ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
বাস থেকে নেমে চারদিক ভাল করে দেখে নিল তারকনাথ। এই অঞ্চলে সে আগে আসেনি। তবে জায়গাটার গল্প শুনেছিল। কলকাতার কাছেই, একেবারে এই শহরের গা ঘেঁষে নাকি আর একটা শহর গড়ে উঠেছে। নতুন কলকাতা।
তাদের অফিসের বড়বাবু গণেশদাই তো তাকে বলেছেন, ‘‘বুঝলে তারক, নিউটাউন জায়গাটার প্যাটার্নই অন্য রকম। বিলেতের ধাঁচে তৈরি। পুরনো কলকাতার মতো ধুলো, ধোঁয়া থাকবে না। চওড়া, বাঁধানো রাস্তাঘাট হবে। জেট গতিতে সেই পথ ধরে ছুটে যাবে হাল ফ্যাশানের মোটরগাড়ি। বড় বড় হাউজ়িং কমপ্লেক্স, ধোপদুরস্ত শপিং মল। পুরোপুরি ডেভলপ হতে দাও শুধু, কী হুলস্থুল কাণ্ডখানা হয় দেখো একবার।’’
তারকনাথ অবশ্য তেমন কিছু দেখছে না। খাপছাড়া ভাবে গজিয়ে ওঠা কয়েকটা উঁচু উঁচু বাড়ি, ধু ধু মাঠ আর শুনশান ফাঁকা ইয়া চওড়া রাস্তা… এর বেশি কিছুই চোখে পড়ছে না তার।
অফিস থেকে ক্লায়েন্টের নাম ঠিকানা সব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরেও বাস থেকে নেমে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারকনাথ। অন্য কেউ হলে থাকত না। তারকনাথ বলেই আছে। নতুন জায়গায় এসে পড়লে অথবা সুন্দর দৃশ্য দেখলে তারকনাথ নিয়ম করে হতভম্ব হয়ে পড়ে। পাড়ায় তার একটা নাম আছে, ‘হাঁ করা তারক’।
অফিসব্যাগ সামলে তারক একটা গুমটি চায়ের দোকানে উঁকি মারল। চালাঘর। তবে দেখে মনে হচ্ছে, চা-বিস্কুট ছাড়াও খুচরো জলখাবারের ব্যবস্থা আছে। তিনটে টেবিল, সঙ্গে বেশ কয়েকটা চেয়ার। ঘরের এক কোণে ছোট্ট পোর্টেবল টিভি সেট, তাতে বাংলা সিনেমা চলছে। দোকানি একটা চেয়ারে বাবু হয়ে বসে মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
ঝাড়পিটের সিন। খয়াটে চেহারার বেঁটেখাটো নায়ক বিশালদেহী দশ-বারোজন গুন্ডাকে পিটিয়ে পাটপাট করে দিচ্ছে।
তারক ঘরে ঢুকল না। গলা বাড়িয়ে বলল, ‘‘দাদা, এই শ্রাচী গার্ডেনটা কোন দিকে বলতে পারবেন?’’ দোকানদার একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তারকের দিকে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ফের চোখ ফিরে গেছে সিনেমায়। গুন্ডারা মার খেয়ে নায়কের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছে, নায়ক তবু তাদের ছাড়ছে না, এত রাগ! দোকানদার সে দিকে তাকিয়েই হাতের ইশারা করে বললেন, ‘‘সোজা রাস্তা ধরে চলে যাও। তিনটে লেন ছেড়ে চার নম্বর লেন দিয়ে ডান দিকে ঢুকে সেকেন্ড রাস্তায় যাবে। ছোট্ট মাঠে দেখবে ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটা আছে, উল্টো দিকে দেখবে বড় করে লেখা আছে শ্রাচী গার্ডেন। এগারো তলা বিল্ডিং।’’
এর পর আর কিছু শোনার বা বলার থাকে না। তারকনাথ ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগাল। শুনতে সহজ মনে হলেও রাস্তা কম নয়। মে মাসের গরমে তার মুখ লাল হয়ে গেল, জামা ঘামে ভিজে লেপ্টে গেছে গায়ের সঙ্গে, গভীরতর হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাস।
এ সমস্তটাই অতি সাধারণ এক মানুষের প্রাণপণ বেঁচে থাকার লক্ষণ। তারকনাথ সেই সব মানুষের প্রতিনিধি যাদের জীবনে কোনও কিছুই খুব সহজে হয় না। গরিব ঘর, তিন ভাই বোন। কোনও মতে বড় হতে না হতেই বাজে একটা অসুখে তার বাবা মরে গেল। মা বাধ্য হয়ে লোকের বাড়ি রান্নার কাজে ঢুকল। বড় ছেলে তারকনাথ অনেক ঘাটের জল খেয়ে তেমন সুবিধে না করতে পেরে এখন এই বিমা কোম্পানিতে এসে ঠেকেছে। তবে এ কাজেও তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি তারকনাথ, প্রতিদিন তার ইমিডিয়েট বস কুন্তলদার কাছে ঘাড় ঝুলিয়ে ঝাড় খেতে হয় তাকে।
আজও তো বেরোনোর আগে কুন্তলদা পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘‘ক্লায়েন্ট হাই প্রোফাইল। চার চারটে ঢাউস গাড়ির ইয়ারলি ইনশিয়োরেন্সের চেক দেবে। খুব রাশভারী পাবলিক তারক। পাঁচ মিনিটের বেশি টাইম দিতে পারবে না বলেছে। তুই কিন্তু ঠিক সাড়ে বারোটায় পৌঁছে যাবি। আর একটু কেয়ারফুল থাকিস, তার কাটা পাবলিক আছে।’’
মাইনে সামান্য। তাই উপরি দুটো পয়সার জন্য ছুটির দিন নিজের হাতে ফিনাইল বানায় তারকনাথ। বাড়িতেই। ছোট ভাইটা সেই ফিনাইল ফেরি করে বাড়ি বাড়ি।
বাজার খারাপ। রোজ খরচ বাড়ছে। সংসার সচল রাখতে নাকানিচোবানি খাচ্ছে মা-ব্যাটায়। তারকনাথ ঠিকানা খুঁজে পেল। ঘাড় ব্যথা হয়ে যাওয়ার মতো উঁচু বাড়িটায় ঢোকার আগে হঠাৎ মুখে একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা অনুভব করল সে। এতক্ষণ তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি, কখন যেন নিদাঘদিনের দৃশ্যপট পালটে গেছে, জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা রোদ সরে গিয়ে এক মনোরম ছায়া ঢাকা পড়েছে চারপাশে। পুবদিকে আকাশের কোনায় বেশ কিছুটা জায়গা ঘন কালো রং নিয়েছে।
তারকনাথের কুঁচকে থাকা ভুরু সোজা হয়ে গেল। দশ তলায় লিফট থেকে নেমেই সামনে জয়সওয়ালদের ডুপ্লে। এমন ঘরবাড়ি তারকনাথ তার সাতাশ বছরের জীবনে এর আগে দেখেনি। সোফায় বসতেই প্রায় আধহাত ডুবে গেল তার শরীরটা। বিশাল লিভিং রুম জুড়ে বৈভব আর প্রাচুর্যের বহু নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেওয়ালে অ্যান্টিক মুখোশ, ছাদ থেকে ঝুলছে বিদেশি ঝাড়লণ্ঠন, প্রায় মুখ দেখতে পাওয়ার মতো চকচকে ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে।
ছোট্ট কাঠের ডিভাইডার দিয়ে আলাদা করে এই বসার ঘরের শেষ প্রান্তের মেঝে কৃত্রিম ঘাস দিয়ে মোড়া। তারকনাথ ঘড়ি দেখল, বারোটা আটত্রিশ। জয়সওয়াল নিজেই টাইম রাখতে পারেনি। তারক অন টাইম। ঘরের দূরতম প্রান্তে চোখ যেতেই হঠাৎ চমকে উঠল তারকনাথ। ঘরের একটা দিকের দেওয়াল পুরোপুরি কাচে মোড়া। সেখান দিয়ে মোটামুটি অর্ধেক শহরের স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। সোফা থেকে উঠে মুগ্ধ তারকনাথ সে দিকে এগিয়ে গেল।
বৃষ্টি নেমেছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। ঝিরঝির, টুপটাপ বৃষ্টি নয়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি, সৃষ্টি রসাতল টাইপের বৃষ্টি। চারদিক ঝাপসা হয়ে এসেছে, গাছপালাগুলো অসহায় ভিজে যাচ্ছে সেই বারিধারায়। পথচারী প্রায় কেউ নেই। সর্পিল বড় রাস্তায় মাঝেমাঝে শুধু দু’ –একটা গাড়ি হু হু করে ছুটে চলে যাচ্ছে। তারকনাথ বিহ্বল হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগল।
উমেশ জয়সওয়াল ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। তাঁর থেকে ঠিক পনেরো হাত দূরে তারকনাথ পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। প্রৌঢ় উমেশ জয়সওয়াল অবাক হলেন না, যেন গাড়ির বিমা করাতে এসে এজেন্টের হাঁ করে বৃষ্টি দেখতে বসে যাওয়া এক অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি তারকনাথকে ডাকলেন না। বসে রইলেন সোফার উপর।
মিনিট পাঁচেক পরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তার পর নিঃশব্দে ফ্ল্যাটের গেট খুলে বেরিয়ে গেলেন। গড়িয়ার দিকে তাঁর নতুন রিয়েল এস্টেট প্রজেক্ট হচ্ছে, আজ একবার দেখে আসতে হবে। লিফটে করে বেসমেন্টে নামতে নামতে তিনি কুন্তল রায়ের নম্বর ডায়াল করলেন।
এই ফোনের ফলাফল মারাত্মক হল। ঝামেলা বহুদূর গড়াল। রিজিওনাল হেড-এর সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মিটিং সেরে বেরিয়ে কুন্তল রায় তারকনাথের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম তারক, কিন্তু পারলাম না। জয়সওয়ালের অভিযোগটা কোম্পানি সিরিয়াসলি নিয়েছে। তুই তো জানিস হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্ট যদি নেগলিজেন্স-এর কমপ্লেন করে, তা হলে কী হতে পারে! আমি দু’মাস সময় চেয়েছি তোর জন্য। তার মধ্যে অন্য একটা কাজ খুঁজে নে তারক।’’ মুখ দিয়ে আফশোস সূচক শব্দ বার করলেন কুন্তল, ‘‘এত করে তোকে বললাম কেয়ারফুল থাকতে... ’’
তারকনাথের মুখে কথা জোগাল না, সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। খবর পেয়ে গণেশদা ম্যানেজমেন্টকে খুব একচোট গালাগাল করল। তার পর নিজে নিজেই গজগজ করতে লাগল। ভদ্রলোক কী বলছেন তা আর এখন শোনা যাচ্ছে না।
তারকনাথ বিড়বিড় করল, ‘‘আমাদের সংসারটা ভেসে যাবে গণেশদা। মাকে মুখ দেখাব কী করে!’’
গণেশদা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল আবার, ‘‘ভেসে গেলেই হল? ইল্লি আর কী! তুই ঠিক আবার চাকরি পেয়ে যাবি। এই চাকরির থেকে অনেক বড় চাকরি। এদের মুখে ইয়ে করে দিয়ে চলে যাবি শালা।’’
তারকনাথ হাসল। মলিন, বিধ্বস্ত হাসি । গণেশদা সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। সে জানে জীবন এত সহজ নয়। এত সহজে গরিব মানুষের অবস্থা পাল্টায় না।
সে দিন বাড়িতে ফিরে নিজের মুখে মাকে খারাপ খবরটা দিতে পারল না তারকনাথ। উঠোনে কলতলার পাশে একটা বাতাবিলেবু গাছ আছে। সেই গাছের বাকলের গন্ধে অনেক রাত অবধি জেগে রইল সে। বোনের বিয়ে, অফিসের অপমান, ভবিষ্যৎ চিন্তা সব ছাপিয়ে এক সময় তার চেতনার ওপর ঝুঁকে পড়ল অদ্ভুত এক বৃষ্টির ছবি। অনেক উঁচু থেকে দেখা, উথালপাথাল, লোকালয় ডোবানো এক বৃষ্টি দুপুর।
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে তারকনাথ ঘুমিয়ে পড়ল।
******
পৃথিবীতে সব কিছুই সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায়, সময় নিজে পাল্টায় সব চেয়ে দ্রুত। ছোটবেলার নীতিকথার বইয়ে লেখা থাকে, ‘কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। অধ্যবসায়ই সাফল্যের চাবিকাঠি’... ইত্যাদি ইত্যাদি।
জীবনের চলার পথে বাস্তবের কঠিন আঘাতে আমরা সেই নীতিকথার ওপর বিশ্বাস হারাই। কিন্তু ঘটনা হল, কথাগুলো পুরোপুরি মিথ্যে নয়। পরিশ্রম আর অধ্যবসায় থাকলে সত্যি সত্যিই অনেক অসাধ্যসাধন সম্ভব।
বড়বাবু শঙ্কর মণ্ডলের রেফারেন্সে কয়েকটা মাঝারি মানের দোকানে ফিনাইল সাপ্লাইয়ের কাজ পেয়ে গেল তারকনাথ। ছোট ব্যবসা বড় হল, কাজের চাপ বাড়তে একটা গ্যারেজঘর ভাড়া নিয়ে ফিনাইল তৈরি করতে লাগল তারকনাথ। কর্মচারী নিয়োগ করা হল, তাদেরও সংখ্যা বাড়ল এক এক করে। ফিনাইলের সঙ্গে সঙ্গে টয়লেট ক্লিনার, সাবান— আরও কিছু নতুন প্রডাক্ট বাজারে ছাড়ল তারকনাথ। চাহিদা বাড়ল। তারকনাথ বুঝল, সময় বদলাচ্ছে। নিজের সবটুকু উজাড় করে দিল ব্যবসায়। বাকিটুকু ইতিহাস।
এই মুহূর্তে যে মধ্যবয়স্ক মানুষটি বিদেশি গাড়ি থেকে নেমে নিজের অফিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনিই যে পনেরো বছর আগের তারকনাথ, তা না বলে দিলে বিশ্বাস করা শক্ত।
তারকনাথের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গত কয়েক দিন হাওয়ায় অস্বাভাবিক আর্দ্রতা। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, এই দুরবস্থা আরও চলবে, বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
তারকনাথের ভুরু কুঁচকে আছে। হেভেন্স অ্যাপ্ল হসপিটালস তারকনাথের কোম্পানির স্থায়ী কাস্টমার, তারা এবছর তারকনাথের কোম্পানির সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে চাইছে না। সকালের ই-মেলে এই খবর পেয়েছে তারকনাথ। আর তার পর থেকেই তার ভুরু কুঁচকে রয়েছে। অফিসে ঢুকতেই হেড অফিসের জনা তিরিশ কর্মচারী উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘‘গুড মর্নিং স্যর।’’
তারকনাথ শুনতেও পেল না। ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের কেবিনে ঢুকেছে, ফোনের ওপারে সেলস এগজ়িকিউটিভ সপ্তক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারকনাথ কড়া গলায় বলল, ‘‘হেভেন্স অ্যাপ্ল-এর কন্ট্র্যাক্ট রিনিউয়াল না হওয়ার অর্থ বোঝো সপ্তক? বছরে প্রায় চল্লিশ লাখ রেভিনিউ কমে যাওয়া। এর দায় কে নেবে? তুমি? না তোমার সেলস-এর টিম! ’’
‘‘আমি দেখছি স্যর, কিছু একটা মিস কমিউনিকেশন হয়েছে।’’
‘‘এই মিস কমিউনিকেশনের জন্যই কি আমি লাখ লাখ টাকা দিয়ে সেলস টিম পুষছি সপ্তক?’’ ঠান্ডা গলায় বলল তারকনাথ ।
সপ্তক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাবড়ে গেল, ‘‘স্যর, ক’টা দিন সময় দিন। ওদের নতুন ম্যানেজমেন্ট, আমি মিটিং ফিক্স করছি স্যর, এখুনি করছি।’’
‘‘নতুন ম্যানেজমেন্ট এলে ভাল প্রডাক্টের ডিমান্ড কমে যায় না। আমি সত্তর কোটির ব্যবসা চালাই সপ্তক, আমাকে গাধা ভেবো না। আমি তোমাদের সঙ্গে নরম করে কথা বলি বলে যে পারলে আমার পিছন মেরে যাবে তা কিন্তু নয়, বুঝলে? তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা শর্ট আউট করো। না হলে সপ্তক, আই হ্যাভ টু টেক সাম হার্শ ডিসিশন।’’
ফোন কেটে দিল তারকনাথ। এম.ডি-র চেয়ারে বসে একটু দম নিল সে। আজকাল অল্পেই বুক ধড়ফড় করে, দম চাপা কষ্ট হয়। প্রেশারটা বেশ বেড়েছে। ঘুম হচ্ছে না গত কয়েক দিন। ডাক্তারকে বলে ঘুমের ওষুধের ডোজ়টা বাড়াতে হবে।
তারকনাথ সিদ্ধান্ত নিল, সেলস টিম কিছু না করতে পারলে সে নিজেই হেভন্স অ্যাপ্ল-এর ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসবে।
টালির চালের বাড়ি বহু বছর ছেড়ে এসেছে তারকনাথ। ভাইকে নিজের ব্যবসায় লাগিয়েছে, বোনের ভাল বিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার জামাই বড় শ্যালক বলতে অজ্ঞান।
মা অবশ্য তারকনাথের এমন মারকাটারি সাফল্য পুরোটা দেখে যেতে পারেননি। বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটটা বুক করার বছরেই মা চলে গেছেন।
তারকনাথের এই পর্যায়ের সাফল্য আসতে বছর বারো সময় লেগেছিল। শহরের আবহাওয়া অবশ্য তার চেয়ে অনেক দ্রুত পাল্টে যায়।
হাওয়া অফিসের পূর্বাভাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বৃষ্টি নেমেছে শহরে। জানলার স্লাইডিং গ্লাস একটু খোলা থেকে গেছে, সেখান থেকে বৃষ্টির ছাঁট এসে টেবিলের কোনা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
বিরক্ত হল তারকনাথ। অফিসটা অদক্ষ লোকে ভরে যাচ্ছে। ক্লিনারকে ডেকে ধমক লাগাবে? থাক। ভাল লাগছে না।
অবহেলায় স্লাইডিং গ্লাসের জানলা বন্ধ করে দিয়ে কম্পিউটারে সেলস রিপোর্ট খুলে বসল তারকনাথ।
জানলার বাইরে ভারী মোহময় বৃষ্টি নেমেছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। রিমঝিম, টুপটাপ বৃষ্টি নয়, সৃষ্টি রসাতল টাইপ বৃষ্টি।
রাজপথ শুনশান করে দেওয়া বৃষ্টি। বহু বছর আগে কেটে ফেলা একটা বাতাবি গাছের বাকলের রহস্যময় গন্ধে তারকনাথের চেম্বার ভরে আছে।
তার জানলার শার্সিতে মাথা কুটে মরছে মরিয়া জলধারা, তাকে ছাড়া বাইরে মিছিমিছি বয়ে যাচ্ছে এক শহুরে বৃষ্টি-দুপুর। তারকনাথের চোখ এই মাসের সেলস রিপোর্টে স্থির। সে এ সবের কিছুই জানতে পারছে না।