স্যর, আমাকে সবাই ভাল হতে বলে। কিন্তু আমার ভাল হতে মোটেই ভাল লাগে না। মা আমাকে কত বকে। বাবা তো একটা সরু ছড়ি দিয়ে সপাসপ মারে! পিঠে, হাতে, পায়ে কালশিটে দাগ হয়ে যায়। তবু আমি একটুও কাঁদি না। অন্য ছেলেমেয়ে হয়তো চিৎকার করে বাড়ি ফাটিয়ে দিত। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেত। আমি কিন্তু কিচ্ছু করি না! হয়তো কখনও-কখনও দু’-চার ফোঁটা জল চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। গাল ভিজে যায়। আমি সে জল মুছে ফেলি না। পড়ুক, গড়িয়ে পড়ুক। কত আর পড়বে! ওই দু’-চার ফোঁটাই তো!
স্যর, ওরা, বন্ধুরা, ইশকুলের দিদিমণিরা আমাকে খারাপ মেয়ে বলে। বলে, “যা-যা, পিছনের বেঞ্চে বোসগে। কিচ্ছু পারিস না। একটা পড়াও না।”
সত্যি বলছি স্যর, আমি কিন্তু পারি। দিদিমণি যখন পড়ান, আমি সব বুঝতে পারি। মনেও রাখতে পারি। কিন্তু রাখি না। মনে রাখতে আমার ভাল্লাগে না। যারা ভাল মেয়ে তাদের মায়েরা বলে, “আরও ভাল হ’।” যে মেয়েটি ফার্স্ট হয়েছে, তার মা বলছিল, “আরও একটু ভাল করতে পারতিস তো!” আমার শুনে কেমন হাসি পায়। কিন্তু আমি হাসি না।
ইশকুলে যখন ছুটির ঘণ্টা বাজে, তখন ক্লাসের মেয়েরা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এক সঙ্গে চেঁচায়। তাদের সেই গগন ফাটানো চিৎকার বড় আনন্দের। যেন এত ক্ষণ তাদের কেউ শেকলে বেঁধে ক্লাসঘরে বন্দি করে রেখেছিল। এক সঙ্গে ছাড়া পেয়েছে সবাই। বইয়ের ভারী ব্যাগটা এক ঝটকায় কাঁধে তুলে পড়িমরি করে দৌড়য়। সিঁড়িতে চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কি। এত বড় বাড়িটার একতলা, দোতলা, তিনতলা নিমেষে খালি! স্যর, ‘আমার স্কুল’ রচনায় সবাই লেখে তারা ইশকুলকে কত ভালবাসে। সত্যি যদি তারা ইশকুলকে এত ভালবাসে, তবে প্রতি দিন এ রকম করে কেন? যে যাকে ভালবাসে, সে তো তাকে ছেড়ে যেতে চায় না। যদিও বা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, দুঃখে কাঁদে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কই, আমার বন্ধুদের তো তা হয় না! অথচ ইশকুল তাদের কত ভালবাসে! প্রতি বছর নাচ-গান-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। টিফিন খাওয়ায়। পরীক্ষায় যারা সেরা হয়, তাদের মঞ্চে ডেকে উপহার দেয়। তাদের নিয়ে কত ভাল-ভাল কথা হয়। বড় মানুষদের সঙ্গে কত ছবি ওঠে। সেই সব ছবি যেন মণি-মাণিক্য। কেউ বাঁধিয়ে রাখে। কেউ অ্যালবামে রাখে। বাড়িতে অতিথি এলে অ্যালবাম খুলে দেখায়। গর্বে তাদের বুকটা ফুলে ওঠে।
ইশকুল আমাকে কখনও কিছু দেয় না। কেনই বা দেবে! আমি তো তাদের মতো ভাল মেয়ে নই। তবু প্রতি দিন আমার ইশকুল ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়। আমি শূন্য ঘরটায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। অনাদরে পড়ে থাকা বেঞ্চগুলোয় হাত বুলিয়ে দিই। ওই যে চকের গুঁড়ো মাখা ব্যাকবোর্ড— যেন কালো মেয়ের মুখে আনাড়ি সাজগোজের ছোপ-ছোপ সাদা পাউডার। আমি হাত দিয়ে আদর করে মুছিয়ে দিই। সেই সাদা গুঁড়ো এসে লাগে আমার হাতে, জামায়, মাথার কালো চুলে। জানি আমি, বাড়ি ফিরলেই জামা নোংরা করার জন্য মা আমায় বকবে। তবু আমি করি। কেন করি? ভাল লাগে? কী জানি!
মা তো এক-এক দিন আমাকে বকতে-বকতে নিজেই কেঁদে ফেলে। বলে, “এত বলি, এত বোঝাই, তোর বাবা, ইশকুলের দিদিমণি এত বলে, তবু তুই ভাল হবি না! কী নম্বর পেয়েছিস সব সাবজেক্টে! শূন্য... এক... দুই... যেন ধারাপাতের শতকিয়া! তোর মাসির মেয়ে মুনু, তোর চেয়েও ছোট! কত ভাল! প্রতি বছর প্রাইজ আনে। পিসির ছেলে রণিতদাদা তো ফার্স্ট হয়। পাড়ার কেউ তোর মতো নয়। বল, কেউ তোর মতো নম্বর পেয়েছে? তোর বাবা সারা দিন কত পরিশ্রম করে রোজগার করে... সে-তো তোর জন্যই, না কি! তুই বড় হবি, কত বড় চাকরি করবি, কত নাম হবে তোর... তোর জন্যই তো সব! তুই ছাড়া আর আমাদের কে আছে...”
মায়ের কান্না চলতেই থাকে। কোনও-কোনও দিন রাগ করে মা রান্না করে না। আমার খাওয়া হয় না। না খেলে আমার কোনও কষ্ট হয় না। খিদেই পায় না। বাবা এসে হাঁড়িকুড়ি সব ওল্টানো দেখে আবার বাজারে খাবার কিনতে যায়। আমাকে নিয়ে বাবা-মা’র মধ্যেও নিত্য অশান্তি। ঝগড়া। এ বলে তোমার মেয়ে ‘এই’। ও বলে, তোমার মেয়ে ‘ওই’। দু’জনেই বলে, ‘তোমার মেয়ে’। আমি ভাবি, আমি কার মেয়ে? কেউ তো বলে না, ‘আমার মেয়ে’। আসলে খারাপ মেয়ের মা-বাবা কেউ হতে চায় না। যদি ভাল মেয়ে হতাম, তা হলে সকলে বলত, ‘আমার মেয়ে’।
পুজোর সময় পিসি, মাসি নতুন-নতুন জামা আনে আমার জন্য। মা-বাবাও তাদের ছেলে-মেয়ের জামা দিয়ে আসে। পিসি-মাসি এলে আদর করে। কাছে টেনে নিয়ে বলে, “বুনু, দেখতে-দেখতে কত বড় হয়ে গেলি! দেখ তো জামাটা পরে সাইজ় ঠিক হয়েছে কি না।’’
আমি জামাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। জানি রান্নাঘর থেকে নির্দেশ আসবে, “থাক না ওটা। পাট ভাঙতে হবে না। পুজোর সময় পরবে’খন। গত বছরের চেয়ে এক সাইজ বড় এনেছিস তো, হয়ে যাবে।”
আমি মাসির হাতে জামাটা ধরিয়ে দিই। মাসি জামাটা আমার পিঠে ঝুলিয়ে দেখে। বলে, “একটু বড় হবে মনে হচ্ছে দিদি।”
“হোকগে। বড় থাক। দিনকে দিন যা ধিঙ্গি হচ্ছে!”
মাসি জামা ভাঁজ করে রাখে। আমি নিঃশব্দে চলে আসি আমার ঘরে। আমার ঘরটা পুবের বারান্দার এক কোণে। ঘরের সামনে দাঁড়ালে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এক ফালি আকাশ দেখা যায়। নীল-নীল সেই আকাশ ভারী সুন্দর। দোতলার এই বারান্দায় রোদ্দুরও আসে। একতলায় ভাড়াটে থাকে। তাদের আবার ছেলেপুলে নেই। ঝামেলাও নেই।
আমার ঘরটা বেশ বড়। আসলে এটা আমার নিজের ঘর নয়। এটা যাদের ঘর, তারা আর এখন এখানে থাকে না। আমি এক সময় তাদের কাছেই থাকতাম। সেই এইটুকুন বয়স থেকে। তখনকার সব কথা এখন আর মনে নেই। তবে এরা এখন যা বলে, ওরা নাকি আমাকে খুব আদর দিত। বেশি আদরে বাঁদর হয়েছি আমি।
এই ঘরে অনেক কিছু ছিল তাদের। ঘরভর্তি। খাটটাই ছিল কত বড়! ঢাউস দুটো কাঠের আলমারি। বড়ির কৌটো, আচারের জার, বিস্কুট-লজেন্স। সেই লজেন্স খেয়ে নাকি আমার দাঁতে পোকা ধরে গিয়েছিল। সেই পোকা-দাঁতগুলো সব পড়ে গিয়েছে। আর পোকা-দাঁতের মতো ওই সব পুরনো হাবিজাবি জিনিসপত্তরও বিদেয় নিয়েছে এই ঘর থেকে। খাট গিয়ে এসেছে বেবি কট। ওই বেবি কটে শুতাম আমি। এখন আমার ঠ্যাং লম্বা। বেরিয়ে পড়ে বাইরে। বেবি কটে এখন আদুরি ঘুমোয়। আমার জন্য নতুন খাট এসেছে। একটা আলমারিও এসেছে কাঠ-কাঠ রঙের। কাঠ নয়, তবু কাঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা। ভাল্লাগে না। আর ওই যে আমার পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক। চারদিকে সব বই-খাতা ছড়ানো। মা প্রতি দিন কত গজগজ করে। তবু তাদের হুঁশ ফেরে না। কাজের মাসি কিন্তু কোনও দিন গজগজ করে না। তুলে-তুলে জায়গামতো রেখে দেয়। ভালবেসে রাখে বলে, ওরা কিন্তু কিছু ক্ষণ এক ভাবে থাকে।
স্যর, আপনি তো জানেন চিনা পুতুল আদুরিকে। ও কিন্তু স্যর সারা দিন একনাগাড়ে ঘুমায়। বেবি কট ছেড়ে উঠতেই চায় না। এ পাশ, ও পাশ। যে দিকে পাশ ফিরিয়ে দিই, সেই পাশেই চুপ করে পড়ে থাকে। দিনে এত ঘুমোলে কি রাতে ঠিকমতো ঘুম আসে, স্যর? রাতে শুতে-শুতে সেই এগারোটা। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন ও জাগে। আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “ওঠ, ওঠ। এত ঘুমোস কেন? ঘুমকাতুরে!”
আমি বলি, “নিশুত রাত। কী করব উঠে?”
সে বলে, “এই তো তারা ফোটার সময়। চল, চল বারান্দায়।”
কী আর করা! উঠে পড়ি। ও আবার হেঁটে আসবে না বাইরে। কোলে করেই আনতে হয়। লাইট পোস্টের আলো সামনের বাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়ে। বারান্দায় চাপ-চাপ অন্ধকার। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে অসংখ্য তারা দেখা যায়। আদুরি বলে, “এ ঘরে যে বুড়োটা থাকত সেটা কোন তারা বল তো?”
আমি বলি, “কী জানি!”
ও বলে, “জানিস না? ওই তো ওইটা। ওই যে বড় তারাটা... ওটাই তো।”
আমি বলি, “ইস! ওর ঘরে আমরা কত আরামে আছি। আর বুড়োটা এই খোলা আকাশের নীচে কত কষ্ট পাচ্ছে, বল!”
“কষ্টই তো! চলে যাওয়ার সময় একটা জামাও দেয়নি জানিস। সব খুলে নিয়েছিল।”
“আচ্ছা ও তো প্রতিবাদ করতে পারত! তার ঘর। তার জামা।”
“কী করে প্রতিবাদ করবে? একটা বাঁশের শক্ত খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে ছিল যে!”
“আমি দেখেছি?”
“দেখেছিস বইকি!”
“আমার মনে নেই। আচ্ছা ওল্ড এজ হোম কী রে আদুরি? বাবা-মা প্রায়ই বলাবলি করে।”
“কী আবার! সেখানে যত রাজ্যের বুড়োবুড়িরা থাকে।”
“সেটা কোথায় তুই জানিস?”
“জানি। এই যে উঁচু-উঁচু মাথাওয়ালা বাড়িগুলো, তার ও পারে। সেখানেই তো এ ঘরের বুড়িটা
এখন থাকে।”
“আচ্ছা, সে যদি ফিরে এসে এ ঘরের জিনিসগুলো ফেরত চায়! কী করবি? একটা জিনিসও তো নেই রে!”
“ও আর কোনও দিন ফিরে আসবে না।”
“কেন রে?”
“তাকে কঠিন রোগে ধরেছে।
খুব শিগগিরই ওই আকাশের তারা হয়ে যাবে।”
“তারা হয়ে যাবে!”
স্যর, হঠাৎ আমার খুব কান্না পায়। এত মার খেয়েও কোনও দিন আমি শব্দ করে কাঁদিনি। এখন আমি ডুকরে কেঁদে উঠি। দু’চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রু গড়াতে থাকে।
আদুরি বলে, “আরে কী হল তোর! কাঁদছিস কেন?”
“জানিস আদুরি, ওরা বলে,
ওই বুড়িটা আমায় আদর দিয়ে-দিয়ে বাঁদর করেছে।”
“তাতে তোর কান্না পাবে কেন? বুড়িটার উপরই তো রাগ হবে।”
“রাগ হচ্ছে না রে। জানি না, কেন খালি কান্না পাচ্ছে।”
স্যর, এখন আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অনেক কান্না। এক সমুদ্র কান্না।
যেন সে কান্না আপনার কানেও পৌঁছয়।