আমাদের বাড়িতে এত লোকের আনাগোনা যে হঠাৎ করে বাড়ি ঢুকে কোনও অপরিচিত মুখ দেখলে কোনও হেলদোল হয় না। আগে তবু ‘কে, কেন’ জানার চেষ্টা করতাম, বিয়ের পর থেকে সে অভ্যেসেও দাঁড়ি টেনেছি। কারণ ক্রেডিট কার্ড বেচার মানুষ কিংবা বহু পুরনো কাজের মাসির সঙ্গে আমার মা-বাবার সখ্য দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। এমনই একটা বাপের-বাড়ি-ট্রিপে গিয়ে দেখলাম, আমাদের ছোটবেলায় যে রিকশাওয়ালা স্কুল নিয়ে যেত, তার বউ বসে রয়েছে। মা’র কাছে, রান্নাঘরে। প্রবল বিক্রমে আলু ছাড়াচ্ছে আর গত রাতে ওর ছেলে মদ খেয়ে এসে কী হল্লাই না মচিয়েছে সে গপ্পো করছে।
পর পর ক’দিন যাই, রোজই তাকে দেখি। এর মধ্যে এক দিন ছোটি বেটি বলে সে মহা উদ্যোগে আমার গা-হাত পায়ে তেল মালিশ করে দিলই দিল। উফ, তার পর কী ব্যথা। তার ওপর সারা ক্ষণ বকরবকর। জীবনের সব বিষয়ে মতামত রয়েছে তার। এক দিন সে এই অভিযোগও করল যে তার রিকশাওয়ালা-স্বামী তার কথা না শুনে বাংলা মদ খেয়ে কী ভাবে অকালে তার প্রাণটা দিল। সেই জন্য তার তেমন কষ্টও নেই। বলেই উচ্চৈঃস্বরে বরের জন্য বিলাপ করতে লাগল। আমরাও সান্ত্বনার মোডে চলে গেলাম। এমনিতে ভারী তেজি সে। মোটে দাবিয়ে রাখতে পারবে না তাকে। মিনিট দুয়েক পর আমাকেই বুঝিয়ে বলল জীবন তো কঠিন, আর সব কিছু কেমন মেনে নিতে হয়। বুঝলাম, বাড়ি এখন ইনিই মাতিয়ে রেখেছেন। আমার মা-বাবার টাইমপাসের কোনও অভাব হয় না।
কিন্তু ওর তখন একটাই ভয়ানক দুঃখ ও আতঙ্ক। ছেলে রোজ রাতে বাংলা খেয়ে এসে সাংঘাতিক ঝামেলা পাকাচ্ছে। শরীরও খারাপ। ডাকদার-বাবুর কাছে নিয়ে গেছিল। বলেছে লিভার খারাপ হয়ে গেছে। এ দিকে ছেলে কোনও কথা না শুনে রোজ মদ খাচ্ছে। এমনকী মায়ের ব্যাংকে সই জাল করে টাকা তুলে মদ খেয়ে আসছে। আমার মা’কে সাক্ষী মানল যে ওর ভবিষ্যতে কী হবে, ওই ক’টাই তো জমানো টাকা! টাকার অঙ্কটা শুনে তো আমি থ’। খুব গর্বের সঙ্গে বলল— তা হাজার পাঁচেক তো হবেই।
মাস তিনেক পর আবার থাকতে গেলাম ও-বাড়ি। হঠাৎ মনে পড়ল, মায়ের বকবক-বুড়ি আসেনি তো! জিজ্ঞেস করলাম। মায়ের মুখটা হঠাৎ নিবে গেল। বলল, ‘ওর ছেলেটা চলে গেছে রে!’ আমার ভেতরে দড়াম করে কী একটা বেদম জোরে মারল।
ও মা, পর দিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ তিনি এসে উপস্থিত। ‘ও মা ছোটদিদি, কখন আইলে?’ আমার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না, বললাম, ‘এই তো কাল রাতে। তোমার ছেলে...’ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ওর কথা আর তুলবে না। কত বারণ করলাম মদ খেতে। শুনল না। পেটটা ফেটে গেল। আর টাকাই বা কত ছিল দিদি। শম্ভুনাথ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু হল না। ডাকদার বলল, অনেক টাকা লাগবে। আমি হাসপাতালের বেডে গিয়ে দু’ঘা দিলাম কষিয়ে। বললাম, দেখলি তো কেন মানা করেছিলাম। আমি কাঁদব না তোর জন্য। আমি খুব শক্ত আছি দিদি।’ এই কথা ক’টা খরচ করে সে লেগে পড়ল মায়ের রান্নাঘরের কাজে। খামখাই আজ যেন বেশি কাজ ওর। খামখাই আজ আমায় মালিশ করে দেওয়ার জেদ। খামখাই আজ নাতির কলবলানির গল্প। খামখাই আজ বালতি মেজে ফেলছে, খামখাই সে খামখা কাজ করে চলেছে অনর্গল।