পর্ব ৬

শেষ নাহি যে

পূর্বানুবৃত্তি: হাসপাতালে যাওয়ার পথে বোমা ও লাঠির আঘাতে আহত হয় দরিয়া। এ দিকে বিহান চাকরি নিয়ে সমস্যায় পড়ে। তার বার্ষিক কনট্র্যাক্ট রিনিউ করা হবে কি না সে জানে না। কাজের ক্ষেত্রে সমস্যার কথা বলে সে আরও বিপাকে পড়ে। চাকরি বাঁচানোর জন্য বিহান নিরুপায়।পূর্বানুবৃত্তি: হাসপাতালে যাওয়ার পথে বোমা ও লাঠির আঘাতে আহত হয় দরিয়া। এ দিকে বিহান চাকরি নিয়ে সমস্যায় পড়ে। তার বার্ষিক কনট্র্যাক্ট রিনিউ করা হবে কি না সে জানে না। কাজের ক্ষেত্রে সমস্যার কথা বলে সে আরও বিপাকে পড়ে। চাকরি বাঁচানোর জন্য বিহান নিরুপায়।

Advertisement

ইন্দ্রনীল সান্যাল

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২৭
Share:

ছবি: শুভম দে সরকার

মিউট করে রাখা টিভির পর্দায় আছড়ে পড়ছে একের পর এক নিউজ় ক্লিপ। পর্দার নীচে পিঁপড়ের মতো হাঁটছে নিউজ স্ক্রল। ‘আততায়ীর গুলিতে নিহত গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বোস। খুনি পলাতক।’ ‘মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের শোকপ্রকাশ।’

Advertisement

দাসের টেবিল থেকে রিমোট তুলে নিয়ে টিভিতে শব্দ দিল বিহান। স্কুপ নিউজ় চ্যানেলে কথা বলছেন, খরাজ পার্টির সুপ্রিমো সুধাকর ঘোষ। “আজ সকাল সাড়ে সাতটায় গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বসু অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। তাঁর স্বামী, গণতান্ত্রিক মোর্চার নেতা মনোজ বসুকে সহানুভূতি জানানোর জন্য কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়। আমি একটু বাদেই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। পাশাপাশি অন্য একটা কথা না বললেই নয়। সেটা হল, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে গণতান্ত্রিক মোর্চা। পুলিশি তদন্ত চলাকালীন মনোজ বসু বলতে শুরু করেছেন, ‘খরাজ পার্টির লোকেরা মানসী বসুকে খুন করেছে।’ বাংলার বুকে মনোজ কি খাপ পঞ্চায়েত বসিয়েছেন? উনি কী করে জানলেন, খুনি কে? তার রাজনৈতিক পরিচয় কী? ওঁর বক্তব্য সম্প্রচার হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে গণতান্ত্রিক মোর্চার চার জন পার্টিকর্মী খুন হয়েছেন। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ, অবিলম্বে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিন। জেনে রাখবেন, প্রতিটি জেলায়, মহল্লায়, পাড়ায় এবং প্রতিটি বুথে আমাদের কর্মীরা সতর্ক আছেন। এক জনের গায়ে হাত পড়লে রাজ্যে কিন্তু আগুন জ্বলবে।”

এই সব দৃশ্য আর শব্দ বিহানের মস্তিষ্কে কোনও অভিঘাত সৃষ্টি করল না। সে রিমোটের মিউট বাটন টিপে টিভিকে শব্দহীন করল। মিস্টার দাসের কেবিন থেকে বেরিয়ে এগোল নিজের খুপরির দিকে। এখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। দরিয়ার সঙ্গেও না। মনে হচ্ছে, পোর্টের সব্বাই জেনে গিয়েছে যে তার চাকরি নেই।

Advertisement

কম্পিউটারের সামনে বসতে না বসতেই কলকলিয়ে উঠল মোবাইল। নির্ঘাত দরিয়া ফোন করেছে।

মোবাইল হাতে নিয়ে বিহান দেখল, ফোন করেছেন সাম্যব্রত। উনি সাধারণত কোনও দরকার ছাড়া ফোন করেন না। ফোন কানে দিয়ে বিহান বলল, “বলুন।”

“যা বলছি, ঠান্ডা মাথায় শোনো। প্যানিক কোরো না। ঠিক আছে?” বললেন সাম্যব্রত।

কথাগুলো প্যানিক তৈরির জন্য যথেষ্ট। বিহান শুকনো গলায় বলল, “শুনছি।”

“দরিয়ার লেবার পেন শুরু হয়েছে।”

“এ তো ভাল কথা!” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বিহান।

“কথা না বলে চুপচাপ শোনো,’ জামাইকে মৃদু ধমক দিলেন সাম্যব্রত, “তুমি জানো কি না জানি না, গণতান্ত্রিক মোর্চার নেত্রী মানসী বসু আজ সকালে খুন হয়েছেন।’’

“এইমাত্র জানলাম,” বলল বিহান। “টিভি দেখে মনে হল কলকাতায় খরাজ পার্টি আর গণতান্ত্রিক মোর্চার মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়েছে।”

বিহানকে থামিয়ে দিয়ে সাম্যব্রত বললেন, “দরিয়াকে নিয়ে নিউ লাইফ মেটারনিটি ক্লিনিকে আসছিলাম। গণতান্ত্রিক মোর্চা আর খরাজ পার্টির মারামারির মধ্যে পড়ে দরিয়ার পায়ে বোমার টুকরো ঢুকে গেছে। হাতে লাঠির আঘাত লেগেছে।”

“দরিয়া কেমন আছে?” কম্পিউটার শাট ডাউন করছে বিহান। মাউস নাড়ানোর সময়ে হাত কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এই শীতেও গলগল করে ঘামছে সে।

“আপাতত ভাল আছে।”

“আপাতত ভাল আছে? এই কথাটার মানে কী?” কথা বলতে বলতে অফিস থেকে বেরিয়ে গলিতে পড়েছে বিহান।

“মেটারনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার মিত্র বললেন, পায়ে বোমার টুকরো অপারেশন করে বার করতে হবে। দরিয়ার ডেলিভারি ওখানে হবে না। এখন দরিয়াকে নিয়ে হাওড়ার বঙ্গবাসী হাসপাতাল যাচ্ছি। শুনলাম হাওড়ার রাস্তায় গন্ডগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। তোমাদের ও দিকের কী খবর?”

“এখনও পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে।”

“তুমি কি আসতে পারবে?” কুণ্ঠাভরে জিজ্ঞাসা করলেন সাম্যব্রত। “আমি একাই সবটা সামলে নেব। তবে পাশে কেউ এক জন থাকলে একটু জোর পেতাম। মেয়েটাও বারবার তোমার কথা বলছে। ওর মোবাইল ফোনটা গন্ডগোলের সময়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছে। আমি ওর নম্বরে ফোন করে দেখেছি। বলছে, ‘সুইচ্‌ড অফ’। কেউ ঝেঁপে দিয়েছে!’’

“ওকে এক বার ফোনটা দিন,” নরম গলায় বলল বিহান। এ দিক-ও দিক তাকিয়ে দেখল। পোর্টের সামনের রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বেলা এগারোটার সময় বাসস্ট্যান্ডে যত লোক থাকার কথা, তত লোক এখন নেই। অভিরুচি রেস্তরাঁর সামনে সারা দিন ভিড় লেগে থাকে। আজ দোকান খোলা থাকলেও খদ্দের নেই। কলকাতাগামী একটা বেসরকারি বাস প্যাঁ-প্যাঁ করে হর্ন বাজিয়ে স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। বাসে যাত্রীর সংখ্যা হাতে-গোনা। কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, “যারা যাবেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। এর পরে আর বাস নেই!”

হর্নের শব্দদূষণের সঙ্গে যোগ হয়েছে মোবাইলের ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসা অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের শব্দ। তার মধ্যে শোনা যাচ্ছে দরিয়ার গলার আওয়াজ। “বিহান, তুমি কোথায়? এত আওয়াজ হচ্ছে কেন?”

দরিয়ার গলার আওয়াজ বৈশিষ্ট্যহীন। হাস্কি নয়, সুরেলা নয়, কোকিলকণ্ঠীও নয়। কিন্তু ওই বৈশিষ্ট্যহীন গলার আওয়াজ শুনেই বিয়ের এত দিন পরেও শ্বাস গাঢ় হয়ে আসে বিহানের। মনে হয়, এক্ষুনি গিয়ে বউটাকে জড়িয়ে ধরে। দরিয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন থেকেই ওর গলার আওয়াজ ভাল লাগত বিহানের। ডালভাত খেয়ে যে শান্তি পাওয়া যায়, দরিয়ার গলার আওয়াজ শুনে সেই শান্তি পায় বিহান।

বিহান বলল, “আমি রাস্তায়। তুমি কেমন আছ?”

“ভাল আছি। খুব ভাল আছি।”

“ইস! কী মিথ্যুক আমার বউটা! তোমার বাবার কাছ থেকে সব খবর পেয়েছি। অফিস থেকে এই বেরোলাম। মেসে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাস ধরব। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তোমার কাছে পৌঁছে যাব।”

“ইস! কী মিথ্যুক আমার বরটা!” বিহানের কথা বলার ধরন নকল করে বলল দরিয়া। “বকুলতলা থেকে বাসে হাওড়া আসতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। আমি যেন জানি না!”

দরিয়ার হাসিতে ক্লান্তির ছাপ। বিহান বলল, “পাড়ায় গুন্ডামি শুরু করেছ নাকি? মাথায় আর পায়ে লাগল কী করে?”

“গুন্ডামি কি শুধু ছেলেরাই করতে পারে?”

“তোমার গুন্ডামি তো সেই সরস্বতীপুজোর দিন থেকে দেখে আসছি। যে দিন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল,” বলল বিহান। তার কথা শুনে দরিয়া আবার হাসছে। হাসি শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে বিহানের। যাক বাবা! ওর তা হলে খুব বেশি চোট নেই। আর থাকলেও সেটা ওকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সাম্যব্রতকে বলতে হবে, দরিয়াকে এই সময়টা টেনশনমুক্ত রাখতে। শারীরিক কষ্টের সঙ্গে যেন মানসিক কষ্ট জুড়ে না যায়। বিহান ঠিক করল, নিজের কাজের ঝামেলার কথা দরিয়াকে বলবে না। বিহান যদি পাখি হত, তা হলে এক্ষুনি ডানা মেলে উড়ে যেত। পরিযায়ী পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার উড়ে অন্য মহাদেশে পৌঁছয়। আর সে মাত্র একশো কিলোমিটার উড়ে যেতে পারবে না?

পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে বিহান বলল, “আমি যত ক্ষণ না তোমার কাছে পৌঁছচ্ছি তত ক্ষণ আমরা দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা... এই সব নিয়ে ভাবব না। এই সব নিয়ে কথা বলব না। আমরা অন্য কথা ভাবব। আমরা অন্য কথা বলব। ঠিক আছে?”

“কী নিয়ে কথা বলব তা হলে?”

“আমি তার কী জানি!” হাসল বিহান, “তুমি কিছু একটা বলো।”

“আমি কিছু বলব না। তুমি বলো।”

বিহান সামান্য ভেবে বলল, “কাল রাতে আমি আর সনৎ মিলে মদ খেয়েছি। বেশি না। অল্প!”

“এইটা ভাল কথা হল?” ছদ্ম রাগ দরিয়ার গলায়, “আমাকে না দিয়ে খেয়ে নিলে? কী স্বার্থপর গো তুমি!”

ফিক করে হেসে বিহান বলল, “তুমি আর আমি মিলে কোথায় ভদকা খেয়েছিলাম মনে আছে?”

“ওই সব ছাইপাঁশ খাওয়ার কথা মনে থাকবে না? খুব মনে আছে।”

“মাতাল হয়ে তুমি আমাকে কী বলেছিলে মনে আছে?”

নিচু গলায় দরিয়া বলল, “বাবা পাশে বসে রয়েছে।”

“আচ্ছা, তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলি?”

“বলো।”

“মদ খেয়ে তুমি বুধনকাকার মতো হিন্দি মেশানো বাংলা বলা শুরু করেছিলে,” জড়ানো গলায় অভিনয় করছে বিহান, “তুমি বলেছিলে, ‘অ্যাই বিহানোয়া! তুমি হামকো ভালবাসতা হ্যায়?’ আমি বলেছিলাম, ‘বাসতা হ্যায়।’ তুমি বলেছিলে, ‘সত্যি সত্যি বাসতা হ্যায় না মিথ্যে মিথ্যে বাসতা হ্যায়?’ আমি বলেছিলাম...”

ও পার থেকে ক্লান্ত গলায় দরিয়া বলল, “ঠিক আছে। আমার মন ভাল হয়ে গেছে। পরে আবার কথা হবে।” তার পরে ফোন কেটে দিল।

মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে গলা থেকে মাফলার খুলল বিহান। হনহন করে হেঁটে এসে গরম লাগছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে ঠান্ডাটাও কমেছে। সামনেই মেস।

বিহান ঘরে ঢুকে দেখল, সনৎ এখনও খাটেই লেপমুড়ি দিয়ে বসে রয়েছে। মোবাইলে কাউকে উত্তেজিত গলায় বলছে, “আমার একটাই কথা। হামলা হলে পাল্টা হবে।” বিহানকে দেখে ফোন কেটে ভুরু নাচিয়ে বলল, “তুই অফিস থেকে চলে এলি?”

ন্যাপস্যাকে বাসি জামাকাপড় ভরতে ভরতে বিহান বলল, “সনৎ, আমাকে কিছু টাকা ধার দিবি? দরিয়ার লেবার পেন শুরু হয়েছে। আমাকে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে।”

“বাচ্চাটা কার?” বিচ্ছিরিভাবে হাসছে সনৎ। “তুই তো সারা সপ্তাহ এখানে থাকিস। অন্য কেউ ব্যাটিং করে দেয়নি তো?”

বিহান মাথা নিচু করে বলল, “তুই আমাকে যত ইচ্ছে অপমান কর। কিন্তু প্লিজ় হাজার দশেক টাকা ধার দে। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি শোধ করে দেব।”

“কী ভাবে করবি? দাসদা তো তোর চাকরির অ্যানুয়াল কনট্র্যাক্ট রিনিউ করেননি।” সনতের চোখ জ্বলন্ত সিগারেটের মতো লাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement