একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

প্রথমেই সপরিবারে বোমকে গেলাম। চারতলা বিয়েবাড়ি। প্রথম দুটো তলায় এক জনদের বিয়ে, পরের দুটো তলায় এক জনদের বিয়ে। যাদের বিয়েতে গিয়েছি, তাদের পরিবারের বেশ অনেককে চিনি তেমনটা নয়। মাত্র জনা কয়েক পহেচানওয়ালা। তাদের এই মুহূর্তে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে ঘনঘোর চিন্তায় মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠল।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩
Share:

প্রথমেই সপরিবারে বোমকে গেলাম। চারতলা বিয়েবাড়ি। প্রথম দুটো তলায় এক জনদের বিয়ে, পরের দুটো তলায় এক জনদের বিয়ে। যাদের বিয়েতে গিয়েছি, তাদের পরিবারের বেশ অনেককে চিনি তেমনটা নয়। মাত্র জনা কয়েক পহেচানওয়ালা। তাদের এই মুহূর্তে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে ঘনঘোর চিন্তায় মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠল।

Advertisement

তখনকার কালে না ছিল মোবাইল, না দরজার ওপর ফুল দিয়ে লেখা থাকত, অমুক ওয়েডস তমুক। আমরা পড়লাম মহা ফাঁপরে। তবু সাহস করে উঠতে থাকলাম সিঁড়ি দিয়ে। এবং বাঙালি যা মনে করে সব সময়, ‘আমার ভাগ্যে কি আর সহজ কিছু থাকবে?’, সেই থিয়োরি মেনে প্রথমেই উঠে গেলাম তিনতলায়। মিনিট পাঁচেক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেনা লোক দেখতে না পেয়ে আমরা গুটিগুটি নতুন বউয়ের কাছে সম্মিলিত ক্যাবলা হাসি হেসে উপহার এগিয়ে দিলাম। বউটিও তা-ই করল— ক্যাবলা হেসে উপহার নিল। আর পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে চেনা কাউকে না দেখতে পেয়ে মা-বাবা ঠিক করল বাড়ি ফিরে আসবে।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নামতেই, ‘এ কী, আপনারা! কোথায় ছিলেন? আসুন আসুন।’ ভদ্রলোক বাবার হাত ধরে টানতে টানতে একতলায় নিয়ে গেলেন। অনেক হাসি-ঠাট্টার পরে বউয়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠতেই বাবা একটু কিন্তু-কিন্তু করে আমাদের ভুলের কথাটা বলল। ‘আজ আমরা বরং যাই। অন্য এক দিন উপহার নিয়ে নতুন বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে যাব।’ ভদ্রলোক হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। ‘তা কেন? আপনি উপহারটা নিয়ে আসুন ফেরত।’ আমি এত ক্ষণ এই নাইট্য-দৃশ্য হাঁ করে গিলছিলাম। এ বার কোপ আমার ওপর। ‘তুমি গিয়ে ওপর থেকে উপহারটা নিয়ে এস তো মামনি?’ এত অবাক যে রা কাড়তে পারলাম না। বলে কী? পাহাড়প্রমাণ উপহারের মধ্যে আমাদের উপহার খুঁজে পাব কী করে? আর কাউকে দেওয়া উপহার ফিরিয়ে নেবই বা কী করে?

Advertisement

কিন্তু আমি সবচেয়ে ছোট। অতএব যা কিছু অস্বস্তিকর তা আমার ভাগ্যে। আমায় টেনে ওপরে নিয়ে যাওয়া হল। যে ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন, তিনি ওপরের এক জন ভদ্রমহিলাকে ব্যাপারটা বলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমায় লেলিয়ে দিলেন। আর আমি গরম কান, চোখ ওপচানো জল নিয়ে উপহারের স্তূপে বাবার নাম খুঁজতে লাগলাম। আমার চেয়ে একটু বড় মেয়েরা খোঁটা দিতে লাগল, ‘জিনিস দিয়ে ফিরিয়ে নিলে কী হয় জানো? কালীঘাটের ইয়ে... ডগি।’ কয়েক জন বয়স্ক ভদ্রমহিলা তো তেড়ে এলেন, এই এই, হাত দিচ্ছ কেন? কিছু ক্ষণ পর উপহারটা পাওয়া গেল। কোনও মতে সেটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বুকে হাতুড়ি পিটছে। দু’গাল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু বিয়েবাড়ির জমজমাটিতে কেউ খেয়াল করেনি। নীচে নেমে বাবার হাতে উপহারটা তুলে দিলাম। আমি তখন চোখে-নাকে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সারা দুনিয়ার ওপর রাগ হচ্ছে। কিচ্ছুটি দাঁতে কাটিনি সে দিন নেমন্তন্নে।

ফেরার পথে ট্যাক্সিতে উঠেই উচ্চৈঃস্বরে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। মা-বাবা কেন আমাকে এ রকম একটা কাজে পাঠাল? কেন জোর দিয়ে বারণ করল না? কেন আমায় এ রকম সহ্য করতে হল? আমি ছোট বলে? এখন বুঝি, মা-বাবাও অন্যের মুখের ওপর তেমন করে কিছু বলতে পারেনি স্বভাবগত কারণেই। কিন্তু তাতে আমার গলাব্যথা কমে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement