ছবি: সুব্রত চৌধুরী
শেখর বিরক্ত মুখে বাইরের ঘরে একা বসে আছেন। গান শেখানোর আওয়াজ আসছে ভিতর থেকে। শেখরের ছাত্রী শিখছে। গান শেখা শেষ হলে শেখরের কাছে আসবে সে। বাংলা পড়তে। বাংলায় অনার্স নিয়েছে। আজ একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছেন শেখর, গানের দিদিমণি বিদায় নেওয়ার আগেই। শেখরের মুখে বিরক্তির ছাপ অপেক্ষার জন্য নয়। গানে সামান্য উঁচু দিকের পরদা এলেই গলাটা একটু চেপে, ভিতর দিকে টেনে নিয়ে স্বরগুলো লাগানো হচ্ছে। শেখরের বিরক্তি সেইখানেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে মধ্যবয়স্কা গানের দিদিমণি বেরিয়ে গেলেন শেখরের সামনে দিয়েই। ছাত্রী বাইরের দরজা বন্ধ করে বলল, ‘‘আসুন স্যর!’’ শেখরের পড়ানোর ঘরে খাটের ওপর হারমোনিয়াম। ঘরের অন্য দিকে পড়ানোর জন্য দুটো চেয়ার, একটা টেবিল। টেবিলে থাক দিয়ে উঁচু করা বই। শেখর ছাত্রীকে বললেন, ‘‘কিসের নোট লেখাতে হবে যেন আজকে? তারাশঙ্করের গণদেবতা? তাই তো? খাতা বের করো।’’ ছাত্রী খাতাপত্র নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এ সময় ছাত্রীর মা এসে এক কাপ চা আর দুটি বিস্কুট নামিয়ে দিয়ে গেলেন।
শেখর দুপুরে মাস্টারি করেন স্কুলে। সন্ধেয় গৃহশিক্ষকতা। কলকাতা থেকে ট্রেনে আধ ঘণ্টা দূরের এই টাউনে ভাল টিউটর হিসেবে খ্যাতি আছে তাঁর। বাংলার শিক্ষক শেখর স্কুলটিচার হলেও প্রধানত কলেজ স্টুডেন্টদের পড়ান।
ছাত্রী খাতাকলম নিয়ে বসেছে, শেখর লেখাতে শুরু করবেন, হঠাৎ কী এক ভূত চাপল শেখরের মাথায়। বলে বসলেন, ‘‘গানে উঁচু পরদার জায়গাগুলো এলেই গলাটা হঠাৎ চেপে ছোট করে, আওয়াজটা একটু ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে গাইছিলে কেন?’’ ওই ভাবেই যে শেখানো হচ্ছিল, সে কথাটা উল্লেখ না করে যোগ করলেন, ‘‘গলাটা খুলে সাহস করে নোট লাগানোর চেষ্টা করতে পারো না? ভয় কিসের?’’
ছাত্রী হতভম্ব। বাংলার স্যর হঠাৎ এ সব কী বলছেন? সে প্রায় কিছু না বুঝে বলে, ‘‘মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন স্যর?’’ ভূতটা আরও চেপে বসল শেখরের মাথায়। তিনি এ বার উত্তেজিত। বলছেন, ‘‘কেমন জানো? তুমি শিখছিলে যে-গানটা, ওই যে ওই ‘শুনেছি মুরতি কালো’ এই জায়গাটা এ রকম হবে...’’ গেয়ে উঠলেন শেখর, ‘‘শুনেছি মুরতি কালো, তারে না দেখা ভাল। সখী, বলো আমি জল আনিতে যমুনায় যাব কি। এখনো তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছি...’’
শেখরের দরাজ গলার গানের সুরভরা খোলা আওয়াজ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল। জানালার পরদা উড়িয়ে যেন চলে গেল বাইরের গাছপালার দিকে। গান মাঝপথে থামিয়েই শেখর বলে উঠলেন, ‘‘ওই ‘শুনেছি’র জায়গায় যেখানে ‘শুনেছি মুরতি কালো’ বলছ, ওই ‘শুনেছি’টা আরও খোলা করে বলো। স্বরটা সাহস করে লাগাও। বনানী ঘোষের রেকর্ড শুনে দ্যাখো। এখন তো তোমাদের ওই ইউটিউবে সব গান পাওয়া যায়!’’
ছাত্রী স্তম্ভিত, ‘‘আপনি এত ভাল গান করেন স্যর? কখনও বলেননি তো?’’
‘‘গানের কথা কখনও ওঠেনি, তাই বলা হয়নি। নাও, খাতাকলম নাও। ‘গণদেবতা’র নোটটা লেখাতে হবে আজকে।’’
ছাত্রীর বিস্ময় কাটছে না, ‘‘আপনি এই রকম ভাবে গাইতে পারেন, স্যর? এই স্টাইলটাই তো আমার একদম অচেনা!’’
শেখর কাজে ফিরতে চাইলেন, ‘‘আর কথা নয়। আমি বলছি, তুমি লিখতে শুরু করো।’’
ছাত্রী ছাড়বে না, ‘‘আর একটা গান অন্তত শোনান স্যর। ওটা তো পুরো গাইলেন না। অন্তত একটা গান পুরো শোনান।’’
‘‘করুন না একটা গান।’’ দরজায় ছাত্রীর মা দাঁড়িয়ে। শেষ যৌবনের আভা ছুঁয়ে আছে তাঁর মুখ। চশমার পিছনে বড় বড় চোখ। তারা তাকিয়ে আছে শেখরের দিকে, ‘‘ও তো রোজই পড়ে, আজ নাহয় একটু গানই শুনলাম আমরা।’’
ভূতটা শেখরের মাথায় আবার চেপে বসল। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে শেখর শুরু করলেন, ‘সে কেন দেখা দিল রে। না দেখা ছিল যে ভাল, বিজলীর মতো এসে সে কোথা কোন মেঘে লুকাল...’
এ বার পুরো গান গেয়ে থামলেন শেখর। চেয়ারে ছাত্রী। দরজায় ছাত্রীর মা। চিত্রবৎ স্থির। শেখরের উদাত্ত গলার গান ঘরের আবহাওয়া পুরো পালটে দিয়েছে।
শেখর এ বার তাড়া দিলেন ছাত্রীকে, ‘‘নাও, নোট নেওয়াটা শুরু করো। অনেকটা লেখাতে হবে। উপন্যাসটা পড়ে নিয়েছ তো?’’
ছাত্রী খাতাপত্র নিল। ছাত্রীর মা দরজা থেকে নিঃশব্দে অদৃশ্য হলেন। নোট লেখানো চলল।
এ বার শেখর বাড়ি যাচ্ছেন। বাইরের দরজা খুলে দিচ্ছে ছাত্রী। শেখর বললেন, ‘‘আজ কিছুটা বাকি রয়ে গেল। এর পর তো শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ আছে। পরের দিন আগে এটা শেষ করতে হবে।’’
‘‘সে দিন আবার গান শোনাবেন তো?’’
শেখর ঘুরে দেখলেন, পিছনে ছাত্রীর মা দাঁড়িয়ে। তিনিই বলেছেন কথাটা। অমনি ছাত্রীও বলে উঠল, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে দিনও গান শোনাতে হবে।’’
‘‘আচ্ছা, সে তখন দেখা যাবে,’’ বলে শেখর দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন।
******
শেখরের বয়স পঞ্চাশ। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল। সাদা পাজামা পাঞ্জাবিই একমাত্র পোশাক তাঁর। বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি চারটে বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে। অনেক ধারদেনা এখনও রয়ে গিয়েছে সে-বাবদ। একটু একটু করে শোধ করে চলেছেন। একতলা এক ছোট্ট বাড়িতে থাকেন। বাবার করা বাড়ি। বাবা-মা দু’জনেই গত হয়েছেন। মা গিয়েছেন শেখরের কৈশোরে, ছোট বোনটার বয়স তখন মাত্র দশ। শেখর একাই থাকেন। একাই রান্না-খাওয়া তাঁর। শেখরের ধারেকাছে একটা গানের ভূত ঘোরাফেরা করে। ভূতটা মাথায় চেপে বসলেই শেখরকে গানে পায়। গান শেখর পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। বাবা গাইতেন ডি এল রায় আর অতুলপ্রসাদ। মাঝে মাঝে দু’একখানি রবীন্দ্রসংগীতও। বাবা যৌবনকালে দস্তুরমত শিখেছিলেন গান। শেখরের সবই শেখা বাবার কাছে। বাবা যখন শেষ শয্যায়— তখন শেখর এক দিন গাইছেন, হঠাৎ দেখলেন, বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাবা যখন গেলেন, তখনও দুই বোনের বিয়ে বাকি। ঋণ করতেই হত। হলও। শেখর তাই গৃহশিক্ষকতার কাজটা করে চলেছেন ঋণ সব শোধ করবেন বলে। এখন গানের ভূতটা মাথায় ঢুকলে শেখর বারান্দায় বসে একা একা গান গেয়ে চলেন। শেখরের বারান্দার সামনে অনেকটা উঠোন। উঠোনে দুটো শিউলি গাছ। শরৎকালের সকালে মনে হয়, কেউ যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে উঠোনে। শেখর যখন বারান্দায় গান করেন, তখন সামনে থাকে শিউলিগাছেরা। শিউলিগাছকেই গান শোনান শেখর। আর কোনও শ্রোতা নেই তাঁর।
******
পর দিন পড়াতে গিয়েছেন শেখর, দেখলেন মা মেয়ে দু’জনে খাটের ওপর উপবিষ্ট। দাবি, আগে গান শোনাতে হবে, তার পর পড়া।
বারবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন শেখর, কিন্তু ওই বাধা দেওয়ার ফাঁকেই গানের ভূতটা আবার ঢুকে পড়ল শেখরের মাথায়। শেখর ধরলেন, ‘ওগো আমার নবীন শাখী, ছিলে তুমি কোন বিমানে। আমার সকল হিয়া মুঞ্জরিছে তোমার ওই করুণ গানে। লয়ে তব মোহন বরন, শুকনো ডালে রাখলে চরণ, আজ আমার জীবন-মরণ কোথা আছে কে বা জানে...’’
গানের তোড়ে সে দিন আর বইখাতা খোলাই হল না। একের পর এক গেয়ে চললেন শেখর। এক সময় ছাত্রী বলে, ‘‘এমন করে গাইতে তো আর কাউকে শুনি না।’’ শেখর বলেন, ‘‘বাবা এমন করে গাইতেন, খোলা আওয়াজে। আমি বাবার মতো করে চেষ্টা করি। হয় না হয়তো।’’
ছাত্রী উঠে একটু ভিতরে গেল। আজ চা বানাবে সে। ছাত্রীর মা তাকিয়ে আছেন। চশমার নীচে কাজল টানা বড় বড় চোখ। ‘‘আপনি কাকে গান শোনান?’’ প্রশ্ন শুনে শেখর হাসেন, ‘‘আমার গান আর কে শুনবে? বারান্দায় বসে গান করি। উঠোনে শিউলিগাছ আছে দুটো, ওরা নিশ্চয়ই শোনে,’’ বলে আবারও হাসেন শেখর। হাসলে শেখরের একটা গজদাঁত দেখা যায়। ভারী সুন্দর লাগে শেখরকে তখন। কিন্তু তিনি সাধারণত হাসেন না।
এর পর থেকে রোজই শেখরকে পড়াশোনা হয়ে যাওয়ার পর দু’একখানা করে গান শোনাতেই হয়। রোজ মানে প্রতি বুধবার আর শনিবার। সপ্তাহে এই দু’দিন এ বাড়িতে পড়াতে আসেন শেখর। সপ্তাহের অন্য দিনগুলো অন্যান্য বাড়িতে পড়াতে যান।
ছাত্রীর বাবা সন্ধেয় বাড়ি থাকেন না কখনও। শেখর শুনেছেন, বিকেলে অফিস থেকে ফিরে তিনি রোজ তাসের আড্ডায় যান। ফিরতে রাত হয়। এক দিন গান শোনাতে গিয়ে বাড়ি যেতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে শেখরের, দরজায় মুখোমুখি দেখা— ‘‘চললেন মাস্টারমশাই? স্টুডেন্ট কেমন পড়াশোনা করছে আপনার?’’ মদের গন্ধ ধক করে নাকে এসে লাগল শেখরের। জোর করে হাসির চেষ্টা করে বললেন শেখর, ‘‘ভালই তো।’’
এক সন্ধেয় শেখরের ছাত্রী বলল, ‘‘স্যর, আমরা চলে যাচ্ছি। বাবার বদলির অর্ডার বেরিয়েছে।’’ খুব একটা অবাক হলেন না শেখর, ‘‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’’ ছাত্রী বলে, ‘‘অনেক দূর। সেই একেবারে জলপাইগুড়ি। আর মোটে এক মাস আছি এখানে। কলকাতায় মাসির বাড়িতে থেকে পরীক্ষাটা দেব।’’ ছাত্রীর কলেজ কলকাতা। যাতায়াত করে রোজ। শেখর বলেন, ‘‘কোর্স তো তোমার কমপ্লিট। এ বার ভাল করে প্রিপারেশন নাও।’’
ছাত্রী বলে, ‘‘এই এক মাস কিন্তু আপনি আসবেন, স্যর। আসা বন্ধ করলে চলবে না।’’ শেখর বলেন, ‘‘আচ্ছা, আসব।’’
নিয়মিতই আসতে লাগলেন শেখর। নির্দিষ্ট এক মাসও দ্রুত ফুরিয়ে যেতে লাগল। একদিন পড়াতে গিয়ে শেখর শুনলেন, ছাত্রী বাড়ি নেই। সে তার বাবার সঙ্গে কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়েছে। ছাত্রীর মা বললেন, ‘‘সামনের শনিবারই আমরা চলে যাচ্ছি তো।’’
শেখরের মনে পড়ল, আজ বুধবার। শেখর বলেন, ‘‘ওহ্, তাই বুঝি। তা হলে তো ওর সঙ্গে আর দেখা হচ্ছে না। বলে দেবেন, আমি এসেছিলাম। তা হলে চলি, কেমন?’’
ছাত্রীর মা বললেন, ‘‘একটু বসুন না। অনেকক্ষণ বেরিয়েছে, ফিরে আসার সময় হল।’’ কী ভেবে শেখর বাইরের ঘরে বসে পড়েন। ছাত্রীর মা বলেন, ‘‘আজ তো আর আপনার গান শোনা হবে না। আর কোনও দিনই আপনার গান শোনা হবে না। আমাদের জলপাইগুড়ির বাড়িতে আসবেন, যদি আমরা ডাকি?’’
শেখর বলেন, ‘‘দেখি। সব কাজকর্ম সামলে, তার পর...’’ কথা শেষ করেন না শেখর।
ছাত্রীর মা বলেন, ‘‘আপনার উঠোনের শিউলিগাছেদের কত ভাগ্য!
শেখর বুঝতে পারেন না কথাটা। বলেন, ‘‘মানে?’’
‘‘তারা তো রোজ আপনার গান শুনতে পায়। আমি যেন পরের জন্মে আপনার বাড়ির শিউলিগাছ হয়ে জন্মাই।’’
শেখর উত্তর দিতে পারেন না।
‘‘আমাকে মনে থাকবে না আপনার। ভুলে যাবেন নিশ্চয়ই। তবু বলে রাখছি, এর পর থেকে বাড়ির শিউলিগাছেদের যখন গান শোনাবেন, মনে রাখবেন, আমিও শুনছি।’’
চশমার নীচে কাজল পরা টানা টানা চোখ জলে ভরে উঠল। চোখ উপচে জলের ফোঁটা নেমে এল দুই গাল বেয়ে।
শেখর স্তব্ধ বসে রইলেন।