অ্যাই, তোর ছোটমাসি তোর বাবার কে হয় রে?— শ্রদ্ধার মানুষটিকে নিয়ে পাড়ার বন্ধুর কাছ থেকে ছুটে আসা এই বাঁকা প্রশ্ন সে দিন ছোট ছেলেটির কাছে ছিল বিরাট এক ধাক্কা। রসসিক্ত ইঙ্গিতটিও যে মিথ্যে ছিল না! সাহিত্যিক সমরেশ বসু ও তাঁর শ্যালিকা ধরিত্রীর প্রবল প্রেম। সমরেশ তখন চার সন্তানের পিতা। কল্যাণীতে স্ত্রী গৌরী বসু ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভরা সংসার। সে সময়ই ছোট শালির সঙ্গে শরীর-মনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সমরেশ। গৌরী ছিলেন বাড়ির বড় মেয়ে, আর ধরিত্রী ওরফে টুনি সবচেয়ে ছোট, প্রায় সমরেশের মেয়ের বয়সিই, সমরেশ বসুর বড় মেয়ে বুলবুলের চেয়ে মোটে কয়েক মাসের বড়! সেই ধরিত্রীকে বিয়ে করে প্যারালালি কলকাতায় দ্বিতীয় সংসার পাতেন সমরেশ।
সমরেশের শ্বশুরবাড়ি ছিল রক্ষণশীল পরিবার। অন্দরমহলে বাইরের পুরুষের খুব একটা যাতায়াত ছিল না। কিন্তু বড় জামাইয়ের অবাধ প্রবেশ। সেই সূত্রেই ক্রমশ দানা বেঁধে ওঠে টুনি আর সমরেশের সম্পর্ক। লোকলজ্জার কথা ভেবে, চাইলে হয়তো সব দায় ঝেড়ে ফেলে তিনি বেরিয়ে আসতেই পারতেন, কিন্তু সে পথে হাঁটেননি সমরেশ। শ্যালিকাকেও স্ত্রীর মর্যাদাতেই ঘরে তুলতে চান তিনি। কিন্তু হিন্দু বিবাহ আইনে এই বিয়ে সম্ভব ছিল না। অসম্ভবকে সম্ভব করলেন গৌরী— সমরেশের স্ত্রী, ধরিত্রীর দিদি। সমরেশের দ্বিতীয় বিবাহে সম্মতি দিলেন। বুক ফেটে গেলেও মেনে নিলেন নিজের বোনের সঙ্গে স্বামীর বিয়ে।
সমরেশের জীবনের এই সব অনালোচিত অংশে আলো ফেলেছেন তাঁর ছোট ছেলে, সাহিত্যিক নবকুমার বসু। কোনও রকম রাখঢাক না রেখে ‘ছিন্ন পাতার তরণী’ প্রবন্ধে (‘সমরেশ বসু বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’, ২০০৮) জানিয়েছেন, বাবাকে নিয়ে কত রকমের মন্তব্য, বাড়তি কৌতূহল তাঁকে শুনতে হয়েছে— ‘সমরেশ বসুর আর একটা বউ আছে (ছিল) বুঝি?’ আরও অনেক কদর্য কথাবার্তা।
পারিবারিক টানাপড়েন আর ছেলেবেলায় নবকুমারের নিজের মধ্যেকার উথালপাথাল অনুভূতির কথাও স্মৃতি থেকে বলেছেন: ‘রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বাবা-মার চাপা ক্ষুব্ধ কথা কাটাকাটি, কখনো ভেঙে পড়া মা-এর কান্না। বুক ঢিপঢিপ করে।... উন্মেষ হওয়ার সেই বয়সে দুটি ব্যাপার সহ্য হত না কিছুতে। মা-এর চোখে জল, আর বাবার অন্য নারী গমন। সে নারী তো আবার পর-ও নয়। কিন্তু তার ভূমিকা, আর লেখক মানুষটিরও তার ডাকে তীব্রভাবে শারীরিক সাড়া দেওয়া, ভেতরে-ভেতরে ওলোটপালট করে দিচ্ছে।’ ‘চিরসখা’ উপন্যাসেও প্রোটাগনিস্ট ‘বিভাস চৌধুরী’র মধ্যে সম্ভবত সমরেশ বসুর জীবনের ছবিই আঁকতে চেয়েছেন নবকুমার।
কেমন রসায়ন ছিল সমরেশের দুই স্ত্রীর সঙ্গে? গৌরী বসুর মৃত্যুর পর তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার ভিতরে পুঞ্জীভূত অন্ধকার আবর্তিত হচ্ছে। তথাপি আমি সকল সত্তা দিয়ে অনুভব করছি, এ অন্ধকার মহান, অনির্বচনীয় তার রূপ।... এই অন্ধকারে একাকী আমি নিজেকে আবিষ্কার করছি, আর তাঁকে দেখবার চেষ্টা করছি।’ এ কথা অনস্বীকার্য, সমরেশের জীবনে গৌরী বসুর অবদান ছিল বিরাট। পরবর্তী জীবনে সম্ভবত অনেকটাই ধরিত্রীর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন সমরেশ। তবে, দ্বিতীয়া ধরিত্রীকে ‘ট্র্যাজিক চরিত্র’ বলে মনে করেছেন নবকুমার, কারণ বাধ্যতই নাকি তাঁকে নানা ভাবে ‘আমিই আসল বউ’ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হত।
সমরেশ-ধরিত্রীর একমাত্র ছেলে উদিত বসু অবশ্য সমরেশের অসংগঠিত জীবনকে পরম মমতায় বেঁধে রাখতে তাঁর মায়ের অপরিহার্যতার কথা বলছেন। ‘বয়সজনিত কারণে বা দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায়’ গৌরী দেবীর পক্ষে তা হয়তো আর সম্ভব হচ্ছিল না বলেই তাঁর ধারণা। (‘কালকূট বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’, ২০১১)
সন্দেহ নেই সমরেশ বসুর জীবন বিতর্কিত ও ব্যতিক্রমী। তাঁর জীবনে কেচ্ছা ছিল, কেচ্ছা থেকে না-পালানোর মতো মহত্ত্বও ছিল।