কৃতজ্ঞতা: জয়ন্তকুমার ভট্টাচার্য
মহালয়ার সকালে গুচ্ছের ‘শুভ মহালয়া’ মেসেজের মধ্যে একটা মেসেজ হারিয়েই যেতে বসেছিল প্রায়। আমেরিকা থেকে এক বন্ধু: ‘‘একটা কাজ করে দিবি প্লিজ়? মা এখন আমার এখানে। পুজোয় কলকাতা থাকতে পারবে না, তাই মনখারাপ। তুই বাগবাজারের ঠাকুরের একটা ছবি তুলে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করবি? আজ তো মহালয়া, সন্ধেয় ওদের উদ্বোধন। দেখ না একটু! মার ভাল লাগবে ছবিটা দেখলে।’’
সন্ধের বাগবাজার স্ট্রিটে মণ্ডপমুখী অবিরল জনস্রোতের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, এই যে ‘বাগবাজারের ঠাকুর’কে না দেখলে বুকের মধ্যে কী-একটা-হল-না ভাব, তার কারণটা কী? ওই বিশাল প্রতিমা? বছরের পর বছর ধরে স্মৃতিতে গেঁথে-যাওয়া ওই একচালার ঠাকুরের রাজকীয়তা? ওই ডাকের সাজ? বিরাট মুকুটের তলায় ওই অতসীপুষ্পবর্ণাভাং মাতৃমুখ? কে অস্বীকার করবে, ‘থিমায়িত’ এ বঙ্গে হরেক কায়দার ঠাকুরের খুঁটিনাটি আমাদের মনে থাকে পুজোর ওই ক’টা দিন মাত্র, কিন্তু যে ঠাকুরের মুখখানা খবরকাগজ, টিভি, লাখো বিজ্ঞাপন আর শুভেচ্ছাবার্তায় ভেসে উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারি, কোনও ক্যাপশন লাগে না, সে হল বাগবাজারের ঠাকুর। বছরকে বছর এই প্রতিমা এক ও অদ্বিতীয়। যে ঠাকুরের মুখটা দেখলেই মনে হয়, এই হলো গিয়ে দুগ্গাঠাকুর!
সেই বাগবাজারের পুজো এ বার একশো বছরে। উত্তর কলকাতার গঙ্গাপাড়ের একটা পুজো কী করে বঙ্গজীবনস্মৃতি ও সত্তার অংশ হয়ে উঠল? জানতে গেলে ফিরতে হবে শেকড়ে, বিশ শতক-শুরুর উত্তর কলকাতায়, বলছিলেন ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’-র সাধারণ সম্পাদক গৌতম নিয়োগী। তখন দুর্গাপূজা করতেন মূলত পয়সাওয়ালা ‘বাবু’রা। সে ছিল যত না পূজা, তারও বেশি টাকার গরম আর আভিজাত্যের গুমোর দেখানোর উৎসব। পুজোর ক’টা দিন ধনীর ঘরে গরিব মানুষকে খাওয়ানোয় যত না সেবার মিষ্টি, তার চেয়ে ঢের বেশি অহমিকা আর হামবড়াইয়ের ঝাল। এমনই এক বাবুর পুজোয় এক বার অপমানিত হয়ে প্রসাদ না পেয়েই ফিরে গিয়েছিলেন এলাকার কিছু মানুষ। তার পরেই ঠিক হয়, সবাই মিলে দুর্গাপুজো করবেন, যেখানে উঁচু-নিচু ভেদ থাকবে না। ১৯১৮ সালে এই সিদ্ধান্ত, ১৯১৯-এই শুরু হল পুজো; কাছেই নেবুবাগানে। স্থান-নাম অনুযায়ী পুজোর নাম হল ‘নেবুবাগান বারোয়ারী’। ১৯২৬-এ এই ‘নেবুবাগান বারোয়ারী’ই নাম পাল্টে হল ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব’। ১৯১৯-এ পুজো-শুরুর উৎস ছুঁয়েই তাই শতবর্ষে পা বাগবাজারের পুজোর।
১৯৩০-এ সলিসিটর দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে হয় পুজোর রেজিস্ট্রেশন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে ‘প্রদর্শনী’ চালু করার ক্ষেত্রেও তাঁরই ভূমিকা। তখন শিল্পে স্বদেশি জোয়ার, দেশজ শিল্পের উন্নতিকল্পে বিবিধ প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুর্গাচরণ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যাঁকে বলতেন ‘মুকুটহীন রাজা’। পুজো-লাগোয়া এই প্রদর্শনী আসলে স্বদেশি শিল্প মেলারই রূপান্তর, মাতৃ-আরাধনার সঙ্গে দেশাত্মবোধ-মেশানো কর্মযোগের উদ্যাপন।
কত যে বড় বড় মানুষের নাম জড়িয়ে বাগবাজারের পুজোর সঙ্গে! চিত্তরঞ্জন দাশ তখন কলকাতার মেয়র, তাঁরই সহায়তায় পাওয়া গেল কর্পোরেশনের মেটাল ইয়ার্ড, পুজোর আগে-পরে মিলিয়ে ৩০-৪০ দিনের জন্য। সেই থেকে সেখানেই পুজো চলেছে। পুজোর স্মারক পত্রিকায় আছে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি-তালিকা, পড়ে তাজ্জব বনতে হয়। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সভাপতি ছিলেন ১৯৩০-৩৩। দু’দফায় সভাপতি ছিলেন স্যর হরিশঙ্কর পাল— প্রেসিডেন্সি কলেজের এই ছাত্রটি বাবা বটকৃষ্ণ পালের ওষুধের ব্যবসা সামলেছেন, ত্রিশ না পেরোতে ইউরোপ গিয়েছেন, টানা ২৪ বছর কলকাতা কর্পোরেশনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৪০-৪২ সভাপতি কুমার বিশ্বনাথ রায়— দেশব্রতী, শিক্ষা ও খেলাধুলোর উন্নতিতে অকুণ্ঠ দাতা, সাংবাদিক-সম্পাদক। সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নাম সুভাষচন্দ্র বসু— ১৯৩৮-৩৯ সালে বাগবাজারের পুজোর সভাপতি ছিলেন। ১৯৩৮-এর প্রদর্শনীতে সার্টিফিকেট অব মেরিট পেয়েছিল ‘ক্যালকাটা কলাপসিবল গেট কোম্পানি লিমিটেড’, সুভাষচন্দ্রের সই-করা সেই শংসাপত্রের কপি সযত্নে রাখা আছে পুজোকর্তাদের কাছে। এই বাগবাজার থেকেই আধুনিক রসগোল্লার যাত্রা শুরু, রসগোল্লার দুই প্রাণপুরুষ, নবীনচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্র দাশের সুযোগ্য উত্তরসূরি সারদাচরণ দাশ পুজোর সভাপতি ছিলেন ১৯৬১-৬৫। ‘রসগোল্লা ভবন’-এর বর্তমান প্রজন্ম ধীমান দাশ বলছেন, ‘‘দাদু (সারদাচরণ) হয়তো আরও থাকতেন, কিন্তু তখন সরকারি নিদানে মিষ্টির দোকানে দুধের জোগান বন্ধ হওয়ায় টাল খেয়ে-যাওয়া ব্যবসার হাল ধরতে হল।’’ ২০১৮ বাগবাজারের একশো আর রসগোল্লার দেড়শো বছর, বাঙালির দুই আইকন হাত মিলিয়ে উৎসবের পরিকল্পনা করছে।
অষ্টমীর দিনটা বাগবাজারের পুজোয় ‘বীরাষ্টমী’। পুজোর অফিসঘরে বসে স্মৃতিমেদুর বর্ষীয়ান কর্মকর্তা অভয় ভট্টাচার্য, ‘‘বীরাষ্টমী যত না শাস্ত্রবিহিত, তারও বেশি জাতীয়তাবোধ আর দেশপ্রেমের গন্ধমাখা। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে স্বদেশি হাওয়ায় অষ্টমীর সকালে এই পুজোর মাঠে লাঠিখেলা, ছুরি খেলা, কুস্তির মতো দেশজ খেলা হত। সাহেবরাই শক্তিমান, বাঙালি ভীরু, দুর্বল, এই বিশ্বাস ভাঙতেই বীরাষ্টমীর উদ্যাপন। আজও অষ্টমীতে সেই ট্রাডিশন অব্যাহত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জুড়েছে জুডো, ক্যারাটে, বক্সিংও।’’ গৌতমবাবু যোগ করলেন, ‘‘শুনেছি তখন বীরাষ্টমীর দিন জনতার ভিড়ে মিশে যেতেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী সদস্যরাও। জনসংযোগের এমন সুযোগ হারাতে চাইতেন না তাঁরা।’’
পুজোর ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি’ তালিকাও তারায় তারায় খচিত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে আশাপূর্ণা দেবী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে বালক ব্রহ্মচারী। অভয়বাবুই বললেন, এক বার পুজো উদ্বোধনে এসেছেন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। প্রতিমার সামনে পর্দা ফেলা, কাঁচি দিয়ে ফিতে কেটে পর্দা সরিয়ে উদ্বোধন করতে হবে, কিন্তু অচিন্ত্যকুমার নারাজ। ‘‘মায়ের পর্দা সরাব আমি? আমি কে?’’ কিছুতেই তাঁকে দিয়ে সেই কাজ করানো গেল না। পুজোর সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও নানান বছরে সভাপতিত্ব করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু, ড. ত্রিগুণা সেন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিকাশ রায়। পুজোর পর একাদশীর দিন কলকাতার মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল, ১৯৬৮-৭০’এর সভাপতি অশোককুমার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আসা বই আমরা উপহার দিতাম ছেলেমেয়েদের, বলছিলেন গৌতমবাবু।
কুমোরটুলির একটা গলি পৌঁছেছে সাধনচন্দ্র পালের বাড়ি। বিখ্যাত প্রতিমাশিল্পী জিতেন পাল বহু বছর বাগবাজারের ঠাকুর গড়েছেন, পরে ওঁর দুই ছেলে কার্তিকচন্দ্র আর সাধনচন্দ্রও। এখন প্রতিমা গড়েন কার্তিক পালের দুই ছেলে নারায়ণচন্দ্র আর নবকুমার। সাধনবাবু বলছিলেন, ‘‘পুজোর ৫০ বছর থেকেই এত বড় ঠাকুর গড়া শুরু। সময়ে সাজসজ্জা একটু পাল্টেছে হয়তো, কিন্তু প্রতিমার একই রূপ।’’ মায়ের ডান পা সিংহের উপরে, বাঁ পায়ের আঙুল মহিষের উপরে। মহামায়ার চরণস্পর্শেই মহিষরূপী অসুরের মুক্তি। আর ওই প্রবাদপ্রতিম মুকুট? কৃষ্ণনগরের শিল্পী আশিস বাগচী ওরফে ‘বাচ্চুদা’র তৈরি মুকুট কলকাতায় এসে সাধনবাবুর এই ঘরেই ঢোকে। এত বড়, মুড়ে ঢোকাতে হয়। ঘরের একটা দিক ভরে যায়। এ বার দশ ফুট ছুঁই-ছুঁই মুকুট সরাসরি গিয়েছে মণ্ডপেই। সেই মুকুট পরানোর ভিডিয়োও, বাগবাজারের ঠাকুরের মতোই, ফেসবুকে ভাইরাল!