটনি! সরকারি হাসপাতালের তুলনায় রোজগারও অনিশ্চিত,” বাড়ির উঠোনে বাবার রাবড়ি টানা দেখতে দেখতে বলেন প্রশান্ত বালতির মধ্যমকন্যা। তাঁদের ছোট ভাই পিন্টুও পড়াশোনায় ভাল। জনাইয়ের স্কুলে ক্লাস টেন। দুই বোন মিলে আলোচনা চলে ভাইয়ের ‘ড্রিম’ পাল্টাচ্ছে। ডাক্তার না পাইলট না ইউপিএসসি— ভাবনার এই গতের ধারেকাছে রাবড়ির গন্ধ নেই। মেয়েদের কথা শুনতে শুনতে পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে তাপসীর কণ্ঠস্বরও, “না না, আমার ছেলেমেয়েরা কক্ষনও এ সব কাজ করবে না! আমি করাব না!”

গ্রামের অন্য প্রান্তে বিষ্টু বালতির কন্যা বর্ষাও রাবড়ির কড়ার সামনে বসে অচেনা আগন্তুককে দেখে আড়ষ্ট। এ ছবি দেখলে শোভারানি কলেজের বন্ধুরা কী ভাববে! কিন্তু রাবড়ির কাজ তো বাঙালির ঐতিহ্যের, তা কি কম গর্বের? এ সব বুলিতে চিঁড়ে ভেজে না। পুজোয় হাতিবাগানে কেনাকাটার খুব ইচ্ছে বর্ষার। কলকাতা গিয়ে ফেসবুকে দেওয়ার ছবি তুলবে! নেপাল বালতির স্ত্রী মিঠুও জানেন, বড় ছেলে শ্যামবাজারের আয়ুর্বেদ কলেজে পড়ুয়া সৌমেন, ছোট জন জ়ুলজি অনার্স পড়ুয়া সৌরভ রাবড়িশৈলী শিখলেও বেশি দিন ‘এ লাইনে’ নেই।

আবার বাপকাকার রাবড়ি-লাইনে ঢুকে নাস্তানাবুদ মঙ্গলা রাবড়ি ভান্ডারের রমেশ হালদার। বত্রিশ-পার যুবকের বিয়ে বার বার কেঁচে যাচ্ছে। ঘরের দালানে কাকিমা আর দিদির রাবড়ি টানা দেখতে দেখতে উদাস চোখে তিনি বলেন, “রাবড়ির বাড়িতে কে আর মেয়ে দেবে বলুন! আজকালকার মেয়ে রোজের রান্নাই হালকা সারতে চায়! কেন মরতে এত খাটতে আসবে!”

*****

রাবড়ি-শিল্পের এই সঙ্কট হয়তো কাটতে পারে আগামী দিনে। রিষড়ার ফেলু ময়রার দোকানে রাবড়ির মেশিন বসানোর চেষ্টা চলছে বেশ কিছু দিন। কাশী ঘরানার ঘাঁটা রাবড়ি হচ্ছেও দিব্যি। চেষ্টা চলছে মেশিনটায় একটু রদবদল করে বাঙালি ঝোল-রাবড়ি দাঁড় করানোর। আঁইয়ার তরুণ তুর্কি রাবড়ি-কারবারি অভিজিৎ পাত্রও সমবায় গড়ে রাবড়ি-স্রষ্টাদের একজোট করার চেষ্টায়। চণ্ডীতলা ব্লকে সমবায়কে দিদির সরকার লোহার কড়া, খুন্তি, ডেকচি, ওজন মেশিন, দুধ তাজা রাখার সরঞ্জাম দিয়েছে। গাংপুরের রাবড়ি-কারবারিরাও আশায় আছেন। ঘরে ঘরে রাবড়ির আঁতুড়ে তারা মা, লক্ষ্মী, গণেশের পাশে পঞ্চায়েতের ক্যালেন্ডারে ‘মমতাদি’!

আবার কেন্দ্রীয় সরকারের মেধাস্বত্ব চেয়ার প্রফেসর পিনাকী ঘোষ ও তাঁর দলবলকে আজকাল নিয়মিত রাবড়িগ্রামে দেখা যাচ্ছে। রাবড়িগ্রামের রাবড়ি কোন ঘরানার, কত জন এই রাবড়ি-চর্চায় মগ্ন— হিসাব কষে জিআই-এর জন্য ওঁরা আর্জি জানিয়েছেন। কাগজপত্র তৈরি করেছেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এর গবেষকেরা। গাঁয়ের সমবায়ের মাথা অভিজিৎ, দেবাশিস বালতিরা আশায় বুক বাঁধেন। পিনাকী স্যর আশ্বাস দিয়েছেন, একটা জিআই তকমা থাকলে রাবড়ির বাজার বাড়বে। সেই সঙ্গে স্বাদ, মান, রাবড়ির আয়ু বাড়ানোর নতুন রাস্তাও খুলে যাবে। নিত্য নিজেদের মনের মতো রাবড়ি সৃষ্টিতে কিচ্ছুটি বাধা থাকবে না।

রাবড়িকে ঘিরে এত স্বপ্ন দুরাশা কি না, কে জানে! তপ্ত কড়ায় দুধের সর টানার সাধনায় মগ্ন রাবড়িগ্রাম নববঙ্গে নবযুগের চালক হওয়ার স্বপ্ন দেখে! তবে গনগনে চুল্লির তাপের পাশে পাখার হাওয়ার আরাম বড়ই পলকা মনে হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement